পাখির আবার বিদায় কি

পাখির আবার বিদায় কি

সুগু দানা। বলল সুগু।

দানা বলতে ডানা, কিন্তু সুগু ড উচ্চারণ করতে পারে না। রোমানিয়ান তরুণী সুগু। যখন ‘বলল’ আই অ্যাম সুগু দানা।

বললাম, ‘দানা? কিসের দানা?’

সুগু দুই হাত পাখির ডানার মতো নেড়ে দেখাল, বলল, দানা, দানা।

এতক্ষণে আমি বুঝেছি, রোমানিয়ান মেয়েটি আমাকে ওর নিজের নাম যা জানাল, তা হচ্ছে, ওর নাম সুগু। কিন্তু কোলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটের ছাত্রী হয়ে পড়তে এসে দু-একটি করে বাংলা শব্দ শিখতে শিখতে নিজের নামের পাশে ডানা লাগাতে চেয়েছে। তাই ওর নাম হয়ে গেছে, সুগু দানা।

নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমি বোঝাতে পেরেছি, আমি একটি মেয়ের কথা বলছি, যার নাম, সুগু দানা। বাড়ি রোমানিয়া। পূর্ব ইউরোপের এক দেশ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। আমার সঙ্গে সুগুর দেখা হলো কোলকাতায়। আমি ২০০২ সালে কোলকাতায় গেলাম বা প্রথমবার বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে গেলাম কবিতা লেখার দায়ে। তাই সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে কোলকাতায় যাওয়া। ঢাকা থেকে গেলাম আমি আর শাহানাজ মুন্নী। তরুণ কবি শিরোনামে আমাদের কোলকাতা গমন। উপলক্ষ বটে। তো আমাদের আবাসিক ব্যবস্থা ছিল গোলপার্কের মোড়ে, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটের আবাসিক হোস্টেলে। সেই আবাসিক রামকৃষ্ণ মিশন হোস্টেলেই সুগুর সঙ্গে মামার পরিচয় হয়েছিল, ওখানকার ক্যান্টিনে। তার আগের দিন সন্ধ্যায় আমি আর মুন্নী একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পড়েছি। সাহিত্য আকাদেমির আয়োজনে ছিল সেই অনুষ্ঠান। নবনীতা দেব সেন ছিলেন অনুষ্ঠান মর্ডারেটর। কোলকাতা থেকে কবিতা পড়েছিলেন জয়দেব বসু, রূপক … মন্দাক্রান্তা সেন। সেই অনুষ্ঠান শেষে কোলকাতার কয়েকটি টিভিতে আমাদের কথাবার্তা নিয়েছিল। সেই যখন পরদিন অন এয়ার হচ্ছিল, রামকৃষ্ণ মিশনের ক্যান্টিনে আমাদের পাশের একটি টেবিলে বসে সুগু সেটা দেখছিল আর আমার দিকে তাকাচ্ছিল। এক পর্যায়ে টিভি দেখতে থাকা পূর্ব ইউরোপের মেয়েটি উঠে এলো আমাদের টেবিলে। এসেই আমাকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘আর ইউ পোয়েট?’

আমি এই ছেলেদের মতো করে মাথার চুল কাটা মেয়েটিকে দেখলাম, তার ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণের প্রশ্নের পর একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালাম, বললাম, ‘আই অ্যাম বার্ড’।

এর পরের প্রশ্ন নিশ্চয়ই এ রকমই হয়ে থাকবে, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

ভাঙা ভাঙা তার বাংলা। সেই বাংলা বলাটা আমার ভালোই লাগছিল। আমরা চা পান করতে করতে কথা বলছিলাম। জানালাম, আমি বাংলাদেশ থেকে। সুগু বলল, ‘আমি রোমানিয়া থেকে। রোমানিয়া সম্পর্কে কিছু জানো?’

বলেছি, চসেস্কুর দেশ তো? পূর্ব ইউরোপ।

সুগু উৎসাহী হলো। বললাম, যেভাবে প্রেসিডেন্ট চসেস্কু তার বউকে চেয়ারে বসিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো, সেটা আমরা টিভিতে দেখেছি বাংলাদেশে বসেই। তাছাড়া বিশ্বকাপ ফুটবল রোমানিয়া খেলতে নামে, তাও দেখেছি।

আমি মেয়েটিকে বললাম, তুমি জানো বাংলাদেশকে?

সুগু যা বলল, তা হচ্ছে, সেও টিভিতে দেখেছে বাংলাদেশকে, বন্যায় ভেসে যায় মানুষের ঘরবাড়ি, ভেসে যায় মানুষের জীবন।

এরপরই আমাদের নিজেদের দিকে তাকানোর পালা। বললাম, তোমার নাম কি?

সেই তখন, সেই রোমানিয়ান মেয়েটি আমাকে বলল, সুগু দানা। আমার মনে হলো, দানাটা আবার কি? তাই বলেছি, দানা কি?

সুগু তার দুই হাত নাড়িয়ে পাখির ডানার ভঙ্গিতে দেখাল, ডানা।

‘কেন এসেছ কোলকাতায়?’

সুগু দানা উত্তর দিল, রামকৃষ্ণ মিশনের স্কলারশিপে এসেছি।

পাঠ্য কি?

সুগু বলল, ‘রামকৃষ্ণ অমৃত বচন’।

বুঝলাম, সুদূর পূর্ব ইউরোপেও রামকৃষ্ণের ভ্যালু পৌঁছেছে।

ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণে সুগু আর আমি খাঁটি যশুরে বাংলার সঙ্গে হালকা পাতলা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের কথাবার্তার ঢংয়ে কথা চালাচ্ছিলাম।

পরদিন রামকৃষ্ণ মিশনের ইনডোর গার্ডেনে দেখা হলে ফের সুগুর সঙ্গে। সুগু ডানার সঙ্গে। বললাম, বাংলাদেশে যাবা?

এরপর এই রোমানিয়ান মেয়েটি যে ভঙ্গিতে আমাকে যা জানাল, তা হচ্ছে, রামকৃষ্ণ যদি নিয়ে যান, যাব।

বুঝলাম, ধরেছে। বেশ।

এরপর আমাদের কয়েকদিন দেখা হলো। কোথায় কোথায় দেখা হলো?

রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলটি পাঁচতলা বিল্ডিং। আমার অবস্থান একতলায়। দোতলায় ছিল সুগু। আমাদের প্রায়শই দেখা হচ্ছিল ক্যান্টিনে, সকালে বা রাতে।

গঙ্গার ধারে, ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, সল্ট লেক, রবীন্দ্রসদন- কোথায় কোথায় গেছি আমরা? আমরা মানে কে? আমি আর সুগু। আমি সার্ক ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে গেছি, ওদের খরচাপাতি। সুগু রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের ছাত্রী আমিও সার্ক ফাউন্ডেশনের নিয়মিত শিডিউল থেকে ফাঁকি দিচ্ছিলাম, সুগুও। রামকৃষ্ণ অমৃত বচন’ থেকে ফাঁকি দিচ্ছিল। দুই ফাঁকিবাজ একসঙ্গে হয়ে যাচ্ছিলাম গঙ্গার ধার, কলেজ সিট, কফি হাউজ, এদিক-ওদিক, সিনেমা হল। আমরা সঙ্গে একটি একটি দুটি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই সুগু উচ্চারণ করত, ইউ আর পোয়েট।

আমি বলতাম, আই অ্যাম বার্ড।

তখন সুগু তার দুই হাত দুইদিকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলত, আমি দানা। সুগু দানা।

সুগু তার নাম ডানা’র বদলে বলত দানা।

আরও পড়ুন: অঞ্জলীর মুখ ও বিন্দু বিন্দু জল

আমার ভালো লাগছিল। কোথাকার কোন কে আমি, কোথাকার কোন সে, আমাদের পাখি হয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আমাদের ডানা হয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা উড়তে চাচ্ছিলমা কোলকাতার আকাশে। একরাতে আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো। মাথা ব্যথায় কেউ মরতে পারে? আমার মনে হচ্ছিল, আমার মৃত্যু হচ্ছে। প্রচন্ডকাতর হয়ে পড়লাম। ছটফট করছিলাম যন্ত্রণায়। আমাকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন হোস্টেলকর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ে গেল। ঢাকার তরুণ কবি কি কোলকাতায় এসে মাথা ব্যথায় মরে যাবে? অ্যাম্বুলেন্সে আনা হলো। সুগু ওর ফ্লোর থেকে এলো, এসে বলল, আমার কাছে চাইনিজ বাম আছে। কপালে লাগিয়ে দিই?

সুগু আমার কপালে চাইনজি বাম লাগাচ্ছিল। আমি মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে চাচ্ছিলাম।

দুদিন পর আমি ঢাকায় ফিরব, বলতেই সুগবে চোখে বিষন্নতা দেখলাম। আমারও মনখারাপ লাগছিল। আমি বললাম, কি দিয়ে যাব তোমাকে আমি?

সুগু হালকা-পাতলা বাংরা উচ্চারণে বললে, তোমার একটি কবিতা।

আমার যে কবিতার বইটি তখনি আমার সঙ্গে ছিল, কবিতা, কুটিরশিল্প। ‘কবিতা’ কুটিরশিল্পই দিলাম সুগুকে।

সুগু নিল, কিন্তু কথা লিখে দাও।’

আমি লিখেছি, ‘কোনোদিন যদি বাংলা ভালো করে বুঝতে পারো, পড়তে পারো, সেদিন কবিতাগুলো পইড়।’

আর আমাদের দেখা হয়নি। আমি কোনোদিন দেখিনি আর সুগুকে। সুগুও দ্যাখেনি আমাকে। এই যে এতএত নেট, ফেসবুক, ব্লগ, সাইট-সুগুকে আর পাইনি। খুজিওনি মনে হয়। নাকি খুঁজেছি? নাকি খুঁজিনি?

আরও পড়ুন: খেয়া নামের গ্রামটি

খুঁজেছি? খুঁজেনি? কিন্তু মানুষ হারালে মানুষকে আর খুঁজে পাওয়া যায়? যায়। নাকি যায় না? নাকি যায়? যায় না? যায় তো? কই? খুঁজে তো পাই না। তাহলে কি খুঁজিও না? কে জানে কার মনে কথা?

এখন, এই শীতে, এলোর উপান্তে এসে আমার মনে প্রশ্ন জানো, সুগু ছিল ডানা। আমি বলেছিলাম বার্ড।

আমরা কি বিদায় নিয়েছি দুজন দুজনের কাছ থেকে? নাকি বিদায় বলে কিছু নেই? নাকি আছে? নাকি থাকতেও পারে? নাকি পারে না?

বলব, তুমি আজ, আমাকে বিদায় বোলো না। আমিও বলব না। ক্যালেন্ডারের পাতায় আমরা তাকাব না।

আমি তাকাব তোমার দিকে, তুক্ষুনি ক্যালেন্ডার হয়ে থাকো, আমিও ক্যালেন্ডার হয়ে থাকি। তোমার মুখে আমি, আমার। মুখে তুমি-চলো না, আমরাই হই পাখি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত