কিছুদিন থেকেই চুপিচুপি আলোচনা হচ্ছে আমার বিয়ের ব্যাপারে। আমি সামনে গেলেই আলোচনা থমকে যায়। তবুও ছোটভাই মারফত যতটুকু জানলাম তার সারমর্ম হলো- বাবা চান আগামী মাসের মধ্যেই বিয়ের ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে। আমিও যে চাইনা তা না। আমি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে বছরখানি হলো জয়েন করেছি। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই মায়ের ঘ্যান-ঘ্যানানি শুরু হয়েছে।
– বয়স তো অনেক হলো, এবার বিয়েটা কর, এরপর তো বুড়ো হয়ে যাবি ইত্যাদি। শুরু থেকেই কাজের চাপ থাকায় এসব দিকে নজর দেওয়ার টাইম ছিলো না। এখন এই দীর্ঘ ছুটিতে সবাই মিলে চেপে ধরেছে যেন বিয়েটা করে ফেলি। মা তো একদিন বলেই ফেললো –
– যদি তোর পছন্দের কেউ থেকে থাকে তো বল। আমরা তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলি। আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম –
– আমার পছন্দের কেউ নেই।
আসলেই কেউ নেই। যে দু একজনকে ভালো লাগতো তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে বেশ আগে। তারপর থেকেই আমার অগোচরে পাত্রী দেখার তোড়জোড় চলছে। এক শুক্রবার বিকেলে ছোটভাই এসে বললো- গরম খবর আছে। আগামীকাল তোমার জন্য পাত্রী দেখতে যাওয়া হবে। পরদিন সেজেগুজে রওনা হলাম। আমার বাবার বন্ধুর কলিগের মেয়ে। পাতলা গড়নের শ্যামলা মেয়ে। টানা টানা চোখ। দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গেল। বাবা- মার ও খুব পছন্দ হলো। আর আমাকে নাকি আগে থেকেই মেয়ের বাবা-মা পছন্দ করে। পাকা দেখা-দেখির দিন তারিখ ধার্য হয়ে গেল। এর পরই বিপর্যয় টা ঘটলো। দুই দিন পরে মেয়ে কোথা থেকে আমার নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন দিয়ে বলে-
-ভাইয়া, প্লিজ এই বিয়েটা আপনি ভেঙে দেন, আমাদের সাত বছরের প্রেমটাকে আপনি বাঁচান। এরকম কাহিনি আমি আগেও শুনেছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটবে কখনো ভাবিনাই। কি আর করা! অগত্যা বিয়ে ভেঙে দিতে হলে। এরপর আরও চারটা পাত্রী দেখা হলো। প্রত্যেকটাই একই কারনে ভেঙে গেল। কখনো আমরা ভেঙে দিলাম কখনো তারা ভেঙে দিলো। পরিবারের লোকজন হতাশ হয়ে পাত্রী দেখা স্থগিত করলো। লোক মারফত শুনলাম, বাবা নাকি বিরক্ত হয়ে এও বলেছে-
– কত বড় গর্দভ, জীবনে একটা প্রেমও করতে পারে নাই! আমিও দেখলাম এই লাইনে আর কাজ হবে না। লাইন পরিবর্তন করতে হবে। এলাকার এক বড় ভাই বললো-
– ছোটভাই, একটা ভালো পরামর্শ দেই, একটা প্রেম করার চেষ্টা করো। এখন প্রেম ছাড়া বিয়ে মানে অন্যের প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিয়ে আসা। কথাটা আমারও মনে ধরলো। শুরু করলাম আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে যেসব মেয়েরা সিঙ্গেল আছে তাদের দিয়ে। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু অনেক ভাবে বললাম। কেউ পাত্তা দিলো না। আবার বড় ভায়ের শরণাপন্ন হলাম। বড় ভাই সব কিছু শুনে বললেন-
– সত্যি কথা বলতে কী, তোমার যে হাল-সুরত তাতে কোন মেয়ে দেখেই প্রেমে পড়ে যাবে এটা ভাবা বোকামি। তোমার কি অন্য কোন গুন আছে? যেমন- গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা কবিতা লেখা?
– গান গাইতে বা ছবি আঁকতে তো পারবো না। তবে চেষ্টা করলে হয়তো কবিতা টা হবে মনেহয়। যখন কলেজে পড়তাম সাবিত্রীকে প্রথম দেখেই একটা কবিতা লিখে ফেলেছিলাম। অবশ্য কখনো কাওকে দেখানো হয়নি।
– তাহলে এক কাজ করো নিয়মিত ফেসবুকে কবিতা আপ্লোড দিতে থাকো। খেয়াল রাখবা যেসব মেয়েরা লাভ রিঅ্যাক্ট দিচ্ছে, কমেন্ট করছে বা শেয়ার দিচ্ছে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করবা। একবার ভাব হয়ে গেলে তখন কবিতা লিখবা ইনবক্সে, দেখবা কেউ না কেউ পটে যাবে। কবিতা লেখার বহু চেষ্টা করলাম। যে কবিতা বের হলো – ” আমি যদি কঞ্চি হই তুমি হবে বাশ আমি যদি গরু হই তুমি হবে ঘাস” দুই মিনিটে সাতটা হাহা রিঅ্যাক্ট পড়ার পর পোস্ট ডিলিট করে দিলাম। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এত খারাপ হয়ে গেল যে, সে রাতে কাচ্চি রেখে আলুভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
দু একদিন পরেই জমির দলিল খুঁজতে যেয়ে কবিতা সমস্যার অলৌকিক সমাধান হয়ে গেল। কীভাবে হল সেটা পরে বলছি। তবে প্রথমদিন ফেসবুকে যে কবিতাটা আপ্লোড দিলাম তার কিছু অংশ- “আমি সবকিছুই তোমার পায়ে এনে রেখেছি; তারপরও তুমি যদি চাও ক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে ওই বিশাল আকাশ এনে রেখে দেবো তোমার পদ সন্নিকটে। শুধু প্রতিবার তোমার কাছে গেলে মনে হয়, হয়তো এসবের পরিবর্তে এবার তুমি আমাকে চাইবে; আর আমি পৃথিবীর সব স্থান আমাকে জড়ো করে এনে রাখবো তোমার পায়ে।” আশাতীত সাড়া পেলাম। অনেকগুলো বালিকার লাভ রিঅ্যাক্ট পেলাম। তার মধ্যে বেছে কয়েকজনকে নক করলাম। রিয়া নামের একটা মেয়ের সাথে কবিতা নিয়ে অনেক কথা হলো। এরপর থেকে প্রায়ই তার ইনবক্সে কবিতা লিখে পাঠাতাম। ” তোমার জন্য ব্লাক ফরেস্টের আদিম গুহা তলে প্রজাপতির রক্ত ডানায় শত জোনাক জ্বলে। তোমার জন্য মারিয়ানার শান্ত গভীর জলে অক্টোপাসে রুদ্ধশ্বাসে দ্বৈত যুদ্ধ চলে।” অথবা, “এক পৃথিবী লিখতে চাওয়া কবির দল যারা এক পাতাও শেষ করেনি, তারা একদিন তোমাকে দেখুক অজস্র পান্ডুলিপি হয়ে ঝরবে তাদের বিস্ময়!
নিখুঁত ভাস্কর্য গড়বে বলে যে তরুণের দল একটি পাথরও এখনো হাতে তোলেনি তারা একদিন তোমাকে দেখুক ধরনীর সকল প্রস্তরখন্ড একেকটি ভাস্কর্য হয়ে তোমার অবয়বে ঘোষণা করবে সৃষ্টির সর্বোচ্চ সৌন্দর্য। এক জীবনের নির্যাস দিয়ে ছবি আঁকবে বলে যেসব শিল্পীরা, একটি তুলির আঁচড়ও এখনো টানেনি তারা একদিন তোমাকে দেখুক ক্যানভাসে ক্যানভাসে ভরে উঠবে রাস্তার দেয়াল, দোকান, অফিস, বাসা, এ শহরতলী। একদিন সবাই তোমাকে দেখুক দেখুক তোমাকে, জানুক এই পৃথিবী, একটি কবিতার জন্য ট্রয় নগরী শতবার ধ্বংস হতে পারে, ধূলি-ধূসরের মাঝে গড়ে উঠতে পারে আশ্চর্য মহল, মুহুর্তে প্রাণ দিতে পারে লক্ষ সিপাহ সালা । তবে আমার কিছুই নেই রিয়া, তোমার জন্য শুধুই পঙক্তিমালা।” এসব কবিতায় কবিতায় একসময় রিয়ার সাথে আমার প্রেম হয়ে গেল। তারপর এক শুভ দিন দেখে বিয়েও হয়ে গেল। বিয়ের রাতে রিয়া আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে বললো-
– তুমি আমাকে নিয়ে যেসব কবিতা লিখছো সবগুলো আমি এ ডায়েরি তে লিখে রেখেছি। এ ডায়েরি আমাদের সাথে চিরদিন থাকবে। তারপর সুখে-শান্তিতে দিনকাল কাটছিলো ভালোই। কিন্তু একদিন কীভাবে কীভাবে যেন সেই ডায়েরি আমার মায়ের হাতে পড়লো। মা তো ডায়েরির লেখা পড়ে থ। সাথে সাথেই আমার ডাক পড়লো মায়ের ঘরে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক। আমি, বাবা এবং মা। মা আমাকে দেখেই বললেন-
– তুই কেমন ছেলে বল তো? বাবার লেখা কবিতা চুরি করে মেয়ে পটালি! একটুও লজ্জা করলো না তোর!
আরও কী কী যেন বললো আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। একটু পরে মা বেরিয়ে যেতেই আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকে বললাম-
– তুমি এত সুন্দর কবিতা লিখতে জানতাম ই না। বাদ দিলে কেন? বাবা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,
– আরে ধূর, আমার কবিতা লেখার জ্ঞান কোথায়! এসব তোর দাদার কাছ থেকে চুরি করা।
গল্পের বিষয়:
গল্প