সাইকো

সাইকো
বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক পর পাড়া-প্রতিবেশীর মুখে জানতে পারি আমার স্বামী মুঈনের দ্বিতীয় স্ত্রী আমি।কথাটা শোনার পর প্রথম প্রথম বিশ্বাস হচ্ছিলোনা কিন্তু একে একে যখন সবার মুখেই শুনছিলাম তখন আর অবিশ্বাস করে থাকতে পারলামনা। সারাদিন এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলাম।বিকালে শাশুড়ির চেঁচামেচিতে দরজা খুলতে বাধ্য হলাম।দরজাটা খোলার সাথে সাথেই তিনি বলতে শুরু করলেন, কি হয়েছে বউমা তোমার?সারাদিন বাইরে বের হলানা একবারো,শরীর টরীর খারাপ করলো নাকি? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা একটা প্রশ্ন করলাম,আম্মা সত্যি করে বলেনতো আমার কাছে কথাটা গোপন করা হলো কেন?
আম্মা বিষয়টা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন আমি তার তাকানো দেখেই বুঝলাম তিনি বুঝতে পারেননি কথাটা।তাই তাকে খোলাশা করেই বললাম,আপনার ছেলের প্রথম স্ত্রী কিভাবে মারা যায়? এতক্ষণ পর্যন্ত আমার শাশুড়ি স্বীয়-স্থানে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন এই প্রশ্নটা শুনে তিনি আর এক মূহুর্তও দাঁড়াতে পারলেননা।সব শক্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি বসে পড়লেন।আমি কিছু বুঝে না ওঠার আগেই দুহাতে শক্ত করে ধরে বসলাম তার কাছে। প্রায় মিনিট খানেক সময় নিরবতা পালন করার পর আম্মা বললেন,এসব মিথ্যা কথা তোমায় কে বলেছে? এবার আমার শাশুড়ির কথা বলার ধরন আর চোখের ভাষা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এর পিছনে বড় কোনো কারণ আছে যেটা তারা আমার কাছে লুকাচ্ছে। আমি বললাম,আপনার ছেলের বদনাম করতে কার দায় পড়েছে?কেন কেউ তার নামে এমন মিথ্যা কথা বলবে?
আমার শাশুড়ি আর এক মূহুর্তও সেখানে না থেকে খুব দ্রুত উঠে চলে গেলেন।রাতে কেন জানিনা এই নিয়ে মুঈনকে আর কিছু বলিনি। দেখতে দেখতে এক মাস চলে গেলো।এর মাঝে আমার শাশুড়ি কে সবসময় দেখতাম আমায় কিছু বলতে চেয়েও যেন মুঈনে’র ভয়ে বলতে পারতোনা।কিন্তু সেই ভয়টা কিসের?সেটা আজও আমার অজানা।এখনোও পর্যন্ত আমার স্বামী কে এই ব্যপারে কোনো প্রশ্ন করিনি আমি।তার কারণ টা ছিলো আমি নিজে বুঝতে চেয়েছিলাম এই মানুষটা সম্পর্কে।অবশেষে বুঝেও গেলাম তার আসল চরিত্র।কিছুদিন যেতে না যেতেই মুঈনের ব্যবহারগুলো বদলাতে লাগলো।
তার ব্যবহারগুলো ছিলো এমন, যদি আমি রাতে আম্মার ঘরেও যেতাম তাহলে তার প্রশ্ন,যদি আমি পাশের বাসার ভাবীদের সাথে কথা বলতাম তার সন্দেহ আর প্রশ্ন,যদি আমি কোনো প্রয়োজনে বাবার বাড়ি একা যেতাম,তাহলে তার অস্বাভাবিক আচরণ কেন একা গেলাম কোন প্রয়োজনে,কোন কারণে এক কথায় হাজারটা অসস্তিকর প্রশ্ন আর সন্দেহ। যদি কখনো বেশি হাসি-খুশি দেখতো তখনো তার প্রশ্ন,কাঁদতে দেখলে আবার তখনও প্রশ্ন।এমন হাজারো প্রশ্ন আর সন্দেহ ভর করে থাকতো তার মাথায়।এমনকি কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে খুব রেগে গিয়েও আমায় ধমকাতো এমনকি গায়েও হাত তুলতো।যেটা স্বাভাবিক মারধর ছিলো না কিছুটা অস্বাভাবিক।আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা মুঈন একটা ‘সাইকো রোগী’।
দিন যত যেতে লাগলো তার ব্যবহারও ততো বাজে হতে থাকলো।একদিন আমার খালাতো ভাই কল করেছিলো কোনো প্রয়োজনে।আমি ঘরে না থাকায় মুঈন ফোনটা রিসিভড করে।তখন ওইপাশ থেকে ছেলের কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই ফোনটা ভেঙ্গে ফেলে।আমি ফোন ভাঙ্গার শব্দে রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসি,ও আমায় দেখামাত্রই কোনো প্রশ্ন না করেই সোজা একটা থাপ্পড় দেয়।আর বলতে থাকে কেন আমার ফোনে ছেলেদের ভয়েস শোনা যায়?আমি কিছু বলার আগেই মুঈন ফোন থেকে সিমকার্ড টা খুলে নিয়ে বাইরে চলে যায়।রাতে বাসায় ফিরে খুব শান্ত গলায় বলে,আমার খালাতো ভাই কেন কল করবে?
আমার শাশুড়িকে এসব ব্যপারে খুলে বলি তিনি জানান ও প্রায় কয়েক বছর যাবত এমন আচরণ করে।এই রোগ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেননা তাই সে কোনো চিকিৎসা করায়নি।কিন্তু আমি জানি এর চিকিৎসা কি হতে পারে।সেই ব্যপারে শাশুড়ি মা কে বলতেই তিনি বলে উঠলেন,সাবধান বউমা এই ভূলটা তুমি করতে যেওনা কখনো।’কেন’এই প্রশ্নটা করতেই তিনি আবারো বললেন,সবটা সময় হলেই জানতে পারবে। আম্মার কথামতো চুপ করেই বসে থাকলাম সময়ের অপেক্ষায়।সেই সময়টাও চলে আসলো খুব শীঘ্রই।
সেদিন ছিলো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত।আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় তাকিয়ে দেখি মুঈন পাশে নেই।বারান্দায় এসে দেখি শাশুড়ির ঘরে লাইট জ্বলছে।আমি কৌতূহল বশত দরজার কাছে যেতেই যা দেখলাম তাতে আমার শরীরের রক্ত বরফ হয়ে যায়। মুঈন আম্মার মুখে বালিশ চেপে ধরে আছে। আম্মা প্রানপনে বাঁচার জন্য পা দুটো ছুটাছুটি করছে কিন্তু অমানুষের রুপে থাকা আমার স্বামী মুঈন খুব ঠান্ডা মাথায় তাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে মারার চেষ্টা করছে। আমি কয়েক পা পিছিয়ে চোখদুটো মুছে রান্নাঘর থেকে একটা কাঠ নিয়ে ঘরে ঢুকেই,আর কিছু না ভেবে কাঠটা দিয়ে পিছন থেকে মুঈনের মাথায় আঘাত করি।
ও আম্মার মুখের উপর চাপানো বালিশটা ছেড়ে মাথাটা দু হাতে চেপে ধরে মেঝেতে পরে যায়।আম্মা কোনোমতে বালিশের নিচ থেকে মুখটা তুলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।মুঈন কে পরে যাওয়া দেখে আম্মা ভয়ার্ত চোখে বলে, বউমা তুমি কি করলে এটা?আমি বললাম ও মরেনি শুধু অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি আম্মা কে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে তার হাতদুটো চেপে ধরে বললাম, কি হয়েছিলো আম্মা আমায় আজ সত্যি করে বলুন।আম্মা যা বললো তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
তিনি বললেন,আমার প্রথম বউমাকে মুঈন নিজেই খুন করে।ঠিক এইভাবেই বালিশ চাপা দিয়ে।পরদিন সকালে অনেক বেলা হয়ে যায় তাও বউমা ওঠেনা তাই দেখে আমি ওদের ঘরে যায়।গিয়ে দেখি বউমা মরার মতো পরে আছে।আমি হাতদুটো ধরতেই বুঝি ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে।মুঈন কে প্রশ্ন করলে ও বলে শ্বাসকষ্টে মারা গেছে,কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনাই।তারপরে মুঈনের মুখ থেকে সত্যটা স্বীকার করাই।স্বার্থপরের মতো নিজের ছেলেকে বাঁচাতে আমি পরের মেয়ের সাথে অন্যায় করেছি পাপ করেছি। আম্মা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলছিলেন।কিছু সময় নিরব থেকে প্রচন্ড ঘেমে নেয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,মুঈন দরজায় ডাকতেই আমি মনে করছি কিছু হলো না কি তোমার তাই তাড়াতাড়ি করে দরজাটা খুলে দেই।ও ঘরে ঢুকেই আমায় বিছানায় বসিয়ে বললো আমি তোমায় কিছু বলেছি কি না?বললাম বলিনি।
কিন্তু মুঈন কে যখন বললাম তোমায় সব সত্য বলে দিতে ও তখন আমার সাথে তর্ক করলো।মুঈন কে বুঝিয়ে বললাম তাহলে আমি বলে দেবো এতো পাপ আর নিজের মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।মুঈন কথাটা শোনামাত্রই আমায় বিছানার উপর বসা থেকে ফেলে দিয়ে মুখে বালিশটা চেপে ধরে।এমন ছেলেকে পেটে ধরছিলাম আমার ঘৃন্না হচ্ছে…এ টুকুই বলেই আম্মা কাঁদতে শুরু করলেন।আম্মাকে পানি খাইয়ে আমি মুঈনের ফোনটা হাতরে খুঁজে নিলাম।তারপর সেই মূহুর্তেই থানায় কল করে বলে রাখলাম।মুঈন তখনো অচেতন অবস্থায় মেঝেতেই পড়েছিলো।
পরদিন সকালে বাড়িতে পুলিশ আসলো।মুঈনের প্রথম স্ত্রী’র বাবা মা কেও খবর দেওয়া হলো।তারা এসে জানতে পারলো তাদের মেয়ে শ্বাসকষ্টে নয় শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। তারা পুলিশদের কাছে মেয়েকে খুনের অপরাধে মুঈনের শাস্তি দাবী করলো।
মুঈনের সমস্ত ঘটনা শোনার পর পুলিশ প্রধান বললেন,তাদের সাথে মুঈন কে নেওয়া হলেও তাকে প্রথমে ‘সাইকোপ্যাথির চিকিৎসা’ করতে পাঠানো হবে তারপরে বাকিসব। মুঈন কে নিয়ে যাওয়ার পর আম্মা বারান্দায় বসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,যদি আমি প্রথমেই ওর অস্বাভাবিক আচরণগুলো দেখে ডাক্তার দেখাতাম তাহলে আজ দুই দুইটা মেয়ের জীবন এভাবে শেষ হতো না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত