সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছি। আপু ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসলো আমাদের সাথে নাস্তা করার জন্য। আপু যখন খাবারটা মুখে নিবে আমি খুব ভালো করে আপুর আঙুলের দিকে লক্ষ্য করলাম। তারপর ওয়াক ওয়াক করতে করতে দৌড়ে বাথরুমে গেলাম। আমার এই অবস্থা দেখে আপু আর আম্মু ছুটে আমার কাছে আসলো। আপু কিছুটা ভয় পেয়ে আমায় বললো,
-কিরে, কি হয়ছে তোর? আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে বললাম,
— বাথরুম করার পর হাত ভালো করে পরিষ্কার করতে পারিস না? আপু অবাক হয়ে বললো,
-মানে! আমি তখন বললাম,
–দেখ তোর নখে হলুদ কি লেগে আছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ আপু রেগে গিয়ে আমার গালে জোরে থাপ্পড় মেরে বললো,
– আরে কুত্তা, এটা নেলপলিশ। অবশ্য কোনটা নেলপলিশ আর কোনটা ইয়ে তোর মত হাঁদারামের বুঝার কথাও না। আনস্মার্ট গাইয়া কোথাকার আপু থাপ্পড়টা একটু জোরেই মেরেছে। বাথরুমের আয়নায় তাকিয়ে দেখি গাল লাল হয়ে আছে। আমি গালে হাত দিয়ে ভাবছি, মানুষের রুচি কতটা নিম্নমানের হলে নখে হলুদ রঙের নেলপলিশ দিতে পারে সেই কথা ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো বের করে গালে ঢলতে ঢ্লতে আপুর রুমে গিয়ে আপুকে বললাম,
— আমি হাঁদারাম না। শুধু আমি কেন, নখে হলুদ রঙের নেলপলিশ দেখলে যে কোন ছেলে ইয়ে মনে করবে
আপু রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– থাপ্পড় যদি আরেকটা খেতে না চাস তাহলে সামনে থেকে যা আপু আমার থেকে ৫ বছরের বড়। আমি আমার জীবনে আপুর হাতে যত মার খেয়েছি লাইফে আর কারো হাতে এত মার খাইনি। আমি যেদিন আপুর কোন কাজ করবো না সেদিনেই আপু আমাকে নিয়ে পড়তে বসবে। আর পড়ার সময় উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করবে। আর আমি উত্তর দিতে না পারলেই মারবে। মা বাবার কাছে নালিশ করলে মা বাবা বলে, “পড়া না পারলে তো মারবেই ” মা বাবা এটা বুঝে না আমাকে পড়ার জন্য না, কাজটা করে দেই নি দেখে মারছে টিভিতে একমনে কবির সিং মুভিটা দেখছিলাম কারণ এই মুভিটা আগে কখনো দেখা হয় নি। এমন সময় আপু এসে বললো,
– একটু দোকানে যা তো। আমার জন্য একটা খাতা কিনে নিয়ে আয় আমি টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম,
— বিজ্ঞাপন শুরু হলে যাচ্ছি আপু টিভি অফ করে দিয়ে বললো,
– এখনি যা বলছি আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— শুধু খাতা না কি আরো কিছু লাগবে? আপু মুচকি হেসে বললো,
– না, আর কিছু না খাতা কিনা এনে যখনি টিভিটা অন করলাম মুভির শেষের দৃশ্যটা দেখার জন্য তখনি আপু এসে বললো,
– এইগুলো একটু তাড়াতাড়ি ফটোকপি করে নিয়ে আয় তো আমি রাগে বললাম,
— আগে কেন বলিস নি? এখন আমি যেতে পারবো না? আপু ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি হেসে বললো,
– তুই এই মুহুর্তে না গেলে আজ রাতে তোকে নিয়ে পড়তে বসবো। আর তোকে রসায়ন পড়াবো। বুঝতেই পারছিস তোর উপর দিয়ে তখন কি যাবে আমি রাগে টিভিটা অফ করে মাকে চিৎকার করে বললাম,
— তোমার এই বুইড়া মেয়েকে এখনো বিয়ে দাও না কেন ? ও যেদিন এই বাড়ি থেকে বিদায় হবে সেদিন দুইটা এতিমকে আমি পেট ভরে খাওয়াবো আমার কথা শুনে আপু হাসছে আর আমি রাগে শিটগুলো হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম মাঝ রাতে আপুর ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে আপুকে বললাম,
— কি হয়ছে, এত রাতে ডাকছিস কেন? আপু মুখটা শুকনো করে বললো,
– খুব ক্ষুধা লাগছে। একটু নুডলস বানিয়ে দে না আমি রেগে গিয়ে বললাম,
–তোর নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে তুই বানিয়ে খা গিয়ে আপু তার হাত আমায় দেখিয়ে বললো,
– হাতে মেহেদী দিয়েছি। হাতে মেহেদী নিয়ে বানাবো কি করে? কথাটা শুনে মেজার খুব খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু তবুও আপুকে কিছু বললাম না। ঘুম ঘুম চোখে নুডলস বানিয়ে আপুর সামনে রেখে বললাম,
— এখন গলা অব্দি খা আপু তখন বললো,
– আমার দুই হাতেই মেহেদী খাবো কিভাবে? তুই একটু খাইয়ে দে আমি রাগে আপুকে মুখে তুলে খাওয়াতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম,
— তোর মত বোন যেন কোন ভাইয়ের কপালে না জুটে আজ দুই মহল্লার মধ্যে ক্রিকেট খেলা আছে। আমি তৈরি হয়ে ব্যাট হাতে নিয়ে যখন বাসা থেকে বের হবো তখন আপু আমায় ডেকে বললো,
– একটু শাড়ির কুচিগুলো একটু ঠিক করে দে তো আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
–পারবো না। তোর মনে রাখা উচিত আমি তোর বোন না ভাই হই। আমার বন্ধুদের বড় আপুরা ভাইদের কত আদর করে। ভাইদের সকল কাজ করে দেয় আর তুই আমাকে দিয়ে তোর সব কাজ করাস। তুই এত অলস কেন?
আপু তখন বললো,
– ঠিক করে না দিলে আজ শূন্য রানে আউট হবি। তুই তো ভালো করেই জানিস আমার অভিশাপ কাজে লাগে
আপুর কথা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম কারণ এর আগে আপু আমাকে যতবার অভিশাপ দিয়েছে ততবারি ফলেছে। ৩০ মিনিট লাগলো আপুর শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে তারপর শাড়ির এইখানে পিন লাগিয়ে দে, ঐখানে লাগিয়ে দে আরো কত কি। সবকিছু ঠিক ঠাক হলে আপু মাকে ডেকে বললো,
– মা, পিয়াসকে বলো না আমাকে ভার্সিটি একটু দিয়ে আসতে। ভার্সিটিতে এমনিতেই গেলে ছেলেরা ডিস্টার্ব করে আজ তো অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেজেগুজে শাড়ি পরে যাচ্ছি। আজ তো আরো বেশি ডিস্টার্ব করবে আপুর কথা শুনে মা আমায় বললো আপুকে ভার্সিটি দিয়ে আসতে আমি আর কিছু বললাম না শুধু হাতে থাকা ব্যাটটা আছাড় মেরে ফেলে দিলাম আমি রাগে রিকশায় বসে কটমট করতে লাগলাম আর আপু মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
– তোকে তো লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলাম। খেললে তো নির্ঘাত জিরো রান করে আউট হতি আর খেলা হারার জন্য সবাই তোকে দোষারূপ করতো আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— দয়াকরে তুই আমার সাথে কোন কথা বলবি না। কোন রকম তোর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই আপু তখন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
– যেদিন আমি থাকবো না সেদিন বুঝবি আমি কি ছিলাম…
আপুর সেদিনের সেই কথাটা এখন ঠিকিই বুঝতে পারছি। আপুর বিয়ে হয়েছে আজ ২১দিন। এখন আমাকে মাঝ রাতে ডেকে কেউ বলে না নুডলস বানিয়ে দিতে, কেউ বারবার বলে না দোকান থেকে এটা এনে দে ওটা এনে দে, পড়ার সময় কেউ আমায় থাপ্পড় মেরে গাল লাল বানায় না, টিভি দেখার সময় কেউ ডিস্টার্বও করে না। এখন শুধু আমার শান্তি আর শান্তি। কিন্তু এই শান্তিটা আমি কেন জানি সহ্য করতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে আমার শরীর থেকে একটা অংশ আমায় ছেড়ে চলে গেছে আপুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাই আপুর বাসায় এসেছিলাম আপুকে দেখতে। কিন্তু ১০ মিনিটের জন্যও আপু আমার সামনে বসে থাকতে পারে নি। শ্বাশুর ডেকে বলে, ” বউমা, পাঞ্জাবিটা একটু আয়রন করে দাও” শ্বাশুড়ি ডেকে বলে, “বউমা, আমার ঔষধ গুলো দেখিয়ে দিয়ে যাও” দুলাভাই ডেকে বলে , “সালা এসেছে খাসির গোশত ভুনা করে রান্না করো” আমি অবাক হয়ে আমার অলস আপুর কাজ কর্ম দেখছিলাম। যে বোন এক গ্লাস পানিও নিজ হাতে নিয়ে খেতো না আর আজ সেই বোন একটা সংসারের পুরো কাজ করছে। হঠাৎ আপুর দিকে খেয়াল করে দেখি আপুর শাড়ির কুচি গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। আমি আপুকে বললাম,
— বিয়ে হয়ে গেছে এখনো শাড়ির কুচিগুলো ঠিক মত দিতে পারিস না? আমি নিজ হাতে আপুর শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে দিলাম। বিদায়বেলা চোখের জলটা কোনরকম ভাবে লুকিয়ে আপুর কানে কানে বললাম,
– আপু, আমি এখন খুব শান্তিতে আছি রে । কিন্তু বিশ্বাস কর এই শান্তিটা আর সহ্য হচ্ছে না আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু পিছন ফিরে আপুর দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে হয় নি। কারণ বোনের চোখের জল কি করে সহ্য করবো
গল্পের বিষয়:
গল্প