বৃদ্ধাশ্রমের যে মহিলাকে আমি সবসময় খুব বেশি ভালবাসতাম তিনি গতকাল থেকে খুব অসুস্থ । কিন্তু সে হাসপাতালে যেতে রাজি হচ্ছে না কারণ তার বাঁচার ইচ্ছে নেই । আমি যতবার ওই আশ্রমে গিয়েছি প্রতিবারই দেখেছি যে , সেখানে প্রায় সবাই তাকে খুব পছন্দ করে । এতদিন তার জন্য আমি নিজে টাকা-পয়সা দিয়ে তার খরচ বহন করে আসছি । বাংলাদেশে যতদিন ছিলাম তখন প্রতি শুক্রবার আমি ওই বৃদ্ধাশ্রম গিয়ে তার সাথে দেখা করতাম ।
ফ্রান্সে চলে আসার পরে আর দেখা হয়নি তবে মোবাইলের মাধ্যমে কথা হয়েছে । আমি তাকে “রাঙা মা” বলে ডাকতাম কারণ তিনি দেখতে অনেক সুন্দর । তার পরিবার সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কিছু আমি জানিনা কারণ রাঙা মা বলেননি । আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু তিনি কখনো সেটা বলতে চাননি । কিন্তু গতকাল সকালে নাকি তিনি বৃদ্ধাশ্রমের বড় মেডাম কে একটা বিশাল চিঠি দিয়েছেন । এবং বলেছেন , ঐ চিঠি যেন আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় । তাই বড় মেডাম আমাকে সেই চিঠির একটা পিকচার তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছেন । সবসময় সেখানে যাতায়াত এবং “রাঙা মা” এর সাথে ইমু , হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার জন্য বড় মেডাম আমাকে চিনে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলে পিকচার দেখতে পেলাম । হাত মুখ না ধুয়ে , ফ্রেশ না হয়ে আমি চিঠি পড়া আরম্ভ করলাম ।
বৃষ্টি মা , শরীরটা বেশ কিছুদিন যাবত খুব খারাপ যাচ্ছে , মনে হয় তোমার আঙ্কেল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে । বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে থাকতে থাকতে জীবন টা নিঃশেষ হয়ে গেল ৷ আমি হয়তো অনেক আগেই মরে যেতাম কিন্তু তুমি যখন আমাকে রাঙা মা বলে ডাকতে তখন নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগতো । তোমার মা-বাবার একমাত্র মেয়ে তুমি , তোমার মা তোমার মত মেয়ে গর্ভে ধারণ করে কতটা আনন্দিত সেটা তুমি উপলব্ধি করতে পারবে না । দোয়া করি তোমার মত মেয়ে আল্লাহ প্রতিটি ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দেন । তাহলে আমার মত মায়েদের আর কখনও বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে না । বাংলাদেশ থাকতে তুমি অসংখ্যবার আমার সন্তানের কথা জানতে চেয়েছ কিন্তু আমি বলতে পারিনি । কারণ আমি চাইনি কেউ আমার ছেলেটাকে খারাপ কথা বলুক । স্ত্রী সন্তান নিয়ে সবসময় সুখে শান্তিতে বসবাস করুক সেটাই কামণা করছি ।
রমজান মাসের চতুর্থ রমজানের রাতে আমার সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে বলে আমরা তখন সন্তানের নাম রেখেছিলাম , মোঃ রহমতুল্লাহ । আমার খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল তাই প্রথম সন্তান জন্ম দিতে কতটা কষ্ট হয়েছে সেটা আজও মাঝে মাঝে মনে পরে । তোমার যখন সন্তান হবে তুমি ঠিক তখন বুঝতে পারবে সন্তান ধারণ করতে একটা মা কতটা কষ্ট করে । আমার সন্তান যখন গর্ভে ছিল , তোমার আঙ্কেল তখন ঢাকা শহরে চাকরি করতো আর আমি আমার শাশুড়ীর সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকতাম । আমার শাশুড়ি খুবই বয়স্ক ছিল তাই বাড়িতে সকল কাজ আমিই করতাম । আমার মা-বাবা আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু আমি যাইনি কারণ আমার শাশুড়ী একা হয়ে যাবে । আমার স্বামী একা ছিল এবং তার দুটো বিবাহিতা বোন ছিল । তাই অসুস্থ শাশুড়িকে রেখে স্বার্থপরের মতো মা-বাবার কাছে যেতে পারিনি । কিন্তু আমাদের গ্রামের বাড়িতে তখন বেশিরভাগ মেয়েদের প্রথম সন্তান মা-বাবার বাড়িতে হতো ।
আমার বাড়ি থেকে আমার ছোট চাচার মেয়েকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসলাম । তাই আমার চাচাতো বোন অনেক কাজে সাহায্য করতে পারতো । আমার শাশুড়ি আমাকে সবসময় দোয়া করতেন , তিনি বলতেন ” বৌমা তুমি যেভাবে আমাকে ভালবাসো একদিন তোমার সন্তানের বউও তোমাকে এমনি করে ভালবাসবে । ” কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন বৃষ্টি , আমার ছেলের বউ আমাকে এতটা বেশি ভালবাসে যার জন্য আজকে আমার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম । রহমতুল্লাহ যখন ৮ মাসের গর্ভে ছিল তখন খুব বেশি নড়াচড়া করতো পেটের মধ্যে । এতটা তীব্র কষ্ট ছিল সেই সময়টা যেটা আজও আমি মাঝে মাঝে মনে করি । মাঝে মাঝে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম । আমার স্বামী শহরে থাকতো তাই কষ্টের কথাগুলো প্রকাশ করার কাউকে পেতাম না । তখনকার দিনে এখনকার মত মোবাইল ছিল না তাই সাথে সাথে কথা বলার কোন ব্যবস্থা ছিল না । তখনকার দিনে চিঠি ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা এবং কাছে আসার মাধ্যম ।
আমার সন্তানের জন্ম হয়েছিল হাসপাতালে কারণ আমার নর্মাল ডেলিভারি হয়নি তাই আমাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে । প্রচন্ড ব্যথা থাকার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ১৮ দিন আগে অপারেশন করা হয়েছে । তবে অপারেশন করতে গিয়ে কি একটা যেন গন্ডগোল হয়ে গেল এবং ডাক্তার বললো আমি নাকি আর কখনো মা হতে পারবো না । আমি জ্ঞান ফেরার পরে প্রথম যখন কথাটা শুনলাম তখন খুব কষ্ট পেলাম । কিন্তু আমার তো একটা সন্তান আছে তাই রহমতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে তখন আমার ১০ মাসের সকল দুঃখ কষ্ট বেদনা সবকিছুই হারিয়ে গেল এবং পরবর্তীতে মা না হবার যন্ত্রণা রইল না ।
আমার শাশুড়ির ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না কারণ রহমতুল্লাহর জন্মের তিনদিন পরে আমার শাশুড়ি বাড়ির উঠঁনে আছাড় খেয়ে পরে গিয়ে প্রচন্ড আহত হন । নয় দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আমার শশুড়ের কাছে ওপারে চলে গেল । আমার শাশুড়ির মৃত্যুর কিছুদিন পরে আমি রহমতুল্লাহকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলাম । আমার স্বামী সেখানে গিয়ে রেখে আসলো কারণ অসুস্থ আমি তখন ঢাকা শহর তার কাছে আসলেও আরেক সমস্যা সৃষ্টি হবে । তাই রহমতুল্লাহর ১০ মাস বয়স পর্যন্ত আমি বাবার বাড়ি ছিলাম । তারপর তোমার আঙ্কেল আমাকে ঢাকা নিয়ে এলো এবং শুরু হলো আমার শহরের বসবাস । আমি রহমতুল্লাহকে আদর করে বাবু বলে ডাকতাম তাই একসময় ওর ডাকনাম হয়ে গেল বাবু । বাবু পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিল তাই তোমার আঙ্কেল আর আমি দুজনে মিলে তাকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখতাম । তাই স্বপ্ন স্বার্থক করার জন্য গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে টাকা যোগাড় করে ব্যাঙ্কে রাখলাম । তারপর সেই একাউন্ট থেকে টাকা তুলে তুলে বাবুর পড়াশোনার খরচ বহন করতাম আর পাশাপাশি তোমার আঙ্কেলের গার্মেন্টসের বেতন তো আছেই । ওহ তোমাকে তো বলা হয়নি তোমার আঙ্কেল গার্মেন্টসে চাকরি করতো সাভারে ।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো আমাদের সন্তান , একমাত্র ছেলে তাই সকল আবদার পূরণ করতাম । এর মাঝে বছর খানেকের ব্যবধানে আমার মা-বাবা দুজনই মারা গেল । মা-বাবার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছি ঠিকই কিন্তু আমিও তো ততদিনে একজন মা এবং সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে তাই নিজে শান্ত থাকার চেষ্টা করেছি । আমাদের কোন ভাই ছিল না আমরা দুই বোন ছিলাম তারমধ্যে আমি ছোট । বড় আপুর বিয়ে হয়েছিল বগুড়া জেলা ।
এসএসসি পরীক্ষার পরে বাবুকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ সিভিল ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করানো হলো । যদিও চান্স পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে তবুও যখন চান্স পেল তখন তো কষ্ট স্বার্থক । চার বছরের ডিপ্লোমা শেষ করলো কিন্তু বিএসসি করার জন্য সরকারিতে আর চান্স পেল না । তাই বাধ্য হয়ে বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ভর্তি করিয়ে দিলাম । তুমি তো জানো বেসরকারিভাবে বিএসসি শেষ করতে প্রচুর টাকার দরকার । আর বাবুর সেই বিএসসি শেষ করতে আমাদের ব্যাঙ্কের জমানো টাকা প্রায় শেষ হয়ে গেল । বিএসসি শেষ করে বাবু একটা কোম্পানিতে চাকরি নিলো । আমি তখন তোমার আঙ্কেলকে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিতে বললাম । কিন্তু তোমার আঙ্কেল আমাকে বললো , ” ছেলেটা সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করেছে এত তাড়াতাড়ি ওর ঘাড়ে সংসারের বোঝা চাপানো ঠিক হবে না । সারাজীবন তো সংসার করবে , তারচেয়ে বরং আরো দুতিন বছর চাকরি করুক । আমার তো বয়স একেবারে শেষ হয়ে যায় নাই , করি আর কিছু বছর । “
তোমার আঙ্কেলের কথা শুনে সেদিন দুচোখ বেয়ে দরদর করে পানি বেরিয়ে গেল । তোমার আঙ্কেল বেশি শিক্ষিত ছিলেন না তাই কাজ জানার পরেও গার্মেন্টসে পদন্নোতি পাননি । আমাদের বিয়ের বছর খানিক আগে থেকেই তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করতো । কিন্তু সেই হিসাবে তিনি তেমন বেশি পদোন্নতি করতে পারে নাই যার একমাত্র কারণ শিক্ষার অভাব । তাই অনেকে ভাবে যে গার্মেন্টসে মনে হয় সব অশিক্ষিত মানুষ চাকরি করে । কিন্তু ধারনাটা ভুল কারণ সেই গার্মেন্টসে ভালো চাকরি করতে হলে পড়াশোনা জানতে হবে । আমি নিজেও চাকরি করতে চেয়েছি কিন্তু তোমার আঙ্কেল অনুমতি দেননি । ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারী তোমার আঙ্কেল মা-রা গেল আর সেই সময় তার গার্মেন্টসে বেতন ছিল ২৭ হাজার টাকা ।
বাবুর পড়াশোনা শেষ হয়েছিল ২০১২ সালে , এক বছর চাকরি করার পরে বাবু তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে বলে জানায় । ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে বাবু একটা মেয়েকে পছন্দ করতো । মেয়েটার বাবা সরকারি চাকরি করতো তাই তাদের মোটামুটি ভালোই টাকাপয়সা ছিল । আমাদের বাবু শিক্ষিত তাই মেয়ের বাবা বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল কিন্তু শর্ত ছিল তিনি তার মেয়ে এবং জামাইকে একটা ফ্ল্যাট উপহার দিবেন । এবং সেই ফ্ল্যাটে বউ নিয়ে বাবুকে থাকতে হবে । আমরা প্রথমে মন খারাপ করেছিলাম কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর প্রতিবাদ করিনি । ছেলে যদি সুখী হয় তাহলে আর আমাদের আপত্তি কিসের ?
বিয়ে দিয়ে দিলাম , বউকে নিয়ে বাবু নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেল । তোমার আঙ্কেল ভেবেছিল আমরা হয়ত সেই বাসায় যায়গা পাবো তাই সবকিছু গুছিয়ে নিতে চাইলাম । কিন্তু বাবু বললো , ” তোমরা সেখানে কি করবে ? আমি তোমাদের বউকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবো । আর তাছাড়া নতুন বাসায় আমাদের দুজনের অনেক নতুন নতুন বন্ধু বান্ধবী আসবে । তোমরা সেখানে একসময় পরাধীন মনে করবে তারচেয়ে বরং এই বাসায় থাকো । ” বিশ্বাস করো বৃষ্টি , বহু বছর পরে সেদিন তোমার আঙ্কেলের চোখে কষ্টের পানি দেখেছিলাম । কিন্তু তবুও আমরা হাসিমুখে ওদেরকে শুভ কামনা করে নতুন বাসায় পাঠিয়ে দিলাম ।
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে তোমার আঙ্কেল অসুস্থ হয়ে পরে । হাসপাতালে নেয়া হলো, ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করে বললেন, “কিডনি সমস্যা হয়েছে দ্রুত অপারেশন করতে হবে । ” তাই বাবু বিভিন্ন ভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো কিন্তু কিডনির অপারেশন করতে তো অনেক টাকা দরকার এবং একটা কিডনি যোগাড় করতে হবে । প্রায় মাস খানিক অপেক্ষা করতে করতে বাবু ধৈর্য হারা হয়ে গেল । তার অসুস্থ বাবার প্রতি সে বিরক্ত সেটা বুঝতে পারছিলাম তার আচরণ দেখে । মাঝে মাঝে ওর কথা শুনে খুব কষ্ট পেতাম কিন্তু ভাবতাম চারিদিকের চাপের জন্য মাথা ঠিক নেই হয়তো । কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগলো এবং তোমার আঙ্কেলের চিকিৎসার আশা ছেড়ে একদিন দিলাম । কারণ বাবু বললো , ” মা অনেক তো চেষ্টা করছি তার উপর আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ । তোমার বউমা বলছিল যে বাবার তো বয়স হয়েছে যেকোনো সময় চলে যাবে । শুধু শুধু এত কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে লাভ কি ? “
সেদিন আমি এত পরিমাণ কষ্ট পেলাম যেটা আমি প্রকাশ করতে পারবো না । তবে তোমরা আঙ্কেলের চিকিৎসার আশা সেইদিনই ছেড়ে দিলাম । এরপর আরো মাস খানিক পৃথিবীতে আমার সাথে থাকার পরে ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারী আমাকে একা করে চলে গেল । মৃত্যুর কিছুদিন আগে তোমার আঙ্কেল শুধু বলতো , ” বাবুর আম্মু , আমার মৃত্যুর পরে পৃথিবীতে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হবে তবুও কখনো আল্লাহ্কে ভুলে যেও না । আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করো , আমাদের সন্তানের যেন আল্লাহ সহীহ্ বুঝ দান করে । ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন না দেখে যদি মাওলানা কিংবা কোরআনের হাফিজ বানানোর স্বপ্ন দেখতাম তাহলে আজ হয়তো এমনটা হতো না । সবই কপাল । ” তোমার আঙ্কেলের মৃত্যুর পরে বাবু আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসলো । কিন্তু আমাকে আনার সাথে সাথে বউমা আমাকে নিয়ে প্রায়ই বাবুর সাথে ঝগড়া করা আরম্ভ করলো । ওরা দুজনেই চাকরি করতো তাই বাসার সকল কাজ আমার উপর পরলো । কিন্তু এখানে কাজ করতে আমি কখনো সঙ্কোচ করতাম না কারণ এটাও নিজের সংসার ।
২০১৫ সালে জুনাসের মাঝামাঝি আমি দাদি হবার সংবাদ পেলাম । বউমা মা হতে চলেছে আর আমার সেদিনের সেই ছোট্ট রহমতুল্লাহ বাবা হবে । বাসায় কাজের ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল কারণ বউমা তার বাবার ছোট বোনকে এই বাসায় নিয়ে আসলো । হঠাৎ করে আমার নিজের কথা মনে পরে গেল কারণ আমার বাবুর জন্মের সময় আমি এমনই করেছিলাম । কিন্তু এবং পার্থক্য হচ্ছে আমার সেই চাচাতো বোন আমাকে আমার কাজে সাহায্য করতো কিন্তু বউমার বোন সারাক্ষণ টিভি সিরিয়াল আর বউমার কাছেই থাকতো । কিন্তু আমার কতবড় কপাল , নিজের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নিজের হাতে সবকিছু করতাম । আবার সেই সন্তানের সন্তান জন্ম নেবার সময়ও আমার কাজের দায়িত্ব বেড়ে গেল । আস্তে আস্তে আমাকে নিয়ে প্রতিদিন গৃহে ঝামেলা আরম্ভ হলো । বউয়ের কথা শুনে শুনে বাবুও আমার সাথে দু একটা খারাপ ব্যবহার আরম্ভ করল ।
আমি একা একা কান্না করতাম আর তোমার আঙ্কেলকের শেষ কথাগুলো মনে করতাম । আমার প্রতি আস্তে আস্তে যখন ওদের সকল মায়া বাসনা নিঃশেষ হয়ে গেল তখন ওই বাড়িতে আমি একটা আগাছা হয়ে গেলাম । বাবু প্রায়ই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করলো যার প্রধান কারণ আমি । শ্রদ্ধা , ভালবাসা আর মমতার প্রতিদান যেখানে অবহেলা , লাঞ্ছনা আর অনাদর সেখানে জোর করে ভালবাসার দাবী তৈরী করা নেহাৎ বোকামি । তাই বারবার ওদের ঝগড়ার কারণ না হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পথে পথে ভিক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম । সন্তানের সংসারে আমার জন্য যেন কোনো অশান্তি সৃষ্টি নাহয় তাই তোমার আঙ্কেলের মৃত্যুর ঠিক এক বছর যেদিন পূর্ণ হলো (মানে ৩০ জানুয়ারি ২০১৬) সেদিন আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম । এবং তার পরেরদিনই তুমি আর সজীব আমাকে সেই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে এই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে গেলে । তোমার যদি বিদেশে পাড়ি দেবার স্বপ্ন না থাকতো তাহলে হয়ত তোমার বাসায় আমার ঠাই হতো । এরপরের সবকিছুই তোমার জানা আছে তাই আর লিখলাম না ।
বৃষ্টি , আমি জানি তোমার মা-বাবা অনেক ভালো মানুষ তাই তাদের দুজনের কোলে তোমার মতো মেয়ে জন্ম হলো । কিন্তু আমি হয়তো অনেক পাপ করেছিলাম তাই শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রম আমার স্থান । তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ রইল , তুমি এ দেশের মানুষের মাঝে মা-বাবার গুরুত্বটা তুলে ধরার চেষ্টা করো । আমার মত একটা মায়ের সেবা করে কোন লাভ হবে না কারণ আমি বৃদ্ধাশ্রমে আসার পরে বুঝতে পারছি যে আমার মতো অনেক মা-বাবা একই কষ্ট নিয়ে আছে । তাই আমি চাই , একজন মা’কে সাহায্য না করে তুমি /তোমাদের মত ভালো মানুষেরা সমাজের সবাইকে সচেতন করতে উৎসাহ প্রদান করো । বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি রুমের চারদেয়াল যেন আর কোন মা-বাবার চোখের কান্না না দেখে । পড়ন্ত বিকেলে ফুলের বাগানে দাড়িয়ে পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্ত দেখে দেখে কেউ যেন নিজের জীবনের অস্ত কল্পনা না করে । বৃদ্ধাশ্রমের মাঝে এত এত মানুষ থাকার পরেও সবসময় নীরব শ্মশানের নীরবতা দেখা যায় কেন জানো ? কারণ , এখানে প্রত্যেকের মনের মধ্যে চাপা কষ্ট , যেই কষ্টের প্রতিটি কণা বের হয় চোখের পানি দিয়ে । আর সেই চোখের পানির প্রতিটি ফোঁটা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে ।
তোমার কাছে আমার একটাই দাবী যেটা নিজের সন্তানের মত দাবী করে বলছি , সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে বারবার পৌঁছে দিতে হবে যে ইসলামে আল্লাহর ইবাদতের পরে মা-বাবার সেবা করতে বলা হয়েছে । মা-বাবার সাথে যারা বেয়াদবি করবে স্বয়ং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না । মা-বাবার কষ্টের প্রতিটি নিশ্বাসে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে । শুধু ইসলাম ধর্মে নয় , পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন যতগুলো ধর্ম রয়েছে সকল ধর্মে মা-বাবার সেবা করতে বলা হয়েছে । কিছুদিন যাবত শরীরটা খুব খারাপ লাগছে তাই মৃত্যু কে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি । আমার বাবুর সন্তানটা ছেলে নাকি মেয়ে সেটাও জানিনা আমি । এখন তার বয়স সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে , আমি আর তোমার আঙ্কেল বাবুকে নিয়ে ছোট্ট বেলা যেমন আনন্দ করতাম । বাবু আর বউমা হয়তো ঠিক সেভাবেই আনন্দ করছে । তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা রইলো , তুমি একদিন অনেক ভালো একজন মানুষ হবে ।
ইতি ,
তোমার “রাঙা মা”
বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে পরলাম । চোখের পানি গুলো বারবার মুছে ফেলার চেষ্টা করছি কিন্তু তবুও বারবার বেরিয়ে যাচ্ছে । বাবার কাছে গিয়ে আজকের মধ্যে একটা বাংলাদেশের টিকিট সংগ্রহ করতে বললাম । সরাসরি না হলেও দুবাই কিংবা কাতার হয়ে যদি যেতে হয় তবুও যাবো । বাবার এক কলকাতার বন্ধু আছে যিনি এয়ারলাইন্সের টিকিট সংগ্রহ করার দায়িত্বে আছে । তাকে বলে একটা টিকিট ম্যানেজ হয়ে যাবে আমি জানি । কারণ গতবছর কোরবানির ঈদের মাত্র তিনদিন পরে সজীব যখন ঢাকা শহরে বসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল । তখন আমি একদিনের মধ্যে টিকেট সংগ্রহ করে বাংলাদেশ গেছিলাম ।
মা-বাবার কাছে সবকিছু সংক্ষিপ্ত করে বললাম , তারা আমাকে নিয়ে বেশি টেনশন করবে না আমি জানি কারণ বাংলাদেশে সজীব আছে । আর নিজের জীবন দিয়ে হলেও সজীব যে আমাকে আগলে রাখবে সেটা আমার মা-বাবা মনে প্রানেই বিশ্বাস করে । সজীব আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে ঠিকই কিন্তু বিয়ে করতে চাচ্ছে না । সজীব এর বয়স এখন ২৬ বছর আর আমার বয়স ২৪ , দুজনেই দুজনকে ভালবাসি কিন্তু আজও বিয়ে করা হয়নি । জন্ম, মৃত্যু বিয়ে এ তিনটি আল্লাহর হাতে তাই হয়তো তিনিই জানেন আমাদের ভাগ্যে কি আছে ?
সজীবের চাকরি বর্তমানে চট্টগ্রাম কিন্তু ফ্রান্সের স্থানীয় সময় সকাল সাতটা বাজে তাকে ফোন দিয়ে ঢাকা বৃদ্ধাশ্রমে আসতে বলছি । টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছি কিন্তু সরাসরি যেতে পারবো না , দুবাই হয়ে তারপর যেতে হবে । ফ্রান্সের অরলিন্স বিমানবন্দর থেকে দুবাই বিমানবন্দর , তারপর সেখান থেকে আরব আমিরাত বিমানে করে বাংলাদেশের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । সজীব কে বললাম , সবকিছু যদি ঠিকঠাক মত হয়ে যায় তাহলে আমি বাংলাদেশের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে তিনটা বাজে বিমানবন্দরে নামবো তাই সে যেন উপস্থিত থাকে ।
দুবাই বিমানবন্দরে দুই ঘন্টা দেরি হবার কারণে ভোর পাঁচটার দিকে আমি ঢাকা নামলাম । বের হতে হতে আরো ৪৫ মিনিট ব্যয় হয়ে গেল এক নাম্বার টার্মিনাল থেকে বের হয়ে সজীব এর সাথে দেখা । ৭ মাস পরে আবারও সেই প্রিয় চেনা মুখ , আগের চেয়ে একটু মোটা হয়ে গেছে । পেটের ভুঁড়ি সামান্য সামনের দিকে বেরিয়ে পরেছে । মাত্র সাত মাসের মধ্যে এত পরিবর্তন কিভাবে হলো বুঝতে পারছি না । Uber থেকে গাড়ি কল করে আমরা গাড়িতে উঠে পরলাম।
গাড়িতে উঠে সজীব বলতে শুরু করলো , আমি গতকাল যখন কল দিয়েছি তার ঘন্টা খানিক পরে সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকা রওনা দিয়েছে । রাত আটটার দিকে ঢাকা পৌঁছে প্রথমেই বৃদ্ধাশ্রম গিয়েছে এবং “রাঙা মা” কে আমি যে বাংলাদেশ আসতেছি সেই কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেছে । হাসপাতালে ভর্তি করার পরে সজীব সেই চিঠি নিজে হাতে নিয়ে পড়েছে । তারপর হাসপাতালে বাকি সময় পার করে রাত দুটোর দিকে বিমানবন্দর এসেছে ।
– আমি বললাম , ” আমরা কি তাহলে হাসপাতালে যাচ্ছি সরাসরি ? “
– সজীব বললো , “না “।
– তাহলে ?
– আমরা এখানে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো ।
– সেখানে কেন ?
– রাঙা মায়ের ঘরটা ভালো করে খুঁজতে হবে কারণ সেখানে তার ছেলের কিছু না কিছু অবশ্যই পাওয়া যাবে । ছবি , ঠিকানা , কার্ড , ইত্যাদি যেকোন কিছু আমাদের খুঁজে বের করতে হবে । ডাক্তার বলছেন রাঙা মায়ের শরীরে তেমন কোন রোগ নেই কিন্তু তিনি মানসিক ভাবে খুবই দুর্বল । রোগী নিজেই যদি বাঁচতে না চায় সেখানে ডাক্তার কিছু করতে পারবে না বৃষ্টি । তাই এখন আমাদের কাজ হচ্ছে যেভাবেই হোক তার ছেলেকে খুঁজে বের করে তাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে ।
– বাহহহ দারুণ বুদ্ধি তো , এ জন্যই আমি তোমার পিছনে নয় বছর ধরে পরে আছি । আরো নব্বই বছর যদি বাঁচি তবুও আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো সাহেব ।
– হয়েছে হয়েছে ।
– একদম চুপ আমি ক্লান্ত তাই তোমার ঘাড়ে মাথা রেখে একটু চোখ বন্ধ করে থাকবো ।
– তাই করো তবুও কথা বলোনা ।
বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে প্রবেশ করে দেখি সবকিছু থমথমে অবস্থা । যদিও সকাল পৌনে সাতটা বেজে গেছে আর এই সময় সবার বাহিরে হাঁটাহাটি করার কথা । কিন্তু ভিতরে গিয়ে বুঝতে পারছি যে রাঙা মায়ের জন্য এদের সকলের মন খারাপ । আমাকে দেখে মরিয়ম খালা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো । বাকিরা তার সাথে তাল মিলিয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে । আহা কতটা ভালবাসা এদের একজনের প্রতি আরেকজনের । সবাইকে মোটামুটি কথা বলে আমি সজীব আরো দু তিনজন রাঙা মা’র রুমের মধ্যে গেলাম । মাত্র ৮০০ টাকা দিয়ে একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক কিনে দিয়েছিলাম আমি কারণ ট্রাঙ্কের মধ্যে কাপড় রাখতো “রাঙা মা” । সেই ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে নিলাম কারণ চাবি খোঁজার সময় নেই । ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তাই রাঙা মা’র ছেলের তিন কপি রঙিন ছবি ও দু তিনটা পারসোনাল কার্ড পেলাম । ছবি আর কার্ড নিয়ে বাইরে বেরিয়ে সাথে সাথে সজীব কল দিলো আমি রুমের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছি ।
– মিনিট দু-এক কথা বলে কল কেটে দিয়ে আমাকে বললো , “চলো এখনই বেরিয়ে পরতে হবে ।”
– পাওয়া গেছে তাকে ?
– হ্যাঁ যিনি ফোন ধরেছেন তাঁর নাম রহমতুল্লাহ আর ডাকনাম বাবু । কিন্তু তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন , তার মা যে আমাদের কাছে আছে সেটা তাকে বলিনি । ভদ্রলোকের সন্তানের নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই তিনি একটু বিজি । তুমি আমি সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করে বিস্তারিত বোঝাতে চেষ্টা করবো । আমি তাকে বলেছি তার সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে হবে তাই তিনি হাসপাতালে যেতে বলেছেন ।
– হুম তাই হবে তাহলে চলো ।
হাসপাতালে যাবার পথে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে এক নজর দেখা করে আবার রওনা দিলাম । রঙা মা’কে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে তাই শুধু একবার তার কপাল স্পর্শ করে বেরিয়ে পরলাম । ঢাকার শহরের ঐতিহাসিক জ্যাম পেরিয়ে পেরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যখন পৌছলাম তখন বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেছে । আমরা রহমতুল্লাহ ওরফে বাবু ভাইকে কল দিয়ে তার অবস্থান জেনে নিলাম । সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে তাদের কাছে গেলাম । ছবির সাথে চেহারার হুবহু মিল আছে যেটা সচারাচর সবার ক্ষেত্রে হয়না । কারণ ছবি আর বাস্তবে সামান্য পরিবর্তন থাকে কিন্তু বাবু ভাইয়ের বেলা তেমনটা দেখলাম না । তার ছোট ছেলেটা মাথায় আর পায়ে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ নিয়ে বেডে সুয়ে আছে । আশেপাশে আরো তিনটা মেয়ে এবং একটা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে । এদের মধ্যে একজন মনে হয় ছেলের মা কারণ কান্না করতে করতে তার চেহারার অবস্থা খারাপ । বাবু ভাই আমাদের দেখে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন , অতি বিপদের মধ্যেও আমরা তাকে বিস্মিত করে ফেলেছি কারণ আমরা অপরিচিত ।
– বাবু ভাই বললেন , “আপনাদের ঠিক চিনতে পারছি না , আর আপনারা বলেছেন খুব জরুরি কথা আছে । দেখুন আমার একমাত্র সন্তান মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তাই এখন আমি আমার সন্তান ছাড়া দুনিয়ার কোন বিষয় কথা বলতে চাই না । “
– সজীব বললো , আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই , আপনার সন্তান তো দেখতে পাচ্ছি এক্সিডেন্ট করেছে তাহলে এখন সমস্যা টা কি খুলে বলা যাবে ?
– হ্যাঁ যাবে , আমার সন্তানের রক্তের গ্রুপ ( A- ) এ নেগেটিভ । প্রচুর রক্তক্ষরন হয়েছে তাই রক্ত দিতে হবে কিন্তু গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমি রক্ত যোগাড় করতে পারি নাই । চারিদিকে বিভিন্ন স্থানে খবর দিলাম কিন্তু যাও পাওয়া যায় তারা সবাই অল্প কিছুদিন আগে রক্ত দিয়েছে । আর তাছাড়া এ নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড পাওয়া খুব কষ্টের ব্যাপার । আর তিন ঘন্টার মধ্যে রক্ত দিতে না পারলে আমার সন্তানকে বাচানো সম্ভব না । আর সত্যি সত্যি যদি এমনটা হয়ে যায় তাহলে আমার স্ত্রীকে বাঁচানো যাবে না কারণ আমার স্ত্রী আমাদের সন্তানকে খুব বেশি ভালবাসে ।
– কথাটা বলার সাথে সাথে যাকে ছেলের মা মনে করেছিলাম তিনি বললেন , ” তুমি কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো ? যাও তাড়াতাড়ি রক্ত যোগাড় করো নাহলে যে আমার শিমুল বাঁচবে না ” ( বুঝতে পারছি বাচ্চার নাম শিমুল )
– বাবু ভাইয়ের স্ত্রী এমন কথা বলার সাথে সাথে আমি পারমাণবিক বোমা মেরে বললাম , ” আজকে আপনি আপনার সন্তানের জন্য নিজেও মরতে চাচ্ছেন । কিন্তু একবারও ভেবেছেন আপনার শাশুড়ি তার সন্তান মানে আপনার স্বামীকে ঠিক এতটাই ভালবাসে ? আপনাদের সন্তান এখন আপনাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মূল্যবান সম্পদ কিন্তু এক সময় রহমতুল্লাহ ওরফে বাবু ভাই আপনিও আপনার মা-বাবার কাছে এমন মূল্যবান ছিলেন । আপনার স্ত্রী যেভাবে তার সন্তানের জন্য মরবে বলে ঠিক করেছে , আপনার মা-ও এমন করেছে আপনার জন্য কিন্তু আপনি আপনার সেই মা’কে কি করেছেন মনে পরে আপনার ? “
– বাবু ভাই বললেন , ” আপনারা কারা ? আর আমার মায়ের বিষয় আর আমার বিষয় এতকিছু জানলেন কীভাবে ? “
– আমি বললাম ,” আপনার মা ৩১ জানুয়ারী ২০১৬ সাল থেকে আমার কাছে আছে । আপনার বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আপনি তাকে বের করে দিয়েছেন । তার পরেরদিন আমি তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছি । আমার মা-বাবা যদি বাংলাদেশ থাকতেন তাহলে আমি আমার কাছে রাখতাম । বিগত বছরগুলোতে আমি বারবার তাকে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কখনো আপনার কথা বলেনি কিন্তু এখন তিনিও মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন । আর আমাকে খুব আপন ভাবেন বলেই আপনার সম্পর্কে সামান্য জানিয়ে গেলেন । আপনার মা অসুস্থ সেই খবর পেয়ে আমি গতকাল রাতে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ এসেছি । আমার সাথে এই যে যাকে দেখতে পাচ্ছেন ওর নাম সজীব , সে গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে এসেছে । মা-বাবার একমাত্র সন্তান হয়ে আপনি আপনার মা-বাবার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি । আজকে আল্লাহ আপনার সন্তানকে আপনার সামনে কিভাবে কষ্টে রেখেছে দেখুন । সন্তানের জন্য মা-বাবার কলিজা কতটা আঘাত পায় সেটা বুঝতে চেষ্টা করুন ।
– এবার বাবু ভাইয়ের স্ত্রী বসা থেকে উঠে আমার সামনে এসে বললেন , ” বিশ্বাস করুন আমার শাশুড়ি চলে যাবার পরে আমরা তাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি । আমার বাবা আমাদের প্রচুর বকাবকি করেছেন এ বিষয় তাই আমরা পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কিন্তু কোনো সন্ধান পাইনি । আপনি কি আমাদের নিয়ে যাবেন তার কাছে ? আমি জানি যতই চেষ্টা করিনা কেন ! আমার শাশুড়ি যদি আমাকে মাফ না করে তাহলে আল্লাহ আমাকে মাফ করবে না । আমি তার সন্তানকে তার কোল থেকে আলাদা করেছি তাই আল্লাহ আমার কোল থেকে আমার সন্তান কেড়ে নিতে চাচ্ছেন । প্লিজ আপনারা দয়া করে আমাকে নিয়ে চলুন ।
– বাবু ভাই ও বললেন, হ্যাঁ বোন আমি আমার মা’কে কষ্ট দিয়ে বড় ভুল করেছি । আমি আগে আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবো তারপর আমার সন্তানের ব্যবস্থা আল্লাহ করে দেব । আপনারা দুজনে এখন আমাদের নিয়ে চলুন আমার মায়ের কাছে ।
– এতক্ষণ পরে সজীব বললো , ” বৃষ্টি তুমি তাদের নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চলে যাও । আমি এদিকে রক্তের ব্যবস্থা করতেছি , আশা করি ছয় ঘন্টার আগেই রক্ত যোগাড় হবে । রক্ত নিয়ে তোমরা ১% ও চিন্তা করবে না । ” ( সাথে সাথে আমাকে একটা বাম চোখ দিয়ে টিপ দিয়ে ইশারা দিল । বাবু ভাই আর তার স্ত্রী সেই ইশারা না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি ।)
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সিএনজি করে আবারও কুর্মিটোলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । পথের মধ্যে আমি তেমন কিছু বললাম না , কারন তারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই জড়াজড়ি করে কান্না করছে । আর আমি তো গতকাল থেকে জার্নি করতে করতে ক্লান্ত তাই বসে বসে ঝিমাচ্ছি । দেড় ঘন্টার মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম লিফটে করে সরাসরি পঞ্চম তলায় চলে গেলাম । বেডের কাছে গিয়ে দেখি “রাঙা মা” জেগে আছে , তার পাশে বৃদ্ধাশ্রম থেকে আসা আরো দুটো মহিলা এবং বৃদ্ধাশ্রমের মেডামকে দেখতে পাচ্ছি ।
আমার পাশাপাশি নিজের সন্তান আর বউমাকে দেখে রাঙা মার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো । তিনি সেই দুর্বল শরীর নিয়ে এক ধাক্কায় শোয়া থেকে উঠে বসলেন । তিনি কিছু বলার আগেই বাবু ভাই আর তার স্ত্রী পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন । আমি হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি আর মা-ছেলের মিলন পর্ব উপভোগ করছি । চোখ বেয়ে গরম কিছু বেরিয়ে আমার গালের উপর পরছে , মনে হয় পানি । রাঙা মা দুহাত বাড়িয়ে বাবু ভাই আর তার স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরলেন । হাসপাতালের অসংখ্য রোগীর মাঝে একটা পরিবারের বেদনার বিদায় অনুষ্ঠান শেষে সুখের আগমন চলছে । প্রায় সবাই ই কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে । বৃদ্ধাশ্রম থেকে আসা মহিলা দুটো ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন । আজকে একটা আনন্দের দিন তাই চোখের পানি বের হতে নেই । হঠাৎ করে “রাঙা মা” বলে উঠলেন , আমার নাতি নাতনী কোই ? তাকে নিয়ে আসিসনি ? ও বৃষ্টি মা , তুই আমার সন্তানকে কোথা থেকে চুরি করে নিয়ে এলি ?
– বাবু ভাই বললেন , মা তোমার নাতি এক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে । ওর রক্তের দরকার কিন্তু এখনো যোগাড় করতে পারিনি । দোয়া করো তাড়াতাড়ি যেন রক্ত যোগাড় করতে পারি নাহলে যে ওকে বাঁচানো যাবে না ।
– বলিস কি ? তাহলে অসুস্থ নাতিকে ফেলে তোরা দুজনেই আমার কাছে চলে আসলি ? এটা কোন ধরনের কথা ? তাড়াতাড়ি চল আমিও আমার দাদু ভাইয়ের কাছে যাবো ।
– আমি বললাম , রাঙা মা তুমি বিচলিত হবার কোন কারন নেই, আমার মনে হয় এতক্ষণে তোমার নাতির শরীরে রক্ত দেওয়া শুরু হয়ে গেছে ।
– রাঙা মা বললো , সত্যি বলছিস ?
– আমি বললাম , হ্যাঁ রাঙা মা , সজীব এর রক্তের গ্রুপ ” এ নেগেটিভ ” আমি আসার সময় সজীব আমাকে ইশারা দিয়ে বলে দিয়েছে । তাই এতক্ষণে সজীব এর রক্ত বের করে তোমার নাতির শরীরে দেওয়া শুরু হয়ে গেছে ।
রাঙা মা অস্ফুটে কি যেন একটা বলে দোয়া করলেন স্পষ্ট বুঝতে পারছি না । বাবু ভাই আর তার স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আছে । বাংলাদেশ নামার পরে আমি আমার বাংলাদেশী সিম চালু করেছিলাম আমার হাতে মোবাইলে কল বেজে ওঠলো । তাকিয়ে দেখি সজীব এর নাম্বার থেকে কল এসেছে , আমি রিসিভ করে ফাঁকা স্থানে এগিয়ে যাচ্ছি ।
– হ্যা গো বলো । (আমি)
– সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে ? (সজীব)
– হ্যাঁ , তোমার ওখানের কি খবর ? রক্ত দেওয়া শুরু হয়েছে ?
– হ্যাঁ ঘন্টা খানিক ফ্রিজের মধ্যে রাখার পরে এখন দেওয়া শুরু হয়েছে ।
– তুমি বিশ্রাম করো আমি আসতেছি ।
– পারবে তো ? এক কাজ করো , নয়নকে কল দিয়ে তাকে নিয়ে একসাথে আসো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমি আমার ভাইকে কল দিয়ে দেখি ও কোথায় আছে । ভুল হয়ে গেছে , আরো আগে ওকে কল দেওয়া উচিৎ ছিল । তাড়াহুড়ো করে কোন কিছু মনে থাকে না আচ্ছা তোমরা থাকো আমরা আসতেছি ।
গল্পের বিষয়:
গল্প