বনানীর ভেতর যে অত্যাধুনিক বারটা আছে তার ভেতরে একজন বুড়ো কে প্রতিদিন দেখা যায় । আবছা আলোয় একাকী একটি টেবিলে বসে গ্লাসের পর প্লাস এলকোহল চালান করে দেয় পঁচে যাওয়া পাকস্থলীতে । কেমন যেন আজকাল সবকিছু ভোতা হয়ে গেছে দামী ব্রান্ডের মদ গুলোও নেশা ধরায় না । আজ যেন একটু বেশিই খাচ্ছে । সুন্দর পোশাক পড়া ওয়েটার মাসুদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কি যেন বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলছে না ।
— বৎস কিছু বলবে ?
— স্যার অনেক তো খেলেন বাড়ি যাবেন না ?
— তুমি আমার বাড়িটাকে বাড়ি বলো, সেটা তো শ্মশান । সেখানে তো কেউ নেই আমার ।
— কিন্তু স্যার আমাদের বারটা কে যে বন্ধ করতে হবে ।
— ওহ্ সরি অনেক রাত হয়ে গেছে মনে হয় বুড়ো উঠে দাঁড়িয়েছে কিন্তু তাল সামলাতে পারেনি, পরে যাচ্ছিল ওয়েটার ছেলেটা তাকে খপ করে ধরে ফেলেছে ।
— স্যার আপনি কিভাবে যাবেন, আপনি তো পুরোপুরি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না ।
— তুমি কি আমাকে আমার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে ?
— কিন্তু স্যার আপনি এই অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করবেন কিভাবে ?
— পারব সমস্যা নেই, মাতালরা মাতাল হলেও গাড়ি ঠিকই গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে ।
— না স্যার আপনি মনে হয় সেটা পারবেন না । একটু বসুন আমি ম্যানেজারের কাছে বলে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি । আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে সমস্যা হবে না । বুড়ো বাসায় এসে বেসিনে অনেক গুলো বমি করে দিয়েছে । কেয়ারটেকার ঘুম ঘুম চোখে সাহেবের পিঠ হাতিয়ে দিচ্ছে । মাসুদ বসে আছে গেস্ট রুমে । তাকে যেতে বারণ করেছে কি যেন কথা বলবে তার সাথে ।
— দুঃখিত বৎস আজ মনে হয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম, তাই পেটে সইলো না, তবে নেশা কেটে গেছে ভালো লাগছে এখন । আচ্ছা এক কাপ কপি খাবে ? ব্লাক কপি, স্বাদটা তেতো হলেও খেতে একেবারে খারাপ না ।
— না স্যার এখন খাব না ।
— আরে খাও খেতে খেতে একটু গল্প করি । আমার তো কথা বলার কেউ নেই । কেয়ারটেকার লোকটা দুই কাপ কফি দিয়ে গেছে কিন্তু তার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ । কফিটা বিরক্তি নিয়ে বানালেও একেবারে খারাপ হয়নি ।
— জান বৎস আমার টাকা পয়সার অভাব নেই কিন্তু সুখ বলতে যে একটা কিছু আছে সেটা আমি কখনো আমার মনের ভেতরে অনুভব করিনি । একটা ছেলে আছে আমিরিকায় সেটেল আর মেয়েটাও তার স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় । ব্যবসা বানিজ্য যা ছিল সব গুছিয়ে টাকা গুলো ব্যাংকে জমা করে রেখেছি । আমার সাত পুরুষ বসে খেলেও সেগুলো শেষ হবে না । শেষের কথাটা শুনে মাসুদ অন্যমনস্ক হয়ে গেছে । একজনের টাকা খরচ করার মানুষ নেই আরেকজনের, মেয়ের ভাল চিকিৎসা করানোর টাকা হয় না ।
— আমার ছেলেটার একটা মেয়ে আছে এতো পাকনা পকনা কথা বলে না, মনে চায় ধরে একটু আদর করি কিন্তু সেটা তো হয়ে উঠে না । খুব ছোট থাকতে আমিরিকায় গিয়ে দেখে এসেছি । ছেলেটা আমাকে রেখে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমার মনে সায় দেয়নি, অপরের সংসারে নিজেকে বোঝা হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে না ।
— আঙ্কেল আমাকে একটু যেতে হবে মেয়েটার শরীর ভালো না ।
— সরি তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, তোমার মেয়ের কি হয়েছে ?
— তেমন কিছু না সামান্য জ্বর ।
কিন্তু মাসুদ বাসায় গিয়ে দেখলেন মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ । চোখের পাতা ফুলে গেছে শরীরটাও কেমন ভার ভার লাগছে । স্ত্রী শান্তা, মেয়ে পুতুলের পাশে বসে আছে ।
— কি ব্যাপার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলেছিলাম নিয়ে যাওনি ।
— হ্যাঁ এলাকার বাচ্চু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম । ওষুধ দিয়েছে কিন্তু জ্বর তো কমছে না ।
মাসুদ মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলো অসম্ভব জ্বর । মেয়েটা একা একাই কি যেন বকে যাচ্ছে । স্বাভাবিক চেহারাটা কেমন যেন হয়ে গেছে । সকাল হওয়ার আগেই পুতুলের অবস্থা আরো খারাপ হলো । প্রচণ্ড ঘুম উপেক্ষা করে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতাল ছুটলো মাসুদ । ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললেন এটা কোন সাধারণ জ্বর নয় । আপনার মেয়ের কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে, নেফ্রোটিক সিনড্রোমে আক্রান্ত আপনার মেয়ে । গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে বাচ্চা কে, যদি সাধারণ ওষুধে আপনার মেয়ে ভালো না হয় তবে অপারেশন করার প্রয়োজন হতে পারে ।
তিন দিন চলে গেছে কিন্তু পুতুলের ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না । বরঞ্চ আরো অবস্থা খারাপ হয়েছে । ডাক্তার বলে দিয়েছে অপারেশন না করলেই নয় কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন তিন লাখ টাকা । টাকা কথা শুনে মাসুদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে । এতো টাকা সে কোথায় পাবে । বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে টাকার জন্য কিন্তু কোন কাজ হয়নি । বারের ম্যানেজারের কাছেও বলেছে নিজের বিপদের কথা কিন্তু এতো টাকা তারা অগ্রিম দিতে রাজি নয় । বুড়ো প্রতিদিনের মতো মদ খেতে আসে কিন্তু তার পরিচিত ওয়েটার কে সে দেখছে না, যে তাকে গত তিন দিন আগে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল । বুড়ো টলমলে শরীর নিয়ে হেঁটে যায় কাউন্টারের দিকে । ফিট ফাট পোশাক পরিহিত মধ্য বয়স্ক ম্যানেজারের কাছে জিজ্ঞেস করে ছেলেটার কথা ।
— হ্যালো মিস্টার, আপনাদের এখানে লম্বা সুন্দর মতো একটা ওয়েটার ছিল তাকে তিন দিন যাবৎ দেখছি না, কারনটা কি বলতে পারেন ?
— হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি আপনি মাসুদের কথা বলছে । ওর মেয়েটার খুব অসুখ । শিশু হাসপাতাল ভর্তি আছে ।
— কি বলছেন আপনি ?
— হ্যাঁ ঠিকই বলছি, কি যেন একটা অপারেশন করতে হবে তিন লাখ টাকার প্রয়োজন, এখানে এসেছিল টাকা জন্য কিন্তু আমরা এতোগুলো টাকা কিভাবে এডভান্স দেই বলুন । প্রতিটি জিনিসের একটা নিয়ম তো আছে ।
–‘আচ্ছা ছেলেটার মোবাইল নাম্বারটা দিতে পারবেন একটু কথা বলে দেখতাম ।
— সিউর
মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে বাসায় চলে এসেছে বুড়ো । অনেক রাত হয়ে গেছে তাই আর ফোন করা হয়নি । সকাল হতেই তার বিএমডাব্লিও গাড়িটা দেখা যায় শিশু হাসপাতালে পার্কিং লনে । মোবাইল নাম্বারটিতে ডায়াল করতেই একটি কোমল সুরের কন্ঠ ভেসে উঠে ।
— হ্যালো কে বলছেন ?
— আমি সেই বুড়ো যাকে তুমি মাতাল অবস্থায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলে ।
— ও স্যার আপনি, কেমন আছেন ?
— আমার কথা বাদ, তোমার মেয়েটা কত নাম্বার কেবিনে আছে সেটা বল । মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করার মাসুদ কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছে ।
— স্যার আপনি আমার মেয়ের কথা জানলেন কিভাবে ?
— যেভাবে হোক জেনেছি, প্লিজ তুমি আগে কেবিন এবং সিট নাম্বারটা বল ।
বুড়ো হাসপাতালে বারান্দা দিয়ে হাঁটছে । চারপাশ থেকে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ, মৃত্যুর আহাজারি । হাসপাতালে না আসলে সে বুঝতে পারতো না সে কতটুকু ভালো আছে । আসলে মানসিক শান্তির থেকে শারীরিক প্রশান্তিটা অনেক বেশি প্রয়োজন । তার যে মৃত্যু ঘনীয়ে আসছে সে ভুলেই গিয়েছিল । ব্যাংকে গচ্ছিত এতো গুলো টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে । কে ভোগ করবে এই সব টাকা পয়সা । তার ছেলে মেয়েদেরও তো টাকা পয়সা অভাব নেই । মাত্র কথা শেষ করা বুড়ো কে দেখে চমকে গেছে মাসুদ ।
— স্যার আপনি এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলেন ?
বুড়ো কোন উত্তর দিচ্ছি না, সে তাকিয়ে আছে বিছানা গত শিশুটির দিকে । ঠিক যেন তার নাতনির মতো দেখতে । কিন্তু চেহারায় স্পষ্ট বেদনার ছাপ । কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার প্রবেশ করেছে কেবিনে । পুতুল কে পরীক্ষা করে আবার সেই একই কথা একই প্রশ্ন । বাচ্চার অবস্থা তো একেবারেই ভালো না । অপারেশনটা খুব জরুরী, টাকা জোগাড় কি হয়েছে ?
— জ্বি টাকা জোগাড় হয়েছে আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন । মাঝ থেকে বলে উঠে বুড়ো মানুষটি । কিন্তু তার কথা শুনে বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে মাসুদ এবং তার স্ত্রী শান্তা ।
— তাহলে তাড়াতাড়ি করে টাকাটা কাউন্টারে জমা দিয়ে আসুন । আজই অপারেশনের ব্যবস্থা করছি । মাসুদের যেন বিস্ময় এখনো কাটছে না । এই মদ খাওয়া বুড়ো মানুষটা যে তার পাশে এসে দাড়াবে সে ভাবতেই পারেনি । কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করছে । মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না । বুড়ো লোকটির কাছে গিয়ে হঠাৎ করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে । ছলছল করা জল গুলো নিরব সাক্ষী হয়ে ঝরে পরে বুড়ো লোকটির শার্টের প্রতিটি সুতোর ভাঁজে ভাঁজে ।
অপারেশনের পর পুতুল ভালো হয়ে গেছে । বুড়ো লোকটিকে আর এখন দেখা যায় না অন্ধকার বার গুলোতে তবে তাকে মাঝে মাঝেই দেখা যায় পুতুলদের বাসায় পুতুলের সাথে খেলা করতে । আজকাল বুড়োর বিশাল অংকের টাকা গুলো ব্যাংক থেকে কমে যাচ্ছে । সে এখন সুখের সন্ধান পেয়েছে । অসহায় মানুষ গুলোকে সাহায্য সহযোগীতা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । দান বা সাহায্য করে যে সুখটা পাওয়া যায়, সেটা মনে হয় মদের গ্লাসে, বিলাস বহল বাড়ি কিংবা বিএমডাব্লিও গাড়িতে চড়ে পাওয়া যায় না । মানব সেবাটাই যে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশান্তি । এটা কয়জনেই বা বুঝতে পারে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প