— তুমি আমাকে একটা চড় দাও তো! লুনার মুখে কথাটা শুনে ফরহাদের পিলে চমকে গেল! শান্তশিষ্ট মেয়েটা হঠাৎ চড় খেতে চায় কেন? সে বলল— চড় দেব কেন? লুনা মাথা ঝুঁকে বলল— আহা দাও না। একটা চড় দিলে কী হয়? ফরহাদের হাত পা শীতল হতে লাগল। মেয়ে মানুষ জেনেশুনে চড় খেতে চাইলে। তার পেছনে নিশ্চিত কোনো কাহিনি থাকে। সে আবারো বলল— চড় দিলে তো কিছু হয় না। কিন্তু হঠাৎ চড় খেতে চাচ্ছ কেন? লুনা বলল— তোমার হাতে আমার একটা চড় খাওয়া উচিত! কাল রাতে জানো কী করেছি? ফরহাদ মাথা নাড়াল। জানে না। লুনা আবার বলল— কাল রাতে তোমার কফিতে একটি জিনিস মিশিয়েছিলাম! বাজে জিনিস! ফরহাদ এবার বুঝল, এই হচ্ছে কাহিনি! সে জানতে চাইল— কীরকম বাজে?
— অনেক বাজে! তুমি শুনতে চাও?
ফরহাদ একবার ভেবেছিল বলবে— বলো, শুনতে চাই। পরে আবার নিজেকে সামলে নিল। যা খেয়ে ফেলেছে তা খেয়ে ফেলেছে। এখন শুনলে আর কী হবে? লুনা আবার বলল— বলো শুনতে চাও?
— নাহ থাক।
লুনা এবার মাথার চুল খুলে বলল— তোমার এই দিকটাই আমার এত অসহ্য লাগে! কোনো কিছুতে তোমার আগ্রহ নাই। কফিতে কী মিশিয়েছিলাম? বিষ না অন্যকিছু? তা জানতে চাইবে না? ফরহাদ স্বাভাবিক গলায় বলল— বিষ মেশাবে কেন আজব? তুমি আমাকে মারতে পারো না কি? লুনা আরো একটু ফরহাদের দিকে ঝুঁকে বলল— মারতে পারব না কেন? তুমি কোন মহান মানুষ যে তোমাকে মারতে পারব না? মহান মানুষরাই বেশি আপন মানুষদের দ্বারা খুন হয়েছে! ফরহাদ এবার টেলিভিশনটা বন্ধ করে বলল— বলো কী এমন মিশিয়েছিলে কফিতে যে আমাকে শুনতেই হবে? লুনা একটু পেছনে ঝুঁকে বলল— কিছু না! তুমি হঠাৎ এরকম তেড়ে আসলে কেন?
ফরহাদ তেত্রিশটা দাঁত বের করে বলল— আমি জানি কিছু না! তুমি আমাকে মারার চিন্তা করতে পারবে? আমার চেয়ে বেশি তোমাকে কেউ ভালোবাসবে? লুনা মাথা নাড়াল। যার অর্থ— না কেউ পারবে না। বাস্তবে সে সত্যিই ফরহাদের কফিতে বাজে একটা জিনিস মিশিয়েছিল। ভেবেছিল ফরহাদ কফিটা খেয়ে মাতলামি শুরু করবে। আর লুনা এই ফাঁকে ফরহাদকে ধরে চুমো-টুমো খাবে! এর নাম হচ্ছে অ্যালকোহলিক লাভ! আমেরিকায় নতুন ট্রেন্ড হয়েছে। লুনার স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। আমেরিকা সে যেতে পারেনি এখনো। কিন্তু আশা ছাড়েনি। একদিন যাবে। আমেরিকা না গেলেও সে সবসময় আমেরিকায় কী হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর রাখে। কিছুদিন হলো এই অ্যালকোলিক লাভ ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। স্বামীদের কফিতে প্রখর নেশা জাতীয় কিছু মিলিয়ে মাতাল করে দিয়ে। স্বামীকে চুমো-টুমো খেয়ে ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করা।
সিনেমা শেষ হতে হতে লুনা বলল— তোমার ব্যবসার খবর কী? লাখ দশেক টাকা এই মাসে ইনকাম হবে?
ফরহাদ বলল— একদম খারাপ। এবার আরো পনের লাখের মতো লস হবে মনে হচ্ছে। স্টকের মাল সব পচে গেছে!
এই কথা শুনে লুনার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা! সে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল— তোমার এত বড় একটা ক্ষতি হচ্ছে আর তুমি কি না আরাম করে সিনেমা দেখছ? আমি হলে তো কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম! ফরহাদ হেসে বলল— কান্নাকাটি করলে মানুষ টাকা দেয়? কান্নাকাটি করলে মানুষ মায়া করে। আর কিছু না। মানুষের বিপদের সময় কি করা উচিত জানো? শান্ত থাকা। আরাম করা। তাহলেই একটা রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। কী রান্না করেছ? টেবিলে ভাত বারো আমি আসছি। লুনার বুঝে আসে না। এই ছেলে মানুষ না কি? এবার যদি এত টাকা লস হয়। তাহলে রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। অবশিষ্ট মূলধন যা ছিল সব দিয়ে এবার মালামাল কিনেছিল। কী হবে বুঝতে পারছে না সে।
রান্নাঘরে ঢুকতেই মনে হচ্ছে লুনার মাথা ঘুরাচ্ছে। কৈ মাছের তরকারির মধ্যে তেলাপোকা ঘুরঘুর করছে! সে মাথায় হাত দিয়ে ভাবল আজ আর বুঝি ফরহাদের খাওয়া হলো না! রাতে কৈ মাছ দিয়ে খাবে। কত আশা করে সন্ধ্যার পরে পায়ে হেঁটে গিয়ে সে কৈ মাছ আনলো। আর কৈ মাছের তরকারিতে না কি তেলাপোকা পড়েছে! ভালো করে ঢেকে রাখলেই তো হত। সে আস্তে আস্তে পা ফেলে ফরহাদের কাছে গেল আবার। নরম স্বরে বলল— কৈ মাছের তরকারিতে তেলাপোকা পড়েছে! এখন কী হবে? ফরহাদ টেলিভিশনের দিকে তাকিয়েই বলল— তাহলে ডিমভাজি করো। তরকারিতে তেলাপোকা পড়েছে এর মানে এই না তো যে অন্য তারকারি রান্না করা যাবে না।
লুনা দীর্ঘশ্বাস নিল। সবকিছুই কেন ফরহাদ এত সহজভাবে মেনে নেয়? সবকিছু সহজভাবে মেনে নেওয়া ঠিক না। এখন যদি রাগ করে দুয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিত ফরহাদ তখন কী হত? আরেকবার এমন করে ঢাকনা খুলে রাখত না সে। গরম গরম ডিম ভাজি করে লুনা টেবিলে ভাত বেরে বলল— খেতে এসো। ভাজি হয়ে গেছে। ফরহাদ টেলিভিশন বন্ধ করে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। লুনার মুখটা কালো হয়ে আছে। ফরহাদ বলল— মুখ কালো করে রেখেছ কেন?
— তোমার এতগুলো টাকা লস হবে!
— ব্যবসায় শুধু লাভই হবে? লস হবে না?
— তাও!
— চিন্তা করো না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
— আমি কি মাকে ফোন করে বলব কিছু টাকা পাঠাতে? যেন তুমি আবার স্টক করতে পারো।
— নাহ। অন্যের সাহায্য নিয়ে অভ্যাস করলে পরে যেকোনো কিছুতে অন্যের সাহায্য লাগে। তারচেয়ে বরং আমরাই একটা ব্যবস্থা করব।
— ব্যাংক লোন দেবে তোমাকে? একবার তো নিয়ে ফেলেছ।
— টাকার চিন্তা তুমি করছ কেন? তুমি লেখাপড়ায় মন দাও। যেন স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকায় যেতে পারো।
লুনা মাথা নুইয়ে বলল— আমি আর কলেজে যাব না! ফরহাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল লুনার দিকে। তারপর বলল— তোমাদের মেয়েদের সমস্যা কি জানো? নিজের আত্মসম্মানবোধের জায়গাটা তৈরি করো না। পরে শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছ থেকে নানান কথা শুনো। তখন মরে যেতে চাও। আগে কিছু একটা চেষ্টা করে দেখলে সমস্যা কী?
লুনা বলল— তুমিও কি এমন বলবে?
— অবশ্যই বলব। বসে বসে খাওয়ার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো না? লুনা মাথা তুলে আবার ফরহাদের দিকে তাকাল। সেই স্কুলে থাকতে ফরহাদের সাথে পরিচয়। তিন বছরের প্রেম। তারপর বিয়ের এক বছর হতে চলল। কখনো এমন কথা বলে না ফরহাদ। কত ঝড়ঝাপটা গেছে জীবনে। এখনো তাঁদের পরিবার বিয়েটাকে মেনে নেয়নি। আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে হচ্ছে। শুধু লুনার মায়ের সাথে কথা হয়। সে ভাবতে পারছে না ফরহাদ এমন একটি কথা বলতে পারবে। সে চোখের পানি মুছে বলল— লবণ কম হয়ে গেছে। একটু লবণ নিয়ে নাও।
লুনা পরদিন থেকে মন দিয়ে পড়া শুরু করল। উদ্দেশ্য স্কলারশিপ। ছাত্রী হিসেবে সে খারাপ না। অষ্টম শ্রেণি ও এসএসসি। দুটোতেই অ্যা প্লাস পেয়েছে। দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পরে লুনা স্কলারশিপ পেয়েই গেল। রাতদিন এক করে দিয়ে সে পড়ালেখা করেছে। যার ফল সে হাতেনাতে পেয়েছে। এর মাঝে ফরহাদ আরো অনেক কিছু বলেছে তাঁকে। মাঝেমধ্যে হাতও তুলেছে। লুনা কান্না করতে করতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। তবুও পড়ালেখার ক্ষতি হতে দেয়নি। আরো বেশি মনোযোগ দিয়েছে। স্কলারশিপ না হোক। দেশেই যেন একটা কিছু করতে পারে সেই আশায়।খুশির খবরটা সর্বপ্রথম ফরহাদকেই দিল লুনা। ভেবেছিল ফরহাদ আনন্দে তাঁকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ফরহাদ বলল— অহ, ভালো হয়েছে। লুনা বলল— তুমি খুশি হওনি? এভাবে অহ বললে যে!
— আমার খুশি আর অখুশি দিয়ে তোমার কিছু আসে যায়? তুমি তো এখন শিক্ষিত মানুষ। আমি মূর্খ। শিক্ষিতদের খুশির খবরে মূর্খরা খুশি হয় না। কথাগুলো গুলির মতো লুনার গায়ে লাগল। কোনোদিনও এরকম কথা সে ফরহাদকে বলেনি। ফরহাদের আচরণ দিনদিন অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে সয়ে যায়। কারণ এই ছেলেটির জন্যই একদিন সে ঘর ছেড়েছিল। আমেরিকা যাওয়ার ফ্লাইট হয়েছে লুনার। পনের দিন আগেই প্রিন্সিপাল তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে। এর ভেতরেই ফরহাদ এক কাজ করে বসল। যা লুনা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি।
রাতে বাসায় ফিরে দেখে ফরহাদ অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে প্রেমলীলায় মেতে আছে! লুনাকে দেখেও সে থামেনি!
লুনা বুক ফেটে চিৎকার করেছে। ফরহাদের পায়ে ধরেছে। যেন আর তাঁর সাথে এমন আর না করে। অন্য কোনো মেয়ের সাথে ফরহাদকে আরেকবার দেখলে সে আত্মহত্যা করবে। ফরহাদ উত্তরে বলেছিল— তবে তাই কর। আমি নওশিনকে বিয়ে করব। ইউ আর এক্সপায়ার্ড প্রোডাক্ট! এত কিছুর পরেও লুনা বিশ্বাস করত। কমপক্ষে ফরহাদ অন্য আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু ফরহাদ তাই করল। ফ্লাইটের ঠিক পাঁচদিন আগে নওশিনকে বিয়ে করে বাসায় আনলো। এবং লুনাকে বলল— তোর জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যা! তোকে আমার আর সহ্য হয় না। তোকে তালাক দিলাম এই মুহূর্তে। তালাক, তালাক, তালাক! লুনা সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। দুদিন পরে জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার বলল— আপনাকে এক লোক রাস্তায় অজ্ঞান পেয়ে হাসপাতালে এনেছিল। তিনি বাইরে আছেন। লুনা বেরিয়ে দেখল লোকটা আর কেউ না। তাঁরই প্রিয় স্যার, জামশেদ উসমান।
উসমান স্যার তাঁকে বুঝিয়ে কোনোরকম আমেরিকায় পাঠিয়ে দিল। আমেরিকায় টানা এক মাস লুনা নৈঃশব্দ্য থেকেছে। কারো সাথে কথা বলেনি। একের পর এক ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছে। হাসপাতালে ছিল আরো একমাস। মানসিকভাবে সে কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। চোখ বুজলেই তাঁর মনে হয় ফরহাদের প্রথম চিঠির কথা। প্রথম হাত ধরা। লুকিয়ে লুকিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়া। এমন কতকিছু। তাঁর সাথে একটা ছেলে গিয়েছিল নেত্রকোনা থেকে। ছেলেটা সবসময় লুনার পাশে থেকেছে। পরবর্তীতে সে ছেলেটাকে লুনা বিয়ে করে। ছেলেটা তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। নাম মনজুর। মনজুরের দিকে তাকালেই লুনার মনে হয়। পৃথিবীতে দুঃখ বলে কোনো কিছু নেই। পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ হয় না।
পুনশ্চ: লুনা আমেরিকা যাওয়ার এক মাসের মাথাতেই ফরহাদ হাসপাতালে মারা যায়! তাঁর ক্যান্সার ছিল! ডাক্তার কোনো ভনিতা না করে বলে দিয়েছিল দুই মাসের ভেতরে তুমি মারা যাবে। এখন আল্লাহ একমাত্র ভরসা। যদি কোনো মিরাকল হয়। মিরাকলের আসা ফরহাদ করেনি। নওশিন মেয়েটাকে সে ভাড়া করে। নওশিন থিয়েটারে কাজ করত যার ফলে অভিনয়টা অনবদ্য করেছে। ফরহাদ জানত লুনা যদি জানে সে ক্যান্সারের কারণে মারা যাচ্ছে। তাহলে অল্প বয়েসী এই লক্ষ্মী মেয়েটা সারাজীবন একলা কাটিয়ে দেবে। ফরহাদ তা চায়নি।
গল্পের বিষয়:
গল্প