এই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বছর তিন আগে। জানুয়ারির মাঝামাঝি, ভীষণ শীত পড়েছিল সেবার। বেশি শীত পড়লে আমার ভালো লাগে। রাতে ভারী হয়ে শিশির ঝরলে বাতাস পরিষ্কার হয়ে যায়। নির্মল বাতাসের লোভে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়তাম। আমার বাসা থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে হাঁটতাম। হাঁটতাম সম্পূর্ণ একা। কারণ, সকালে হাঁটতে আসা লোকজন আসত আরও অনেক পরে, চারদিক ফরসা হয়ে এলে।
সেদিন বেশ ঘন কুয়াশা নেমেছে। পাঁচ হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি বুক ভরে বাতাস নিতে নিতে মহানন্দে জোরে জোরে হাঁটছি। কোথাও কেউ নেই। শুধু দুই পুলিশ ছোট্ট একটা টিনের খোপের মধ্যে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। তাদের পেছনে ফেলে কিছু দূরে এগিয়ে যাওয়ার পরে দেখতে পাই, ঝিলের পাড়ে একটা লাইটপোস্টের গোড়ায় ঘাসের ওপর খবরের কাগজ পেতে বসে আছে এক লোক, তার কোলের ওপর ম্যাগাজিন সাইজের একটা মোটাসোটা বই। বসে আছে হাতিরঝিলের দিকে মুখ করে। আমি কাছে যেতে পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকাল। আমি বললাম, ‘এত ভোরে এখানে বসে কী পড়েন, ভাই?’
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। বেশ লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ শরীরের তরুণ। পরনে শুধু একটা ফুলহাতা শার্ট, বেশ ময়লা, আর খদ্দরের মতো প্যান্ট। ঠান্ডায় কাঁপছে।
‘আরে, উঠলেন কেন? বসেন বসেন। আমি এমনিই…এত সকালে তো এখানে কাউকে দেখি না…।’
‘স্যার, আমি আজই প্রথম আসলাম। পুলিশ ঢুকবার দিতে চায় না। খুব করে হাতেপায়ে ধরে বুঝায়ে বললাম, তারপর আসতে দিল।’
‘আপনি এখানে শুধু পড়ার জন্যই এসেছেন?’
‘জি।’
‘কেন? থাকেন কোথায়?’
‘এই তো, কাঁঠালবাগানের ঢালে।’ ঠান্ডায় ছেলেটার ঠোঁট থিরথির কাঁপছিল।
আমি নিশ্চিত ধরে নিলাম, সে মেসে থাকে। এত ভোরে তার রুমমেটরা তাকে আলো জ্বালাতে দেয় না। এখানে লাইটপোস্টের আলোতে বসে পড়বে বলে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী করেন?’
‘কিছু করি না, স্যার।’
‘চাকরি খুঁজছেন? ইন্টারভিউ দেবেন, তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন?’
‘জি স্যার।’
‘কী পরীক্ষা দেবেন?’
‘সঠিক জানি না, স্যার।’
আমি হেসে বললাম, ‘এটা আবার কেমন কথা? কী পরীক্ষা দেবেন সেটাই জানেন না, তাহলে এই ভোররাতে ঠান্ডার মধ্যে বসে কী পড়ছেন, দেখি?’
ছেলেটা অবলীলায় তার হাতের বইটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি নিলাম। ঢাউস একটা গাইড বই। প্রচ্ছদে বাংলায় বড় বড় হরফে লেখা ‘কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স’। উল্টেপাল্টে দেখারও ইচ্ছা হলো না। যার বস্তু তাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘এইটা পড়ে কী পরীক্ষা দেবেন?’
‘সঠিক জানি না, স্যার।’
আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। ‘আচ্ছা, পড়েন’ বলে তার কাছ থেকে সরে এসে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
পরদিন আবার একই সময়ে একই জায়গায় তাকে দেখতে পেলাম। একইভাবে কোলের ওপর গাইড বই রেখে বিড়বিড় করে পড়ছে আর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। আজও সে আমার পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু আমি থামলাম না। সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এই ধরনের ছেলেরা জীবনে কিছুই করতে পারে না।
আমার একটা চক্কর হেঁটে আসতে তিন মিনিট লাগে। ফিরে আসার সময় দেখতে পেলাম, সে দাঁড়িয়েই আছে। এবার আমি বললাম, ‘কিছু বলবেন?’
‘স্যার, আপনে কী করেন?’
‘খবরের কাগজে চাকরি করি। কেন?’
‘স্যার, আমার একটা কাজের খুবই দরকার ছিল। কী করব কোনো বুদ্ধিই পাচ্ছি না।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘আব্বা-আম্মা আছে। ছোট ছোট তিনটা বুন আছে।’
‘আপনিই সবার বড়?’
‘জি স্যার।’
‘বাবা কী করে?’
‘কিছু করে না, স্যার। চলতে-ফিরতে পারে না।’
‘অসুস্থ?’
‘জি।’
‘কী অসুখ?’
‘ঘাড়ে ব্যথা পাইছে।’
‘কীভাবে?’
ছেলেটা তার বাবার বৃত্তান্ত বলল। তাদের বাড়ি ঝিনাইদহের একটা গ্রামে। বাবার বিঘা-দেড়েক জমি আছে। তাতে ফসল ফলাত, কিন্তু শুধু তা দিয়ে সংসার চলত না বলে দিনমজুরের কাজও করত। তারপর একই গ্রামের কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে ঢাকায় আসে। লোকগুলো কারওয়ান বাজারে ট্রাক থেকে মাল খালাসের কাজ করত। ছেলেটার বাবাও তাদের সঙ্গে একই কাজে যোগ দেয়। তারা কাঁঠালবাগানের ঢালে একটা মেসে থাকত, এক ঘরে দশ-বারোজন।
ট্রাকের মাল খালাস করে ছেলেটার বাবার রোজগার ভালোই হতো, মাসে মাসে বাড়িতে দশ-বারো হাজার করে টাকা পাঠাত। ছেলেটা তখন ঝিনাইদহের এক কলেজে বিকম পড়ত। তারপর পরীক্ষা দিয়ে পাস করল। এর মধ্যে একদিন ছেলেটার বাবা ট্রাক থেকে চালের বস্তা খালাস করে মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘাড়ে ব্যথা পেল। তার সঙ্গীরা তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেল, ডাক্তাররা বলল, ঘাড় ভেঙে গেছে। কিছুদিন চিকিৎসা চলল, কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলো না। ঘাড়ের নিচ থেকে পুরা শরীরটা অবশ হয়ে গেল। ডাক্তাররা বলল, আর কিছু করার নেই। লোকটা আর কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। প্রতিবেশীরা তাকে গ্রামে রেখে এল। পরিবারটা একদম সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। অনাহারে মরে যাওয়ার অবস্থা। ছেলেটার মা একটা ধানের চাতালে কাজ নিল। ছোট ছোট মেয়েগুলো স্কুলে যেত, তাদেরও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। অচল বাবা দিনরাত মরার মতো পড়ে থাকে। শুধু মাথা ছাড়া আর কিছুই নাড়াতে পারে না। এমনকি হাত দুটিও না। সমস্ত শরীর অচল। কিন্তু কথা বলতে পারে। সে ছেলেকে ঢাকা গিয়ে চাকরি খুঁজতে বলল।
‘আমি আগে কখনো ঢাকায় আসি নাই, স্যার’, ছেলেটা আমাকে বলে, ‘ঢাকা আইসে কোথায় থাকব, কী চাকরি পাব কিছুরই ঠিক নাই। আব্বা তা-ও বলে, ঢাকা যা। টাকা-পয়সাও নাই। শেষমেশ আব্বার এক বন্ধু, সুলেমান করে নাম, কাওরান বাজারে কাজ করে, তার সাথে ঢাকা আসলাম। বাসের টিকেট কিনার টাকা তার কাছ থেকেই কর্জ নিলাম। ঢাকায় বাস থেকে নেমে কই যাই? সুলেমান চাচা কয়, তুমি আমার সাথে আমাগের মেসে চলো। তার সাথে গিলাম।’
কিন্তু মেসে ছেলেটার বাবার যে সিট ছিল, সেখানে এখন অন্য একজন এসে উঠেছে। সিট ভাড়া মাসে ৮০০ টাকা। মেসে সবার জন্য রান্না হয়, তিন বেলা খাওয়ার জন্য মাসে ৩০০০ টাকা দিতে হয়। কিন্তু ছেলেটার হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। সেই মেসের বাসিন্দা সে হবে কী করে?
কিন্তু তার বাবার বন্ধুরা তাকে তাড়িয়ে দিল না, তারা তাকে তাদের বিছানায় রাতের বেলা ঘুমানোর সুযোগটা দিল। তারা প্রতিদিন কাজে যায় রাত দশটায়। সারা রাত কারওয়ান বাজারে ট্রাকের মাল খালাস করে। কাজ শেষ হয় ভোর চারটার দিকে। তখন তারা মেসে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
অর্থাৎ রাত দশটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত মেসের ঘরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকে। ছেলেটা এই সময় সেখানে ঘুমাতে পারে। কিন্তু ভোর চারটার দিকে যখন লোকগুলো কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে, তখন আর ছেলেটার শুয়ে থাকার উপায় থাকে না। তাকে উঠে একদম মেসের বাইরে চলে যেতে হয়, কারণ পরিশ্রান্ত লোকগুলো ঘুমাবে। ছেলেটা ঢাকার কিছুই চেনে না। কাঁঠালবাগানের আশপাশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। একদিন ঘুরতে ঘুরতে শাহবাগের দিকে চলে গেল। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেল রমনা পার্কে।
‘পার্কে গিয়ে সারা দিন বসে থাকি। আর কোথায় যাব জানি না। টাকাপয়সা নেই। দুপুরবেলা খাওয়া জোটে না। সন্ধ্যার পরে তারা ঘুম থেকে ওঠে, আমি তখন মেসে ফেরত যাই। তারা খাইতে বসলে আমারেও খাইতে ডাকে। আমি তাগের সাথে ভাত খাই। আমার টাকা লাগে না। তারা ভাতটাত খেয়ে কামে চলে যায়। আমি শুয়ে পড়ি। কিন্তুক চাকরির চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। বাড়িতে বাপ-মা আশায় আছে আমি চাকরি পাব, বাড়িতে টাকা পাঠাব। কিন্তু কীভাবে একটা চাকরি পাব, বুঝে পাই না। এই সব চিন্তায় রাত্র কাবার হয়ে যায়, ভোর চারটা বাজতে না–বাজতে আব্বার বন্ধুরা কাম থেকে ফিরে আসে, আসার সাথে সাথে একেকজন দড়াম দড়াম করে শুয়ে পড়ে, একখানা ঘরের মধ্যে তারা ১২ জন মানুষ থাকে, এক চকিতে দুইজন করে, আমার আর শুয়ে থাকার উপায় থাকে না…স্যার, আপনি তো সাংবাদিক, আমাকে একটা চাকরি দেওয়া যায় না?’
‘চাকরি পাওয়া তো কঠিন। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ভার্সিটি থেকে পাস করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘যেকোনো চাকরি, স্যার। পিয়ন, দারোয়ান যা হয়, একটা চাকরি হলেই হলো…।’
‘আচ্ছা দেখব। কিন্তু আমার আশায় বসে থাকবেন না। আপনি নিজেও চেষ্টা করেন।’
তারপর আরও বার দুয়েক ওর সঙ্গে ওইখানে দেখা হয়েছিল। প্রতিবারেই সে একটা চাকরির জন্য বড্ড করুণ সুরে মিনতি করেছিল।
তারপর এক ভোরে দেখি, লাইটপোস্টের নিচে ছেলেটা নাই। পরদিনও দেখি আসেনি। তারপরের দিন পুলিশদের জিজ্ঞাসা করলাম ছেলেটার কথা। তারা কিছু বলতে পারল না।
আমি ছেলেটার কথা ভুলে গেলাম।
দুই
২৬-২৭ বছরের সুঠাম সেই ছেলেটা এখন আমার সামনে। প্রথমে চিনতে পারিনি। কিন্তু চেনা চেনা লাগছিল, মনে হচ্ছিল আগে কখনো ওকে দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি তা আর কিছুতেই স্মরণে আসছিল না।
‘বাড়ি কোথায়?’
‘ঝিনাইদহ।’
‘কী হয়েছিল?’
‘অ্যাকসিডেন্ট।’
ছেলেটা শুয়ে আছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের একটা বিছানায়। সবাই একে সিআরপি বলে। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ভ্যালেরি টেইলরের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলাম। সাক্ষাৎকার শেষ হলে তিনি আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে ঘুরে ঘুরে রোগীদের দেখাতে লাগলেন। আমি দেখলাম, বেশ প্রশস্ত একটা ওয়ার্ডে সারি সারি বেডে রোগীরা শুয়ে আছে। নীরব। শুধু মাথার ওপরে সারি সারি সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ। আমি অনেক হাসপাতাল ঘুরেছি, রোগীদের আর্তনাদ, গোঙানি শুনেছি, যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেছি অনেক রোগীকে। কোনো হাসপাতালে এ রকম নীরব নিস্তব্ধতা দেখিনি। এখানে এরা নীরব নিশ্চল নিস্তব্ধ। কারণ, এদের শরীর আর কোনো ব্যথা-বেদনা-যন্ত্রণা অনুভব করে না। যন্ত্রণার পর্ব পার হয়ে এদের প্রবেশ ঘটেছে অনুভূতিহীন স্থবির জগতে।
ভ্যালেরি বললেন, এদের কারও ঘাড় ভেঙেছে, কেউ মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, কারও স্পাইনাল কর্ড কেটে দিয়েছে অদ্ভুত কোনো ভাইরাস।
‘রোড অ্যাকসিডেন্ট?’
ছেলেটা আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ভ্যালেরি আমাকে বললেন, ‘ট্রাক থেকে মাথায় করে ভারী বস্তা নামাচ্ছিল। ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছে।’ আমার মনে হলো, ভ্যালেরি চাইছেন না ছেলেটা বেশি কথা বলুক। কিন্তু আমি কৌতূহল সংবরণ করতে পারছিলাম না। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় কাজ করতেন আপনি?’
‘কারানবাজার।’
আমি যে সংবাদপত্রে কাজ করি, সেটার অফিস ঢাকার কারওয়ান বাজারে। সেখানে আমার প্রতিদিন আট-দশ ঘণ্টা কাটে। শুধু অফিসের ভেতরে নয়, বাইরেও। পুরো কারওয়ান বাজারে আমি ঘুরে বেড়াই; স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানের বিক্রেতা, পাইকারি আড়তদার, ট্রাকচালক, দিনমজুর ও মিন্তিওয়ালাদের সঙ্গে আলাপ করি, তাদের গল্প শুনি। একসময় ‘জীবনের গল্প’ নামে ফিচার লিখতাম, তাদের জীবনসংগ্রামের কাহিনি থাকত সেসব লেখায়। তাদের অনেকে আমাকে চেনে। অবশ্য আমার সবাইকে মনে থাকে না। ভিড়ের মধ্যে তাদের কেউ আমাকে সালাম দিলে বুঝতে পারি, তার সঙ্গে আমার কখনো আলাপ হয়েছে।
‘আমার সঙ্গে কি আপনার কখনো দেখা হয়েছে? কারওয়ান বাজারে?’
ছেলেটা চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে। তার চোখের মণি দুটো একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। যেন সে আমাকে চেনার চেষ্টা করতে লাগল। কিছু বলল না।
‘আপনি বললেন, আপনার বাড়ি ঝিনাইদহ। তা ঢাকায় এসেছিলেন কী জন্য?’
‘চাকরির খোঁজে।’
ট্রাকের মজুর ‘কাজ’ না বলে ‘চাকরি’ বলায় আমার খটকা লাগল।
‘লেখাপড়া কদ্দুর?’
‘বিকম পাস করিছিলাম।’
‘বিকম পাস করে ট্রাকের বস্তা খালাসের কাজ নিয়েছিলেন?’
এবার ছেলেটার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘স্যার, আমি জাহাঙ্গীর! সোনারগাঁও হোটেলের পিছনে হাতিরঝিলের পাড়ে আপনার সাথে দেখা হতো।’
‘আরে জাহাঙ্গীর! এই অবস্থা আপনার? আশ্চর্য! কীভাবে হলো?’
ছেলেটা কিছু বলল না, বড় বড় চোখে বড়ই করুণভাবে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।
ভ্যালেরি টেইলর ওয়ার্ডের দরজা দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, বাংলাদেশে প্রচুর লোকের এ রকম অ্যাকসিডেন্ট হয়। বিশেষ করে রাজমিস্ত্রির জোগালিদের, যারা মাথায় করে বিশ-তিরিশটা ইট নিয়ে মই বেয়ে ছাদে উঠে যায়, সিমেন্টের বস্তা মাথায় করে নামায়; ধানচালের আড়তেও অনেক মজুর এই দুর্ঘটনায় পড়ে…দুঃখজনক বিষয় হলো, ঘাড় বা মেরুদণ্ডে সিরিয়াস ইনজুরি হলে আর কিছু করার থাকে না, পেশেন্টকে বাকি সারাটা জীবন…
ভ্যালেরি বলে যাচ্ছিলেন, বলতে বলতে রোগীদের ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, আমিও তাঁর পাশে পাশে আসছিলাম, কিন্তু তাঁর কথাগুলো আর আমার কানে ঢুকছিল না, কেবলই মনে হচ্ছিল আমার নিশ্চয় ভুল হচ্ছে, নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে, কারণ, কারওয়ান বাজারে ট্রাকের মাল খালাসের কাজ তো করত জাহাঙ্গীরের বাবা, জাহাঙ্গীর তো বিকম পাস করে ঢাকায় এসে চাকরি খুঁজছিল, সে কেন কারওয়ান বাজারে ট্রাকের বস্তা খালাস করতে যাবে…?
‘ম্যাডাম, এক মিনিট, আমি ছেলেটাকে আর শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করব…’
‘বাট হি ইজ ইন ট্রমা, ইউ নো…’
‘প্লিজ, জাস্ট এক মিনিট!’
আমি ভ্যালেরির অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই আবার গিয়ে দাঁড়ালাম ছেলেটার বেডের কিনারে।
‘জাহাঙ্গীর, আপনি তো বলেছিলেন…আপনি তো, আপনি তো চাকরি খুঁজছিলেন…’
‘চাকরি একটা পাইছিলাম, স্যার। কিন্তু বেতন মাত্র ছয় হাজার। আমার আব্বা কারানবাজারে কাম করে মাসে মাসে দশ-বারো হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাইত, আর আমি বিকম পাস করে বেতন পাই মাত্র ছয় হাজার। ঘর ভাড়া আর নিজের খাওয়া খরচের পিছেই সব টাকা খরচা হয়ে যায়, বাড়িতে আর কিছুই পাঠাতে পারি না। কিন্তুক বাড়িতে সবাই আশা করে বসে আছে…। একদিন আব্বার ওই বন্ধুদের কাছে আবার গেলাম, তারা আমার বেতনের কথা শুনে হাসাহাসি করে। কয়, ওই চাকরিরে গুল্লি মার, আমাদের সাথে চইলা আয়। আমি স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচাদের সাথে ট্রাকের মাল খালাসের কাজ আরম্ভ করলাম। মাসে বিশ হাজার পর্যন্ত কামাই হইতো। চোদ্দ-পনর হাজারই বাড়িতে পাঠায়ে দিতাম। আব্বারে জানাই নাই কী কাজ করি। সে ভাবছে আমার ভালো চাকরি হইছে…কিন্তু কপাল খারাপ স্যার, ঘাড়টা ভেঙে গেল…আর নাকি জীবনেও উঠে দাঁড়াইতে পারব না। আমি আর সত্যই ভালো হব না, স্যার?’
আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জাহাঙ্গীর করুণ চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
‘মিস্টার আলম, হ্যাভ ইউ ফিনিশড?’ ভ্যালেরি টেইলরের কণ্ঠস্বর কানে এল।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, তিনি আমার অপেক্ষায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখেমুখে বিরক্তি।