-তুমি থাকলে আমাদের বউরা এই বাড়িতে আসবে না।
-কেনো?
-তুমি তা ভালো জানো।
-তো কি করতে বলছিস?
– এখন চাকরি নেই। বাসা ভাড়া দিতে পারছি না। তুমি অন্য কোথাও চলে যাও আমরা আসবো।
-এইটা আমার বাড়ি, তাছাড়া আমি যাবো বা কোথায়?
-সেটা আমি জানি না। তাছাড়া বাড়িটা বাবার। তাই আমাদের অধিকার আছে বাড়িতে। তোমার নেই।
কথাটা শুনে ধুপ করে বসে পড়লাম। সারাজীবন যুদ্ধ করে এই বাড়ি বানিয়েছি এখন আমাকে চলে যেতে বলছে, যাতে তাদের বউরা এই বাড়ি দখল করতে পারে। ছোট বেলায় বাবা মারা যায়। মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছি। মামী যখন মামা থাকে তখন ভালো ব্যবহার করতো মামা না থাকলে খেতে দিতো না। তখন দিদিমা শিখিয়ে দিয়েছিলো যাতে মামার সাথে খেতে বসি। আমিও তাই করতাম। মামী খাবার দেওয়ার পরে তার ছেলে মেয়েকে শিখিয়ে দিতো কেড়ে খেয়ে ফেলার জন্য। তখন শিখেছি চোখ রাঙানো। তাই সবাই আমাকে ঝগড়াটে ডাকতো।
পড়াশোনা বেশি করি নি। কিন্তু যা করেছি তা যথেষ্ট ছিলো তখনের দিনে৷ মামা ভালো ছেলের কাছেই বিয়ে দিয়েছিলো। লোকটা আসলেই খুব ভালো ছিলো। সহজ সরল। কিন্তু গরীব ঘরের ছিলাম বলে আমার অন্য জায়েরা আমাকে সব কাজ করাতে চাইতো। আমি করতাম এবং শশুড়ের সামনেই করতাম তাই শশুড় ভীষণ ভালোবাসতো সেটাও ওরা মানতে পারতে না। মিতুনের বাবা শহরে কাজ করতো। একদিন বিনা নোটিশে ছয় ছেলে মেয়ে নিয়ে আমাকে আলাদা করে দিলো। আমি কোথাও যাই নি ঘরের সামনেই নিজের কাছে থাকা লুকানো খাবার খাইয়ে বাচ্চাদের, বসে ছিলাম এক রাত এক দিন। মিতুনের বাবা আসলে সে ঘর চাইতে যায়। কিন্তু অন্য ভাইয়েরা তেড়ে আসে। তখন আমি বটি হাতে সামনে দাঁড়িয়েছিলাম ঢাল হয়ে।
নিজের আলাদা ঘর করি৷ চার ছেলে দুই মেয়ে কে স্কুলে পড়ায়। মিতুনের বাবা শুধু টাকা এনে দিতো। সে টাকা দিয়ে ঘর কি চলছে কি চলছে না সে খবর কোন দিন রাখেনি। সে ঘরে থাকলেও দিনের বেলায় চায়ের দোকান আর পাড়া মহল্লা বৈটকে দিন কাটিয়েছে। ঘরের ধান চালের কাজ। কাজের লোকদের উপর তদারকি সব আমার উপর থাকতো। নিজের আলাদা ঘর করি,আলাদা পুকুর, আলাদা জমি-জমা। আমার জায়গায় কেউ পা দিতে পারে নি , কখনো নরম হয় নি তাতে অন্যরা আবার চড়ে বসবে। তাই সবাই আমাকে ঝগড়াটে ডাকতো। পড়ার সবাই যখন বিকেলে পান নিয়ে বসে গল্প করতো আমি গেলে চুপ হয়ে যেতো। তাই দূরে থাকতাম। ছেলে মেয়ে গুলোকে ভালো স্কুলে পড়ায়। মিতুনের বাবা মাঝেমধ্যে লোকজন নিয়ে আসতো আমিও খাওয়াতাম। কখনো গিয়ে দেখেনি আমি কি খেয়েছি। বাচ্চাদের নিয়ে আধিখ্যেতা আমার ছিলো না৷ খেলে খায় নইলে অন্য কাউকে খাইয়ে দিতাম৷ একটা মেয়ে ছিলো নাম ছিলো শিউলি। ছোট থেকে বাড়িতে থাকতো। মা বাবা ছিলো না। আমার কাছেই কাজ করতো আর খেতো। কত বকা ঝকা করতাম। কোন উত্তর ছিলো না৷ আমার মেয়ের বয়েসিই ছিলো তাই ওরা ওকে ফরমায়েশ খাটাতো।
আমি আমার ঘরের সব। আমার কথা ছাড়া চলতো না কিছু। আস্তে আস্তে ছেলে মেয়েগুলো বড় হয়। মেয়েদের বেশ ভালো ঘরেই বিয়ে দিয়েছি। আমাকে না জানিয়েই সে তার ভাইয়েদের কথায় বড় ছেলের জন্য বউ ঠিক করে ফেলে। যারা তাকে মারতে এসেছিল তাদের ঘরে গিয়ে সে চা-নাস্তা খেয়ে ভালো হয়ে আসে। খারাপ থেকে যায় শুধু আমি।
তাই বড় ছেলের বউকে আমার অপছন্দ ছিলো। কিন্তু কষ্ট দিতে চাই নি কখনো৷ এরপর মেঝ ছেলে আর সেজো ছেলে তাদের পছন্দের মেয়ে ঘরে এনে তুলে। কিছু করার ছিলো না। তাদের জীবন তারা যেমন বুঝে। কিন্তু আমার মধ্যে কোন পক্ষপাত ছিলো না কাউকে নিয়ে। সব বউকে সমান দেখতাম। মেয়েরা আসলেও বেশিদিন থাকতে দিতাম না।
তারপর ও আমার আধিপত্য তাদের ভালো লাগে না। কিন্তু দায়িত্ব নিতে রাজি নয় কেউ। মাথার উপর যাতে না নাচে তাই আমি কখনো কঠিন থেকে নরম হয় নি। বিভিন্ন উছিলায় তারা শহরে গিয়ে পাড়ি জমায়। আসে ছুটির সময়। তখনো আমার ধান চালের কাজ। মিতুনের বাবাও পাড়ি জামায় অন্য পাড়ে। ছোট ছেলেটাকে নিজের পছন্দে খুব শখ করে বিয়ে করিয়েছিলাম। বউটাও ছোট ছিলো। আদর যত্নেই ছিলো বেশ। ভালোই ছিলো। কিন্তু অন্য ছেলের বউদের তাও সহ্য হয় না। তাকেও ভীড়িয়ে নেয় তাদের দলের পাল্লা ভারী করতে৷ আমি কখনো বাধা দিতে যায় নি। ছেলেদের জন্য বানানো রাজ প্রসাদে আমিই রয়ে যায় একা। ধান চালের কাজ এলে ছেলেদের বলি বউদের পাঠা ওদের বাহানা বাচ্চার পরীক্ষা এই সেই। আমি একাই করি সব। এখন বয়স হয়েছে। কাজ করে খেতে ইচ্ছে করে না। তাও দুটো করে খায় বসে থাকি কখন ছেলেরা আসবে। মেয়েরা ফোন করে চলে যেতে বলে। মেয়েদের কাছে যাই আবার চলে আসি। মেয়েদের ও তো শশুড় বাড়ি৷ তাও ওরা বলে,
-কেন পরে আছো যক্ষের ধন আগলে ধরে?তুমি মরলে লুটেপুটে খাবে।
-তাও ভালো। আমি মরার পর করবে।
না তাদের আর তর সয়ছে না। আমি মরার আগেই তারা সব দখল চায়। এখন বলছে এইটা তাদের বাপের বাড়ি আমার অধিকার নেই৷ বেশ তাদের বাপের বাড়িটাই তাদের থাক। অন্য সব তো আমার। তাই সব ঠিক করে নিয়েছি। জমি জমা সব আমার নামেই ছিলো। ওরা আসার আগেই সব বিক্রি করে দান করে দিয়েছি। এইখনের স্কুলের জন্য নতুন বিল্ডিং বানাবে। তাতে যেন আমার নাম থাকে। নতুন মন্দিরের জন্য দান করে দিয়েছি। ছেলেরা সবাই আসে তাদের বউ নিয়ে। তারা আমার সামনে আসে না। সবাই মিলে এক জোট। আমি ওদের কে বাড়ির দলিল বুঝিয়ে দিলাম। ছেলেরা বলল- জায়গা-জমির দলিল? আমি তাদের বাপের যা ছিলো তা বের করে দিলাম।
-কিন্তু এইগুলো তো আসল দলিল না।
– হ্যাঁ, আসল দলিল যাদের কাছে বন্ধক রেখেছি তাদের কাছে।
-মানে? আর বাকি গুলো?
– ওগুলো তে তো তোমাদের কোন অধিকার নেই। ওগুলো সব আমার জমি। আমি সব বিক্রি করে দান করে দিয়েছি।
-মানে? কি বলছো?
-আমার উপর অধিকার নেই কারো। দায়িত্ব নেই কারো আমার জমির উপর পুরো অধিকার তাই না?আর বন্ধক রেখেছি জমি এত বছর ধরে যে চাষের ধান নিয়ে গেছো কেউ তো টাকা দাও নি। আমার চিকিৎসার জন্য। তাই ওসব বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছে। যে যেটা ছাড়াতে পারবে সে তা নিয়ে নাও। নিজের কষ্টের টাকা করে দেখো কত কষ্ট এইসব জমি কিনতে। ভাগ চাইতে এসেছো তাই না? আমি চলে যাচ্ছি এই ঘর আমার বানানো এতগুলো বছর ধরে তিলে তিলে গড়েছি আমি। তোমরা তো উৎসব করতে আসতে প্রতিটা দিন একা একা আমি কিভাবে এই ঘরে কাটিয়েছি তা তোমাদের অজানা৷ কত রাত শুধু উঠে খেতে হবে এই জ্বালায় না খেয়ে কাটিয়েছি। কল তলায় আছাড় খেয়ে পা ভেঙে পড়ে ছিলাম তা নিয়ে বছরের পর বছর কষ্ট পেয়েছি তোমরা কি করে জানবে তা। চাষের সময় কেউ কাজের লোকের জন্য রান্না করতেও বউ পাঠাও নি কিন্তু এসে চাল নিয়ে গেছো।
বাদ দাও,তাও তোমাদের এই ঘর দিয়ে যাচ্ছি। যাদের কথা তোমরা এইসব করছো তোমার চাচীদের কথায়। তোমরা যখন কাটাকাটি করবে তখন তারা দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখবে শুধু। তোমাদের আগলে রাখতে গিয়ে সবার কাছে খারাপ হয়েছি আমি। আমি তো ঝগড়াটে মা। তাই সবাই এক হয়েছো আমি শত্রু? তোমরা যদি সত্যি এক হতে জানতে আমাকে আজ এত বছর একা থাকতে হতো না। খারাপ শিক্ষা কখনো দিয় নি তাও তোমরা আমাকে খারাপ মায়ের জায়গায় বসিয়েছো। প্রকৃতি তার নিয়মে হয়ত তার উত্তর দিবে। আমি চলে যাবো। তোমরা ভাগ করে নাও এইঘর।
-তুমি কোথায় যাবে? বোনদের কাছে?
এইবার আমি সত্যি হেসে দিলাম। আমি জানি না আমি কোথায় যাবো। নিজের কিছু কাপড় নিয়ে সব দিয়ে নিঃস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়। তখন সেই কাজের মেয়েটা শিউলি হাতের মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসছে। কাছে আসতে মা বলে চিৎকার করে উঠে। ওর মেয়ে পিএসসি তে জিপিএ- 5 পেয়েছে। সব শুনে বললো -চলো তুমি এখন চলো আমার কাছে। তোমার মতো অট্টালিকা না হলে ছোট্ট একটা ঘর হয়েছে আমার। সব তো তোমার দয়ায়। তুমি মেয়ের মতো মানুষ করে সব দিয়েছো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। সত্যি কি তোকে আমি নিজের সন্তানের মতো বড় করেছিলাম? সবাই যখন পড়তে বসতো সে হাড়িপাতিল নিয়ে পুকুরে যেতো। ওরা যখন খেলতো তখন ধোয়া উঠা চুলায় ফু দিয়ে রান্না করতো। সবাইকে খাওয়ানোর পর যেদিন থাকতো সেদিন এক টুকরো মাছ দিতাম না থাকলে আমার থেকে ভাগ করে দিতাম। যে আমার জন্যও থাকতো না সেদিন,
-মা তুমি কি দিয়ে খাবে বলে, ডিম ভেজে আনতো। নইলে দুধ গরম করে আনতো। এক বছর ধান চালের কাজ করার জন্য এক ছেলে আসে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো ছিলো। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ও সে যায় না। সে ও আমাকে মা ডাকতো। বলতো,
-আমাকে টাকা দিতে হবে না তোমার কাছে থাকতে দাও। তোমার অন্য সব কাজ করে দিবো।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম, শিউলির জন্য আটকা পড়েছে সে ছেলে। কয়েক বছর পর তাদের বিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম। জানতাম এই ঘরে থাকলে বিনা পয়সার কাজের লোক হয়ে থাকবে। অনেক দূরে মামার বাড়ি ওদিকে একটা জমি কিনে ফেলে রেখেছিলাম। চাষ হতো না, সে জমি ওদের দিয়েছিলাম। মোটা অংকের টাকা দিয়ে বলেছিলাম এইটা দান নয়,তোদের কাজের বেতন। সে জমিতে চাষ করে আরো জমি করেছে ওরা। তিন রুমের ঘর বানিয়েছে। দুইটা ছেলে মেয়ে। আমাকে পেয়ে যেন ওরা রাজ্য জয় করেছে। কি খাবো ? কি করবো? কিভাবে থাকবো? ওর বাচ্চাগুলো এই প্রথম কাউকে দিদা ডাকতে পেরে ভীষণ খুশি। তারচেয়ে বেশি খুশি ওরা দুইজন। আগে মা ডাকতো মালিক হিসেবে। এখন মা ডাকে সন্তান হিসেবে। এই যেন ওদের বড় পাওয়া।
গল্পের বিষয়:
গল্প