পদদলিত পুষ্পের খোঁজে

পদদলিত পুষ্পের খোঁজে

-কী লিখব! বড়ি?
-বড়ি আপনার নাম! বড়ি কারো নাম হয় নাকি?
-‘হ! ওইডাই আমার নাম। তোমার যদি লিখতে অসুবিধা হয়, তুমি অন্যকিছু লেহ গিয়া, কিন্তু নাম আমার বড়ি। বাপ আমার ঐ নামই রাখছিল। খালি ক্যাম্পের সুমায়ডাতে ঐহানকার মাইয়াগুলো আমারে বড়িদি কইয়া ডাকতো। এহন আর আমার কোনো নাম নাই, নামের দরকারও নাই।’

কথাগুলো বলতে-বলতেই অশিতিপর বৃদ্ধার মুখে জমে উঠল একগাদা নোংরা-দুর্গন্ধযুক্ত থুতু। দু’বার ‘সর-সর’ বলে আমাকে সরে দাঁড়ানোর অবসর না দিয়েই ‘ওয়াক থু’ করে গালভরা নোংরা থুতু উগরে দিল আমার পায়ের উপর। ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠল সারা শরীর। প্রথমে ভাবলাম, অসুবিধা নাই, পা-টাকে ঝাড়া দিয়ে আর একটু দাঁড়াই, কথা বলি। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। পায়ে জুতো থাকলে হয়তো হতো, কিন্তু সেদিন আমার পায়ে ছিল কোলাপুরি স্যান্ডেল। ফলে একটু দাঁড়িয়ে দু’একবার পায়ের দিকে তাকাতেই ক্ষুুধার্ত পেট থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে এলো ‘ওয়াক-ওয়াক’, চোখে জমে গেল পানি। করুণার নয়; তীব্র অস্বস্তি আর ঘেন্নাজাত। সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়ে আমি বাড়ি ফিরে গেলাম। রাতেই অফিসের ফোন-

-‘আপনার হাতে আর মাত্র দুদিন সময় আছে। বিজয় দিবসের বিশেষ সংখ্যায় আমরা স্টোরিটা ছাপতে চাই।’

-‘জি মানে, আমি এখনো অমন কাউকে খুঁজে পাইনি, আবার ছবিও লাগবে, যদি কাউকে পেয়েও যাই তবে ছবি তুলতে রাজি হবেন কিনা সন্দেহ আছে। তারচে’ অন্য কাউকে যদি অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়ে দিতেন দাদা…।’

-‘চুপ করুন! হাতে আছে দুদিন, এখন আপনার এসব প্যানপ্যানানি শুনতে চাই না। অন্য কাগজের ছেলেরা পারলে আপনি পারবেন না কেন? আমি তো আপনাকে সোর্স বলেই দিয়েছি, আপনার এলাকাতেই, এখন যেখানে সিনেমা হলটি, তার পেছনের পরিত্যক্ত পাটের গুদামেই ছিল মিলিটারি ক্যাম্প। ওখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল ত্রিশ জন নারী। যাদের অনেকের বাড়িই আপনার এলাকায়, কেননা তাদের আশপাশের গ্রামগুলি থেকেই ধরে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে একজন নারীকেও খুঁজে বের করতে পারবেন না আপনি! আপনাদের এই প্রজন্মের ছেলেদের সামর্থ্য দেখে সত্যিই তাজ্জব বনে যাই। কোন যোগ্যতায় আপনারা সাংবাদিকতা করতে আসেন, ভেবে পাই না! স্টোরি আমার চাই, কালকের মধ্যেই।

-উফ! এই যন্ত্রণা নিয়ে চাকরি করা যায়! চাকরিটা যে ছেড়ে দেব, তাও ঠিক সিদ্ধান্ত করে উঠতে পারি না। সুতরাং নানা চিন্তায় আধোঘুমে এপাশ-ওপাশ করেই রাতটা কাটল আমার। আর কোনো উপায় নেই। যা করার ওই বুড়িকে ধরেই করতে হবে। প্রয়োজনে বুড়ির নোংরা থুতু আরও দু’একবার হজম করে হলেও। তা ছাড়া আলাপের শুরুতেই বুড়ি আমাকে বলেছে, সে ওই ক্যাম্পে ছিল, ওই ক্যাম্পে আর কারা ছিল, তারা কে কোথায়, তা ওই বুড়িটারই জানার কথা।

আরও গল্প পড়ুন: বাড়িঅলা

পরদিন সকাল ৯টা বাজার কিছুটা আগেই আমি বুড়ির সামনে হাজির হয়ে যাই। বুড়ি আমাকে চিনতে পারে। দেখি তার টিনের থালায় কয়েকটা কয়েন আর ছেঁড়া-খোঁড়া এক টাকা-দু’টাকার নোট বাদে তেমন কোনো টাকা-পয়সা জমে ওঠেনি। আমাকে দেখে ডানে-বাঁয়ে মুখ ঘোরায় দু’বার। তারপর জানায়, আজ সে কথা বলতে পারবে না। রোববার; রোববারেই এলাকাটা জমে ওঠে বেশি, সুতরাং আজ তার কালেকশনের দিন। আমি তাকে বোঝাতে লেগে যাই; পত্রিকা অফিসের কথাটা শুধু জানাই না। পত্রিকা অফিস কিসে কখন ব্যস্ত হয় তা বুড়ির জানার কথা নয়। তবে আমার হাতে মুখ খোলা কলম আর পকেটের বেরিয়ে থাকা স্লিপ প্যাড নিশ্চয় তার চোখ এড়ায় না। কেন যেন বুড়ি একটু নরম হয়, আমি তার চোখের দিকে তাকাই, আশপাশে তাকিয়ে দেখি আমার পরিচিত কেউ আছে কি-না। তার পর বসে পড়ি; বুড়ির মুখোমুখি। বুড়ির দুই চোখের কোণে জমে থাকা হলদে পিচুটি প্রথমদিকে আমাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা সয়ে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমার স্টোরিতে তার নাম হবে বড়ি বিবি।

বড়ি বিবির বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি গ্রামে ছিল। এখন আছে কি-না তা সে জানে না। তবু নলছিটিতেই তার বাড়ি। যুদ্ধের এক কি দু’বছর আগে বড়ি বিবি এখানে আসে। তার পাটকল শ্রমিক স্বামীর হাত ধরে। তখন তার বয়স কত হবে? ৪০ ছাড়িয়ে গেছে, ছেলেপুলে হয়নি। হয়নি যে, তার জন্য বুড়ি কয়েকবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। ছেলেপুলে নিয়ে তার স্বামীরও কোনো আক্ষেপ ছিল না। যেখানে দুই মুখের আহার জোগানোই প্রায় অসম্ভব, সেখানে ছেলেপুলে হয়ে গেলে তো বিপদ আরও বাড়ত।

-আপনার স্বামী কোথায়? তাকে কি রাজাকারেরা মেরে ফেলেছিল?

-চুপ! কথা কম কইবি। আমি কমু, তুই খালি শুনবি।

-জি আচ্ছা। বুড়ি বলে যায়-

শহরে মিলিটারি আসার খবরটা তারা সাথে সাথেই পেয়েছিল। খবর এসেছিল বাতাসে, আর বাতাসের চেয়েও দ্রুততায় এসেছিল মিলিটারি জিপ। বস্তির উপর একটানা গুলির্ষণ করে তারা, কানে তালা লেগে যায়। নারী-শিশু-বৃদ্ধ-জোয়ান ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটতে থাকে দিজ্ঞ্বিদিক। কিছু মারা পড়ে, কিছু পালাতে সক্ষম হয়। বড়ি বিবির স্বামী ছিল ব্যথার রোগী। ব্যথাটাও উঠত তার সময়ে-অসময়ে, তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে যেত শরীর। সেদিনও তেমনই হয়েছিল। ব্যথায় কাতর স্বামীকে শুইয়ে রেখে সোডা জোগাড়ের জন্য কেবলই ঝুপড়ির দরজা ঠেলে মুখ বাড়ায় বড়ি বিবি। আর তক্ষুণি শুরু হয় গুলি। ওর স্বামী তবু বলেছিল তাকে রেখে পালিয়ে যেতে। সে পালায়নি, পালাতে পারেনি। গুলি থেমে যাওয়ার পর শুরু হয় খানা-তল্লাশি। দুটো রাজাকার ঢুকে পড়ে তাদের ঝুপড়িতে। তারা ‘পাইছি-পাইছি’ বলে চেঁচিয়ে বড়ি বিবির হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। বড়ি বিবির স্বামীর ব্যথাক্রান্ত কুঁজো শরীরে হঠাৎই যেন শক্তি ফিরে আসে। খাটের তলা থেকে টান দিয়ে শাবলটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে লোকটা এবং দরজার সামনেই ক্ষুুধায়-ব্যথায় কুঁকড়ে থাকা পেটে একগাদা গুলি নিয়ে ছিটকে পড়ে। তার হাত ধরে টানতে থাকা রাজাকার দুটো একটু থমকে দাঁড়ায়। সেই অবসরে বড়ি বিবি তার গুলি খেয়ে ছিটকে পড়া স্বামীর দিকে একবার তাকায়। পড়ে থাকা দেহটা দেখার পর সে যে অপহৃত হচ্ছে- সেই বিষয়ক ভীতি ও গ্লানি কেটে যায় তার। তীব্র ব্যথার হাত থেকে স্বামীর এমনতর মুক্তি মুহূর্তে তাকে কিছুটা আনন্দ এনে দেয়। তার পর তাকে আর খুব বেশি টানাহ্যাঁচড়া করতে হয় না রাজাকারদের। অনেকটা স্বেচ্ছায় সে হেঁটে গিয়ে মিলিটারির জিপে চড়ে বসে।

পাটের গুদামটা আগে থেকেই চেনা ছিল তার। ধরে আনার প্রথম রাতে সেখানেই তাকে আটকে রাখা হয়। রাতে একজন অফিসার ও দুজন সেপাই তাকে নির্যাতন করে। কিন্তু ওই তিনবারই; তারপর আর করেনি। পরদিন বিকেলের আগেই সেখানে আরও পাঁচটি অল্প বয়সী মেয়েকে ধরে এনে তার সাথে আটকে রাখে মিলিটারিরা। মেয়েদের ক্রমাগত কান্নায় বড়ি বিবি নিজের দুঃখ ভুলে যায়। জ্যৈষ্ঠের শেষ আর আষাঢ়ের শুরুতে সেখানে সে বাদে আরও প্রায় ত্রিশজন নারীকে ধরে এনে বন্দি করা হয়। ওরা আসার পর বড়ি বিবির বন্দিত্ব কিছুটা শিথিল করে দেওয়া হয়। তাকে রান্নাঘরে পাচকের সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সে রান্নাঘর আর বন্দি নারীদের দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত থাকে। মিলিটারিরা রুটি-মাংস আর ভাত খেলেও বন্দিনীদের দেওয়া হতো কেবল ভাত ও সবজি; কখনও মাছ। বন্দিনী কার কোন জাত, সেটা মিলিটারিরা জানত না। তাই এমন খাবারই তাদের পরিবেশনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

প্রথম প্রথম ওরা কিছু খেতে চাইত না। পরে খাওয়া শুরু করে। এমনকি কান্নার ফাঁকে ওরা গুনগুন সুরে গানও গাইত বলে বড়ি বিবি আমাকে জানায়। বুড়ির কাজ ছিল ওদের গোসল করানো, খাবার পরিবেশন আর কাপড় পাল্টে দেওয়া। কাপড় বলতে ওদের লুঙ্গি আর জামা দেওয়া হয়েছিল। শাড়ি বা সালোয়ার পরতে দেওয়া হয়নি। সবাইকে গোসল করানোর দরকার ছিল না। কেবল অফিসাররা যে বিশেষ পাঁচ-সাতটি মেয়ের সাথে মিলিত হতো, তাদেরই দু-একদিন অন্তর গোসল করাতে হতো। বাকিদের গোসল করানো হতো পনেরো দিন কিংবা এক মাস অন্তর।

-তাদের দু-একজনের কথা আপনার মনে আছে কি?

-মনে আছে মানে! সক্কলের কথাই আমার মনে আছে।

-দু’একজনের কথা বলতে পারবেন?

-পারুম।

ওর নাম ছিল শেফালি; হিন্দুর মেয়ে। বাপ ছিল মাস্টার, আশপাশের দু’চার গ্রামে তার সম্মান ছিল, নামডাকও ছিল। মেয়েটা বিএল কলেজে পড়ত। প্রথমে ওরা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি, হোস্টেলেই ছিল। কাটাকাটি-গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর হোস্টেল ছেড়ে পালাতে গিয়ে শিরোমণির কাছে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে। ওদের বাড়ি ছিল দাকোপ। বাড়ির সামনে একটা শেফালি ফুলের গাছ ছিল। গাছটির বয়স ওর সমান। জন্মের দু-একদিনের মধ্যেই নাকি ওর বাবা ঘরের পেছন থেকে চারা গাছটি উপড়ে এনে বাড়ির সামনে লাগায়। আর চারাটির গোড়ায় পানি ঢালতে ঢালতে চেঁচিয়ে তার মাকে জানায়- তাদের কন্যার নাম হবে শেফালি, শেফালি রানী। ওর একটি ছোট ভাই ছিল, তার নাম সুভাষ। স্কুলে পড়ত, কোন ক্লাসে তা বড়ি বিবি জানে না। শেফালি ওই ছোট ভাইটা আর বাড়ির সামনের শেফালি ফুলের গাছটার কথা বলে ভীষণ কাঁদত। গাছটাকে নাকি ওর নিজের বোন মনে হতো। কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেলে বড়ি বিবি ওর মুখ চেপে ধরত। কেননা, কান্নার শব্দ বাইরে গেলে ওদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেত। ও-ই ছিল অফিসারদের প্রথম পছন্দ। ফলে দ্রুতই ওর গর্ভ চলে আসে। ও একা না; আরও কয়েকজনের গর্ভ হয়েছিল।

একদিন দুপুরেই মুক্তি খতমের অভিযান শেষ করে অফিসাররা ফিরে আসে। এবং বড় অফিসার ভরদুপুরেই শেফালিকে তার ঘরে নিয়ে আসার হুকুম দেয়। বড়ি বিবি অফিসারকে জানায়, ওর গর্ভ হয়েছে। অফিসার তবু ওকেই নিয়ে আসতে বলে। বড়ি বিবি হুকুম অনুযায়ী শেফালিকে অফিসারের ঘরে পৌঁছে দিয়ে রান্নাঘরে যায়। কিছুক্ষণ পরে বাইরে থেকে একটি গুলির আওয়াজ আসে। আওয়াজ শুনে বড়ি বিবি বাইরে যায়। গিয়ে দেখে গুদামের চত্বরে কেউ নেই, সবকিছু সুনসান। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পায়ে-পায়ে রাস্তায় যায় বড়ি বিবি। দেখে শেফালি চিৎ হয়ে পড়ে আছে- পেটভর্তি রক্ত, মুখে হাসি, গুলিটা ওর তলপেটেই করা হয়েছে; যেখানে একটি ভ্রূণ কেবল গজিয়ে উঠে জেঁকে বসেছিল।

বড়ি বিবির পেছন-পেছন লায়েক খান নামে দাড়িওয়ালা এক বয়সী পাঠান হাবিলদারও বেরিয়ে আসে। লায়েক খান তাকে জানায়, এই ‘পেয়ারি’র লাশ ধরতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে। পারলে সে যেন দূরে কোথাও লাশটি নিয়ে ফেলে আসে। এখানে পড়ে থাকলে পচে গন্ধ বেরুবে। ততদিনে বর্ষাকাল চলে এসেছে, মাটির রাস্তাগুলো স্যাঁতসেঁতে, কর্দমাক্ত। শেফালির লাশটি বড়ি বিবি কিছু দূর বয়ে নিয়ে যায়। তারপর আর পারে না। কোমর-পিঠ ব্যথা হয়ে আসে। কাঁধ থেকে নামিয়ে এবার সে শেফালির পা ধরে টানতে থাকে। ভেজা রাস্তায় এই প্রক্রিয়ায় শেফালিকে টেনে নিয়ে যেতে তার কষ্ট কিছুটা কম হয়। টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় বারবার বড়ি বিবির চোখ যায় শেফালির মুখের দিকে। বড়ি বিবির মনে হয়, ওর মুখের হাসিটা যেন ক্রমশ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বড়ি বিবি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সন্দেহ হয়, মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে না-তো! মরে গেলেই ভালো, বেঁচে থাকলে যন্ত্রণা বেশি। পা ছেড়ে দিয়ে বড়ি বিবি ওর মুখের কাছে যায়। হাত দিয়ে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে, নিশ্চিত হয়, তবু সন্দেহ কাটে না। চোখ দুটো একেবারেই বন্ধ, মনে হয় ঘুম কিংবা অচেতন। বড়ি বিবি ওকে টানতে টানতে ঠিকই শ্মশানে নিয়ে যায়। শ্মশানটা একেবারেই শ্মশান হয়ে আছে; কেউ নেই। আরও সামনে যেখানে বিলের শুরু সেই ঢালু জায়গায় নিয়ে যায় ওকে। একটু বসে, তার পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখে অজস্র গলিত লাশ পড়ে আছে পানি ছুঁই-ছুঁই হয়ে। দুটো কুকুর লাশগুলোকে শুঁকছে এবং কুকুর দুটো নিঃশব্দ, ঝগড়া-বিবাদ করছে না। মুখগুলো শান্ত; যেন শোকাভিভূত। এই গলিত লাশের গাদায় ওদের মনিবও রয়েছে কি-না কে জানে! শেফালির লাশের সৎকার সংক্রান্ত চিন্তা বড়ি বিবির মাথা থেকে চলে যায়। অগণন গলিত লাশের পাশে শেফালির তাজা লাশটি রেখে বড়ি বিবি ক্যাম্পে ফিরে যায়।

ঢোকার পথেই হাবিলদার লায়েক খান তাকে জানায়, মেজর সাহেবের হুকুম- ‘পেয়ারি’দের কেউ যেন গর্ভবতী না হয়, সে দায়িত্ব বড়ি বিবির। আর যদি সেটা হয়, তো যেটার গর্ভ হবে সেটা তো মরবেই, সাথে মরবে বড়ি বিবি। হাবিলদার লায়েক খানের কথা শুনে বড়ি বিবির হাসি পায়। মরণ যে কত ঠুনকো, তা বড়ি বিবি সেই দিনই জেনে গেছে। জানতে পারেনি কেবল হাবিলদার লায়েক খান ও তার মেজর। এই হুকুমে বড়ি বিবির দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। গর্ভ হলেই মৃত্যু, সুতরাং ওদের বাঁচাতেই হবে। তখন বর্ষাকাল, শর্ষে ফুল পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সন্ধ্যার পর খানেরা যখন মেয়েগুলোর শরীর ছিঁড়তে ব্যস্ত তখন বড়ি বিবি মুখ ঢেকে ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে নামে। অধিকাংশ ঘর-বাড়িই ফাঁকা। কিছু বাড়িতে লোকজন থাকলেও আলো নেই। থাকলেও তা এতই ম্রিয়মাণ যে, টিমটিমেও বলা যায় না। বিশেষ কেউ বড়ি বিবিকে চেনে না। আর যারা চেনে তারা কেউ খানসেনাদের ক্যাম্পে থাকার অপরাধে ভ্রষ্টা-জ্ঞানে তার সাথে কথা বলে না। বড়ি বিবি বাড়ির পর বাড়ি বাগানের পর বাগান ঘুরে কচি ভাঙের পাতা আর রক্তজবা ফুল সংগ্রহ করে। ওগুলো ক্যাম্পের রান্নাঘরের পাটায় ছেঁচে নির্যাস তৈরি করে তারপর সকাল বেলা সে নির্যাস ঝিনুকে নিয়ে একজন-একজন করে মেয়ের দু’পায়ের ফাঁকা দিয়ে জরায়ুমুখে ঢেলে দেয় গর্ভনিরোধক হিসেবে। এ কাজ করার সময় মেয়েগুলো হাসে, গুনগুন করে গান গায়। বড়ি বিবি ওদের ধমক দিয়ে বলে, ‘হাসিস না বইন’। গর্ভ হয়ে গেলে আর তোদের বাঁচানো যাবে না। বাঁচার কথা শুনে ওদের হাসি আরও বেড়ে যায়। তবে বড়ি বিবির প্রাণান্ত চেষ্টাও ওদের গর্ভ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এমন গর্ভবতী দু’তিনজনকে শেফালির মতোই গুলি খেয়ে মরতে হয়। বাকি দু’তিনজন গর্ভিনীকে আড়াল করতে অন্য বন্দিরা নিজের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

এ সময়ে হঠাৎ গোলাগুলির মাত্রা যায় বেড়ে। ক্যাম্পের ভেতর অন্ধকার হেঁসেলে শুয়ে কোনো কোনো রাত পুরোটাই গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে কাটে বড়ি বিবির। ক্যাম্পে চাঞ্চল্য আর ভীতি বেড়ে যায়। হাবিলদার লায়েক খান একদিন তাদের আসন্ন পরাজয়ের শঙ্কা ভুল করে বড়ি বিবির কাছে বলেই ফেলে।

-আপনি ওদের নাম জানেন না? দু’চারজনের নাম বলতে পারবেন?

-পারুম। সক্কলের নামই আমার মনে আছে।

-তাহলে বলুন।

-ওগোর নাম হইলো গিয়া জুঁই, চামেলি, জবা, কুসুম, নার্গিস, কলমি, গেঁদা, মালতি, শাপলা…

-থামুন-থামুন! কী বলছেন এসব! এগুলো তো ফুলের নাম।

-হ! ফুলের নাম। ফুলের নাম ফুল হইবো না-তো মান্দার গাছ হইবো?

আমি দমে যাই। শ্বাস ফেলে বলি, তারপর কী হলো?

তারপর একদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই ক্যাম্পের দরজায় দাঁড়ানো হাবিলদার লায়েক খান গুলি খেয়ে ভেতরে ছিটকে পড়ে। একের পর এক বোমা এসে পড়তে থাকে ক্যাম্পের আশেপাশে। বড়ি বিবি তখন জুঁই-চামেলিদের জরায়ুতে ভাঙ ও রক্তজবার নির্যাস ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। একের পর এক বোমা এসে মাটি কাঁপিয়ে শুধু ফুটতে থাকে। বড়ি বিবির হাতের ঝিনুক পড়ে যায়। ভয়ার্ত মেয়েগুলো কয়েক মুহূর্ত পরেই ধাতস্থ হয়ে ওঠে। কয়েকজন যারা স্কুল-কলেজে পড়ত, ওরা কিছু একটা বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে বড়ি বিবিকে জড়িয়ে ধরে হো-হো করে হাসতে থাকে। তবে সে হাসি দীর্ঘায়িত হয় না; মিলিয়ে যায়।

দুপুরের আগেই গোলাগুলি থেমে যায়। গোলাগুলি থামার পর ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে বেশ কয়েকটি খানসেনার লাশ ফেলে রেখে বাকিরা দ্রুত গোছগাছ করে নিয়ে জিপে উঠে চলে যায়। যাবার প্রাক্কালে বন্দিনীদের ঘরে ঢোকে বেশ কয়েকজন খানসেনা। মেয়েগুলোর হাত পিছমোড়া করে বাঁধে, তারপর একটি লম্বা কাছি প্রত্যেকের বগলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে মালার মতো গেঁথে টানতে-টানতে ওদের জিপে তুলে নেয়। বড়ি বিবিকে বাঁধে না, সাথেও নেয় না। বরং বড়ি বিবি স্বেচ্ছায় লাফিয়ে জিপে উঠতে গেলে একজন সৈন্য একটি প্রচণ্ড লাথি কষে দেয় বড়ি বিবির বুকের ওপর। তার আর শাপলা-জবাদের সাথে যাওয়া হয় না।

-সবাইকে নিয়ে গেল! ওরা কি আর ফিরে আসেনি?

পিচুটির আড়াল দিয়ে বুড়ির রুক্ষ চোখ হঠাৎ যেন জ্বলে ওঠে।

-আমি আমতা-আমতা করে বলি, ওদের কোনো ছবি, মানে আমার একজনের অন্তত…

বুড়ির চোখের আগুন নিভে যায়। হেসে ওঠে সে।

‘হ! ছবি আছে আমার কাছে, তয় সেগুলো আছে আমার বুকের মইদ্যে, কলজেটার গায়ে সাঁটানো। ত্রিশজনের ছবিই আছে। কেমনে যে তোরে দেই!’

আমি বলি, ‘আপনার একটা ছবি তুলি?’

-‘হ! তোল।’

আমি বুড়ির চোখের পিচুটিসহ একটি ছবি তুলি। ছবি তোলার সময় সে হাসে, দাঁতগুলো কালো হয়ে গেলেও এখনও আছে। কতটা নড়ে গেছে, জানি না।

সন্ধ্যার মধ্যেই কাগজের বেঁধে দেওয়া শব্দসংখ্যার ভেতরে আমি স্টোরিটা তৈরি করি। আর বড়ি বিবির ছবিসহ সেটাকে মেইল করে দিই অফিসের ঠিকানায়। বাসায় ঢোকার পথেই ফোন আসে-

-‘ইজ দিস দ্যাট স্টোরি হোয়াট আই ওয়ান্টেড?’

-‘জি! সেটাই।’

-‘ব্ল্যাডি রাবিশ! আমি আপনাকে একজন বীরাঙ্গনার ওপর একটি স্টোরি করতে বলেছিলাম, ছবিসহ। কোনো নোংরা ভিক্ষুকের হাসিমুখের ছবি আর অদ্ভুত কথাবার্তা টাইপ করে পাঠাতে বলিনি। অনুগ্রহপূর্বক আপনার আইডি কার্ডটা রেজিস্টার্ড ডাকে অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবেন, আগামীকালই।’

আমি বলি, ‘জি আচ্ছা।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত