অঞ্জলীর মুখ ও বিন্দু বিন্দু জল

অঞ্জলীর মুখ ও বিন্দু বিন্দু জল

কুত্তার কানের মতো শার্টের কলার প্রতি পদক্ষেপে ওঠানামা করছে। হাতির কানের মতো বেল বটম প্যান্টের হাঁটুর নিচের ভাগ পতাকার মতো উড়ছে। আমি দৌড়াচ্ছি ডালহৌসি মোড়ে। কলকাতা শহরের মধ্যখানে মেট্রো সিনেমার লবীর দিকে। ভুল ট্রামে ওঠায় চলে এসেছি এদিকটায়। সাড়ে চারটায় পৌঁছাতে হবেই মেট্রোর লবীতে। সে আশা করি এসেছে! অপেক্ষা করছে আমার। আমি অঞ্জলী রায় চৌধুরীর সঙ্গে দ্বিতীয় বার দেখা করতে যাচ্ছি। আমার পরনে দামি শার্ট-প্যান্ট, হাতে ওমেগা ঘড়ি কিছুই আমার নয়। সবই খালাতো ভাইয়ের বন্ধু ডাক্তার সালামাত ভেইডের, তিনি জোরাজুরি করে পরিয়ে দিয়েছেন। হাজার হোক, কলকাতায় এই প্রথম কোনো সুন্দরীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আমিও রাজি হয়ে পরে ফেললাম, ধারণা ছিল দামি জিনিস পরলে মেয়েদের কাছে গুরুত্ব বাড়ে। আসলে তখন আমি এ রকমই ফালতু মনস্কের মানুষ ছিলাম। সময়টা বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরপর।

অঞ্জলী তখনকার সুপারহিট নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের পিসুতো বোনের মতো। অনেকটা মিল তবে রঙটা ফর্সা নয়। চোখ বড় বড়, কাজল লাগালে ফাটাফাটি।

আমার কলকাতায় সেই প্রথম। তবে শহরটাকে খুবই আপন আর চেনা লাগছিল। ছোটবেলা থেকে বাংলা উপন্যাসে কলকাতার বর্ণনা পড়তে পড়তে সব কিছু যেন চেনা-জানা মনে হচ্ছে। চট্টগ্রামে বড় হয়েছি, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার তেমন সুযোগ হয়নি। নারীসঙ্গ ছাড়াই যৌবনে পদার্পণ। অথচ উপন্যাসে কত না পড়েছি কলকাতা প্রেমের শহর। অঞ্জলীর সঙ্গে আলাপ হতে তাই মাথা ঘুরে গেছে। চট্টগ্রামের ধর্মীয় আবহাওয়া তখন এখনকার মতো ভয়াবহ ছিল না। তবে তখনও গিলাপ পরানো কোলবালিসের মতো ছিল। নিজের খালতো মামাতো বোনরা পর্যন্ত ক্লাস সেভেন, এইটে উঠলে পর্দানসিন হয়ে পড়ত। তাই অঞ্জলী রায় চৌধুরীর মতো রূপসী স্মার্ট মেয়ের সঙ্গে আলাপ এক স্বর্গীয় ঘটনার মতো। তবে অঞ্জলীর কথা বলার আগে কলকাতায় আমি কীভাবে নাজিল হলাম সে কথা বলা উচিত।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়তেন আমার খালাতো ভাই শওকত উল আলম। আমরা ডাকতাম ননী ভাই, আমার থেকে চার বছরের বড়। পড়াশোনার সুবিধার জন্য হোস্টেলে তিনি একটা রুম রেখেছিলেন। ননী ভাইয়ার পাশের রুমে থাকতেন তার চরম বন্ধু সালামাত ভেইড। ভারতীয় গুজরাটের তিনি। তবে ওনার বাবার বিশাল কাপড়ের ব্যবসা কলকাতায়। ছেলে কলকাতায় মেডিকেলে ভর্তিতে পাস না করায় ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সালামাত ভেইডকে। টাকা-পয়সা ওনার চলার মতো কলকাতা থেকে আসত। তখন নেপাল এমন কী মালয়েশিয়ায় ভালো কোনো মেডিকেল কলেজ না থাকায় ছেলেরা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে মেডিকেলে পড়তে আসত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে সালামাত ভেইড আটকা পড়েছিল চট্টগ্রামে। সঙ্গে এক সুটকেস পাকিস্তানি টাকা ভর্তি। অথচ কলকাতা যাবে কীভাবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ছয় জায়গায় সেতু ভাঙ্গা। তা ছাড়া মানুষ হন্য হয়ে ঘুরছে পাকিস্তানি পেলেই হত্যা করছে। ভেইড দেখতে মোটেই বাঙালির মতো নয়। তার বাবা-মা কলকাতায় অস্থির অপেক্ষায় আছেন সালামাত ভেইডের জন্য। দুশ্চিন্তায় ভাসছেন, তার ছেলে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে কি-না! আমার খালাতো ভাই ননী ভাই রাজি হলেন বন্ধুকে তিনি নিজে বাই রোডে নিয়ে যাবেন। খুলনা পর্যন্ত গেলে তারপর তাদের দালাল আছে তারা নিয়ে যাবে কলকাতা। আমার কেন জেন মনে হলো ব্যাপারটা বেশ অ্যাডভেঞ্জারের, সঙ্গে যেতে পারি। ননী ভাই খুব খুশি হয়ে সঙ্গে নিলেন। সঙ্গে একজন থাকলে ভয় কিছুটা কমবে। শুধু বন্ধুর জন্য এত বড় রিস্ক তিনি নিতে যাচ্ছেন।

সালামাত ভেইড দেখতে পুরোপুরি বোম্বাইয়া হিরোদের মতো। বাঙালি হিসেবে মোটেই লাগে না। বেশিরভাগ শাল দিয়ে ঘোমটা দিয়ে চালাতে হবে। পথে যত ব্রিজ সব মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছেন। ট্রেন থেকে নেমে নৌকা দিয়ে পার হয়ে অন্য পাড়ে ট্রেনে আবার চড়ে বসতে হয়। মানুষ ঘৃণায় উন্মাদ তখন পাকিস্তানিদের ওপর। সালামাত ভেইডকে দেখলে তরুণ অফিসার হিসেবে কিছু শোনার আগেই মেরে ফেলবে। তবু যেতে হবে! খুলনা পর্যন্ত তাকে নিয়ে পৌঁছা মানে হিমালয়ের চূড়ায় দিয়ে দাঁড়ানোর সমান। তবু আমরা পৌঁছালাম। বিস্তারিত বলতে গেলে তৌকীরের জয়যাত্রার স্ট্ক্রিপ্ট হয়ে উঠবে। এত বাধা এত শঙ্কা মুহূর্তে এদিক থেকে ওদিক হলে সালামাত ভেইডের প্রাণ গেল! খুলনায় পৌঁছে জানা গেল ভেইডের পরিচিত দালাল কেউ মারা গেছে কেউ পালিয়ে গেছে। এর মধ্যে খবর এলো, ননী ভাইয়ার আর্জেন্ট চট্টগ্রাম ফিরতে হবে, এমবিএসএস পরীক্ষার দিন ঘোষণা করেছে। তিনি আমাকে সাহস দিয়ে খুলনা থেকে জলপথে বরিশাল-চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম ফিরে গেলেন।

সালামাত ভেইডকে কলকাতা পৌঁছানোর পুরো দায়িত্ব তখন আমার। আমি অতি তরুণ, তবে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি করে এসেছি বলে অসীম সাহস।

একদিন খুলনার পথে ঠিক মোড়ে সালামাত ভেইডসহ আমাকে ঘিরে ফেলে। গুণ্ডা-পান্ডার গ্যাং সঙ্গে এস ফোর্স, ডি ফোর্স নামে ভ্রষ্ট নকল যোদ্ধার দলরা। সালামাত ভেইডকে দোকানির সাহায্যে দোকানের পেছন দিয়ে পালাতে সক্ষম হলাম। তবে আমাকে ধরে বেধড়ক মারলো তারা। দু’ঘণ্টা হাসপাতালে থেকে ফিরে এসে দেখলাম, গোপন আস্তানা কাস্টমদের হোস্টেলে যেখানে ছিলাম ভেইড নিরাপদে ফিরে এসেছে। আমি আবার বেরিয়ে খুলনার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির হাই কমান্ডদের ঠিকানা ছিল, দেখা করলাম।

তাদের ইজ্জতের প্রশ্ন! তাদের চট্টগ্রামের ক্যাডারকে খুলনায় মার খেতে হবে, এতো সহ্য করা যায় না। যা মেরেছে আমাকে, সবাই চিহ্নিত হয়ে গেছে। অ্যাকশন হলো পর দিন সন্ধ্যায়। মাথা ফাটলো, দাঁত ভাঙলো। কমরেড আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-খুশি?

আমি একজনের পেটে কষে আরও দু’টো লাথি মেরে বল্লাম-খুশি!

তারা ভোর রাত পর্যন্ত আমাদের পাহারা দিয়ে আলো ফোটার আগেই বেনাপোল চেকপোস্টে পৌঁছে দিলেন। বর্ডার ক্রস করার পারমিট ঢাকা থেকে জোগাড় করা আছে। রাবার স্ট্যাম্প দেওয়া এক পৃষ্ঠা কাগজ। ঝামেলাহীনভাবে পার হয়ে গেলাম। বনগাঁ চেকপোস্ট পার হয়ে দেখি এলাহি ব্যাপার। তিনটি সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি আর একটি টাটা ভ্যানে ভরে সালামাত ভেইডের বাবা-মা, ভাইবোন-আত্মীয়রা রিসিভ করতে এসেছে। তারা তাদের সন্তানকে তাদের কাছে এনে দেওয়া মহাপুরুষকে জেমসবন্ড টাইপের কাউকে ভেবে রেখে ছিলেন! আমার মতো নেংটি ইঁদুর দেখে সবাই অবাক। ইচ্ছে হলো ওদের বলি, ‘চাটগাঁইয়া ফোয়া ম্যাডিৎ পইড়লে লোহা’ চট্টগ্রামের ছেলে যতবার মাটিতে আছড়ে পড়ূক সে তো লোহা! কিচ্ছু হবে না। ওরা তো চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝবেন না, তাই বলা হলো না। তবে মুহূর্তে আমি মানুষ থেকে অবতার হয়ে পড়লাম তাদের কাছে। কলকাতা ফিরে আমার আদর-যত্নের শেষ নেই। দিন যায় ফেরার কথা বল্লেই, না! গুজরাটে পর্যন্ত আমাকে দেখার জন্যে তাদের আত্মীয়স্বজন নাকি অপেক্ষায় আছে। আপাতত চিৎপুর রোডে নাখোদা মসজিদের কাছে সালামাত ভেইডের বাবার চারতলা বিল্ডিংয়ের তিনতলার সাজানো ঘরে থাকি। যা চাই বলার আগেই হাজির। ধীরে ধীরে কলকাতাও ভালো লাগতে শুরু করেছে। কফি হাউসে একা যাই। কোল্ড কফি নিয়ে বসে থাকি। কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকানে ঘুরি। তবু কেমন ফাঁকা লাগে। সালামাত ভেইড জানতে চাইলেন কেউ মেয়ে বন্ধু হয়েছে কি-না!

হতাশ হয়ে বল্লাম, না। কত বাংলা উপন্যাসে পড়েছি কলকাতা প্রেমের শহর। কই আমার সঙ্গে তো ঘটে না রোমান্টিক কিছু। হাঁ করে দেখি শুধু পথে-ঘাটে বাসে কী অপরূপ মেয়েরা হেঁটে যায়। এমনি-এমনি কথা বলা যায় কারও সঙ্গে! লাজুকও ছিলাম কিছুটা।

শেষ পর্যন্ত আমি বল্লাম না, মেয়েই কথা বল্লো! যে বল্লো তার নামই অঞ্জলী। তার সঙ্গেই দ্বিতীয়বার দেখা করতে সালামাত ভেইডের দামি ঘড়ি আর জামা পরে ছুটছিলাম ভুল করে ডালহৌসির ট্রাম ধরে আবার দৌড়ে মেট্রো সিনেমা হলের লবিতে।

প্রথম দেখার কথা বলার পরই তো দ্বিতীয় দেখার কথা বলা উচিত। আমি সেদিন গড়ের মাঠের সামনে শিল্পমেলা জাতীয় এক জাগায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এক বিশাল চাকায় দোলনা লাগানো। ছোটরা উঠে বসলে চাকাটি ঘুরে প্রায় আকাশে উঠে আবার ঘুরে আসে নিচে। ঠিক শার্মিলা ঠাকুরের মামুতো বোনের মতো দেখতে মেয়েটি তার ছোট্ট বোনকে দোলনায় একা তুলে দিতে পারছিল না। মুহূর্তেই দোলনা আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বল্লো- পিল্গজ হেল্প মি।

আমি এক হাতে অন্য হাতে চিমটি কেটে দেখলাম সত্যি কি মেয়েটি আমাকে বল্লো।

এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে দোলনায় বসিয়ে দু’জন একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। হাসির সঙ্গে সে বল্লো- থ্যাঙ্কয়ু। আমি অঞ্জলী রায় চৌধুরী তবে অঞ্জলী চৌধুরী নামেই চেনে সবাই আমাকে। আর ও হচ্ছে আমার ভাইয়ের মেয়ে গুড্ডু।

আমি কেন যেন জড়তায় নিজের নাম বলতে পারলাম না।

-আপনার নাম? আবার সে তাড়া দিলো।

আমি আতঙ্কে ভুগতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল আমার আসল নাম বল্লে সে আর কথা বলবে না। তাই কিছু না ভেবে হুট করে বলে ফেল্লাম

– বাবুল চৌধুরী।

অঞ্জলী চোখ বড় করে হেসে বল্লো বলবেন না আবার রায় চৌধুরী!

-না, না তা নয়।

এরপর যেন নাম-টাম বড় কথা নয়, বন্যার মতো কথা পরস্পরের জন্যে ভেতর থেকে বেরোতে লাগলো। এতো দ্রুত সে আমাকে তুমি বলছে আমি খেয়ালই করতে পারিনি। আমি ওকে তুমি করে শুরু করলাম। অবশ্য কলকাতায় পরস্পরের একটু ভালো লাগলেই আপনি-টাপনি বলে না আর।

-তোমাকে দেখে জয় বাংলার লোক মনে হচ্ছে?

– ওমা কী করে বুঝে গেলে?

-ওই যে লম্বা চুল, দাড়ি গজায়নি ভালো করে তবু দাড়ি রাখার চেষ্টা।

-ভালো লাগলো। অনেক কষ্টে অনেক কিছুর বিনিময়ে আমরা বাংলা নামের একটা দেশ পেয়েছি। এক্কেবারে নতুন দেশ তবু তুমি চিনতে পারলে আমি সেই দেশের লোক! বড় ভালো লাগে।

-তোমাদের যুদ্ধ নিয়ে ন’টা মাস আমাদের কত উচ্ছ্বাস। আমার পাঁচ দাদা, বোনেরা বাবা-মা সবাই তোমাদের জয়ের প্রার্থনা করতাম। পাঁচ দাদার কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো।

-তোমাকে আমার চা খাওয়ানো উচিত। তুমি গুড্ডুকে তুলে ধরতে হেল্প করেছো। আমার ভেতরে তারা বাতি জ্বলতে শুরু করলো। চট্টগ্রামে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপ পর্যন্ত না করা এক স্বপ্নবাজ ছেলে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। এমন অপরূপ শার্মিলা ঠাকুরের মামুতো বোন তাকে চা পানের কথা বলছে। একহাতে চায়ের কথা অন্য হাতে প্লেট ধরে টকটক করে কাঁপনের শব্দ ঠেকাতে চেষ্টা করছিলাম, আমার হাত কাঁপছে।

-তোমার কাপ আর প্লেটে এতো বাড়ি খাচ্ছে কেন? শব্দ হচ্ছে।

-আমার হাত কাঁপছে। তাই শব্দ হচ্ছে।

-কেন?

-ও কিচ্ছু না! মাঝে মাঝে কেন যে নিজের হাত নিজের বাধ্য থাকে না! কে জানে। অঞ্জলী খিলখিল করে হেসে উঠলো।

-কী বললে? তোমা হাত তোমার বাধ্য থাকে না!

-হাঁ, এতে অবাক হওয়ার কী আছে। মানুষের সবকিছু কতটাই বা বাধ্য থাকে।

-পাগল তোমরা, দেশটাকে স্বাধীন করলে কীভাবে!

-পৃথিবীতে যতবড় কিছু হয়েছে সব পাগলরাই করেছে। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষরা বড় কিচ্ছু করতে পারে না।

আমি যে ভেতরে ভেতরে কতটা উত্তেজনায় ভুগছি অঞ্জলীকে তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। ঠিক যেন উপন্যাসের মতো সবকিছু ঘটা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমি কোনো বইয়ের চরিত্র। পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় বিস্তৃত হচ্ছি।

-বাবুল তুমি খুব মজা করে কথা বলো। শুনতে ভালোলাগে। বলো না ট্রামে আমাকে ছেড়ে তারপর বাসায় যেয়ো।

-আমি তো চিনবো না, কোন ট্রামে উঠবো, কী করবো।

-ধ্যাৎ, আমি নেমে তোমাকে ঠিক চিৎপুরের ট্রামে তুলে দেবো। পকেটে যা কয়েন ছিলো, হাতে নিয়ে তার সামনে মেলে ধরলাম। কত ভাড়া লাগবে যেতে তুমি আলাদা করে দাও।

অঞ্জলী একটা একটা করে তার আঙুল দিয়ে আমার হাতে স্পর্শ করে পয়সা নাড়াচাড়া করছে। তার এই হালকা স্পর্শ আমার শিরায় শিরায় নাচন তুলছে। আমি যেন ট্রামে ছাদ ফুটো করে ঊর্ধ্বগননে ভেসে পড়বো এক্ষুনি। ও নেমে আমাকে অন্য ট্রামে তুলে দেয়ার আগে ঠিক হয়ে ছিলো দ্বিতীয়বার দেখা হবে চৌরঙ্গী মেট্রো সিনেমা হলের লবিতে সাড়ে চারটায়। সব শুনে সালামাত ভেইড খুব খুশি। আমাকে কেন যে দামি জিনিসে সাজিয়ে দিল কে জানে। শুধু বল্লেন- নামটা মিথ্যা বলা ঠিক হয়নি।

-ও আপনি বুঝবেন না। মুহূর্তে হারিয়ে ফেলতাম। তা আমি চাইনি। ঘেমে হাঁপাতে-হাঁপাতে দৌঁড়ে এসে থামলাম মেট্রোর লবিতে।

নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জলী। সরি বললাম, ট্রাম ভুল করার কথা বললাম। একটা ট্যাক্সি ডাকল অঞ্জলী। আমরা গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসলাম। অগুনতি ঠোঙ্গা চিনেবাদাম শেষ হলেও কথা আমাদের শেষ হয় না। বারবার ভোঁ ভোঁ করে জাহাজেরা আমাদের অভিবাদন করছে। হাত তুলে অঞ্জলী দেখানো পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজের দিকে- এটা ভাসে না জলে, এটি ‘গলের্ভ’ নামে এক রেস্টুরেন্ট, আমরা লাঞ্চ করব একদিন এখানে। দিন যায়, আমি আর ও ঠিক উপন্যাসের মতোই বিস্তৃত হচ্ছিলাম গোটা কলকাতাজুড়ে। কলকাতার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা প্রাণ আর আজব সব দাস্তান অঞ্জলী আমাকে সব দেখাতে বদ্ধপরিকর! আমি তো অঞ্জলীর জারে আচারে লেবুর মতো ডুবে আছি। হুঁশ জ্ঞান তেমন নেই। সালামাত ভেইডেদের পারিবারিক একটা হোটেল ছিল পার্ক স্ট্রিটে। সালামাত ভেইড ব্যবস্থা করে দিল যখনই যাই ঘণ্টাকে ঘণ্টা থাকি, কথা বলি। খাই-দাই। এত দ্রুত একে অন্যের ভেতরে ছেয়ে যেতে পারে।

এক সময় আমার ভয় লাগতে লাগলো। মনে হতে লাগলো মিথ্যার ওপর প্রাসাদ বানিয়ে লাভ নেই। ভেঙে পড়বেই একদিন এক টোকায়। অঞ্জলীকে কিছু না বলে ফিরে যাব! প্রশ্নটা নিজের মধ্যেই হাতুড়ির মতো ফিরে এসে বাড়ি দেয়! অসম্ভব, একদিন ওকে ছাড়া তুমি থাকবে কী করে। ওকে ছেড়ে চোরের মতো পালানো অসম্ভব। অনেক ঠেকানোর পর আর পারলাম না। ওদের বাড়িতে যেতেই হলো। একসঙ্গে পাঁচ ভাইবোন আর বাবা-মায়ের সামনে মিথ্যা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবে আর আমি কিবা করতে পারি। ভাইয়েরা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে দেখছে মনে হলো। অনেক কষ্ট, তবুও উৎরে গেলাম সেবার। এরপর ও ভালোই চলছিল। অঞ্জলীর বাংলাদেশে যাওয়ার স্বপ্নে ভুগছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী আর পাহাড়ের কথা শুনেছে প্রতিবেশী মিত্রবাবুদের বাড়িতে।

আমার কিন্তু টালমাটাল অবস্থা, কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এর মধ্যে যা ঘটার তাই ঘটল। অঞ্জলীর এক ভাইয়ের বন্ধু এলো চট্টগ্রাম থেকে। দক্ষিণ নালাপাড়ার ছেলে, যেখানে প্রায় সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে সাহিত্যের আড্ডায় আমি যাই বন্ধু কবি স্বপন দত্ত, ময়ুখ চৌধুরী, মিলন চৌধুরীদের সঙ্গে বসি। দাদার বন্ধু ভালো করে চেনে আমাকে। নো ওয়ে আউট, আমার বাঁচার আর কোনো উপায় ছিল না। মানুষের চেয়ে ধর্ম কেন এত বড়, তখন থেকে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল সব। পাঁচ দাদা কফি হাউসে ডাকিয়ে বলল- জয়বাংলার লোকদের আমরা ভালোবাসি। তাই তিন দিন সময় দিলাম। চলে যা কলকাতা ছেড়ে। আর তা না হলে কলকাতা তোমাকে ছাড়বে না নিজের বুকে শুইয়ে রাখবে। সালামাত ভেইড সব শুনে বললেন- আগেই বলেছিলাম মিথ্যা বলা ঠিক হয়নি। সময় ভালো না যখন তখন নকশাল বলে ভালো মেধাবী ছাত্রদের মেরে ফেলছে। আমি খবর নিয়েছি ওর দাদারা সব যুব কংগ্রেস করে। আমি চাই না তোমার ক্ষতি হোক। আমার প্রাণ বাঁচাতে তুমি অনেক বড় কিছু করেছ। আমি তোমার এ ব্যাপারে কিচ্ছু করতে পারব না। আমি বুঝলাম দেশে ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

তিনদিনের দ্বিতীয় দিনে শিয়ালদা রেলস্টেশনে বনগাঁগামী ট্রেনে বসে আছি। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে পাঁচ দাদার সঙ্গে অঞ্জলী দাঁড়িয়ে আছে। ধীর পায়ে সে এগিয়ে আসছে। দাদারা দাঁড়িয়ে রইল। একেবারে কাছে এসে জানালায় দু’হাত দিয়ে দাঁড়াল অঞ্জলী। দুই চোখে অশ্রুধারা। জানালায় রাখা ওর হাতে হাত রাখতে গেলাম। সে হাত সরিয়ে নিল। খুব সরু ধার গলায় অঞ্জলী বলল

-আমাকে সত্যিটা বললেই পারতে।

আমি চুপ করে রইলাম। কী বলবো? আমি চিরতরে অঞ্জলীকে হারাতে কী কষ্ট পাচ্ছি কেউ তা বুঝলো না।

ট্রেন ধীরগতিতে চলতে শুরুর করায় অঞ্জলী হাতের বড় ব্যাগ থেকে একটা সোয়েটার আমার দিকে ছুড়ে মারল।

-তিলে তিলে এটা নিজের হাতে তোমার জন্য বানিয়েছিলাম, দূর হয়ে যাক! ট্রেনের গতি বাড়তে অঞ্জলী হারিয়ে গেল। আমার শুধু মনে প্রাণে জুড়ে ভেসে থাকল বিন্দু বিন্দু জলে ভরা অঞ্জলীর মুখ।

এই ঘটনায় আমার বড় প্রাপ্তি জীবনে প্রথম গল্প লিখেছিলাম ‘মেট্রোর লবীতে সাড়ে চারটায়’। গল্পটি তখনকার চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মমতাজউদ্দিন আহমেদের খুব ভালো লেগেছিল। জীবনের প্রথম গল্প হিসেবে ছাপা হয়েছিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত