মাছের মাথা’টা এই বাটিতে কেন?তোমায়তো বলেছিলাম আজ আব্বার বাটিতে মাছের মাথাটা দিতে? প্রশ্নটা শুনে মনে হয় আমার বউ এর খুব একটা ভালো লাগলোনা।সে আমতা আমতা করে বললো, না আসলে আমার মনে ছিলো না।আর আব্বাও মনে হয় এতক্ষণে খেয়ে উঠেছেন।ভাবী কে তো দেখলাম সেই কখন রান্না শেষ করে ঘরে গেছেন,তাই আর দিতে যায়নি। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাছের মাথা টার সাথে তিনটা বড় বড় মাছের পিছসহ তরকারির বাটি টা নিয়ে চলে গেলাম ভাইয়ার ঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকেই দেখলাম আব্বা মাত্রই ভাত খাওয়া শুরু করেছেন।তরকারির বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,আব্বা আপনার পচ্ছন্দের রুই মাছ। আব্বা খানিক বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,এতো পিছ আনতে গেলা কেন? আমি বললাম,আব্বা আপনারতো খুব পচ্ছন্দ তাই আজ হাটে রুই মাছটা দেখেই কিনে এনেছি। পাশেই মা বসেছিলো কিছু না বলে চুপচাপ আব্বাকে বাতাস করছিলো।আমার কথাটা শুনে আব্বা কে বললো,হায়াত আনছে যখন শখ করে মাছের মাথা টা খান না আপনি। সেইদিনও তো বলছিলেন মা..ছ.. কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই আব্বা মা’কে থামিয়ে দিয়ে খেতে শুরু করলেন।বুঝলাম আব্বাও হয়তো মা কে মাছের কথাই বলেছিলো।বের হয়ে আসার সময় মা কে বললাম,মা একটা পিছ নিয়ে তুমিও ভাত খেয়ো।মা শুধু সম্মতিসূচক মাথাটা নেড়ে বললো,হায়াত বাবা তোরা খাইছিস?
আমি কিছু না ভেবেই মিথ্যে বললাম, হ্যা মা খাইছি। ভাইয়াদের ঘর থেকে এসে কি যেন ভেবে রাতে আজ না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।কপালের উপর হাতটা রাখতেই অনেক ভাবনা মাথায় এসে ভর করলো। ছোটোবেলায় মা কে দেখতাম একটা বড় মাছ অনেক পিছ করে রান্না করে আমাদের তিন ভাইবোন কে খাওয়াতো।আব্বা হাটবার এলেই আমাদের দুই ভাই কে নিয়ে ইয়া বড় একটা ব্যাগ সঙ্গে করে হাটে যেতো।বড় বড় মাছ অথবা গরুর মাংস কিনতো।আমরা তিন ভাইবোন’ই গরুর মাংস খুব পচ্ছন্দ করতাম।আব্বা হাট থেকে গরুর মাংস আনলে মা সেটা অনেক টুকরো করে কেটে রান্না করতো।দুই বেলার কাছে আমাদের তিনবেলা খাওয়াতো।তখন বুঝতামনা আব্বা-মা না খেয়ে কতবেলা সেই মাছ মাংস আমাদের খাওয়াইছে।
সেইদিন গুলো আজ শুধুই স্মৃতি।আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে যায়।ভাইয়ারও বিয়ের বয়স হওয়াই আব্বা মা ও’কেও বিয়ে করায়।ভাইয়ার বিয়ের পর থেকেই বুঝলাম সংসারটা কি জিনিস। ভাবী ছয়মাস একসাথে থাকতে না থাকতেই আলাদা হতে চাইলেন।আব্বাও আর কিছু না বলে বড় ভাইয়া কে অনুমতি দিলো আলাদা খাওয়ার।সেদিন দেখেছিলাম যখন এক পাটিতে ভাইয়ার জায়গাটা ফাঁকা ছিলো শুধু আব্বা আর আমি মিলে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম তখন আব্বা বুকের ব্যথা বলে খাবার ছেড়ে উঠে যান।মা ও আর সেই রাতে খেতে পারেনি। ভাইয়ার দুই বছরের ছোট ছিলাম আমি।তাই ভাইয়ার বিয়ের বছর-দেরেক পর আমাকেও আব্বা-মা বিয়ে করায়।তখন থেকে শুরু হলো সংসারে আরেক অশান্তি।ভাইয়া আলাদা খায় বলে আমার বউ বললো সেও আলাদা খাবে।আমি বললাম তাহলে আব্বা মা’র কি হবে? তারা জা’রা মিলে ঠিক করলো আব্বা মা দুই ঘরে এক সপ্তাহ এক সপ্তাহ করে খাবে। এখনো মনে পড়ে এই ভাগবন্টনের কথাটা শুনে আব্বা মা ঘর থেকে বের হয়নি সারাদিন।হয়তো লজ্জায় নয়তো অকৃতজ্ঞ সন্তানদের জন্ম দেওয়ার অনুশোচনায়।
আব্বা মা’র মুখ থেকে খুশি নামক চিহ্ন আমি সেদিন থেকেই বিলীন হতে দেখেছি।বড় ভাই আমায় প্রায় বলতো,
হায়াত রে আব্বা মনে হয় বেশিদিন বাঁচবে না।মুখটার দিকে একদম তাকানো যায় না কত কষ্ট বুঁকে নিয়ে যে ভাত খায় আমি রোজ দেখি। আব্বা-মা কোনোদিনো ভাবেনি তার ছেলেরা ভিন্ন হবে আর তাদের এভাবে বন্টণ করে খাওয়াতে হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কখন যে আমার চোখ ভরে উঠেছে বুঝতেই পারিনি। পরদিন সকালে একটু বাজারে গেলাম আলাদা করে ভাইয়ার সাথে এই ব্যপারে কথা বলতে।এভাবে সংসারটা ভিন্ন করে আব্বা মা কে ভাগ ভাগ করে নেওয়াটা আমাদের আর সহ্য হচ্ছে না। বাজারে যেতেই বউ কল করে জানালো তার বাবা মা আসবে তা কে নিতে।তাই মাছ মাংস সহ বাজার করে নিতে বললো।ফোনটা রেখে ভাইয়ার কাছে আর না গিয়ে সবজির বাজারে ঢুকলাম।প্রয়োজনীয় সবজিসহ মাছ,মাংস কিনে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়িতে ফিরতেই দেখি শ্বশুর শাশুড়ি এসেছেন।বউ এতোবড় ব্যাগসহ বাজার দেখে হাসিমুখে ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।রান্না শেষে দুপুরের খাবার খেতে দিলো তার বাবা মা কে।আমাকেও বসতে বললো আমি অন্য অযুহাতে বাইরে চলে এলাম। পুকুর পাড়ে বসে বসে ভাবছিলাম,কাল থেকে তো আব্বা মা’র আমাদের ঘরে খাওয়ার সপ্তাহ।আর আজ আমার বউ বাবার বাড়ি চলে যাবে? মুহূর্তেই মেজাজটা বিগ্রে গেলো।বসা ছেড়ে উঠে সোজা ঘরের দিকে গেলাম।ঘরে ঢুকেই দেখি শ্বশুর শাশুড়ি আর আমার বউ গোল মিটিং হয়ে কথা বলছে।সবার মুখ দেখে এটাই মনে হলো যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা।শাশুড়ি কে বললাম,আম্মা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি? শাশুড়ি অবাক হয়ে বললো,হ্যা বাবা বলো। বললাম,ও কে এই অসময়ে নিতে এসেছেন যে কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
কথাটা শেষ না হতেই আমার বউ বলতে শুরু করলো,আরে সমস্যা কি বলছো অনেক বড় সমস্যা হইছে।জানো বাবা মা কে বড় ভাইয়া আর ভাবী বলছে এখন থেকে না কি মেজো আর সেজো ভাইয়ার সাথে ভাগ করে খেতে হবে।চিন্তা করছো আমরা বেঁচে আছি আর তারা এখনি আমার বাবা মা কে ঘরে ঘরে ফকিন্নির মতো খাবার খেতে বলে?তাই কাল গিয়ে ওদের সাথে কথা বলবো,দরকার পরলে ঝগড়া করবো তুমি কি বলো? আমি খানিক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,বাহ এই না হলে ঘরের মেয়ে,কিন্তু ঘরের বউ না। আমার বউ মনে হলো ঠিক বুঝলোনা কথাটা।সে ভ্রু-জুগল কুচকে প্রশ্ন করলো, মানে? এবার আমি মনের সমস্ত রাগ ঝেড়ে বলতে শুরু করলাম, মনে পড়ে যেদিন তুমি এই বাড়িতে এসেছিলে একমাসও একত্রে ভাত খাওনি আব্বা মা’র সাথে? বন্টন করে দিয়েছিলে ভাইয়াদের সহ।
আমার আব্বা কে মাছের মাথাটা দেওয়ার কথা ভূলে যাও অথচ নিজের বাবা মা আসবে বলে বড় বড় মাছ মাংস আনতে বলার কথা ভোলোনা। ঘরে এমন জোরে জোরে কথাবার্তার আওয়াজে আব্বা মা’র সাথে ভাইয়া ভাবীও চলে আসে।মা এসেই বললো,হায়াত তুই চুপকর কি হচ্ছে এসব?ঘরে মেহমান দেখছিস না? মা কে বললাম,চুপইতো ছিলাম এতোদিন।কখনো দেখেছো আমরা ভাইয়েরা এই বউ নামক প্রাণীদের সাথে ঝগড়া করেছি?করিনি কারণ আব্বা সবসময় পরিবারে শান্তি চেয়েছেন।তাই অশান্তির ভয়ে ওদের সব অন্যায়কেই আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি মুখ বুজে। মা আর কিছু না বলে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমি আবার বলতে শুরু করলাম, মনে আছে আমার বড় আপা যেদিন এই বাড়িতে আসতো তোমাদের বউদের মুখ কালো কুচকুচে অন্ধকার হয়ে যেতো?কেন যখন তোমাদের মা,বাবা,বোন,ভাই আত্মীয়ের গুষ্ঠি আসে কই আমাদের ভাইদেরতো মুখ কালো হয়না? আমার আপা গরুর মাংস পচ্ছন্দ করে।একদিন আপা আসাতে আমি এক বাজার না পেয়ে অন্য বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে আনি।আর তুমি ইচ্ছে করেই সেদিন মাংসে লবন বেশি দিয়েছিলে।কি ভেবেছিলে আমি বুঝিনি?আমার আপা লবনে তেতো মাংসের ঝোল দিয়ে ওমনি ভাত খেয়েছিলো,সেদিনও আমি কিছুই বলিনি। আর আজ যখন তোমার ভাইয়েরা তোমার বাবা মা কে ভিন্ন করে খাবার দিতে চাইলো তখন তোমার কাছে তা ফকিন্নির মতো লাগলো?আর আমার আব্বা মা কে যে এইভাবেই মাসের পর মাস খাবার দিচ্ছো তোমরা তখন আত্মসম্মানে বাধে না? সবশেষে শ্বশুর শাশুড়ি কে বললাম,কোনো মনুষ্যত্বহীণ প্রানীর সাথে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।আজ আপনাদের সাথে ও’কে একেবারেই নিয়ে যাবেন।
বিকেলের দিকে আপা কে কল করে আসতে বললাম।ভাইয়া আর আমি বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে এনে মা কে বললাম ভালো করে কষিয়ে রান্না করতে। রাতে আমি আব্বা ভাইয়া আর আপা মিলে খেতে বসলাম এক পাটিতে।মনে হচ্ছে যেন সেই ছোটোবেলায় ফিরে গেছি। পাশের পাটিতে ভাবী আর আমার বউ বসেছে খেতে।তারা তাদের ভূলের জন্য অনুতপ্ত আর আব্বা-মা বরাবরের মতোই এবারও ক্ষমা করে দিয়েছেন। সবাইকে হাসিমুখে খাবার পরিবেশন করছে আমার মা।আজ সবার মুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির খুশি। আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ আমি সেই খুশিটা দেখছি যা গত দুই বছরে দেখিনি।
(আপনি নিজের বাবা মা কে যতটা ভালোবাসেন আপনার স্বামীও ঠিক ততোটাই বাসে।নিজের ভালো টা যদি বুঝতে পারেন তাহলে স্বামীর’টা কেন নয়?বাবার বাড়িতে থাকতে মনুষ্যত্ব থাকে অথচ শ্বশুর বাড়িতে গেলে অনেকেরই সেই মনুষ্যত্ব লোপ পায়।সবসময় একটা বিষয় মাথায় রাখবেন,আপনি পরের বাবা মা’র সাথে যা করবেন আপনার বাবা মা’র সাথেও পরের মেয়ে তাই করবে।)
গল্পের বিষয়:
গল্প