অপরাধের ঐশ্বর্য

অপরাধের ঐশ্বর্য
সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বাসায় ফিরেই বাবা আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি টি জ্বালিয়ে দিলেন।ড্রয়িংরুমে বসে আমি কাজের মহিলার সঙ্গে গল্প করছি।সেই সময় বাবা ঘনঘন কলিংবেল টিপলেন,সদর দরজা খুলে দিতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে দুইতলার সর্বদক্ষিণের রুমে চলে গেলেন।ওটা আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি।
আগামীকাল আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে।হালকা খাবার খেয়ে পড়তে বসবো এই কথা চিন্তা করে ফলের রস নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছি,কাজের মহিলার সঙ্গে গল্প করছি।আমার বাবাকে এরকম উদভ্রান্তের মতো ছুঁটতে এর আগে কখনো দেখিনি।আমি দৌঁড়ে বাবার পেছন পেছন উপরে উঠে গেলাম।ততক্ষণে বাবা লাইব্রেরির সমস্ত আলমিরাগুলো রুমের মাঝখানে জড় করে ফেলেছেন।আমাদের ড্রাইভারকে পেট্রোল নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন।বাবা গাড়িতেই বোধ হয় পেট্রোলের বোতল নিয়ে এসেছেন আজ।ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে এনে দিলেন।বাবা আলমিরাগুলোর এপাশে ওপাশে গিয়ে পেট্রোল ঢালছেন।আমি কান্না করছি আর বাবার সাথে সাথে এপাশ ওপাশ করে ছুটাছুটি করছি।
-বাবা,বাবা আমার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলো না প্লিজ। বাবার পা জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম।বাবা কোনো কথাই বললেন না।দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে যাবে তখন আবার বললাম,
-বাবা বাবা, একটু দাঁড়াও তাহলে।আমার ডায়রি টা আর প্রিয় এক দুইটা বই নিয়ে নিই। ছেলের কোনো আকুতিতেই মন গললো না।বাবাকে ছেড়ে দিয়ে আমি রুমের কার্পেট আর জানালার পর্দা রুমের বাইরে সরিয়ে ফেললাম।দাউ দাউ আগুন জ্বলতে লাগলো।বাবা রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন।আমি দাঁড়িয়েই আছি।বাবা কাজের মহিলাকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে বের করে আনলেন।এখন আমার হাত পায়ে একদম বল নেই।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত শিখা দেখছি আর কাঁদছি।
একেকটা আলমিরার একেক তাকে ধর্মীয় বই,রুশ সাহিত্য,বাংলা সাহিত্য,ইংরেজি সাহিত্য,গ্রীক নাটকের বইগুলো আলাদা আলাদা সাজিয়ে রেখেছিলাম।এমনকি আমার প্রিয় লেখকদের বইগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন তাকে রেখে কাঁচে তালা মেরে রেখেছিলাম।সেগুলো প্রতিনিয়তই পড়ি,বাবা ছাড়া এ রুমে আর কেউ আসে না কিন্তু বই চুরি হওয়ার ভয়ে আমি সেগুলো তালা দিয়ে রাখি। এখন তার সমস্ত কিছুই জ্বলছে।রবিঠাকুর,নজরুল, তলস্তয়,শেক্সপিয়ার সবাই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার সামনে।আমার প্রিয় ডায়রিটাতে দেশের বড় বড় গুনি জনের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম।বাবা একটা বড় কোম্পানির এ্যাডভাইসর।বাবার সাথে বড় বড় প্রোগ্রামে গিয়ে অনেক বড় ব্যক্তিদের নিকট থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছি।সেসবও এখন ছাই হয়ে যাচ্ছে।আমি নির্বাক হয়ে চোখের পানি ফেলছি। বাবা,ড্রাইভার,কাজের মহিলা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত শিখার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি বাবার উপর অনেক বেশি অভিমান করলাম।অভিমানই করলাম কারণ বাবার সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা তাতে অভিমান ছাড়া রাগ করার স্পর্ধা আমার নেই।
চোখ মুছে আমার রুমে গিয়ে পড়তে বসলাম।কালকে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে।এখন পড়তে বসা ছাড়া উপায় নেই।বাবার উপর অভিমান করে আমি রিডিং টেবিলের উপর বই খুলে চেয়ারে বসেছি কিন্তু পড়া হচ্ছে না। আমার চোখ থেকে একেক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে আর বইয়ের পৃষ্ঠা গোল হয়ে ভিজে যাচ্ছে।আমার মা যেদিন মারা গেলেন সেদিন খুব কেঁদেছিলাম।শোকের বাড়িতে সবাই একইরকম শোকে কাঁদে না।কিন্তু যার মা মারা যায় তার শোক অন্য সবার শোককে অতিক্রম করে যায়।
আমার সেদিনের কান্নায় ছিলো বেদনা আর আজকের কান্নায় রয়েছে অস্থিরতা।বই থেকে এক এক লাইন পড়ছি আর আগুনের ছবি চোখের উপর ভাসছে।জোর করে কানে হাত দিয়ে দাঁতে দাঁত রেখে পড়তে লাগলাম। পরদিন পরীক্ষাটা অনেক ভালো হলো।লেখা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেলো কিন্তু কোনো বন্ধুকেই এক লাইনও দেখালাম না আজ।পেছন থেকে অঙ্কিত,রাতুল এরা ডাকাডাকি করছিলো,আমি পেছনেও তাকালাম না।কিন্ত হল থেকে বের হয়ে খারাপ লাগলো আমার।আবার চিন্তা করলাম ঠিকই করেছি কারণ আজকে প্রশ্ন যা হয়েছে তাতে সবাই নাইন্টি পার্সেন্ট মার্ক এমনিতেই পাবে।যে স্টুডেন্ট ফেল করবে নিশ্চিত তাকে পরীক্ষার হল এ বলে দেওয়া যায়,খাতা দেখানো যায় এমনকি তার খাতায় লিখেও দেওয়া যেতে পারে।কিন্ত যে স্টুডেন্ট নাইন্টি মার্ক পাবে তার আবার অন্যেকে এতো ডাকাডাকির কি আছে! গেটের বাইরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বসে আছেন।গাড়ির কাছে না গিয়ে দূর থেকেই ড্রাইভারকে বললাম,
-আপনি বাসায় চলে যান।আমি কফি হাউজে যাবো।দেরি হবে বাসায় যেতে।আপনাকে আবার অফিসে যেতে হবে বাবাকে নিয়ে আসতে।
-দেরি হোক।কফি হাউজে গাড়িতেই চলেন।স্যার আজ অফিসে যাননি।
-না,আমি আজ রিকশায় যাবো।আপনি বাসায় চলে যান।
কাল রাতের পর থেকে মাথা অনেকখানি ভার হয়ে আছে।কফি খেয়ে ফ্রেশ লাগছে এখন।আরো দুই কাপ খেলাম।টাকা দিতে গিয়ে ঝামেলা টা হলো।হাত দিয়ে দেখি পকেটে টাকা নেই।পরীক্ষার হলে আজ পেন্সিলও নিয়ে আসতে ভুলে গেছি।এরকম তো হয় না আমার!
-আঙ্কেল টাকা আনতে ভুলে গেছি! ম্যানেজার দ্রুত আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।ভালো করে দেখে মুচকি হাসলেন।
-আচ্ছা কালকে দিয়ে যেও।কালকে না হয় তার পরদিন দিও।তা না হলে তার পরদিন দিও।এভাবে চার পাঁচবার তার পরদিন তার পরদিন বলতে বলতে শেষে হেসে দিলেন। আমিও হেসে দিলাম কিন্তু ওনার মতো শব্দ করে হাসতে পারলাম না।পেছন থেকে বাবা আমার কাঁধের উপর বাম হাত রেখে ডেবিট কার্ড ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিলেন।এরকম সময়ে এখানে বাবাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি কিন্তু আমার মুখে হাসিটা স্থায়ী হলো না। টাকা মিটিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় নজর পড়লো আমাদের ড্রাইভারের দিকে।দেখলাম সে হাসছে।বাচ্চাদের ভূতের ভয় দেখিয়ে সফল হলে বাবা মা বা বড় ভাইবোন যেমন আনন্দ পায় ড্রাইভারের ঠোঁটে ঠিক সেরকম হাসি।
বাবাকে বললাম,
-আজকে চলো অনেক দূর থেকে ঘুরে আসি।তুমি আর আমি। বাবা ড্রাইভারকে কয়েকট টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে রিকশা যোগে বাসায় চলে যেতে বললেন।ড্রাইভারকে ঠিক তার সেই একটু আগের অহংকার মেশানো বিজয়ের হাসিটা আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম।সে বাসায় ফিরে গেলে আমি আর বাবা হাইওয়েতে চলতে আরম্ভ করলাম। কালকের ঘটনার পর এখন আমার স্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে বাবা কোনো বিস্ময়ই প্রকাশ করছেন না।
-কালকে লাইব্রেরিটা কেনো জ্বালিয়ে দিলাম জিজ্ঞাসা করলি না?
-বাবা,কালকে সন্ধ্যায় তোমার পা জড়িয়ে ধরে আমার আহাজারি করার কথা কি তোমার মনে পড়ে?এরপরও তুমি চাও আমি প্রশ্ন টা জিজ্ঞাসা করি! বাবার দিকে না তাকিয়েই কথাটা বললাম।বাবা কথাটা শুনে কিছুটা দমে গেলেন।
-আচ্ছা শোন।কালকের আগের দিন আমার বস মানে আমাদের কোম্পানির এমডি আমাদের বাসায় এসেছিলো তোর মনে আছে নিশ্চয়?
-হ্যা মনে আছে।
-স্যার গতকাল বিকালে আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন তোমার বাসার লাইব্রেরিটা এক ঘন্টার মধ্যে জ্বালিয়ে দিতে হবে।
এবং পুড়িয়ে ফেলার আগে একটা পৃষ্টাও সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে না।আমি বললাম স্যার লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে তো! সেগুলোও পুড়ে যাবে।তার চেয়ে আমাদের লাইব্রেরিতে আপনার কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বললে আমিই সেটা সমাধান করার চেষ্টা করলে ভালো হতো না? কিন্তু স্যার আমার সামনে টেবিলের উপর একটা চেক এগিয়ে দিয়ে বললেন,এখানে যে এ্যামাউন্ট লেখা আছে তাতে তোমার বইগুলো চারবার কেনা যাবে।কিনে নিও।বাট আই ওয়ান্ট টু সি ইউর পার্সোনাল লাইব্রেরি টার্নড্ ইনটু এ্যাশেশ উইদিন এ্যান আওয়ার।আমি বাসায় ফিরে লাইব্রেরিটা জ্বালিয়ে দিলাম।
-কিন্ত বাবা, শুধু চার পাঁচ গুন টাকা হলেই তুমি ভারত,সিঙ্গাপুর,ইংল্যান্ড থেকে যে বইগুলো কিনেছো সেগুলো হটাৎ করেই পেয়ে যাবে?নিশ্চয় পাবে না।আচ্ছা বাবা,তোমার বস যে এই কাজটা করলেন তোমার একটুও ডাউট হচ্ছে না তিনি এরকম টা কেনো করবেন?
-হ্যা নিশ্চয় সন্দেহ হয়েছে কিন্তু কি ই বা করার ছিলো! আমি বাবার কথার উত্তর দিলাম না।জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বাইরে বের করে দিলাম।বাতাস এসে আমার মুখে লাগছে, রাস্তার পাশের গাছগুলো নিমিষেই পেছনে ধেয়ে চলেছে,বেশ ভালো লাগছে।গাড়ি সামনে এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে।এরপর কিছুক্ষণ দু’জনের কেউই কোনো কথা বললাম না। রাতে বাবা আমার রুমে আসলেন এক বাটি আইসক্রিম নিয়ে।অন্যদিন আইসক্রিম দেখে আমি যে লোভনীয় দৃষ্টি দেই আজকে সেটা পারলাম না।আমি এক পলক বাবার দিকে তাকিয়ে আবার ক্যানভাসে পেইন্টিং করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।আবার মাথা তুলে বললাম,
-বাবা,বসো এখানে।
-পেইন্টিং এ যে বিষয়গুলো আঁকতে হয় সে বিষয় টা ফুটিয়ে তোলার জন্য পেইন্টিং এ কিছু স্পেস রাখতে হয়।ক্যানভাসে কিছু জায়গা ফাঁকা রাখতে হয়।আজকের ছবিতে তুই যে বিষন্নতা ফুটিয়ে তুলতে চাইছিস,সেজন্য ডান দিকের উপরে আরেকটু কম রং ব্যবহার করতে হবে।সাদা রং দিয়ে ওই জায়গা টা ঢেকে দে। বাবা সামনে এগিয়ে এসে আমার পেইন্টিং খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলেন আর এই মন্তব্য করলেন।
-বাবা,আমি পেইন্টিং টা তে বিষন্নতা ফুটিয়ে তুলতে চাইছি আর তুমি সেটাকে আরো সহজ করে দিচ্ছো?
-তাহলে পেইন্টিং টা আরো সুন্দর দেখাবে।এজন্যই তো তোকে বললাম। বাবা ক্যানভাসের দিকে তাকিয়েই আমার কথার জবাব দিলেন।
-কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বলবে এই ক্যানভাসটা ফেলে দিয়ে নতুন একটাতে ভিন্ন কিছু আঁকতে।যেটা আঁকলে আমার মন ভালো হয়ে যাবে।যেখানে বিষন্নতার বদলে সুখানুভূতির কিছু অঙ্কিত হবে। বাবার চোখের দিকে তাকালাম।এই কথাটা শুনে বাবা আগের কথাটা অনুধাবন করতে পেরেছেন।অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন।
-মাই বয়,ক্যানভাসে সুখের আঁচর থাকুক বা দুঃখের সেটা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেলেই কিন্তু আর্টিস্ট সফল।আচ্ছা যাইহোক।তোর মনে যেন বিষন্নতা আর না থাকে সেজন্য আমরা আগামীকাল থেকেই বই কিনতে আরম্ভ করবো।যত বই নষ্ট হয়েছে তারচেয়ে বেশি কিনবো এবার।
ক্যানভাস ছেড়ে এসে আমি বাবার সঙ্গে দুজনে মিলে আইসক্রিমটা খেয়ে ফেললাম।আর কালকে কোথায় কোথায় ঘুরে বই কিনবো সেটা আলোচনা করলাম।আমার তিনটা পছন্দের জায়গার মধ্যে একটি হচ্ছে বইয়ের বড় দোকান।বাবা জিজ্ঞাসা করলেন অন্য দুইটি পছন্দের জায়গা কোনটা কোনটা।আমি বললাম কবরস্থান আর নার্সারি কবরস্থানে গিয়ে দাঁড়ালে অন্যরকম একটা অনুভূতি জাগ্রত হয়।মনের অস্থিরতা দূর হয়ে যায়।মন একেবারে শান্ত হয়ে যায়।আমাকে যদি কেউ বলে “আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না,বিষন্ন লাগছে” তাদের প্রত্যেককেই আমি কবরস্থান যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।সেই পরামর্শ শুনে কেউ কেউ ধন্যবাদ দিয়েছে আবার কেউ কেউ আমার দিকে তাকিয়ে অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছে। আর নার্সারি ভালো লাগে কারণ সেখানে কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসা করে প্রচুর নতুন নতুন গাছের নাম জানা যায়।আমার এটা ভালো লাগে।
পরদিন সকালে বাবা আর আমি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম।যতদূর সম্ভব ভালো বই কিনে ফেলবো।গতদিন বইয়ের সঙ্গে আলমিরাও সবগুলো পুড়েছে।শুধু বই আর আলমিরাই না, ঘরের সিলিং এর রং ও কালো হয়েছে গিয়েছে আগুনের ধোঁয়ার কারণে।সেখানে নতুন করে রং করতে হবে,আলমিরা কিনতে হবে এভাবে আমার আবার লাইব্রেরি তৈরি হবে।সারাদিন ঘুরে ঘুরে অনেক বাছাই করে শ’খানেক বই কিনতে পেরেছি সেদিন। কিন্ত সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আমার মন টা আবার দমে গেলো।বাসার সামনে দেখলাম বাবার কোম্পানির এমডি স্যার গাড়ি পার্কিং করে নিজের গাড়ির উপরে বসে আছেন।তাকে দেখে আমার চোখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ দেখা গেলেও বাবার চোখে আমি ভয় দেখতে পেলাম।আমি আমাদের গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম, বাবা তার স্যারের দিকে এগিয়ে গেলেন।
– হ্যালো মি. মুরাদ।আই এ্যাম ওয়েটিং হেয়ার ফর হাফ এ্যান আওয়ার।হয়্যার ওয়্যার ইউ।ইভেন ইউ ডিডন্ট টেক ইউর সেলফোন উইথ ইউ। বাবার স্যার কথাগুলো বললেন এক প্রকার ধমকির সুরে।বাবা সরি বললেন তাকে।
-দেখো আমি সহজভাবে একটা কথা বলতে এসেছি, বলেই চলে যাবো।মনোযোগ দিয়ে শোনো।
আমার বাবা বললেন,
-স্যার আপনার অফিসে কাল ডাকলেই তো আমি চলে আসতাম।আপনি এখানে আসতে গেলেন কেনো!
-আমার প্রতি তোমার আজকের এই অযাচিত অনুগত্য আমার পছন্দ হচ্ছে না একদমই।যাহোক আমি যেটা বলতে এসেছি সেটা হলো তোমার বাড়িটা আমি কিনে নেবো।ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই,বাজার মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি দাম পাবে তুমি।আর তোমার কাজের মহিলাকে আমি খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো। বাবা জড়ানো গলায় বললেন;স্যার,আপনার ওয়াইফ আছে তারপরও একটা কাজের মহিলাকে শুধু শুধু…। বাবা এইটুকু বলার সাথে সাথে বাবার স্যার হাত উঁচু করে বাবাকে থামিয়ে দিলেন। এইসব আলোচনার মাঝে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একদম পছন্দ করলাম না।বাসার ভেতরে চলে গেলাম।স্যারের সাথে বাবার বাগবিতণ্ডা চলছে এখনো।
বাড়ির সদর দরজা পাড় হয়ে দেখলাম আন্টি সোফার উপর শুয়ে আছেন।চোখ দিয়ে তার অঝোরে পানি ঝরছে।মুখ মলিন,এক দৃষ্টিতে ঝাড়বাতির দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই কোনো কথা না বলে আন্টি নিজের ঘরে চলে গেলেন। সবকিছু ওলট-পালট লাগছে আমার কাছে।প্রচন্ড তৃষ্ণা পাচ্ছিলো এতক্ষণ।কিন্তু পানি পান করার কথা ভুলে গেলাম।সোফার উপর বসে মুখে হাত দিয়ে বসে আছি।কয়েক মিনিট পর বাবা বাসার ভেতরে ঢুকলেন।বাবার চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে তার বস এই বাড়ি কিনে নিয়েই ক্ষান্ত হবেন এবং আন্টিকে বিয়েও করবেন। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং স্পর্ধার সঙ্গে বললাম,
-বাবা তুমি কালকেই এই অফিসে রিজাইন দিয়ে অন্য কোম্পানিতে জয়েন করবে।তুমি নিজেই বলেছো গত মাসেও অন্য দুইটা কোম্পানি তোমাকে বেশি সেলারি দিয়ে তাদের কোম্পানিতে জয়েন করার জন্য অফার দিয়েছে।তাহলে এই স্কাউন্ড্রেলের আন্ডারে থাকবে কেনো তুমি?তোমার স্যার সেদিন এক প্রকার জোর করেই আমাদের লাইব্রেরি টা পোড়ালো।আজকে বললো বাড়িটা কিনে নেবে,আন্টিকে বিয়ে করবে। তুমি এতসব সহ্য করে নিচ্ছো কি করে আমার মাথায় ঢুকছে না। বাবার সাথে এরকম ভাষায় কখনো কথা বলি নাই তাই হটাৎ করেই এইটুকু বলে থেকে গেলাম।বাবাও নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকালেন।
-ইচ্ছা করলেই রিজাইন দিতে পারবো না আমি।একটা কমিটমেন্ট আছে না?
-বাবা,তুমি তোমার বস এর সাথে শেয়ারে বিজনেস করো না যে পাঁচ দশ বছরের কমিটমেন্ট থাকবে আর সেজন্য তুমি শেয়ার ভেঙে দিতে পারবে না।তুমি তার কোম্পানির একজন উপদেষ্টা।মানে একজন কর্মকর্তা।যখন ইচ্ছে রিজাইন দিয়ে অন্য জায়গায় জয়েন করার রাইট রাখো তুমি। বাবা এবারও চুপ রইলেন।বাবার এরকম নির্লিপ্ত ভঙ্গি দেখে আমি সত্যিই হকচকিয়ে যাচ্ছি।কোথায় বাবার সেই তেজস্বীতা,কোথায় সেই এ্যাটিচিউড! বাবার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে চেয়ে বললাম,
-বাবা,তুমি কি আসলেই তোমার স্যারের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাকি তুমি ব্লাকমেইলড?মানে এমন কিছু আছে তোমার আর তোমার বস এর মধ্যে যার দরুন তুমি তোমার বস এর কোনো কথা ফেলতে পারছো না?
বাবা এবার হতাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন কিন্তু নৈতিক দূর্বলতার কারণে আমাকে কোনো ধমকি দিতে পারলেন না।সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত দুই তলায় উঠে গেলেন। আমি সোফায় বসে একটা জিনিস মেলাতে চেষ্টা করলাম।বাবা কি তাহলে এজন্যই আমাদের কোটি টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখে একটা বেতনভুক্ত কর্মকর্তার চাকরি করছেন!আর বাবার বস বাবার একটা অপরাধকে ইস্যু বানিয়ে একের পর এক কাজ করিয়ে নিচ্ছেন বাবাকে দিয়ে।আমার লাইব্রেরি,আমাদের বাড়ি এগুলো হাতছাড়া হোক সমস্যা নেই।এরকম আরো কয়েকটা বানানোর টাকা ব্যাংকে আমাদের আছে।তাই বলে আন্টিকে বাবার ব্লাকমেইলের স্বীকার হতে হবে!ওই স্কাউন্ড্রেল বসকে বিয়ে করতে হবে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম।আমার চোখ এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে। আমার চিন্তার দরজা খুলে গেছে।আজ সন্ধ্যায় এই এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে আমার জীবনে অভিজ্ঞতার এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো।হটাৎ করেই একটা লাইন মনে পরে গেলো “বিহাইন্ড এভরি ওপিউলেন্স দেয়ার ইজ আ ক্রাইম”-প্রতিটা ঐশ্বর্যের পেছনে থাকে একটি করে অপরাধ।
আমাদের ঐশ্বর্যও বাবা এরকমই গড়ে তুলেছেন বোধ হয়। আন্টির মুখটা আমার হটাৎ মনে পরে গেলো।তার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত