জলবোমা

জলবোমা

মাটির ঢেলাটি কপালে ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন রাজু চৌধুরী। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে দেশের মাটি কেন কপালে ঠেকাতে হলো, জানেন না নিজেও। তবুও চৈত্রের রোদ, রোদের ভেতর থেকে বিকীর্ণ রূপালি রোশনি চোখে পুরে আবার মুঠি ভরে তুললেন আরেক দলা মাটি। স্মৃতির নদীজলে ডুবতে থাকা খরস্রোতা ইতিহাসের ভরদুপুর আর চৈত্রের কড়া রোদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে গেল নিজের অজান্তেই। সূর্যাস্তের সময় যখন রক্তিম চোখ তুলে তাকায় ডুবতে থাকা সূর্য, তেমনি রক্তলাল স্মৃতির ঢাকনা খুলে গেল আচমকা। আর তখনই উদ্দেশ্যবিহীন হাতে তুলে নেওয়া মাটির ঢেলাটি ছুড়ে মারলেন পুকুরে। ঘোলাটে নিথর জলে তরঙ্গ উঠে ছড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই পাড়ের আমগাছের পাতার ঝাড়ের ভেতর থেকে উড়ে গেল কয়েকটি কাক। কাকের রঙ কালো হলেও গাছ সেজেছে নানা রঙের আলপনায়- লাল, হলুদ, কমলা আর পাতার সবুজের মহা মিলনে চৈত্রের খরতাপের উষ্ণতার মাঝেও প্রাণকাড়া নির্মলতা আর সৌন্দর্যের ছাঁট আটকে গেল চোখের মণিতে। এ বোধের সুন্দর ঢিলটিও মাটির ঢেলার মতো আবার ঝাঁকি দিল খরস্রোতা ইতিহাসের সমুদ্রজলে। এবার তিনি ডুবে গেলেন স্বপ্নচোখের গভীরে।

কী কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, ভাবতে গিয়েও নিভে গেল ঘোর লাগা স্বপ্নচোখের আলো। পুত্রবধূ পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, ‘আব্বা, এই খররোদে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন? স্কুল থেকে ফুলকথাকে আনতে যাবেন না স্কুলে?’

আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ থাকার কথা। বন্ধ নেই। লাগাতার অবরোধ আর মাঝেমধ্যে হরতাল ডাকার কারণে বন্ধের দিনও চলছে স্কুল। স্কুলে আনা-নেওয়ার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। একমাত্র নাতনি ফুলকথাকে ঘিরেই কাটে সময়। পুত্রবধূর কথা শুনে স্মৃতির খরস্রোতা উজান ঠেলে ফিরে এলেন বর্তমানে। তারপর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুল ছুটির সময় কি হয়ে গেছে?’

‘জি! হয়ে গেছে। তাই স্মরণ করিয়ে দিলাম আপনাকে। দূর থেকে দেখলাম কেমন যেন বেখেয়ালি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এখানে!’

‘না। ভুল দেখনি তুমি। আজ পত্রিকায় দেখলাম, অবরোধের ৭৪তম দিন চলছে। মোট নিহত হয়েছেন ১২৩ জন। পেট্রোল বোমা ও আগুনে মারা গেছে ৬৭ জন; ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘গণপিটুনি’তে ৩৭ জন; সংঘর্ষ, ‘গুলিবিদ্ধ লাশ’ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন। আর ১৩৮৮টি যানবাহনে আগুন-ভাংচুর ঘটেছে। এ রকম ঘনঘটা, দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার জন্যই কি একাত্তরে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম আমরা? ভেবে কাতর হয়ে গিয়েছিল মন। আনমনা হয়ে স্মৃতির সাগরে খাবি খাচ্ছিলাম। তবে ফুলকথার কথা ভুলিনি। ঠিক সময়ে তাকে নিয়ে আসব। এখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সে। তার কথা কি মনে করিয়ে দেওয়া লাগবে আমাকে?’

‘সরি আব্বা। আমি জানি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবুও মন মানে না। আজ কেমন যেন একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে মনে! নিরাপত্তাবোধ হারিয়ে গেছে মন থেকে। কী করব বলুন?’

পুত্রবধূকে দোষ দিতে পারলেন না রাজু চৌধুরী। হরতালে কার্যকারিতা হারিয়ে গেলেও প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে খবর আসে পেট্রোল বোমা হামলার। গতকালও চাঁদপুরে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে একজন নিরীহ ট্রাকচালক। এমন চলতে থাকলে তো গোপনে গোপনে মানুষের মনে ভয় ওঁৎ পেতে থাকতেই পারে। প্রয়োজনের তাগিদও অস্বীকার করতে পারে না মানুষ। উপরে উপরে সাহসী; ভয় মাথায় নিয়েই বেরোয় সবাই। তবে রাস্তায় এলে ভয়টা টের পাওয়া যায় না। এটুকুই সান্ত্বনা। বন্ধের দিনে স্কুলও খোলা রাখা যাচ্ছে না। এখনও এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়নি। বন্ধের দিন এসএসসি পরীক্ষা চলে অধিকাংশ স্কুলে। তবে পড়াশোনা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফুলকথাদের স্কুলে বন্ধের সময়ও পড়াশোনা চলছে। সমস্যার সামনেও নুয়ে পড়েনি ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। বিকল্প উপায় বের করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ রকম বিদঘুটে একটা পরিস্থিতির মখোমুখি হবে দেশ- কখনোই ভাবতে পারেননি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজু চৌধুরী। ভেবেছিলেন, শত্রুমুক্ত হয়েছে দেশ, স্বাধীন হলেও যে স্বপ্নপূরণ হয়নি- সে কথা আর ভুলতে পারছেন না তিনি। অসহনশীল সময়ে তাই পুরনো স্মৃতির ঝাঁপি আবার ঢেকে দিলেন। ফুলকথার স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিলেন।

হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন, পথের ধুলোতেও ফুটে আছে ধুলোচিত্র। ফুলের আকৃতির ধুলোয় পা রাখতে গিয়েও রাখলেন না, খানিকটা সরে দাঁড়ালেন এবার। সড়কের পাশে আমগাছের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কচি সবুজ পাতার ঝাঁকও ভরে গেছে নতুন গজানো হলুদ পাতায়, আর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠেছে তুলতুলে নরম আর হালকা লালচে রঙের নতুন কচি পাতাও। প্রকৃতিতে জোয়ারের মতো ধেয়ে আসছে নবীনের জয়োচ্ছ্বাস। নবীন পাতার নিখাদ নির্মলতা ছুঁয়ে দেখার অন্তর্গত আগ্রহে হাত বাড়ালেন সড়কের পাশের আমগাছের কচি পাতার ঝাঁকের দিকে। তখনই অন্য একটি ডাল থেকে উড়ে গেল তেলতেলে ডানার কুচকুচে একটা কালো কাক। ওড়ার সময় কা-কা শব্দ করল। চৈত্রের নিখাদ দুপুরে ছায়ায় বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে নীরবে উড়ে যায় না। পুকুরের জলে প্রতিফলিত ছায়া ফেলে উড়ে যায় তারা। একটা উড়লে আর বসে থাকে না সতর্ক চোখের অন্য কাকের ঝাঁক। এখন শব্দহীন উড়ে গেল একটি কাক। আচমকা কেঁপে উঠল শরীর, কেঁপে উঠল মাটি। ধুলোমাখা চিত্ররেখায় পরিবর্তন না ঘটলেও ধুলোচিত্র পেতে চাইল যেন স্থায়ী মাটিতে আপন বসবাস। বুকের চোরা স্রোতে ভয় লুকিয়ে রইল না কেবল; ভয়ের ঢেউ উঠল চোখেমুখেও। আর তখনই দেখল সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা। দুঃস্বপ্নের ঝাঁপি আবার খুলে গেল। অটোতে উঠবে কি উঠবে না, ভাবার সুযোগ পেলেন না রাজু চৌধুরী। ড্রাইভিং সিটে বসা চালক প্রশ্ন করল, ‘আপনি রাজু মুক্তিযোদ্ধা না? রাজু কমান্ডার…।’

বহুদিন পর তিনি শুনলেন কমান্ডার শব্দটি। কিন্তু বালক চালকের প্রশ্নের মধ্যে শ্রদ্ধা নয়, ওঁৎ পেতে আছে যেন তাজা পেট্রোল বোমা। চট করে চিনতে পারলেন বালকটিকে। এই বালক আর কেউ নয়; একাত্তরে তাদের এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান রহমত আলীর বড় ছেলের ঘরের নাতি। একবার এ বালক এ পথে সন্ধ্যায় নির্জন সময়ে দুম করে সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আপনি নাকি একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে আমার দাদাজানরে খতম করবার লাগছিলেন?’ দুরন্ত স্পর্ধাপূর্ণ প্রশ্নটির জবাব দিতে গিয়েও দিতে পারেননি তখন। সামনে তাকিয়ে দেখেছিলেন এককালের উর্বর জমির শস্যহীন খাঁ-খাঁ মাঠ ফেটে চৌচির। নতুন শস্য বোনার জন্য নেই জলধারা। মাটি খোঁজে জল, অথচ জল নেই কোথাও। শীতল মাটি নেই কোথাও। পোড়া মাটির গন্ধ ভাসে চারদিক। সোনার বাংলার সোনা ফলানো মৃত্তিকায় গলল পরশ পাওয়ার জন্য মুহূর্তেই মার্চপাস্টের লেফ্‌ট-রাইট, ডান-বামের মতো বাম পা দিয়ে একবার সজোরে আঘাত হেনেছিলেন মাটিতে। ধুলো উড়ে গিয়েছিল চারপাশে। সেই তেজ তখনকার চৈত্রের খর রোদের চেয়ে কড়া শাসন ছড়িয়ে দিয়েছিল। সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল রহমত আলীর নাতি।

‘কমান্ডার স্যার, আমি শুনেছি, আপনার কারণে ওই সময়ে দাদাজানের জান বাঁইচ্যা গেছিল। যহন দাদাজানরে গুলি মারবার লইছিল এক তরুণ মুক্তি, তহন আমার বাবজান কোত্থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দাদাজানের ওপরে। আপনার মায়া হইছিল। ছাইড়া দিছিলেন দাদাজানরে। আপনার আদেশে ছাড়া পাইছিলেন তিনি। আমায়ে এসব কথা কইছেন দাদাজান।’

কমান্ডার রাজু চৌধুরীর ভেতর থেকে এখন কমান্ডারের তেজ ফুঁসে উঠল রহমত আলীর নাতির কথা শুনে। মনে মনে বললেন- ভুল করেছিলাম, ভুল করেছিলাম। ওই সময়ে তোমার দাদাজানের কারণে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের গ্রামে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়েছিল, মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনে সহায়তা করেছিল সে। তাকে মেরে ফেলাই উচিত ছিল। শত্রুর বীজ রাখা ঠিক হয়নি। ভুল করেছিলাম মায়ার হাতে বন্দি হয়ে। এখন রহমত আলীর প্রজন্ম স্বাধীনতাপক্ষের বিরুদ্ধে ভয়াল রূপে আবির্ভূত হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও করছে সর্বত্র।

মনের কথা ঢুকে গেল মনে। চেতিয়ে ওঠা বুক আবার নেতিয়ে গেল রহমত আলীর নাতির এ মূহূর্তের বিগলিত কথা শুনে- ‘ওডেন আমার অটোয়। আপনার দেরি হইয়া গেল। স্কুল ছুটি হইয়া গেছে। আপনার নাতনি ফুলকথা অপেক্ষা করব,ভয় পাইব। ওডেন তাড়াতাড়ি। আপনার উপকার করতে পারলে খুশি হমু। দেশের অবস্থা ভালা না।’

স্কুলে যাওয়ার সময় অটোরিকশায় ওঠেন না তিনি। ভেবেছিলেন, রিকশায় যাবেন। রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। ফুলকথাকে স্কুল প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রাখাও শোভন নয়। ঠিক হবে না ভেবে দ্রুত উঠে বসলেন অটোতে। দ্রুতই স্কুলে পৌঁছে দেখলেন পুরো খালি হয়ে যায়নি স্কুল প্রাঙ্গণ। ছুটির পর বাসায় ফেরতগামী ছাত্রীরা এখনও মাঠের কোণে জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। দাদাজানকে দেখে ছুটে এসে ফুলকথা পাশে দাঁড়ানো সিএনজি অটো রিকশা দেখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘রিকশায় না এসে অটোতে এলে কেন?’

রাজু চৌধুরী জবাব দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। অটো চালক এবারও নরম ভাষায় বিগলিত ভঙ্গিতেই বলল, ‘পথে ওনার দেরি দেইখ্যা আমিই তুলে আনছি রাস্তা থেইক্যা। রিকশা পাচ্ছিলেন না তো।’

ফুলকথা বলল, ‘রিকশায় ফিরব। অটোতে না।’

‘খুব মন খারাপ হইল আমার। উপকার করলাম আমি, আর অপমান করলেন আপনি?’ বলল অটো চালক।

রাজু চৌধুরী ফুলকথাকে থামিয়ে বললেন, ‘থাক না রিকশা। আজ না হয় অটোতেই যাই। ও যেহেতু নিয়ে এসেছে; ফিরে গিয়ে একসঙ্গে ভাড়াটা দেব।’

এক পা পিছিয়েও দাঁড়িয়ে রইল ফুলকথা।

রাজু চৌধুরী মৃদু হাসলেন। হেসে উঠে বসলেন সিএনজি অটোরিকশায়। ইশারা করলেন ফুলকথাকেও। দাদাজানের আহ্বান অবহেলা করতে পারল না ফুলকথা। উঠে বসল সেও। আচমকা তার মনে হলো চৈত্রের রঙে রঙিন প্রকৃতির আদর সৌন্দর্যের জোয়ারের উল্টোদিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। তার কচি মনে বেমানানভাবে হঠাৎ দার্শনিক প্রশ্নের উদয় হলো- শিকড়হীন শিকড়ের দিকেই কি এ যাত্রা? একবার কেবল বলল, ‘দাদাজান, ভয় করছে। এ সময় সিএনজিতে ওঠা কি ঠিক হলো?’

দুই.

অটোরিকশা এগিয়ে চলেছে। ফুলকথা দাদার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘ও তো একটা মাস্তান। ওর অটোয় উঠলে কেন, দাদাজান?’

একটা অচেনা আধ্যাত্মিকতায় ডুবে গিয়ে বিমূর্ত জগৎ থেকে মূর্ত জগতে ভেসে উঠে রাজু চৌধুরী জবাব দিলেন, ‘মাস্তানদের সিএনজিতে কেউ পেট্রল বোমা মারার সাহস পাবে না।’

‘তবু তো ভয় করছে।’ বলল ফুলকথা।

‘ভয়ের কিছু নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়ে গেছে। এখন হয়তো জ্বালাও-পোড়াও কমে যাবে।’

‘না। তোমার কথায় সাহস পাচ্ছি না। এ এলাকায় ওকে সবাই চণ্ডাল মাস্তান বলে ডাকে। জানো তো তুমি, ও হলো রহমত আলীর নাতি। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের নাতির অটোরিকশায় উঠতে পারলে তুমি!’

নাতনির কথার মধ্যে থেকে বোধের জগতে সাঁই করে আঘাত হানল নতুন বুলেট। এই বুলেটের উদ্বেগ-দহনকে অচেনা মনে হলো। এমন উৎকণ্ঠার ঝাঁঝ কখনও আগে লাগেনি গায়ে। তবুও আশ্বস্ত করলেন নাতনিকে। আবারও বললেন, ‘ভয় পেয়ো না ফুলকথা।’

আরও পড়ুন: পাতা ঝরার দিন

এবার রাজু চৌধুরীর কথা কিছুটা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হওয়ায় শুনে ফেলল চণ্ডাল মাস্তান। আপাতত তার লুকোনো মুখোশের ভেতর থেকে শুদ্ধ ভাষায় বেরোল জোরাল রাজনৈতিক কথার সুর- ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলেই কি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে? কী বললেন এটা!’

প্রশ্নটি রাজু চৌধুরীর মাথায় আরেকটা বুলেট হিসেবে আঘাত হানল। সরলভাবে যা তিনি চিন্তা করেন, তার আড়ালেও থাকে আরেক চিন্তা- সঠিক সময়ে সেই ধারণাটা অগ্রিম ধরতে পারেন না তিনি।

উত্তর না পেয়ে চণ্ডাল মাস্তান আবার বলল, ‘পেট্রল বোমা বন্ধ হবে, কি হবে না- নির্ভর করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। ফলাফল গুম করলে, কেড়ে নিলে আরও বেগবান হবে পেট্রল বোমার আক্রমণ।’

শুনে ঘাবড়ে গেল ফুলকথা। চণ্ডাল মাস্তান তো দেখছি কেবল সিএনজি চালিত অটোই চালায় না; রাজনীতিও করে- ভাবলেন রাজু চৌধুরীও। বুঝলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির অঙ্কুরিত বীজ সুশোভিত হয়েছে। আরও নির্মম আরও ধ্বংসাত্মকরূপে ছড়িয়ে গেছে বর্তমানেও। তবে কি সত্যি সত্যি একাত্তরে রহমত আলীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি? ইতিহাসের ভুলের বোঝা কি তবে বইতে হবে এখনও?

আরও পড়ুন: বিদায়ের দায়

দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছে ফুলকথা। বিকৃত ভঙ্গিতে সান্ত্বনার স্বরে চণ্ডাল মাস্তান বলল, ‘আমার অটোয় পেট্রল বোমা মারবে না কেউ। এমন সাহস নেই কারও। তবে জলবোমার ভয়াল ঘূর্ণি আক্রমণ করতে পারে আমাদের। সে ব্যাপারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নাই আমার হাতে।’

কথাটার অর্থ বুঝল না ফুলকথা। দাদার মুখের দিকে তাকাল প্রশ্নবোধক চোখে। জলবোমার কথা এর আগে শোনেননি রাজু চৌধুরীও। তবে মিছিল ভঙ্গ করার জন্য ঢাকায় জলকামান ব্যবহারের কথা শুনেছেন। এই মফস্বল শহরে কখনও জলকামান দাগানো হয়নি; জলবোমার কথাও শোনেননি কেউ।

জলবোমাটা দেখতে কেমন, কীভাবে বিস্টেম্ফারিত হয় এ অচেনা বোমা, কিছুই জানা নেই ফুলকথার। তবুও কল্পচোখে মূর্ত হয়ে উঠল বিমূর্ত জলবোমার উৎসারিত জলাক্রমণ। জলের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে যেন সে চলেছে অজানা কোনো দেশের উদ্দেশে।

আরও পড়ুন: কোন সুরে ডাকি তোমারে

তিন.

একটা বুনোফুলের গন্ধ নাকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অটোতে একটা তীব্র ঝাঁকি টের পেলেন পেছনের সিটে বসা বদ্ধ দরজার ভেতর আটকে থাকা রাজু চৌধুরী আর ফুলকথা। কোত্থেকে এলো এ গন্ধ? হঠাৎ দেখা গেল সামনের দরজা খুলে চলন্ত অটো থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়েছে চণ্ডাল মাস্তান। তারপর আর কিছুই দেখলেন না রাজু চৌধুরী; ফুলকথার ভাষাও চুপ হয়ে গেল। সড়কের পাশের বড় ডোবার দিকে নেমে যাচ্ছে সিএনজি অটো। পেছনের সিটের দরজা খোলার কথা ভুলে গেলেন তারা। বিপদে নিজেদের রক্ষা করার বোধও হারিয়ে ফেললেন। সিএনজি অটো সড়সড় করে নেমে গেল খাদের গভীর জলে। চকিতে ফুলকথার মনে হয়েছিল পেট্রল বোমা উড়ে এসে আঘাত হেনেছে অটোতে; দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের শিখায় এসে পড়েছে জলবোমা; জ্বলে ওঠা কল্পিত বারুদের স্টম্ফুলিঙ্গ নিভে গেল মুহূর্তে। বারুদ ভিজে গেল জলে কিন্তু ভেজা বারুদ থেকেও বেরোচ্ছে আগুন। রাজু চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সে-আগুন স্পর্শ করল না চণ্ডাল মাস্তানের বোধের জগৎ। ত্রূক্ররতার আনন্দ নিয়ে একবার চিৎকার করল সে। তারপর খালি সড়কে এগিয়ে আসতে থাকা অন্য একটি অটো রিকশাচালকের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘যাত্রীসহ আমার অটো ডুবে গেছে খাদে। আমার অটো উদ্ধার করুন, যাত্রীদের উদ্ধার করুন।’ চেতনার বারুদ ভিজে গেল নবপ্রযুক্তির উদ্ভাবনী এ কৌশল, জলবোমার প্লাবনে। সবাই জানল, দুর্ঘটনায় মারা গেছেন রাজু চৌধুরী আর তার ফুলের মতো নাতনি, ফুলকথা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত