বিদায়ে এত বেদনা কেন? কেন এত কান্না, এত কষ্ট? এত হাহাকার? কেন?
বিদায় মানে কি তবে বিরহ? বিদায়ের অন্য অর্থ কি তবে বিচ্ছেদ? বিদায় মানে কি প্রিয় মানুষটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা? বিদায়ের ক্ষণটি সে জন্যই কি ব্যথাভরা? সে জন্যই কি বিদায়বেলায় কারো ‘সজল করুণ নয়ন’ নত হয়ে থাকে বেদনায়? কিন্তু আমরা যে চাই হাসিমুখে বিদায় নিতে। কারো চোখের পানিতে বিদায়ের পথটি ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে উঠুক, তা যে চাই না। সে জন্যই কি আকুতি- ‘মোছ আঁখি, দুয়ার খোল, দাও বিদায়।’ সে জন্যই কি চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলি- ‘শুভ বিদায়’?
হায়, এক জীবনে কত রকমের, কত ধরনের, কত বিচিত্র বিদায়ের ভার বহন করি আমরা! কখনো বিদায় দিই, কখনো বিদায় নিই। একটি বিদায় পেছনে ফেলে যায় কত প্রিয় মুখ, কত চেনা চেহারা! কত নীরব দৃষ্টি, কত কথা! কত হাসি-গান, কত স্মৃতি! বিদায়ের বেদনা কার বেশি? যে বিদায় নেয়, তার? নাকি যে বিদায় দেয়, তার? নাকি দু’পক্ষই সমান বেদনাভারে কাতর? একই দুঃখে দুঃখী হয়ে একই সমান কষ্ট পায়?
বিদায়েরও কি তবে কিছু দায় থাকে? বিদায়ে কি শেষ হয়ে যায় সব? নাকি বিদায়ের পর শুরু হয় আরেক নবতর যাত্রা? অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না। জীবনভর কত বিদায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয় আমাদের! শৈশবকে বিদায় দিয়ে কৈশোরে পৌঁছাই; কৈশোরকে বিদায় দিয়ে যৌবনে। যৌবন বিদায় হলে প্রৌঢ়ত্ব, আর প্রৌঢ়ত্বকে বিদায় জানিয়ে আসে বার্ধক্য। সবশেষে অনিবার্যভাবেই এই ইহজীবনকে বিদায় জানিয়ে না-দেখা কোনো অনন্ত জগতের পথে যাত্রা! যে জগৎ থেকে ফিরে এসে কেউ কখনো জানায়নি- কী আছে ওই পারে। ফলে ওই বিদায়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তার ভয় থাকে। থাকে দ্বিধা, থাকে অনিচ্ছা। কিন্তু হায়! তবু নিতে হয় বিদায়। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অংশ নিতে হয় নিঃশেষ হবার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়।
আমাদের স্কুলে প্রতি বছর ক্লাস টেনের আপুরা বিদ্যালয়ের সব শেষ পরীক্ষার আগে বিদায় নিতেন আর কেঁদে বুক ভাসাতেন। তাদের জন্য আয়োজন করা হতো ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান। ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে প্রতি বছর সেই অনুষ্ঠানে চুল খুলে শাড়ি পরে আর্দ্রকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতাম আমরা-
‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর, হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর,
জনশূন্য পল্লিপথে ধুলি উড়ে যায়, মধ্যাহ্ন বাতাসে …
এ অনন্ত চরাচরে সবচে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন-
যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়। ‘
স্কুল শেষে কলেজের হাতছানিতে, নতুন জগতে পা রাখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় ছাত্রছাত্রীরা। তারপরও তাদের চোখে থাকে জল, মনে থাকে পিছুটান। কয়েক বছর পরে যখন নিজের’ও সময় হলো স্কুল ছাড়ার, যখন যথারীতি আয়োজন হলো ফেয়ারওয়েলের, তখন একই বেদনা আমার বুকের কোণেও চিন চিন করে বেজেছিল। স্কুলের সবচেয়ে রাগী শিক্ষকের জন্যও তখন মন কেমন করে উঠেছিল! স্কুল ক্যান্টিনের অখাদ্য শিঙ্গাড়াকেও জগতের শ্রেষ্ঠ খাবার ভেবে মিস করছিলাম।
অথচ অন্তরে তখন যেন শুনতে পাচ্ছিলাম কালের যাত্রার ধ্বনি। বুঝতে পারছিলাম, সেই ধাবমান কাল অন্যদের মতো আমাকেও তার দ্রুত রথে উঠিয়ে নিয়েছে, পরিবর্তনের অনিবার্য স্রোতে নিজেকে এবার ভাসাতেই হবে। তাই ‘ফিরিবার পথ নাহি, দূর হতে যদি দেখ চাহি, পারিবে না চিনিতে আমায়, হে বন্ধু বিদায়।’
বিদায়ের আরেক অর্থ প্রস্থান। বিদায়কালের চিরন্তন প্রশ্ন, ‘আবার কবে ফিরবে? আবার ফিরে আসবে তো?’ গাড়িয়াল তার পেছনে যে বধূকে রেখে যাচ্ছে, সেও কেঁদে কেঁদে বলছে, ওহে বন্ধু বিদায় যদি নেবেই তবে বলে যাও কবে আবার আসবে- ‘ওহো কি ও, বন্ধু কাজল ভ্রমরারে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু, কয়া যাও, কয়া যাওরে…’
কারো ফেরার সময় হয়তো ঠিক করা থাকে। নির্ধারিত সময়ে কেউ কেউ ফিরেও আসে। কেউ কেউ আবার কোনোদিনও আসে না।
আমাদের প্রচলিত সামাজিক সংস্কারে ছোট থেকেই শেখানো হয়েছে- ‘যাই’ বলতে নেই। বিদায়ও স্পষ্ট করে বলতে নেই। বলতে হবে ‘আসি’। সারাজীবন ঘরের বাইরে কোথাও যাওয়ার আগে তাই সব সময় বলেছি, ‘আসি।’ অর্থাৎ যাওয়ার আগেই ফিরে আসার এক ধরনের নিশ্চয়তা দিয়ে যাওয়া। তবু কি সব সময় ফেরা নিশ্চিত করা যায়? যায় না বলেই হয়তো আজম খান গান গেয়েছেন, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না।’
প্রাত্যহিক বিদায় এক রকম, দূরের যাত্রার বিদায় আরেক রকম। সব বিদায় তো আবার প্রকাশ্যেও ঘটে না। কিছু বিদায় প্রকাশ্যে হয়, কিছু অপ্রকাশ্যে। কিছু বিদায় সম্ভাষণ, আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। আবার কিছু বিদায় ঘটে সবার চোখের আড়ালে, একান্তে গোপনে। যেখানে হয়তো মুখ ফুটে বিদায় বলার সুযোগটাও থাকে না। এমনকি যাকে বিদায় দিলাম, তার জন্য শোক করারও অবকাশ থাকে না। বুকের মধ্যে নীরবে তার কবর রচনা করে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে অবিরাম। কিন্তু ভুলতে চাইলেও কি সব ভোলা যায়? বিদায় দিলেই কি সে আসলে বিদায় নেয়? কারণে-অকারণে মনের মধ্যে উদয় হয়ে সে বুঝিয়ে দেয়- চোখের আড়াল হলেও আসলে বিদায় নেয়নি সে। আমার অজান্তেই মিশে আছে আমার মনের গহন গহিন গোপন কোণে।
এই যে বছরটা বিদায় নিচ্ছে; কত ঘটনা, কত হাসি-কান্না, কত পাওয়া না পাওয়া, পেছনে ফেলে। সেই চলে যাওয়া বছরটাকে আর কি ফিরে পাব? আর কি শুধরে নিতে পারব অবহেলায় করে ফেলা ভুলগুলো? আর কি ফিরে পাব সেই নানা রঙে রঙিন দিনগুলো? পাব না; আর তারে ফিরে পাব না। এই যে আর তারে ফিরে পাব না- বিদায়ের মূল বেদনাই মনে হয় এটা।
ছোটবেলায় মনে আছে, নানাবাড়ি নেত্রকোনায় বেড়াতে যেতাম। যখন ঢাকায় ফিরে আসার সময় হতো তার দু-একদিন আগে থেকেই শুরু হতো আমার খালাদের নীরব কান্না, রান্নাবান্নার ফাঁকে ফাঁকে নানু চোখ মুছতেন। নানা ও মামারা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াতেন। ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাওয়ার জন্য যখন আমরা রিকশায় ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেই মুহূর্তে শুরু হতো কান্নার রোল। আম্মাও কাঁদতেন, আমরাও কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় ফেরা। পেছনে ফেলে আসা কিছু উজ্জ্বল সোনালি দিনের স্মৃতি।
বিদায় কি শুধুই বিষাদের? আনন্দের বিদায়ও কি নেই? আমাদের জীবনের সুন্দর বিদায়গুলোর একটি হচ্ছে কনে বিদায়। বিয়েবাড়িতে যান, সেই আনন্দ-চাপা কান্নাভরা বিদায় দেখতে পাবেন। সানাইয়ের করুণ সুরের পটভূমিকায় বাবা-মা যখন তাদের বধূ সাজে সজ্জিত কন্যাকে বিদায় জানান, তখন সেই বিদায়ে শুধু বিষাদ নয় বরং সন্তানের অনাগত জীবনের আনন্দময় স্বপ্নের ছবিও হয়তো মিশে থাকে। বিয়ের কনেও তো আকুল হয়ে কাঁদে বিদায়বেলা। কাঁদে- হয়তো, এতদিনকার পরিচিত পরিবেশ, মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায়। কিন্তু সত্যি বলতে কী- এ জায়গার শিকড় তো উপড়ানো হচ্ছে তাকে ভিন্ন জায়গায় রোপণ করার উদ্দেশ্যে। যেখানে সে হয়তো নিজের ডালপালা আরো বিস্তৃত করবে; ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হবে। তাই বিদায়ের এই রীতিসম্মত কান্নার পরও সে জানে, তার স্বজনেরা জানে, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে নতুন স্বপ্ন, নতুন দায়িত্ব, নতুন রোমাঞ্চ। ফলে এই বিদায় বেদনার চেয়ে বেশি আনন্দের। দুঃখের চেয়ে বেশি সুখের।
আবার সন্তান বা স্বজন যখন প্রবাসে যায়, উচ্চশিক্ষা নিতে কিংবা উপার্জনের জন্য; তখনো তো তাকে বিদায় দিতে হয়। তবে সেই বিদায় যেহেতু চিরবিদায় নয়, বরং সাময়িক বিদায়, তাই তাতে সাময়িক বেদনার সাথে গৌরব ও প্রাপ্তির আশাটুকুও মিশে থাকে। এ বিদায় অল্প দিনের জন্য। স্বজনেরা জানেন, বিদায়ের নির্দিষ্ট সময় পরে থাকবে তার সফল প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা। বিজয়ীর বেশে আবার তাকে স্বাগত জানানোর জন্যই এই বিদায়।
আরও পড়ুন: খেয়া নামের গ্রামটি
তবে সবাই যে বিজয়ী হয়, তা তো নয়। কাউকে কাউকে তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফিরতে হয় ব্যর্থ হয়ে। কেউ হয়তো সব লেনদেন চুকিয়ে ফেরে, কাঠের কফিনে শুয়ে। সাময়িক বিদায় তখন রূপ নেয় চিরবিদায়ে। বিদায়ের আগে ‘চির’ শব্দটি জুড়ে দিলে সেটি কী রকম অন্তহীন শূন্যতার মধ্যে ফেলে দেয়; তাই না? শোক, কান্না, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর আবেগমিশ্রিত একটা কষ্টকর অনুভূতি গলায় আটকে আসে।
প্রিয়জনকে আমরা হয়তো কখনোই বিদায় দিতে চাই না। পারলে কলিজার ভেতর, অন্তরের গহিনে তাকে বেঁধে রাখি। কিন্তু চাইলেই কি তা পারা যায়? প্রিয় মানুষরাও তো জীবন শূন্য করে দিয়ে বিদায় নেয়। তাদের অভাবে আমাদের জীবন মুহূর্তের জন্য নীরব-নিথর, নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: অমানুষ
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর বিদায় নেওয়ার বা বিদায় চাওয়ার সেই বিখ্যাত গানটা মনে আছে?
‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি/হাসি-হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।’
এখানে যে বিদায়, তা আসলে মায়ের কাছ থেকে সন্তানের শেষ বিদায়। সে বিদায় বেদনার হলেও দেশমাতৃকার জন্য আত্মবলিদানের গৌরবে উজ্জ্বল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কত মায়ের সন্তান, কত বোনের ভাই, কত স্ত্রীর স্বামী এভাবে বিদায় নিয়ে চলে গেছে ‘চিরবিদায়’-এর রাজ্যে! নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য।
আরও পড়ুন: পাতা ঝরার দিন
শুকনো পাতা প্রাকৃতিকভাবেই বিদায় নেয় নতুন কিশলয়কে জায়গা করে দিতে। আবার সেই নতুন পাতাও এক সময় বিবর্ণ হয়, শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে। তাই বিদায় মানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। একটা বিদায় হয়তো আরেকটি নতুন কিছুকে প্রতিস্থাপন করার জন্যই দরকারি। বিদায়ের দায় একটাই। সেটা হলো জায়গা ছেড়ে দেওয়া। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। পেছনে কারো জলে ভরা চক্ষু থাকবেই। নিজের চোখও হয়তো ছল ছল করবে জলে; পা সরবে না সামনে, তবু যেতে হবে। কারণ বিদায় চিরন্তন, বিদায়-ই মৌলিক, সম্ভবত।