অনেকদিন পর সুখ-স্বপ্নময় নির্ঘুম একটি রাত কাটালো লাল মিয়া। যৌবন তার ভাটির দিকে। তবু শরীরের অটুট গঠন আর তাকত যে এখনো তার ফুরিয়ে যায়নি গতকাল আবার সেটা প্রমাণ হয়েছে। গৌরবর্ণের এই মানুষটির নাম তার বাপ-মা কেন যে, লাল মিয়া রেখেছিল তা হয়তো লাল মিয়ারও অজানা। পরের বাড়িতে বদলি খেটে রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে গায়ের রঙ এখন তামাটে। দু’চারটে চুলে পাকও ধরেছে।
ফসলের মাঠে মাটির সঙ্গেই তার যত কাজ। হয়তো এ কারণেই প্রকৃতিও তাকে আপন করে নিয়েছে। না হলে এত পরিশ্রম আর অসম আহার-বিহার করার পরও মধ্য চলিশের ঘরে বসে এতটা নিরোগ ও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী থাকে কি করে! অন্তত কুড়ি-বাইশজন যুবা-বুড়া কামলার কেউই সাহস করেনি মাঠে পাওয়া এই সম্ভাব্য সোনার ডিব্বাটি নিজের দখলে নিয়ে যায়। সবাই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে কেবল। কারো সাহস হয়নি এর হিস্যা চাওয়ারও। এমন কি যে আবু তাহের নিজে দৌড়ে গিয়ে জিনিসটি কুড়িয়ে এনেছে সে-ও সেটা খুলে পর্যন্ত দেখেনি। অবশ্য লাল মিয়াও এখনো তা খুলে দেখেনি কি আছে তাতে। তবে এতে যে কোনো গুপ্ত-সম্পদ রয়েছে এবং এ সম্পদ যে তার এই পোড়া কপালের ভাগ্য বদলে দিতে পারে এ ব্যাপারে সে অনেকটাই নিশ্চিত। আশঙ্কা কেবল গ্রামে এটা ব্যাপকভাবে জানাজানি হয়ে গেলে না আবার অনাকাক্সিক্ষত ফ্যাসাদে পড়তে হয়।
গ্রামের নাম ঠনঠনিয়া। ঠনঠনিয়া বিলের পাশেই এর অবস্থান। বৃহত্তর মোমেনশাহীর নেত্রকোণা-কিশোরগঞ্জ আর সিলেটের হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জের মিলনস্থলটা একটা বিশাল জলাধার বললে ভুল হবে না। ধেনু গাঙ-এর মত বিশাল নদী যেমন আছে তেমনি বহু হাওড়-বাওড় ও বিলঝিল রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই নিন্মাঞ্চলটিতে। এর মধ্যেও বিশাল মাছের পিঠের মত জেগে আছে স্থলভাগ। শুষ্ক মওসুমে জেগে ওঠে বিশাল ফসলের মাঠ আর বর্ষায় পানি থৈ থৈ। বন্যায় বাড়ি-ঘরেও পানি ওঠে। দুর্ভোগ বাড়ায় খেটে খাওয়া মানুষদের। তবু এসবের সাথে যাদের আজন্ম পরিচয় তারা কি আর ডরে? মোটেও না, এ যেন তাদের জীবন-যাপনেরই একটা অংশ। চির সখ্য তাদের পানির সঙ্গে।
পানি নেমে গেলে গ্রামবাসী দল বেঁধে নেমে যায় মাঠে। ফসল বুনে। প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট অনিষ্ট থেকে রক্ষাও করে তা। ঘরে না ওঠা পর্যন্ত স্বস্তি আসে না কৃষক পরিবারে।
ঠনঠনিয়া গ্রামটা যদিও অনেক উঁচুতে তবু বর্ষায় এর সমস্ত ফসলের ক্ষেতই তলিয়ে যায়। অধিক বৃষ্টি আর উজানের ঢল নামলে তো বাড়িঘরও তলায়। এ গ্রামেও তাই ত্রি-ফসলী জমি নেই বললেই চলে। দ্বি-ফসল বা এক ফসল। তাও তো যাদের পর্যাপ্ত জমি আছে। বেশিরভাগ মানুষের জমি-জিরাত আছে নামমাত্র। দাদার আমলের দাদন ব্যবসায়ী, সুদখোররাই এখন ভূঁইয়ের একচেটিয়া মালিক বলা যায়। কৃত্রিম সেচ বা নিষ্কাসনের ব্যবস্থা না থাকায় আগের দিনের কৃষকক‚ল খরায় বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে যেত। আর দ্বারস্ত হত মহাজনের। তাদের ঋণের দায়ে একে একে জমাজমি সব ওই মহাজন শ্রেণীর হস্তগত হয়। ফলে গরিব আরো গরিব আর পয়সাওয়ালা সুদী মহাজনরা হয়ে ওঠে জোতদার। সাবেকী জোতদারের সংখ্যাও এখানে অনেক কম। ফলে খেটে খাওয়া কামলা মজুরের সংখ্যাই এ গ্রামে বেশি। শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতা-ভব্যতা তাদের খুব একটা তাড়িত করে না। বড়জোর গ্রামের প্রাইমারী স্কুল। স্বল্পসংখ্যক জমিনদারদের জন্যই ওসব বিলাশ। অন্যরা অঘোষিত সেবক তাদের। তাই গ্রামের মানুষ বলা যায় এ দুটি শ্রেণীতেই বিভক্ত। লাল মিয়া ওই কামলা শ্রেণীরই একজন।
গাঁয়ে তার পরিশ্রমী কামলা হিসেবে সুনাম আছে। তাই কাজের মওসুমে তার কদর বেড়ে যায় বহুগুণে। অনেক জোতদারই চায় তাকে পুরো সিজনের জন্য বুকিং দিতে। ফলে রেট বেড়ে যায়। এবার যেমন কাশেম মেম্বার তাকে সিজন চুক্তিতে নিয়েছে।
ফজরের আযান শুনে সুখস্বপ্নের ঘোর কাটে লাল মিয়ার। সে বুঝতেই পারে না রাতটি নির্ঘুম কেটেছে নাকি স্বপ্নময় ঘুমে। চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করেছে। আযান শুনে আজ ফজরের নামায পড়তে সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে, যদিও সে জুমার নামায ছাড়া নিয়মিত নামায পড়ে না। এমন ভাবনার মাঝেই পাশ ফিরে শোয় সে এবং যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ে। নামায পড়া আর হয়ে ওঠে না। ঘুম ভাঙে অনেক বেলা করে। উঠোনে তখন রোদ বেশ তাপ ছড়িয়েছে। তবু তার মনে হয় ঘুমের অভাব রয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় ওঠে বসে। বেমালুম ভুলে যায় কাশেম মেম্বারের ক্ষেতে কাজে যাবার কথা। বউ দু’তিনবার ডাকাডাকি করে তার গভীর ঘুম ভাঙাতে না পেরে মনে করেছে হয়তো শরীর খারাপ। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে। খানিকটা না হয় ঘুমিয়েই কাটাক।
প্রাতঃক্রিয়া সেরে বদনা হাতে যখন সে ওঠোনে আসে তখনই দেখা হয় কাশেম মেম্বারের সঙ্গে। নিশ্চয়ই কাজে না যাওয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছে। কিন্তু কাশেম মেম্বার এ ধরনের কোনো প্রশ্ন না করে গভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অবাক হয় লাল মিয়া। সে নিজেই কিছু বলতে যাচ্ছিল এ সময় মুখ খুলে কাশেম মেম্বার। কিরে আলাদীনের চেরাগ পাইছিস শুনলাম। কাম কাজ বুঝি আর করতে অইবো না? তা গুপ্তধনের ডিব্বাটা আমার ক্ষেতেই পাইলি অথচ আমারে তুই জানানোর গরজটাও দেখালি না! মনে হয় একলাই ভোগ করবি সব?
বিড়ি খাওয়া ময়লাযুক্ত দুর্গন্ধময় দাঁত বের করে হাসে লাল মিয়া। কি যে কন মেম্বার সাব! আমগো গরিব মাইনষের আঙ্গুল ফুইলা কি আর কলাগাছ অইবো! শরীরটা ভাললাগছে না। যামু, এহনই ক্ষেতে যামু কামে! বইবেন নাহি? বইতে আসি নাই। আনতো দেহি, কি পাইছোস কালকে!
লাল মিয়া বুঝলো মেম্বারের নজর পড়েছে পাওয়া জিনিসটায়। গোপন থাকার বিষয় নয়। মাঠের কামলা-মজুররা সবাই দেখেছে। মেম্বারের কানে যেতে কতক্ষণ। তাই ক্ষেতের কাজে না যাওয়ার কসুরের চেয়ে গুপ্ত-সম্পদের লোভটাই তাকে কামলা-বাড়ি টেনে এনেছে। শেষ চেষ্টা করে লাল মিয়া বলেন আপনেও যেমুন কতা কন! কি পাইমু, একটা খালি গুঁড়া দুধের ডিব্বা! আমি এইটা খুইলাই দেহি নাই।
তাইলে আন দেহি তোর খালি দুধের ডিব্বা! সবাই কইল কাইল বিকালে সেই যে কৌটা নিয়া বাড়িতে হান্দাইছস, আর নাকি বার হস নাই!
কই নাই শইলডা খারাপ! খালি দুধের কৌটা, পুলাপানে খেইলা কই ফালাইছে কে জানে!
মেম্বারের মনে এবার সন্দেহ গাঢ় হয়, চোখে জ্বলে ক্ষোভের অনল। রুক্ষকণ্ঠে বলে ওঠে লাল মিয়া! তুই আমারে দুধের পোলা পাইছোস! সাত-পাঁচ বুঝাইবার চাস? আমার জমিনে পাওয়া সম্পদ তুই একলা ভোগ করবি আর আমি চাইয়া চাইয়া দেখুম! কই লুকায়া রাখছোস বাইর কর, নইলে খারাপ অইব কইলাম!
সকালবেলার খালি পেট। ক্ষুধায় এবং রাগে তার শরীর কাঁপে। তবু মেম্বারের মত গর্জে ওঠতে পারে না। অনেকটা শীতল গলায়ই মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলে পাইছি, সাত রাজার ধন, মানিক রতন! আমি পাইছি, আফনারে দিমু ক্যান?
মেম্বার রাগ আর সামলাতে পারে না। হুংকার ছেড়ে বলেন কেন দিবি সেইটা বার করুম নে। আমি এহন গেলাম; নসিবে খারাবি আনতে না চাইলে জিনিসটা নিয়া বাড়িতে দিয়া আইবি। ভালয় ভালয় দিলে তোরে না দিয়া খামু না। নইলে…!
কথা শেষ করে না মেম্বার। ‘নইলে’ শব্দটা দাঁত কিড়মিড় করে এমনভাবে উচ্চারণ করে যেন তাতেই লাল মিয়া ভস্ম হয়ে যাবে।
মেম্বার চলে গেলে লাল মিয়া ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। ডিব্বাটা যে সে নিজেই এখনো খুলে দেখেনি কি আছে তাতে! সে এটা খুলে দেখার চেয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখাটাই প্রথমকর্ম স্থির কর।
শেষ শরতের রোদমরা বিকেলে অন্য কামলা-মজুরদের সাথে মেম্বারের ধান ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছিল সে। চারদিকে সবুজ ধান ক্ষেত। উত্তর-পূর্ব কোণে বিশাল ঠনঠনিয়া বিলে স্বচ্ছকালো পানি। নীচে সবুজের চাদর আর সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। এইতো ঠনঠনিয়া গ্রামের এ সময়ের চিরচেনা দৃশ্য। লাল মিয়া আপন মনে নিড়ানি দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ। শব্দের প্রচণ্ডতায় উপরে তাকায় সবাই। বেশ নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক যানটি। বিশাল পাখার ঘূর্ণন এমন কি দরজা-জানালা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখে সবাই। তাদের মাথার উপরে যখন এটি- ঠিক তখনি কি একটা জিনিস হেলিকপ্টার থেকে নিচে পড়তে দেখা যায়। অনেকদিন আগে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে এরকম উড়োজাহাজ থেকে এটাসেটা ফেলা হত। বন্যার সময় একবার খাবারের প্যাকেট ফেলা হয়েছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণের উপদেশসহ লিফলেট ফেলেছিল। লাল মিয়া অন্তত এইটুকু জানে, উপর থেকে যা-ই নিচে ফেলানো হোক না কেন তা কোন না কোন কাজের জিনিসই হবে।
জিনিসটা চোখের সামনে ধান ক্ষেতেই পড়ল। চারদিক থেকে ছুটে আসছে মাঠে কাজেরত কিষাণ-কামলারা। এবার গর্জে ওঠে লাল মিয়া কেউ ধরবে না এইটা! আবু তাহেরের কাছে পড়ায় ততক্ষণে সে এটা তুলে হাতে নিয়েছে। অন্যেরা কাড়াকাড়ির জন্য ছুটে এলেও লাল মিয়ার গর্জনে ভয়ে বোকার মত হাসতে লাগল। কেউ কেউ বললাম দে, ওস্তাদরে দিয়া দে।
আবু তাহের গুঁড়া দুধের ডিব্বা সদৃশ চকচকে নতুন কৌটা খুলতে চেষ্টা করেনি। দু’বার শুধু ঝাঁকি দিয়ে চেষ্টা করেছে কি আছে তা বোঝার জন্য। লাল মিয়ার ধমকে সে অপরাধীর মত মুখ করে ফিরিয়ে দেয় জিনিসটি।
রতন মাস্টার সেদিক দিয়েই যাচ্ছিল। জটলা দেখে ছাতাটা বগলের তলায় চেপে দাঁড়িয়ে পড়লেন গোপাটে। পাখির কলকাকলির মত কলকল ধ্বনিতে সবাই সমস্বরে মাস্টারের কাছে বয়ান করল ঘটনা। লাল মিয়া কেবল বুকে আগলে ধরে আছে ডিব্বাটি। বিস্মিত সবাই মাস্টারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, মাস্টার কি বলে তা শোনার জন্য।
মাস্টার গম্ভীর মানুষ। সকলের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে চেয়ে বললেন, মূল্যবান কিছুও তো হতে পারে, তোমরা আবার এ নিয়ে ঝগড়া করো না।
মাস্টারের কথায় অনেকেরই চোখ চকচক করে ওঠলেও না পাওয়ার বেদনা মনের গভীরে খোঁচাতে থাকে। তবে মুখে তা প্রকাশ করে না।
বিষয়টা এত জটিল আকার ধারণ করবে তা কল্পনায়ও ছিল না লাল মিয়ার। পুরো গ্রাম এখন দু’টিভাগে বিভক্ত। কাশেম মেম্বার আর লাল মিয়া দু’দলের নেতৃত্বে। সম্পদ যাই থাক অন্যে ভাগ পাক বা না পাক কিষাণ-কামলা শ্রেণী সবাই লাল মিয়ার দলে আর বিত্তবান জোতদার শ্রেণীর সাথে সখ্যতার সুবাদে তারা কাশেম মেম্বারের দলে। কাশেম মেম্বারের ধারণা ওটাতে গুপ্তধন আছে এবং এই সময়ের মধ্যে হয়ত লাল মিয়া তা লুকিয়েও ফেলেছে। তার এমন ধারণার পক্ষে যুক্তিও আছে। অনেকেই তাকে বলেছেন চোরাচালানের কোন অবৈধ চালান যা আকারে ছোট হলেও খুবই মূল্যবান, হতে পারে তা সোনার অলংকার, বার, বিস্কিট বা এ জাতীয় কিছুই ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বিমান থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালানীদের দ্বারা এমনটা হতেই পারে। এমন সম্ভাবনা তার মনে বদ্ধমূল হবার পর সে লাল মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠে পড়ে লেগেছে। অন্যদিকে লাল মিয়াও মেম্বারের এহেন তৎপরতা দেখে অনুমান করতে পারছে যে এতে নিশ্চয়ই এমন মূল্যবান কোন সম্পদ রয়েছে যা তার ভাগ্য খুলে দিতে পারে। এ নিয়ে সারা গাঁয়ে যখন তোলপাড় তখন ক’জন সমাজদরদী এর সমাধানে আয়োজন করেছে সালিশের। পুরো গ্রামের লোকজনের সিদ্ধান্ত মতে রায় হবে কে এটার মালিক হবে। তার আগে সকলের সামনে তা হাজির করতে হবে এবং কি আছে তা জানতে হবে। তেমন কিছু হলে লাল মিয়া ও কাশেম মেম্বারকে কিছু অংশ দিয়ে বাকিটা সমাজকল্যাণমূলক কোন কাজে লাগানো হবে। কিছু ক্লাব, সংগঠন আর সমাজপতিরা এ নিয়ে খুচরো দেন-দরবারও চালিয়ে যাচ্ছে।
লাল মিয়া ডিব্বাটি তার বাড়ির আঙিনায় কোন এক গোপন স্থানে পুঁতে রেখেছে। এ ব্যাপারে সে এতটাই সচেতন যে তার স্ত্রী-পরিজনেরও কাউকে জানায়নি কোথায় তা লুকিয়ে রেখেছে। লেখাপড়া না জানলেও জমি চষতে গিয়ে সোনার ঘড়া পাওয়া কৃষক ও তার বোকা স্ত্রীর গল্প সে শুনেছে। তাই তার এ সতর্কতা।
লাল মিয়া চকচকে অ্যালোমিনিয়ামের ডিব্বাটি পাওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছেন এই বুঝি তার ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। লাল মিয়া সত্যিই এবার লাল হয়ে যাবে এমন কথা গ্রামের লোকজনের মুখেও শোনা যায়। অতএব লাল মিয়া তা ভাবতেই পারে। সে ভাবে তার অভাব নিয়ে। পয়সা-কড়ির অভাবে বড় মেয়েটার বিয়ের নামও নিতে পারছে না। বয়স আঠার-ঊনিশ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় মেয়েটারই তো জন্ম গতবারের আগের বড় পানির সময়। লাউয়ের ডগার মত শত অভাবের মাঝেও মেয়ে দুটি কেমন তিরতির করে বড় হয়ে গেছে। গাঁয়ের যা পরিবেশ, কখন কোন অঘটন ঘটেনি এ আশঙ্কায় কাটে তার দিন। এমনিতেই পাশের বাড়ির ছমিরুদ্দিনের পোলাডা কিছুদিন ধরে তার বাড়ির আশপাশে ঘুর ঘুর করে। অকারণে শিশ দেয়, গানে টান মারে। কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার মেয়ের দিকে।
লাল মিয়ার ভয়ে এখনো পাড়ার ছেলে-ছোকরারা যদিও ইজ্জতের ওপর আক্রমণের সাহস দেখায়নি তবু সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কারণ নিজের সন্তানের ওপরই আস্থা রাখা যায় না। একদিন সন্ধ্যায় তো ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে নিজের মেয়ে ফুলবানু আর ছমিরুদ্দিনের পোলা বশারকে ফিসফিসিয়ে কিসব বলাবলি করতেও দেখেছে। তখন থেকেই হুঁশিয়ার হয় লাল মিয়া। ইজ্জত খোয়ানোর ভয় আর শঙ্কায় নিজের ভেতরটা তোলপাড় করতে থাকে। ছিন্ন বসনে মেয়েটার বাড়ন্ত শরীর বুঝি বা আর ধরে রাখা যায় না। তার চেয়েও গরীব ঘরের একটা কর্মঠ ছেলের কাছে মেয়েটাকে তুলে দিতে গেলেও কম করে হলে দশ পনের হাজার টাকা দরকার। কোথায় পাবে সে এত টাকা? দুটো গরু কিনে বড় করেছিল মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু এবারের বন্যায় যখন নিজেদেরই বসবাসের সংস্থান নেই তখন পানির দামে গরু দুটি বিক্রি করে দিতে হয়। সেই টাকাও বন্যার অভাবে কিছুটা খরচ হয়ে গেছে। এখন দুটো বাছুর কিনে নিলে হয়তো বছর দুয়েকের মধ্যে একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু এতদিনে কি হয় কে জানে! হয়ত মেয়েদুটোর কপাল গুণেই হাতে এসেছে এই গুপ্তধন লাল মিয়া।
কথিত গুপ্তধনের ডিব্বাটা পাওয়ার পর লাল মিয়ার ভাবনারাও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। যদি এমন হয় যে এতে প্রচুর সোনার গয়না রয়েছে তাহলে দুই কন্যা আর তার বউকে কিছু অলংকার দিয়ে বাকিটা বিক্রি করে মেয়েদের বিয়ে দেয়াসহ তার অভাব মোচনের একটা হিলে হয়। কিন্তু কাশেম মেম্বার যেভাবে লেগেছে তাতে না আবার তার আশার গুড়ে বালি মিলে
ঠনঠনিয়া গ্রামের মানুষ বহুদিন এত বিশাল সালিশ প্রত্যক্ষ করেনি। সকাল থেকেই মতি মোড়লের বাড়ির আঙিনা লোকজনে ভরে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকজন আরও বাড়তে থাকে। পূর্বঘোষিত সময়ে মাতবর-সমাজপতিদের সকলেই উপস্থিত না হওয়ায় বিলম্ব হচ্ছে। পুরো গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই ছুটে এসেছে লাল মিয়ার গুপ্তধন পাওয়ার সংবাদে। কি গুপ্তধন পেয়েছে সেটা না কি লাল মিয়া স্বীকার করছে না। এবার দেখি ব্যাটা লুকিয়ে রাখে কি করে!
