যে বড় রাস্তাটা সমুদ্রের দিকে চলে গেছে, সেখানে অনেক জোরে হাওয়া বইলে খুব মুশকিল। সুজি’র ওজন মাত্র ৪৮ কিলোগ্রাম। ঝাউ গাছ, পাইন গাছ, অশ্বত্থ গাছ শনশন শব্দ করে ঢেউ তুলছে। বিড়বিড় করে বলছে সে, ‘চালিয়ে যাও’; আর সমুদ্র থেকে তীরের যে জায়গাটায় পানি ছুটে আসছে তার বিপরীতে নিজের ভঙ্গুর বাম কাঁধটা কোনাকুনি করে বাড়িয়ে দিল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যে ভাইস অ্যাডমিরাল তার জীবনের শেষের ক’টা দিন তার দেখাশোনা করেছে সে প্রায়ই ‘চালিয়ে যাও’ কথাটা বলত। আনাবেলে, ওর বোর্ডিং স্কুলের বান্ধবী। স্ত্রীর শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পরপরই দ্বিধাহীনভাবে সুজি তার শোয়ার ঘর, খাবার ঘরে প্রবেশ করেছে। ওরা আনাবেলকে কবরস্থানের দেয়ালে রেখে এসেছিল। সেখানে এখন সে নিজেও তার পাশে আছে। লুস তার আগের হাসি-খুশি জীবনটা আনাবেলের অন্য গ্রামে রেখে এসেছে।
ওয়েল্স, যেখান থেকে তারা সবাই এসেছে, সেখানে তারা এই কাজটি কিছুতেই করতে পারত না। এটি একটু নিন্দার কাজ তো বটেই, কিন্তু তারা আগেই সেটা আনাবেলের সাথে কথা বলে নিয়েছিল, মারা যাওয়ার সামান্য আগে। একটি জীবন প্রদীপ নিভে গেল। শেষদিকে তার আর কথা বলার কোনো শক্তিই ছিল না। আহ! যদি সে ফিসফিস করেও বলার চেষ্টা করত, তার সল্ফ্ভ্রান্ত আওয়াজ দিয়ে, এই নিয়ে এত হৈ-চৈ করো না। আমাদের সবার বয়স হয়েছে, শুধু বৃহস্পতিবারের লোকজনই যা কিছু বলার একটু বলতে পারত, তবে বললেই বা কী লাভ হতো? বৃহস্পতিবারে সব ইংলিশ একে অপরের সাথে শহরে আসত, ব্রিজ খেলত, গল্প করত আর স্প্যানিশদের গালাগালি করত। আনাবেলের জামাকাপড় ছিল সবচেয়ে ঝামেলার বিষয়। কাশ্মীরি প্রিঙ্গেল সোয়েটারগুলো সে ফেলতেই পারল না।
এগুলো সে একবার ড্রাই ওয়াশ করল, তারপর এগুলোর ওপর শ্যানেল ফাইভ ছিটিয়ে দিয়ে কিছুদিন বাইরে বাতাসে ঝুলিয়ে দিয়ে রাখল। জামাগুলো থেকে আনাবেলের গন্ধটা মুছে ফেলার জন্য। আর লুস এগুলো’র কিছুই খেয়াল করল না। কিংবা হয়তো খেয়াল করেছে, কিন্তু যেটাই হোক, কিছুই বলেনি এ সম্বন্ধে। বিছানার আর অন্য কোনো মানে ছিল না। এটার প্রয়োজনীয়তা ছিল শুধু উষ্ণতার জন্য। সেখানে সে তাই কিছু বাধা দেয়নি। আর গ্রামের মানুষরা কী বলল, না বলল তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তিনি ছিলেন নৌ-সেনাপতি। তার একটা বেশ প্রতাপ ছিল। সে সময়ের সেনাপতিরা অন্য রকম ছিল, এখনকার মতো ইজিজেট দিয়ে উড়ে গিয়ে ক্যাফেতে রোদ পোহাতে পোহাতে বিয়ার খাওয়ার জীবন ছিল না তাদের। তারা এতটা ভালো স্প্যানিশ বুঝতেন যতটা ভালো, হয়তো বলতে পারতেন না। লুস কঠিন প্রকৃতির ছিলেন না।
শুধু তাকে ‘দৈনিক টেলিগ্রাফ’ দিতে হবে, সাথে খেতে দিতে হবে বিখ্যাত গ্রাউস পাখির মাংস। আর যুদ্ধদিনের তার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে দিলেই হলো। বিয়ে করতে তিনি চাইছেন না, সে-ও না, সে তার স্বামীর পেনশনের টাকায় জীবন নির্বাহ করত, যে অনেক আগেই মৃত। তার স্বামীও নৌবাহিনীতেই ছিল কিন্তু সেনাপতি ছিল না। তিনি তার বাড়িটা তার নামে লিখে দিয়েছিলেন। সে এই বাড়িটা বিক্রি করে অনেক দূরে সমুদ্রের ধারে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে এখানে এসে থাকছে।
সেপ্টেম্বরের শেষ, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে অক্টোবর। এ বছর সবকিছুই খুব আগেভাগে চলে আসছে।
এটা নিয়ে লুস সব সময় ভুগত। স্পেনে কখনও এতটা শীত পড়ত না। তখন তাকে আবার নিজেকে যতটা সম্ভব ইংরেজ হতে হতো, সবকিছু বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে হয়, বাগানের দরজা বন্ধ, পর্দা ঢাকা আলো, জ্যাম দেওয়া রুটি আর খুব সামান্য রাম মেশানো চা। তাকে কিছুক্ষণ থামতে হলো। দূর থেকে দেখতে পেল লুস এসটেরেলা বার থেকে বের হয়ে দেখছে সে এসে পৌঁছেছে কি-না।
চত্বরে বিয়ার ক্যান আর চেয়ারের ওখানে কেউ নেই, তাহলে লুস বোধ হয় আবার ঝগড়া করছে। আজকেও কোনো বখশিশ নেই। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে চারটে টেবিলে লোক আছে। ব্যস, আজকে এই, কিন্তু একদম যদি কেউ না থাকে তাহলে হঠাৎ জায়গাটা অনেক বড় আর বিষণ্ণ দেখায়। হেমন্তে, শুধু দ্রুত সন্ধ্যাই নামে না … তুমি ঠিক করে কোনো সংবাদপত্রও পড়তে পার না। টেলিগ্রাফ পড়া হয় নি। শহরে যেতে হবে। তারা এখনও যেতে পারে। যদি টেলিগ্রাফ পড়ার ব্যাপার না থাকত, তাহলে ওরা বাসায়ই থাকত। সপ্তাহে দু’বার বাজারে গেলেই যথেষ্ট ছিল তাদের, সবকিছু তো ডিপ ফ্রিজেই রাখা যায়। বৃহস্পতিবারের কথা আলাদা অবশ্য, ওদের ছাড়া তো চলাও যায় না। ওরা বসে সমুদ্রের গর্জন শুনছিল। এই রাস্তাটি কোনো বাঁক না নিয়েই একটি মাঠে শেষ হয়েছে, যেখানে গরমের দিনে বুনো রসুন হয়, অন্তত সে এভাবেই বলত। লম্বা গাছটার মাথায় বেগুনি রঙের বল, মাটিতে ছুরি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে টান দিলেই বেরিয়ে আসে। ও এসব দেখে সব সময় মজা করে হাসত। রসুনগুলো এক সাথে জট পাকিয়ে সাদা কাগজে মোড়ানো হয়ে তাকে তাকে থাকত।
তুমি এগুলো তুললে আবার ছোট শক্ত কোয়াগুলোকে বাদামি পর্দায় মুড়িয়ে রাখতে হতো। ওরা একটু আঠাল ছিল। কিন্তু এগুলো তাকে সব সময় খুব তৃপ্তি দিত। গরমের সময় কিছু করা ছাড়াই এগুলো নিজ থেকে উঠত। সে রসুন পছন্দ করত না, কিন্তু সুজি সব সময় ওর সবজি পিঠেতে সামান্য রসুন ব্যবহার করত। সে অবশ্য সবজি পিঠে খেয়ে নিত। বাকি পুরো মাঠ ছিল বেশ পাথুরে, যেখানে শুধু সমুদ্রের পানিতে ময়লাগুলো পড়ে থাকত। যখন সে ভালো হাঁটতে পারত তখন খাবারের জন্য সব সময় বাইরে যেতে চাইত। তখন সেখানে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়াত, দেখত এবং শুনত। সে বলত, আমি ঠিক ঠিক জানি সমুদ্রের কী দাবি। কিন্তু দাবিটা কী ছিল, সেটা কখনও বলত না। ও সমুদ্রের ডাক শুনতে ভালবাসত। আহা! এই পুরনো বড় জাহাজের সাথে আজকের মেঘটার কী দারুণ সামঞ্জস্য! সে সব সময় নিজের কাছে একটা দূরবীন রাখত, বিশেষ করে যখন কোনো জাহাজ আসত। মাঝে মাঝে ওকেও দেখতে দিত।
আজকের আবহাওয়া অনেক বেশি উত্তাল, কোথাও কোনো জাহাজ দেখা যাচ্ছিল না। বাড়ির পেছন দিকের উপসাগরে তাদের ছোট নৌকাগুলো বাধা ছিল, সমুদ্রে ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার কারণে দুইবার করে শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয়েছিল।
লুস, সে এখনই বাইরে দাঁড়ানো ছিল, এখন আবার ভেতরে। সে জানত, ও শুধু দেখে নিল সে আসছে কি-না। এটাও খেলার একটি অংশ; একটি নিঃশব্দ অঙ্গীকার যেটা দু’জন দু’জনকে কখনও বলেনি। সেই অব্দি লুস ভেতরেই ছিল, যতক্ষণ না সে চেয়ারে বসল। তখন ও বাইরে এলো। ওর মালিক, একজন লম্বা, মোটা মানুষ যাকে দেখলেই বুড়ো আমেরিকান ড্রাম বাদকের মতো মনে হতো, যার টাক মাথার পেছন দিকে একটা মর্মস্পর্শী ঝুঁটি। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, সে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে নাশতা বানাচ্ছিল যেগুলো তার মোটেই পছন্দ নয়। অতিরিক্ত তেল দেওয়া। সে ভেতরে দেখছিল। লুস এমন ভাব করছিল, যেন সে কত ব্যস্ত। প্লেটগুলো এদিক ওদিক করছিল। সুজির জন্য ওর এসব করার কোনো দরকার ছিল না। ও জানত, সে কখনও কিছু খায় না। খুব বেশি হলে ক’টা বাদাম। সে তার ছোট সাদা ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল। তার মধ্য থেকে ডানহিলের প্যাকেটটা বের করে আনল। টেবিলগুলো এমন কিছু উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু সে অ্যালুমিনিয়ামের মতো চকচকে দেখতে ওপরটুকু কে পছন্দ করত, ব্যাগটাকে এর বিপরীতে দারুণ দেখাত, আর সোনার মধ্যে লাল পাথর বসানো আংটিটুকু যেটা ও আনাবেলকে দিয়েছিল। নিজের হাতের প্রতি সে সব সময় খুব মনোযোগী। এগুলো বুড়িয়ে সাদা হয়ে যাওয়া হাত, সেটা সেও খুব ভাল জানত। কিন্তু নখগুলোকে সুন্দর করে পলিশ করলে সরু নীল শিরাগুলো দেখতে তত খারাপ লাগত না। আর হাতটাকে এ রকম ব্যাগ আর প্যাকেটের মাঝখানে রেখে দিলে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখতে বেশ লাগত। আগে এসব দিকে তার তেমন মনোযোগ ছিল না। কিন্তু এখন সে পৃথিবীর সব সময় নিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মন দিয়েছে। লুস এলো টেবিলের পাশে। ও একটি পরিস্কার বাদামি শার্ট পরে আছে। এই শার্টগুলো ছিল তার ইউনিফর্মের অংশ, সে কখনও এর বাইরে অন্য কিছু পরত না। সবাই জানত, তার স্ত্রী বেঁচে নেই। কিন্তু ওর শার্টগুলো সব সময় নিখুঁত ইস্ত্রি করা থাকত। কালো প্যান্ট, সব সময়, কালো জুতো। ওর পা ছিল বেশ ছোট। ইংলিশ জুতো পরলে তাকে আরও বেশি ভালো লাগত। কিন্তু ওই স্প্যানিশ জুতোগুলোতে তেমন নয়। সমুদ্রের কী কথা, সেটা সেনাপতির জানা উচিত ছিল। সে শুধু জানতো লুসকে কীভাবে ভালো দেখায়। সেটা ঠিক নয়। আসলে ওর বাইরে আসারও কোনো দরকার ছিল না। ও ঠিক জানত সে কী খাবার চাইবে। কিন্তু এটাও ছিল তাদের খেলারই একটা অংশ। আর কেউ যদি না থাকত তাহলে ও তাকে সব সব কথা বলত যেগুলো সে আগে থেকেই জানত। সে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ বলত, কিন্তু সুজি এই গল্পগুলো ওর কাছে এতবার শুনেছে যে, সে তাকেই এই গল্পগুলো শোনাতে পারত। তার ওপর, ওর ইংলিশ জ্ঞান ছিল শূন্য। সে ওকে কখনও সখনও বুঝতে পারত। সুতরাং তারা চুপ ছিল। তার আসলে ওর কথা শোনার কোনো দরকারও ছিল না। এটা ছিল অনেকটা আগের দিনের চার্চে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। কথাগুলো প্রায় সবই তোমার জানা আর তুমি নীতিকথা ও প্রার্থনা সঙ্গীতের মধ্যে প্লাবিত হবে। এখানে বসে ওরা দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন শুনত। বাদামি শার্ট পরে, তার পিচ্ছিল নিপাট করে আঁচড়ানো চুল, যেগুলো পেছনে বেশ লম্বা ছিল। গত বছর এখানে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন অবশ্য অন্য বিষয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু সে এ বছর আর ফিরে আসেনি। কিছু করার নেই। সে একটি সিগারেট ধরাল। তার আসলে গোলাপি মাফলারটা নিয়ে আসা দরকার ছিল, সেটা অবশ্য আনাবেলেকেও সব সময় খুব মানাত। লেডি আনাবেলে….ওর হাতটা একটু কেঁপে উঠল, কিন্তু সেটা বাতাসের জন্য। লুস ভেতরের গানের শব্দটাকে কমিয়ে দিল। এখন ও জিন আর টনিক নিয়ে আসবে, একটি গ্লাসে প্রচুর বরফ আর এক টুকরোর জায়গায় দু’টুকরো লেবু দিয়ে, আর পাশে টনিক। ওই দুটো টুকরো খেতে তাকে অভ্যাস করতে হয়েছিল। ওর নিজের নর্ডিক মিস্ট ভালো লাগত এই স্কেওপেস থেকে। জিনের স্বাদটা ভাল আসত। সে শুধু তার নিজের জন্য নর্ডিক মিস্ট কিনত, ওকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ওকে সেটা ভালোবেসে দেওয়া হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার না থাকলে সে শুধু জিন পেত, কতটুকু বেশি সেটা নির্ভর করত লুসের মতামতের ওপর। যদি সে নাবালক সাজত তাহলে বেশি, হিসেবটা এত সহজই ছিল। তারপর প্রথমে আসত প্রথম বউ, তারপর দ্বিতীয় বউ, এর পর বাচ্চারা। সব শেষে শুনত সে ওই প্রবাদ বাক্যটা, কিন্তু সেটা একদম সন্ধ্যে হলে, যখন সে বিছানায় শুয়ে পড়ত, বিড়বিড় করত, romper la intimidad,, কিন্তু সেটা দ্বিতীয় জিনের পরে।
এটাকে ঠিক কীভাবে ভাষান্তর করা যায়, সেটা সে ভেবে পাচ্ছিল না। অন্তরঙ্গতা ভেঙে যাওয়া? এটা খুব নন-ইংলিশের মতো শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু একজন স্প্যানিশ প্রেমিকাও হয়তো তার মরে যাওয়া প্রেমিকার জামা পরত না। সে এখনও আনাবেলের একটা জামা পরে আছে, একটা ব্লাউজ যেটাতে ছোট ছোট গোলাপি ফুল তোলা, লওরা আসলে থেকে কেনা। খোদা, আনাবেলে। প্রথম জিনটা ভেতরে যেতেই প্রতিদিন শুরু হয়ে যেত। লুস ভেতরে কীভাবে লম্বা গ্লাসে বরফ পুরত সে সব সময় শব্দ শুনতে পেত আর যখনই সে গ্লাসটা দেখতে পেত তখনই বুঝতে পারত তার অনুমান সঠিক ছিল, তাতে কদাচিৎ টনিক মেশাত। এর মানে, ওর আগেই পরিকল্পনা ছিল। সে ভাবত তার উদ্যোগের কথা।
দেখে বোঝা যাচ্ছে, আজকে খুব একটা ব্যস্ততা নেই। ও কাঁধ ঝাড়া দিল। সুজি একটি কথা বললে ও কম করে হলেও দশটি কথা বলবে। এক কথায় ও দশ কথা বলবে, এভাবেই সে তার নিজের জন্য ভেবে নিয়েছে। না, এটা ছিল খুবই অগোছাল একটি সময় temporada de mierda)। লুসের আসলে কখনোই এখানে আসা উচিত হয়নি। সেভিলাতে এখনও কী গরম! কিন্তু এখানে শীত শুরু হয়ে গেছে। কাল রাতে ক্যাফে’র মালিক হিসাব করে দেখেছে, এ পর্যন্ত এ বছর ছয় হাজার ইউরো কম এসেছে। সিগারেটের বিজ্ঞাপনটাতে যদি কখনও তার চোখ না পড়ত তাহলে খুব ভালো হতো। কিন্তু সে এখন আর একটা অন্যরকম করে লিখেছে, ওভিএডোতে। প্রথম স্ত্রী যদি তাকে ছেড়ে না দিত তাহলে তার আজকে নিজের ব্যবসা থাকত না। ওভিএডোতে, ওরা সিডার পান করত, সেটার ছিল বমি করে দেওয়ার মতো স্বাদ। কিন্তু ওখানে যারা ছিল তারা কেউ খঁটি স্প্যানিশ নয়। অস্টুরিয়াস, যেখানে এখনও গোবর আছে। অনেকটা সাইবেরিয়ার মতো। একজন সেভিলিয়ানের সেসব নীচু জায়গায় কিছুই পাওয়ার নেই।
কিন্তু ওর কোনো উপায় ছিল না। এখন তার জীবনের খারাপ সময় চলছে।
সুজি এক চুমুক পান করল। যদি পৃথিবী উল্টেও যায়, এটাই ছিল আজকের দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। সে অনুভব করছিল, কী করে তার ভেতরে শান্তি প্লাবিত হচ্ছিল। ওর দুঃখের বিলাপের সাথে যদিও যাচ্ছে না। সে তার সিগারেটটা ওঠানোর আগেই লুস তার দেয়াশলাই নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। প্রচ বাতাস। এখন লুস বলবে অগোছাল দ্বীপ, আর সামনে একটা লাথি কষাবে- বুম। আমি ভাবছি, এ বছর আমরা ক্যাফে আগেই বন্ধ করে দেব। সে এর পরের কথাটা শুনল, দ্বিতীয় বাক্যটা, এভাবেই একটা চুমুক যেন শুনতে পেল। আর তখন তুমি সুন্দর করে তাকিয়েছিলে, একজন বুড়ো ইংলিশ দুশ্চরিত্রা মহিলা, কারণ তখন এখানে আর তোমার কিছুই পাওয়ার থাকবে না। সে একটুক্ষণ ভাবল, আর একবার সিগারেটটা তার ঠোঁটে ছোঁয়াল, বন্য হাওয়ায় সিগারেটের ধোঁয়াকে মিশে যেতে দিল এবং সেই নিঃশ্বাসেই সে কথাটা বলল, যেটা শোনার জন্য ও অপেক্ষা করছিল। না, এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না, তাই না? কিন্তু তখন লুস নিজের পথে এসে গেছে। এখন বাচ্চারা আসবে।
ওরা মালোরকা’তে(মায়োর্কা) থাকে, কিন্তু সেখানে তার যাওয়া নিষেধ। সুজি একটি চুমুক দিয়ে কথাটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল, লুস তার বাচ্চাদের ভেঙিয়ে দেখাচ্ছিল, ওর সেই কোঁচকানো চেহারাটা দেখছিল। এখানে অন্তরঙ্গতার বিরতি (romper la intimidad)। বাচ্চারা এক সাথে অন্তরঙ্গ ছিল, এখনও হবে কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে। অথচ সে তার নিজের মাকে ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের বাড়িতে রেখেছে। হ্যাঁ, আগে আমাদের তো এসব ছিল না, ঢঙের অন্তরঙ্গতা। আর প্রথম স্ত্রীর সাথে তো কখনোই না। আর সে তো ওর মা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই নিখোঁজ হয়ে গেল, ঘর-সংসারের কাজ তার একদম ভাল লাগত না। লুস ভেতরে গেল, ভাব দেখাল, একটা পরিস্কার ছাইদান আনতে যাচ্ছে, কিন্তু সুজি জানত, পর্দার পেছনে গিয়ে ও এখন এক পেগ হুইস্কি খাবে। সে গুনল তার আর কয়টা সিগারেট আছে। হুম! আর ওর ছাইপাঁশ খেতে সে একদম ভালোবাসে না।
সাদা ফিল্টারের সাথে পুড়ে যাওয়া কাগজ, কী শুকনোই না লাগে ঠোঁটে! ভাঁড়, এই সিগারেটই মানায় তোকে, মনে মনে ভাবল সে কিন্তু মুখে বলল, আমি আশা করছি তোমরা এভাবেই কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবে। তোমরা এখানে না থাকলে জায়গাটা ভীষণ শূন্য শূন্য লাগবে। সুজি আবার একবার তার নিজের সিগারেটের প্যাকেটের দিকে তাকাল। আর মাত্র তিনটা, আর সে কালকে শহরে যাবে। সেই মুহূর্তে একটা খোলা নীল গাড়ি দ্রুত গতিতে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আর সমুদ্রের কাছে গিয়ে ভীষণ জোরে থামাল।
লুস বলল, ও আসলে চলে যেতে চাচ্ছিল। শেষমেশ তবুও একটা কিছু করার কাজ পাওয়া গেল। গাড়িটা ঘুরে ক্যাফেতে এলো। জার্মানির নাম্বারপ্লেট লাগানো। খুব জোরে জোরে গান বাজছিল, সাথে গভীরভাবে কাজে ব্যস্ত মালিকরা, এবং কোনো রমণীর অনেক চিৎকারপূর্ণ কণ্ঠের কথা শোনা যাচ্ছিল, কাউকে মেশিন কারখানায় পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এখানে কি খাওয়ার কিছু পাওয়া যাবে? সে তার জিনে আর একটু টনিক মিশিয়ে নিল। এখন সবকিছু মিলিয়ে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাকে জেগে থাকার চেষ্টা করতে হবে। স্কাইতে সিনেমা দেখাটাই বোধ য় ঠিক হবে।
নাকি আরও একটা নেবে সে? জার্মানরা গাড়ি পার্ক করেছে। হঠাৎ আবার সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! জার্মানরা যারা স্প্যানিশ বলতে পারে না তারা ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধের সিনেমার সংলাপের মতো শোনা যাচ্ছে। ইয়োওয়েল, জনাব।
লুস ওদেরকে দুটো বিয়ার এনে দিল। তারপর ওদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আর একটু তেল মাখার চেষ্টা করতে লাগল। সেটা আসলে মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। ও তাকে বোঝাতে চাইল, তাকে ছাড়াও সে চলতে পারবে। শেষ পর্যন্ত যখন ও তার কাছে এলো তখন ও আবার গোড়া থেকে কথা বলা শুরু করল, যেগুলো একটু আগেই বলা হয়েছে। সে ওভিএডো চেনে তো? না, সে ওভিএডো চেনে না আর তার ওভিএডো চেনার কোনো আগ্রহও নেই। আর তুমি যদি ওদিকে যাও, আমি ঠিক একবার তোমাকে দেখতে আসব, বলল সুজি, আর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে লাগল। বাতাসের বেগ প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছিল। সে টালমাটাল হয়ে যাচ্ছিল। পয়সাটা সে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছে, তার ওপরে পিরিচ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, বাতাসের ঝাপটায় উড়ে যেন যেতে না পারে। লুস জার্মানদের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, তার দিকে পিঠ দিয়ে।
নিজেকে বিড়বিড় করে বলছে সে, চালিয়ে যাও সুজি। এ মুহূর্তে অন্তত কেউ ভাবতে পারবে না যে মাতাল হয়ে সে এসব বকছে। কিন্তু রাস্তায় কেউ নেই। নিজেকে দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল সে। যদি ও কিছু না বলত লুস জানত না সে কোথায় যাচ্ছিল। কিন্তু সুজি কিছু না কিছু তৈরি রাখতই। এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় গুণ, যে কোনো মুহূর্তে একটা কিছু সব সময় তৈরি করতে পারত। এখানে রূপার চামচ, টেলিফোনের পাশে একটি বিরাট মদের বোতল, আর সাথে বিখ্যাত গ্রাউস পাখি, শুধু রান্নাবান্না করলে খুব সাধারণ দেখাত। এটাকে একটু মোহনীয় করে তুলতে হবে, এবং সাথে সাথে খানিকটা চমকপ্রদও মনে হতে হবে। এর আগের বার খুব বেহায়াপনা করা হয়েছিল। তখন ও আনাবেলের রূপার লাইটারটা সাথে নিয়ে এসেছিল। এটা একদম উচিত হয়নি, কিন্তু লুস তাকে এ নিয়ে কিছুই বলেনি। সে টেলিভিশন চালিয়ে রেখেছিল, করিডোরে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। ও ঘরের ভেতরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অনেক বেশি আলো, পর্দা ঢাকা আলোটা বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এখনই কি সে জামা-কাপড় খুলবে, নাকি পরে?
বারোটা পর্যন্ত এমনিতেই কিছু হবে না। সে একটু টিভি দেখল- তিনজন মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে; তারপর সে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
বিছানায় শোয়ামাত্র সুজি ভাবল, সে কিছু রেখে আসেনি, কিন্তু তখনই সে বাড়ির পাশে বাগানের রাস্তায় লুসের পায়ের আওয়াজ পেল। বাইরের আলোটা সে সব সময় নিভিয়ে দেয়, কেউ যেন ওকে দেখতে না পায়। করিডোর, ঘর, বেড়াল সব অন্ধকার। ৬৩ বছরের একজন বুড়ো স্প্যানিশ বেড়াল, কালো স্প্যানিশ জুতো পায়ে যাকে আসলে ইংলিশ জুতোতে ভালো দেখাত।
এখন শুধু অপেক্ষা দরজার আওয়াজের, নিঃশ্বাসে হুইস্কির গন্ধ, অপরিচিত, আকস্মিক গোঁ-গোঁ শব্দ তারপর হঠাৎ স্থায়ী আশাহত গলায় ভীষণ রেগে যাওয়ার তীব্র শব্দ শুনল, যার সাথে আগের ঘটনাগুলোর কোনো মিল নেই।
যখন তার ঘুম ভাঙল তখন চারধার আলো হয়ে গেছে। বিবিসির নিউজ ওয়ার্ল্ডের খবর শুনতে শুরু করল সে। সে ঠিক মন দিয়ে কখনও খবর শুনত না কিন্তু বাগদাদ, দার্ফুর, গাজা, কাবুল শব্দগুলো শুনতে তার ভালো লাগত। সকাল সকাল নরম ইংলিশ উচ্চারণে দিনটা শুরু করলে নিজেকে সে পুরো পৃথিবীর সাথে যুক্ত ভাবত, কোনো ব্যথা ছাড়া। সে এখন ৭৯ বছরের, যতদূর তার মনে পড়ে সে শুনে গেছে। আবহাওয়ার মতো সংবাদ ও চিরকালীন ব্যাপার। আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
আরও পড়ুন: পাখির আবার বিদায় কি?
রেডিওতে গোটা বিশ্ব শোনা যাচ্ছিল, আর এখানে সে দেখতে পেল লুসকে, পুরো খালি রাস্তা বোঝাই ঝরা পাতা। বাতাসের কোনো শব্দ নেই, রাস্তায় একটি কুকুরের ডাক। সব যেমন থাকে, ঠিক তেমনই আছে।
টেবিলের ওপর তার সাদা জ্যাকেটটা খোলা পড়ে আছে। মানিব্যাগটা খালি। সে মনে করার চেষ্টা করল, এর মধ্যে কত টাকা ছিল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না।
খুব সাধারণ একটা মানুষ সে, সুজি ভাবছিল, রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সে চায়ের পানি বসাতে, তখন বড় টেবিলের ওপর রাখা রূপার ফ্রেমে বাঁধানো আনাবেলের ছবিটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই মাথাটা নাড়াল সে। পাশে রাখা ছাইদানটাতে একটা সাদা ফিল্টার সিগারেটের শেষাংশ পড়ে আছে। মৃতপুরী থেকে আনাবেলে হেসে উঠল, একটু সন্দেহজনক, অর্ধেকটা সম্মতির হাসি, কিন্তু আনাবেলেকে তুমি জানো, কখনোই ওকে ঠিক ঠিক বোঝা যায় না।