ঝুম বৃষ্টি নেমেছে!
শীতের গোধূলি মাখা রাঙ্গা বিকেলে আকাশ ভেঙে আচমকা ঝুম বৃষ্টি, সত্যিই অন্যরকম, স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা ব্যতিক্রমও বটে। কেননা, শীতের এই হিম হিম ঠাণ্ডা পড়ার প্রারম্ভে বৃষ্টির এক একটি কণা যেন এক একটি বরফ খণ্ডের মতো অনুভূত হচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো, আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে পৌষী।
এই সন্ধ্যাটা যখন কারো কাছে বিশেষ মমতার, কারো কাছে পরম স্নেহাকর্ষণের তখন তা হয় অতীত স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো পৌষীর চিরঋণী ক্ষণ। ঠিক যেন, দিগন্তের কাছে মিশে আছে মোষের পিঠের মতন, তবুও পাহাড়ের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে তার আড়ালে ডুবে যাওয়া রক্তিম লাল সূর্য। ক্রমশই স্মৃতির টানাপোড়েন গভীরতায় রূপ নিতে থাকে।
এমনই এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় একবার এক বালক বলেছিল তার প্রাণ প্রেয়সী বালিকাটিকে- ‘তুমি কি আমার রোজ সকালে বিনা পারিশ্রমিকে ঘুম ভাঙ্গানোর চাকুরিটা নিবে? হবে কি আমার নিত্য দিনের ভোরের এলার্ম? বাজাবে কি আমার কানের কাছে সুরালো ঝংকার !!’
সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বালিকাটি এলার্ম হয়ে বাজতে একটাদিনও ভুল করেনি কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাসে বালিকাটির ডাকে বালকের ঘুম ভাঙ্গার সকল প্রয়াসই যেন আজ ব্যর্থ যখন মানুষটিই চিরনিদ্রায় শায়িত।
জগতের সবচেয়ে বাস্তব কঠিনতর রূপ হলো যে, প্রতিটি দূরত্বই জানে একদিন খুব বেশি নিকটে ছিলাম।
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়; নয় বিচ্ছেদ!
চলে যাওয়া মানে কি তবে বন্ধন ছিন্ন করা আদ্র রজনী!
তাহলে অধিক কিছু কেন থেকে যায় না থাকা জুড়ে!
টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ভাঙ্গা হৃদয়টা কেন পরিপাটি হয়ে বসে ভালবাসার নীল শুভ্র রচনায়!
যেখানে স্বপ্ন আছে জীবন নেই, আদ্য আছে প্রান্ত নেই, অস্তিত্ব আছে প্রকাশ নেই।
সমুদ্রের কাছে গিয়ে জল স্পর্শ না করার মতো দুঃস্বপ্নটি যেন ঠিক এভাবেই পৌষীর বুকের ভেতরে হঠাৎ ঘাপটি মেরে বসেছে, এক বিশাল নীলাঞ্জনা আকাশ, চোখের তারায় নাচে একশ কোটি নক্ষত্র যা ফিরে আসে একই আবর্তে, নৈবদ্য সাজাতে, ভীষণ গোপনে। কিন্তু তবুও যে মেনে নিতে হয় নক্ষত্রের মৃত্যু, মেনে নিতে হয় স্বপ্নেরা অনিন্দ্য সুন্দর, ভালবাসা বিষন্ন যার জন্ম শুভ্র অথবা শীতল যা আগমনে চঞ্চল হয়ে এক বা দু’ফোটা জলকণার জন্ম দিয়ে নিশ্চলতার মাঝে গতির সূচনা করে। যে গতির টানেই শুরু হয় তার অথবা তাদের যাত্রা।
হ্যাঁ, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, মন ভালো নেই, আসার কথা ছিল, যাওয়ার কথা ছিল, আসা-যাওয়ার পথের ধারে ফুল ফোটানোর কথা ছিল সেসব কিছুই হলো না, থেকে গেলো শুধু গুমড়ে পড়া ১ কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত, হাহাকার জড়িত শূন্যতা!!!!
রাত বারোটা প্রায়!
দোতলা বাসাটির ব্যালকনি জুড়ে নীরবতা কিংবা শূন্যতা। এবার প্রায় বছর খানেক আগের স্মৃতি খুঁজে বেড়ালো অতীত স্মৃতির পুরানো পাতাগুলো। এবার অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মায়াজাল যেন পৌষীর ভারাক্রান্ত মনটাকে অপ্রাপ্ত বাসনায় চরম বিদ্রোহী করে তুলতে লাগলো। বৃষ্টি নিয়ে তার যথেষ্ট আদিখ্যেতা ছিল একসময়, দেহমন পুরোটাই যেন উচাটন হয়ে উঠতো সময়টাতে কিন্তু আজ কিছুটা বিদ্রুপ ভাষায় সম্ভাষণ জানালো পৌষী, বৃষ্টি- তোমার কাছে সত্যিই আজ আমি চিরকৃতজ্ঞ, কারণ আমার চোখের নোনা জল তুমি খুব সযত্নে মুছে দাও, সে আরও বিড়বিড় করে কাকে যেন বলতে লাগলো, বুঝেছি, একেবারেই ভুলে গেছো আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ভালোবাসি, ভালোবাসি শাড়ি পড়তে কিন্তু আজ নীল শাড়ি, চুড়ি, টিপে নিজেকে সাজানো বড় দ্বিধা আমার, ঘন কালো চুলে যেন বেলী ফুলের মালা জড়াতে নারাজ এ মন, কোন এক শান্ত নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আমার চিরচিনা বৃষ্টিভেজা কদম ফুল হাতে তোমার প্রতীক্ষা যেন দুঃস্বপ্নের গহীন বালুচর।
জানো কি!
সেই সময়টা কত বেশি কঠিন যখন অবিশ্রান্ত চোখের পানি লুকিয়ে হাসিমুখে জীবনধারায় প্রবাহিত হতে হয়, গতিহীন শুষ্ক জীবনকে গতিময় প্রতিযোগিতায় প্রতিনিয়ত টিকিয়ে রাখতে হয়।
রাত গড়িয়ে ভোর তখনো সূর্য ঢাকা পড়ে আছে বিরামহীন বৃষ্টির ঘনঘটায়। পুরানো ঢাকার গ্রেভ ইয়ার্ডের সবগুলো কবরেই নাম্বার ফলক আছে, এপিটাফও আছে কোন কোনটাতে, বামপাশের লেন ধরে চলে গেলে শেষ মাথায় ৩২ নাম্বার কবরটা পড়ে। ঠিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এক মধ্য বয়স্ক মহিলা। নীল রঙের শাড়ি পরিহিত যার গায়ে নীল চাদর মোড়ানো।
যদিও অনেক বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এই অবেলায় নেমে আসা বৃষ্টিকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও তার হাতের নীল রঙের খামটি খুব সযত্নে চাদরের নিচে ধরে রেখেছে সে। মহিলাটি আর কেউ নয়, সে হচ্ছে পৌষী।
আজ অরণ্যর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী!
ধীরে ধীরে খামের ভেতর থেকে নীল গোলাপের ১৫টা পাপড়ি বের করে এনে গুনে গুনে কবরের উপর রাখলো সে, তৎক্ষণাৎ মমতা আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশটুকুও প্রকাশ পেয়ে গেল চোখের জলে যদিও তার স্পর্শ ও অনুভূতি একজন ছাড়া আর কেউই পেলো না।
এবার মুখ খুললো, পৌষী!
না জানি কতো প্রহরের ক্ষোভ,অভিমান, ভালবাসা, প্রশ্ন, দ্বিধা, যন্ত্রণায় তার বাঁধ ভাঙ্গা কন্ঠস্বর আজ ব্যতিব্যস্ত।
অরণ্য- আমার কাছে তোমার কোন ঠিকানা নেই, নেই কোন নম্বর।
কতোটা তীব্রতা ছিল তোমাকে পাবার, তুমি কি কখনোই তা জানবে না!
অনেক যে বলার ছিল!
অরণ্য- তুমি কি শুনতে পাচ্ছো!
কেমন করে খুঁজে বেড়াই দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি তোমায়।
শুনতে পাচ্ছো তুমি!
ভোরের আলোয় তোমাকে দেখার ভীষণ সাধ ছিল, রাঙ্গা ভোরে, তুমি আসোনি।
আরও পড়ুন: পাখির আবার বিদায় কি?
দুপুরের কড়া রোদে তোমাকে কেমন দেখায় তাও যে অজানায়ই থেকে গেল, কেননা, দুপুরের পথও যে নিরাশ করেছে আমায়।
বিকেলের রক্তিমায় তোমার রক্ত কি বদলায়! তাও যে অচেনা রইলো আমার, সিক্ত সনাতনী মনে, তুমি এলে না বিকেলেও।
গোধূলীলগ্নে তোমার অপেক্ষায় ক্লান্ত দু’চোখ দরজার নিকট উঁকি মারে, এই বুঝি এলে আমার প্রিয় বেলী ফুলের মালা নিয়ে সাথে সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনা নীল গোলাপ হাতে, সাঙ্গ হলো মোর বেলা! অপেক্ষার ক্ষণগুলো আমাকে রক্তাক্ত করে ঠাঁই নিলো এবার জমাট লাল রঙের মাঝে।
এভাবেই হয়তো কোন এক বসন্ত বিকেলে ঝড়ে যাবে জীবনবৃক্ষের ক্লান্তপাতা মৃদু বাতাসে, ভাসবে আমার অসার দেহটি তোমার না ডাকা সেই নামে যার সৃষ্টি ছিল সঙ্গোপনে।
আরও পড়ুন: বিদায়ের দায়
জানো অরণ্য!
আজ সারাটি দিন কষ্টের নীল চাদর জড়িয়ে থাকবো। না, আমার কষ্টের রূপ আর অপেক্ষা কোনটাই যক্ষের বিরহের মতো নয় যে কালিদাস তার অলংকারে অলংকৃত করবে, সেগুলো অতি সাধারণ, ঋতুভেদে রঙ বদলালেও কষ্টগুলো কষ্টই থেকে যায়। অপ্রাপ্তিতে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভীষণ, হৃদয় থেকে ভালবাসার অনুভূতিটাকেই ছিড়ে নিয়ে নির্লিপ্তে ছুড়ে ফেলি বঙ্গোপসাগরে, এরপর যখন মৌসুমী সমুদ্রে পেটের মতো দুঃখগুলো ফুলে ফেঁপে উঠবে তখন ইচ্ছে করে চোখ বুজে চলে যাই ব্যবলিনের শূন্য উদ্যানে তবুও যে এড়ানোর পথ নেই সিদ্ধান্ত নেওয়ামাত্রই প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে দমিয়ে রাখা ভালোবাসা যার কিছুটা অনায়াসেই পুড়তে থাকে আর কিছুটা যায় নির্বাসনে।
আরও পড়ুন: পাতা ঝরার দিন
এভাবেই, এতোটা পথ একাই হেঁটেছি, বাকিটাও না হয়——–!!
তুমি ভালো থেকো অরণ্য। আমাকে নিয়ে ভেবো না, পারলে আমার পংক্তিমালার রস আস্বাদন করো ঝুম বৃষ্টির নিগূঢ় কান্নায়!!!!!!
পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে, বলিও আমার পরদেশীরে!
সে দেশে যবে বাদল ঝড়ে, কাঁদে না কি প্রাণ একলা ঘরে!
বিরহ-ব্যথা নাহি কি সেথা!
বাজে না বাঁশি নদীর তীরে!