রমজান মাতবর, তমসুর ডাক্তার (পলীচিকিৎসক ও ফার্মেসী মালিক), রতন মাস্টার থেকে শুরু করে ফটকা জালাল, গরুর দালাল জাহেদালীসহ কেউই বাদ নেই। মোটামুটি যার যার প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনুযায়ী আসন অলংকৃত হয়েছে। বাকীরা দুর্বাঘাসের পিঁড়িতে আয়েশ করে বসে পড়ে। সালিশের বাদী-বিবাদীর চেয়ে দর্শক-শ্রোতা তথা আয়োজক সমাজপতিদেরই যেন গরজ বেশি। এসব বুঝেই হয়তো রাতের অন্ধকারে কাশেম মেম্বার গিয়ে হাজির হয়েছিল লাল মিয়ার কুটিরে। প্রস্তাব রেখেছিল সততার সাথে সমান ভাগ হবে, সালিশের প্রয়োজন নেই। আমরা আপস করে ফেলেছি, জানিয়ে দিলেই হল।
রাজি হয়নি লাল মিয়া। গ্রামবাসীকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে কাশেম মেম্বার মানাতে পারলেও তার সে ক্ষমতা নেই। বরং পুরো গ্রামের মানুষের কাছে সে আরও ছোট হয়ে যাবে।
সালিশ বৈঠকে বেশি সময় লাগেনি লাল মিয়ার মুখ থেকে সত্য বের করতে। কোথায় লুকিয়ে রেখেছে গুপ্তধনের ডিব্বাটি তাও জেনে গেছে। বিশ্বস্ত চার জোয়ানকে পাঠানো হল পুঁতে রাখা ডিব্বাটি নিয়ে আসতে। যাতে সালিশে নিয়ে আসার আগে কেউ সেটা খুলে না ফেলে তা তদারকির জন্য গেল রতন মাস্টার। সাথে লাল মিয়া ও কাশেম মেম্বারও যায়। সময় লাগে না বেশি। অল্পক্ষণ পরেই তারা এটি উদ্ধার করে নিয়ে আসে জমায়েতের সামনে। ডিব্বা খুলার আগে নেতৃস্থানীয়দের সাথে ফুসুর-ফাসুর করে সালিশের রায় ঘোষণা করে রমজান মাতবর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্পদের তিন ভাগের একভাগ সমান অংশ করে পাবে লাল মিয়া ও কাশেম মেম্বার, বাকি দু’ভাগ সমাজকল্যাণে সমাজপতিদের মাধ্যমে ব্যয় হবে।
এবার ডিব্বা খোলার পালা। সবাই উৎকর্ণ হয়ে আছে কি আছে এতে জানার জন্য। কোন ধমক বা নির্দেশ ছাড়াই পিনপতন নীরবতা নেমে আসে জমায়েতে। রমজান মাতবর তাহের মিয়ার গামছা দিয়ে ডিব্বার গায়ে লেগে থাকা ধুলোমাটি পরিষ্কার করে নেয়। তারপর জমায়েতকে উদ্দেশ করে বলেন আপনারা সবাই দেখুন, কৌটা খোলা হচ্ছে। তারপর চাবির রিং থেকে একটা বড় চাবি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুব কায়দা করে খুলে ফেলে ডিব্বার মুখ। মাথা নীচু করে একই সাথে পাঁচ-সাতজন সালিশদার ঝুঁকে পড়ে দেখতে যায় ডিব্বার ভেতরের সম্পদ এবং প্রায় সাথে সাথেই ‘ওয়াক থু’ বলে কেউ কেউ বমিই করে দেয়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা উৎকট দুর্গন্ধে আশপাশের সকলেই নাক চাপা দিয়ে ধরে। পাঁচদিন আগের মানুষের মলের গন্ধে ভারি হয়ে পড়ে আশপাশের বাতাসও। রমজান মেম্বার দু’হাতে ছুড়ে মারে ডিব্বাটি অপেক্ষাকৃত ময়দানের দিকে। সেটি গিয়ে পড়ে শুয়ে থাকা এক কুকুরের গায়ে। ঘেউ ঘেউ শব্দে বকে প্রতিবাদ জানিয়ে কুকুরটি লেজ গুটিয়ে সরে যায়। ছেলে ছোকরাদের অনেকেই ছুটে যায় ডিব্বার কাছে। কিন্তু দুর্গন্ধে খুব নিকটে যাওয়া বাদ দিয়ে তারা খিলখিল করে হাসতে থাকে।
‘কি আছে, কি পেল’ হৈচৈয়ের মাঝে সমবেত জনতা জেনে যায় আসল ঘটনা। অনাকাক্সিক্ষত বস্তু পেয়ে ঘটনার আকস্মিকতায় মাতবররা চুপ। হাসির গমকে অনেকের দম বন্ধ হবার উপক্রম। হাসি নেই মাতবরদের মুখে, কাশেম মেম্বার আর লাল মিয়ার মুখে। মাতবরদের বিকৃত গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে কাশেম মেম্বার জুচ্চোর, জালিয়াত! লালু গেরামের সব মানুষের মুখে চুনকালি দিয়েছে, তার উচিত বিচার হওয়া দরকার!
নির্বাক নিশ্চল লাল মিয়া। অজানা উত্তেজনায় কাঁপছে তার পা। কোনমতে একটা ঢোক গিলে ধরা গলায় বলে বিশ্বাস করেন আফনেরা, আল্লাহর কসম, আমি এইটা খুইলা দেহি নাই!
কাশেম মেম্বার আরও ক্রুদ্ধ হয়ে লাল মিয়াকে গালিগালাজ করতে থাকে। শালা ছোটলোকের বাচ্চা, ভিতরের জিনিস সরিয়ে এই অপকর্ম করেছে! ওকে আচ্ছা করে পেটালেই মাল বেরিয়ে আসবে!
লাল মিয়ার চোখে রক্ত এসে যায়। ইচ্ছে করে মেম্বারের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়, পরেও হবে না। কারণ এই রাগটা পরে আর অবশিষ্ট থাকবে না হয়ত।
দুরন্ত গ্রাম্য বালকরা তখন লম্বা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ডিব্বার রহস্য উৎঘাটন করে চেঁচাতে লাগল হে. হে. হি. হি, গু, গু পাইছে ডিব্বায়!
লাঠির গুঁতোয় বেরিয়ে আসে মল মোছা টয়লেট পেপার। অনেক চিৎকার চেঁচামেচি, কানাঘুষা, হাসাহাসির পর বুদ্ধিমান মাতবররা এই সিদ্ধান্তে আসে যে এ বিষ্ঠা দু’একদিনের নয় বরং বিষ্ঠাশুদ্ধই এটি পড়েছে হেলিকপ্টার থেকে। তাছাড়া লাল মিয়ার টয়লেট পেপার ব্যবহার করার কথা নয়। তবু যদি দেখা যায় অল্পসময়ের ব্যবধানে লাল মিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে তাহলে না হয় আবার বসা যাবে। লাল মিয়া তো আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না, তার বিচার যে কোন সময় করা যাবে।
আরও পড়ুন: বাড়িঅলা
পরিবেশ শান্ত হয়ে এলে সালিশের লোকজন যে যার পথে চলে যায়। চেয়ার, বেঞ্চ, মোড়া, জলচৌকি, পিঁড়ি, পাটি এসব গুটিয়ে নিচ্ছিল মাতবর বাড়ির দু’জন তরুণ কামলা। রাগে গজরাতে গজরাতে চলে গেল কাশেম মেম্বারও। মলযুক্ত খোলা টিনের কৌটাটি পড়ে আছে রাস্তার ধারে। আশাহত লাল মিয়া তাকিয়ে থাকে ওই বস্তুটার প্রতি যা কিছুক্ষণ আগেও তার কাছে ছিল অপার আশাজাগানিয়া এক মূল্যবান ধন। গভীর একখানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। মাছের চোখের মত নিষ্পলক চোখে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। মাতবর বাড়ির শূন্য উঠোনে থেকেও যেন তার মন অন্যকোন নতুন স্বপ্নের ঠিকানা খোঁজে ফিরে। নয় বছরের একমাত্র ছেলেটার ডাকে সে সম্বিত ফিরে পায়।
: বাপজান, চল বাড়ি যাই গা!
ছোট ছেলের মাথায় হাত রাখে লাল মিয়া। টলতে টলতে পা বাড়ায় বাড়ির পথে হ, চল! যাই গা।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী।