এই রাতদুপুরে তোমায় কে সাজতে বলেছে? এমন প্রশ্ন শুনে আমার স্ত্রী কাজল দেওয়া বন্ধ করে মাথাটা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আমি আর কোনো কথা না বলে সোজা রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আমাদের বিয়েটা হয় বাবা-মায়ের পচ্ছন্দেই।আমার স্ত্রী কালো,যার জন্য তাকে আমার মন থেকে পচ্ছন্দ নয়।এই কথাটা মুখে না বললেও আমার ভাব ভঙ্গিতে ঠিকই প্রকাশ পায়।
একদিন বিকেল বেলায় মুষলধারে বৃষ্টি পরছিলো।আমি তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি।ঠিক সে মূহুর্তে দেখলাম আমার স্ত্রী চা নিয়ে হাজির সেখানে।আমি পিছন ঘুরে শুধু চা’র কাপটা হাতে নিলাম।সে কিছুক্ষণ ওখানে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।এর মাঝে আমি চা’র কাপে চুমুক দেওয়া ছাড়া একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি।হয়তো সে কিছু বলতেই দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু আমি তা শোনার ইচ্ছা পোষণ করিনি। সত্যি বলতে প্রয়োজনের বাইরে তার সাথে আমার কোনো কথা হতোনা।মন থেকে কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলামনা যে আমার স্ত্রী কালো।এমন অবহেলার পরেও তার কোনো অভিযোগ ছিলোনা আমায় নিয়ে।
দায়িত্ব কর্তব্যের বাইরে ভালোবাসা নামক কোনো শব্দ তৈরি হয়নি তার প্রতি।অথচ সে আমায় ভালোবাসতো তার নিজের মতো করেই।কখন কি লাগবে,কি প্রয়োজন, কি পচ্ছন্দ-অপচ্ছন্দ সবটা মানিয়ে চলার চেষ্টা করতো প্রতিনিয়ত। এইভাবেই এক ছাঁদের নিচে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকটা মাস চলে যায়।অফিস শেষে একদিন বাসায় এসে জানতে পারি আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।সাধারণত এমন খবরগুলো স্ত্রী’ই তার স্বামী কে দেয় কিন্তু আমি খবরটা শুনি আমার মায়ের মুখ থেকে।কারণ আমি সেদিনও আমার স্ত্রী কে কথা বলার মতো সময় দেয়নি। এর মাঝে এমন অনেক দিন গেছে যেদিন আমার স্ত্রীর সাথে আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি।কিন্তু আমার মা-বাবা আমার স্ত্রী কে সবসময় ভালোবাসতো।হয়তো তাদের ভালোবাসাতেই সে আমার হাজার অবহেলা কেও উপেক্ষা করে চলতে পারতো।
আজকে আমার স্ত্রী’র সন্তান প্রসবের তারিখ। আজ কেন জানিনা এই কালো মানুষটার জন্যই আমার খুব খারাপ লাগছে। কিছু সময় পার হওয়ার পর মা প্রচন্ড উত্তেজনার সাথে আমায় ডাকতে শুরু করলো,আবীদ এই আবীদ দেখনা তোর মেয়ে হয়েছে। আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে দেখলাম ও আমার স্ত্রীর মতোই কালো হয়েছে।অথচ আজ আমার এটা একবারো কেন মনে হচ্ছেনা জানিনা।কিন্তু আমার স্ত্রী যে কালো এই কথাটাতো আমার বার বার মনে হতো। মায়ের ডাকে ঘোর কাটলো আমার। কি ভাবছিলি এতক্ষণ?
-মা তোমার বউমা কি আমায় ক্ষমা করতে পারবে?
–আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আমি আমার ভূলটা বুঝতে পেরেছি।আল্লাহ আমার কালো মেয়েকে পাঠিয়ে আমার সেই ভূলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো।
–আবীদ শোন বাবা,নারীরা সবসময় ধৈর্য্যশীল হয়। বউমা তোর সব অবহেলা মেনে নিয়েছে কারণ ওর মনটা যে খুব ভালো।তুই যে তোর ভূলগুলো বুঝেছিস এটা শুনলেই মেয়েটা খুশি হবে দেখিস।আমি এখন বাবুকে নিয়ে যাই বউমার কাছে,আর তুইও চলে আয়।
আজ নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার স্ত্রী পারবেতো আমায় ক্ষমা করতে?এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার সামনে চলে এলাম। রুমে ঢুকতেই দেখলাম ও’রা মা-মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।আজ প্রথম আমার স্ত্রী কে দেখে মন একবারো বললোনা সে কালো।ঘুমিয়ে থাকা আমার ছোট্র মেয়েটাকে যেন পরীর মতো লাগছে।দুজন কালো মানুষকে পাশাপাশি দেখেও যেন কালো মনে হচ্ছেনা।তাহলে কি এতোদিন আমার চোখের সাথে সাথে মনটাও কুৎসিত ছিলো? কথাগুলো মনে হতেই মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি যেন অনুতপ্তের আগুন আমায় পুড়িয়ে ফেলছে প্রতিটা সেকেন্ডে।চোখের পলকেই আমার স্ত্রী জাগ্রত হয়ে বলে উঠলো,দাঁড়িয়ে আছো যে?বসো এখানে।
জানিনা সে আমার মুখ দেখে কি বুঝলো।আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,মা(শাশুড়ি)এসে সবটা বলেছে।তুমি শুধু শুধু এতো ভাবছো আমিতো কিছুই মনে রাখিনি। আমি আর কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলামনা।আমার স্ত্রী সন্তানের পাশে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবছি আমার মা সত্যি বলেছে, ‘কালো মানুষদের মন সত্যিই অনেক ভালো হয়’।
গল্পের বিষয়:
গল্প