‘আমরা’ যখন ‘আমি’তে এসে ঠেকল, সেই মুহূর্তেই দাদনের ভিক্ষুক সত্তাটা পুরোপুরি চাগিয়ে উঠল। এখন পর্যন্ত সে কেবল একটা বেছে নেওয়ার বিষয় ছিল, এবার হয়ে উঠল অবধারিত। রাত তে-প্রহরে যখন নীতা তার সহধর্মীকে বলল, ‘বাকি জীবন কি আমি এভাবেই চলব? তোমার বাবার পেনশন দিয়ে কত চলে?’ দাদন তখন একমনে ফেসবুকে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত একটি লেখা পড়ছিল এবং অতিশয় কাকতালীয়ভাবেই সেই লেখাটির নাম ছিল ‘বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের শরণ ভিক্ষা: নিজ গৃহে আগন্তুক।’ তখনো অপেক্ষমাণ অবসাদ দাদনকে আক্রান্ত করেনি, কেবল নীতার উচ্চারিত প্রথম বাক্যের ‘আমি’ শব্দটি তার মাথায় ঢুকে গেল আর বিয়ের কলমা পড়ার দিনের মতোই তার অবচেতন মন আপনা আপনিই উচ্চারণ করল, ‘কবুল।’
অবসাদের অপেক্ষা ফুরোল যখন পরদিন ভোরবেলাতেই কাজের বুয়া বাসায় ঢুকেই ঝগড়া লাগিয়ে দিল। দাদনের অস্থির ঘুম ভাঙল এই দুটি বাক্য শুনে, ‘কামের অভাবনি? মানুষ থাকলে কাম আছে, কাম থাকলে মানুষ আছে, বহুত দেখছি, এগারো বছর দইরা ঢাকাত কাম করি।’
অপেক্ষমাণ অবসাদ দাদনকে এবার আক্রান্ত করল, সে সকালে তার পেট পরিষ্কার হলো না এবং ‘মানুষ থাকলে কাম আছে, কাম থাকলে মানুষ আছে’ বাক্য দুটি উপর্যুপরি তার ঘিলু মন্থন করতে লাগল। মনস্থির করতে এবার আর তেমন অসুবিধা হলো না। বিকেলেই তাকে একটি ছাপানো কাগজ হাতে ওয়ার্ড কমিশনারের জনাকীর্ণ কার্যালয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। কমিশনার একেক দর্শনার্থীর সঙ্গে একেক মেজাজে কথা বলছেন। হঠাৎ অল্পবয়সী একটা ছেলেকে ঠাস করে চড় মারলেন। বদ্ধ কার্যালয়ে চড়ের শব্দটা সবাইকে চকিত করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কমিশনারের হুংকার, ‘শুয়োরের বাচ্চা, এই নিয়া তিনবার তোর বাপরে ডাকছি, তোরেও ডাকছি। পাঁচবার সাবধান করছি। এরপরও তোরা ঠিক হস নাই। আবার যদি শুনি, তোর বাপের সামনে তোরে চড়ামু। তা-ও না শুনলে তোর সামনে তোর বাপরে চড়ামু। বেজাতের গুষ্ঠি সব। বেজাতের এলাকার কমিশনার হইছি।’
পরবর্তী দর্শনার্থী এক পান খাওয়া বুড়ো। কমিশনার তাঁকে বললেন, ‘ভাইবেন না। আপনের টাকা আমি তুইলা দিমুনে। আমি থাকতে আপনের টাকা মাইরা খাইব? আপনে চা খাইয়া বাড়িত যান। আপনের পোলা আইছিল হেইদিন নাগরিকত্বের সার্টিফিকেটের লাইগা। আমি ছিলাম না, পাডায়া দিয়েন। সাথে আমার জিনিসটাও পাডায়েন। চা খান।’
পরের জনকে দেখেই কমিশনার গম্ভীর মুখে বললেন, ‘তোমার কেস মিয়া কোনো কেসই না। এইহানে এর চেয়ে দরকারি কাজ নিয়া বহুত মানুষ বয়া রইছে। তুমি আজাইরা কাজ নিয়া আইসা আগে সিরিয়াল দিছ। পিছে যাও মিয়া।’
সুতির শাড়ি পরা এক মহিলা পরের দর্শনার্থী। কমিশনার বিগলিত হেসে নিচু গলায় তার সঙ্গে আলাপচারিতা করতে লাগলেন। দাদনের সামনে শুধু ঘটনা ঘটে চলেছে, কী হচ্ছে সে দেখতে পাচ্ছে, কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না। প্রথম ছেলেটি কেন চড় খেল, তার বাবাকেই বা চড়ানো হবে কেন! পান খাওয়া বুড়ো কার কাছে টাকা পাবে, সে কেন চা দিয়ে আপ্যায়িত হবে! আর এই মহিলার সঙ্গে কী এমন কথা, যা কেউ শুনতে পাচ্ছে না! হাবভাবে মনে হচ্ছে মহিলাও চায়ের হকদার হবে। কেন? সে নিজে কি চড় খাবে, নাকি চা! নাকি তার কেস কোনো কেসই না! মস্তিষ্কের এই বিভ্রান্ত ভাব চোখে প্রকাশ না-করা খুব জরুরি মনে হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে আশপাশে তাকাতেই দুটি চোখে সে নিজের মানসিক বিভ্রান্তিকে ভাসমান অবস্থায় দেখল। একেবারে সনাতন ভিক্ষুকের বেশে তার বাবার বয়সী লোকটা বিভ্রান্তি না চেপেই কমিশনারের দিকে চেয়ে আছে। সাদা ফতুয়া আর লুঙ্গি-পরা, সাদা গোঁফ, চুলহীন মাথা ঘামে চমকাচ্ছে এবং তার হাতে থাকা কাগজটা দাদনের কাগজের মতোই দেখতে।
আচমকা কমিশনার হা হা করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে মহিলাকে বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি রাজি হবেন। একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন, এলাকাবাসীকে নিয়ে আমি আপনার সাথে আছি।’ তারপর জনতাকে উদ্দেশ করে ঘোষণা করলেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানরা আমাদের ভাইবোন। মিয়ানমার সরকার তাদের ওপর যে অনাচার করছে, আল্লাহ তার বিচার করবেন। আমরা কারও সাথে শত্রুতা চাই না, আমরা মানবতার পক্ষে। এই ভদ্রমহিলা একটা এনজিও থেকে এসেছেন, তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে একটা প্রজেক্টে কাজ করছেন। আপনারা যে যা পারেন, আমার কাছে দেবেন, আমি ওনাকে পৌঁছে দেব। এই টাকা রোহিঙ্গা মুসলমানদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।’
কমিশনারের উচ্চ হাসি, রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে মুসলমান এবং ‘আমি জানতাম আপনি রাজি হবেন’-এর সঙ্গে পরের কথাগুলোর কোনো যোগসূত্র না পেয়ে সে আবারও ভিক্ষুকের দিকে চেয়ে দেখল ভিক্ষুক হাতের কাগজের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা তুলে আগের মতোই বিভ্রান্ত চেহারায় কমিশনারের মুখের দিকে চেয়ে আছে।
মানুষ আসতে লাগল, বিদায় নিতে লাগল, কমিশনারের টেবিলে আর্জি জমা হতে লাগল, কেউ চা পেল, কেউ পেল না, এরই মধ্যে একসময় ভিক্ষুকের ডাক পড়ল। কমিশনার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম?’
কফ ঝেড়ে ভিক্ষুক বলল, ‘বসন চৌধুরী।’
‘বলেন, কী অসুবিধা আপনার।’
‘জে, মাগিরি হাই। অনে হাগজ্জানত ছাইন গরি দিলি মাইনষে দয়া গইরত। বেশি হষ্টত আছিদি অবাজি।’
কমিশনার তার এক সহকারীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বাড়ি চিটাগাং না? এই লোক কী বলে আমারে অনুবাদ কইরা শোনাও।’
কাগজটা পড়তে পড়তে কমিশনার বললেন, ‘বুঝতে পারছি ভিক্ষা আপনার পেশা, এই কাগজে সাইন করে দিতে বলছেন। চৌধুরী বংশের মানুষ ভিক্ষুক হয়া গেলেন ক্যামনে?’
‘নদী আঁরে ভিক্ষুক বানাইয়্যি। আঁর সাত বিঘা জমি এহন পানির তলাত।’
‘কন কী! আমারে কইছেন, আর কাউরে কয়েন না, কেউ ভিক্ষা দিব না জানলে। কাম কইরা খান না ক্যা?’
‘হনে হাম দিবু? টেন্গত পুঁজ।’ ভিক্ষুক তার লুঙ্গি তুলে পায়ের ক্ষত দেখাল। কমিশনার পায়ের ছিদ্রের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘গুলির দাগ মনে অইতাছে।’
‘জে। ছোরাওর্দির ছাম্মদি মিছিলত ভিক্ষা গইরতি যাই গুলি লাইগ্গিদে।’
‘মেডিকেলে যান নাই?’
‘পয়সা নাই।’
‘হিন্দু না মুসলমান?’
‘জে, মুসলমান।’
‘হিন্দু অইলে আপনের লাইগা সিগনেচার ছাড়া আরও কিছু করতে পারতাম। কিছু সুবিধা আছে সংখ্যালঘুগো জন্য। আপনে লেখছেন আপনে আমার বিশেষ পরিচিত, কিন্তু আমি তো আপনেরে চিনি না। যাক, লন।’
‘সার, অনের মন বউত ডর। আঁরে গমগরি ন’ ছিনিও সাইন গরি দিয়্যন।’ কমিশনারের সহকারী এই প্রথম ভিখারির কথা ভাবানুবাদ করল, ‘স্যার, বলতেছে আপনার মন অনেক বড়। উনারে ভালো করে না চিনেই আপনি সই করে দিছেন।’
‘বড় মনটন কিছু না মিয়া। আপনের সাত বিঘা জমি গেছে নদীতে, আমার সাততলা বাড়িটা যাইতে পারে ভূমিকম্পে। যান অহন।’
দাদনের স্পষ্ট মনে হলো, প্রমিত বাংলার সঙ্গে মিল থাকা নদীভাঙনের অংশটুকু ছাড়া ভিখারির কথা কমিশনার কিছুই বোঝেননি। ভিখারির দেহভঙ্গি তার উচ্চারিত শব্দকে উপচে গেছে। শুধু শেষের ধন্যবাদের অংশটুকু অনুবাদ ছাড়া বোঝা যেত না।
দস্তখত করা কাগজটা নিয়ে ভিক্ষুক বেরিয়ে গেলে কমিশনারের নজরটা কী করে যেন দাদনের ওপর এসে স্থির হলো, হাত তুলে ডাকলেন।
‘তুমি খবির ভাইয়ের বাড়িতে থাকো না?’
‘জি, না। আনোয়ার সাহেবের চারতলায় থাকি।’
‘বাবার নাম কী? শরফুদ্দিন? ওহো, তোমার বাবার সঙ্গে সেদিন দেখা হয়েছিল। তোমার কথা বলল। তোমার নাকি আরও আগেই আসার কথা? চাকরি নিয়ে কী যেন ভেজাল।’
আপাতদৃষ্টিতে ভিক্ষুকের অনুরূপ একটা কাগজ দাদনও বাড়িয়ে দিল। কমিশনার সেটা পড়তে পড়তে বললেন, ‘একটা বিষয় লিখতে ভুলে গেছ-ছেলেটি আমার বিশেষ পরিচিত-কথাটা লিখলে আরেকটু জোরদার হতো। যাক, অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার সিগনেচারে কী হবে বলো? কোনো মন্ত্রী বা সচিবের কাছে যাওয়া যায় কি না দেখো। আর যদি তাদের কাউকে দিয়ে একটা ফোন করাতে পারো, সবচেয়ে ভালো।’
‘তেমন কেউ তো নেই, কাকা। আমরা ছোট মানুষ, আমাদের পরিচিত আপনিই আছেন। এমপি সাহেবকে যদি আপনি একটু বলেন…’
‘দেখি। আমি সিগনেচার করে দিচ্ছি, ফোনও করে দেব, পারলে কালই যাও। উনি একসময় আমার বাড়িতে ভাড়া ছিলেন। একসাথে অনেক আড্ডা দিয়েছি। এইটুকু পরিচয়ে যদি কিছু হয় হবে। তোমার নাম দাদন সরকার? ব্রিটিশ আমলে দাদন প্রথা ছিল, দাদন সরকার একটা অফিশিয়াল ডেজিগনেশন ছিল। কে রেখেছে নাম?’
‘আমার দাদা। উনি ব্রিটিশ আমলে দাদন সরকার ছিলেন।’
‘নাম দেখে তো হিন্দু না মুসলমান বোঝার উপায় নেই।’
‘জি, মুসলমান।’
‘সেটা আমি জানি। সিভিতে সবার আগে নামটা চোখে পড়ে, জানো তো? কিন্তু একটা চাকরি না তুমি করতে? ছেড়ে দিয়েছ?’
অপরাধীর মতো মুখ করে দাদন বলল, ‘জি। অথরিটির সাথে বনিবনা হচ্ছিল না।’
‘ওটা তো সংসার না যে বনিবনা না হলে তালাক দিয়ে চলে আসবে। ওখানে দরকার আনুগত্য। যাক, সিগনেচার করে দিচ্ছি। এটা নিয়ে তার কাছে চলে যাও, দেখো কী হয়।’
কমিশনারের কার্যালয়ের বাইরে একটা ছোটখাটো শোরগোল শুনে দাদন এগিয়ে দেখল সেই ভিক্ষুক কমিশনারের সুপারিশপত্র গলায় ঝুলিয়ে তাঁরই কার্যালয়ের সামনে ভিক্ষায় বসে গেছে। কমিশনারের কিছু সেবক তাকে সেখান থেকে সরাতে চাচ্ছে। ধাক্কাধাক্কির উপক্রমের একপর্যায়ে ভিক্ষুক বলে উঠল, ‘কমিশনার সাআব পারমিশন দিয়্যি। এই দেশত যেহোন জাগাত আঁর ভিক্ষা গরিবার অদিকার আছে।’ কিছুতেই তাকে বোঝানো যাচ্ছে না। একসময় কমিশনার নিজে বেরিয়ে এলেন। ভিক্ষুকের সামনে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বললেন, ‘শোনেন চাচা মিয়া, পেপার পড়েন?’
একমুহূর্ত চিন্তা করে ভিক্ষুক বলল, ‘জে না।’
‘ওহ, অসুবিধা নাই। শোনেন, আপনার অবশ্যই এইখানে ভিক্ষার অধিকার আছে। তবে অধিকার থাকলেই সব জায়গায় সবকিছু করা যায় না। এই যে রোহিঙ্গাগো কথা ভাবেন। মিয়ানমারে তাগো থাকার অধিকার আছে, বাপ-দাদার ভিটা। কোন দেশে তারা বাস করতাছে, সেইটাই দেখার বিষয়। জন্মসূত্রে তো তারা নাগরিক। কিন্তু এই অধিকার কি তারা পাইতাছে? এই দেশেও কিছু সমস্যা আছে। সরকার বহুত এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করছে। এহন এলাকার এমপি সাব যদি জানতে পারে তার দলের লোক হইয়া আমি অফিসের সামনেই ভিক্ষুক বসাইছি, তাইলে সম্মান থাকব? আপনে এইখানে ছাড়া যেকোনো জায়গায় গিয়া ভিক্ষা করেন, কোনো অসুবিধা হইলে খালি আমারে জানাইয়েন।’
ভিক্ষুক এবার খুঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। তার হাতে শূন্য থালা, গলায় ভিক্ষার সুপারিশপত্র। দাদনের মনে হলো চাকরির সুপাশিপত্রটা গলায় ঝুলিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার গলাটা কোনো একটা কোম্পানির পরিচয়পত্র ঝোলানোর জন্য। ‘মানুষ থাকলে কাম আছে, কাম থাকলে মানুষ আছে’-দৃশ্যমান দরিদ্র পরিবারে জন্ম না নেওয়ার একটা আক্ষেপ এই প্রথম তার মধ্যে জন্ম নিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ধীর-অদম্য ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া ভিক্ষুকের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করল। ভিক্ষুকের কাছে গিয়ে বলল, ‘কাকা, আপনার বাড়ি কই?’
সন্ধ্যাত্তীর্ণ আলোয় দাদনের দিকে একবার চেয়ে ভিক্ষুক বলল, ‘কীল্লাই?’
‘আপনার এই কাগজটা বৃষ্টি নামলে নষ্ট হয়ে যাবে। আসেন লেমিনেটিং করে দিই।’
কম্পিউটার সার্ভিসের একটা দোকান কাছেই ছিল, কমিশনারের কার্যালয়ের পাশে এসব থাকতে হয়। ভিক্ষুক সুরক্ষিত ভিক্ষার সুপারিশপত্র হাতে নিয়ে দাদনকে বলল, ‘অনেরটা গরিবেন না?’
‘না। আমারটা ক্ষণস্থায়ী। কালই এর মেয়াদ শেষ হবে, চাকরি হোক বা না হোক।’
‘আশীর্বাদ গরি।’
দাদন একটা পাঁচ টাকার মুদ্রা বের করে বলল, ‘আসেন, প্রথম ভিক্ষাটা আমি দিই।’
সে ও ভিক্ষুক মুখোমুখি।
দাদনের চাকরিটা হলো না। সে আমি থেকে আমরা হয়ে উঠতে পারল না। চাকরির বিশাল বাজারে একটা ছোট এলাকার কমিশনারের সুপারিশপত্র ঝোড়ো বাতাসে শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল। দাদনের আফসোস হলো, কোনো একটা ছোটখাটো কোম্পানিরও যদি শাখা অফিস এই এলাকায় থাকত, তবে কমিশনারের দস্তখতটা কাজে আসত। ভিক্ষুকের অবশ্য একটা আশ্রয় হলো, খালের কালো স্রোত পেরিয়ে মূল রাস্তায় ওঠার জন্য প্রাচীন পাকা সাঁকোটির ওপর। ভিক্ষুকেরা কোম্পানির ধার ধারে না, কাজেই সে কমিশনারের এলাকাতে তাঁরই সুপারিশপত্র গলায় ঝুলিয়ে দু-বেলা খাচ্ছে। দাদনের সাঁকো পারাপার এবং ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া যুগপৎ চলতে থাকে। সামাজিক বেকারের বাসায় বসে থাকা একটা অপরাধবিশেষ। পথ বরং দাদনের পছন্দ, কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না, তার উত্থান-পতনে কারও সেখানে ভ্রুক্ষেপ নেই। কাজেই তাকে সাঁকো পেরোতেই হবে। আর কাজই-বা কী তার! নিজের ঘরে ভিখারিবেশে থাকার চেয়ে এই যেন ভালো।
এ রকম সাড়ে তিন মাস কেটে গেল। ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া থামেনি, চাকরির অনুসন্ধানও থামেনি। ভিখারির সঙ্গে তার শেষ দেখার দিন যখন সে এলাকার সাঁকোতে উঠল, তখন রাত ১০টার একটু বেশি। ভিক্ষুক এখনো সেখানে বসে আছে, অর্ধনিমীলিত চোখে সে মানুষের যাতায়াত দেখছে। দাদনের মনে হলো ভিক্ষা একটা সাধনা। প্রত্যেক পথচারি ভিখারির জন্য একেকটি আশা নিয়ে আসছে। এদের যে কেউ তাকে ভিক্ষা দিতে বা না দিতে পারে। কেবল দাদনের ব্যাপারে ভিক্ষুক নিশ্চিতভাবেই জানে যে সে ভিক্ষা পাবে এবং কিছুক্ষণ গল্প করতে পারবে, সঙ্গে সঙ্গে এক কাপ চা-ও খাওয়া যাবে। একজন মানুষকে দেখা গেল পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা গুনতে গুনতে আসছে, ভিক্ষুক ভিক্ষার থালাটা আরেকটু বাড়িয়ে দিল। অথচ লোকটা মানিব্যাগ আবার পকেটে ঢুকিয়ে নির্বিকার চলে গেল। ভিক্ষুক হতাশ হতে না হতেই আরেকজনকে আসতে দেখা গেল, সে যেতে না যেতেই আরেকজন আসবে। পেশাগত কারণেই এই লোকটার হতাশ হওয়ার বিশেষ সুযোগ নেই। ভিক্ষুকের এই আশায় ভরা জীবন দেখে দাদনের ক্লান্ত শরীর-মন ভিক্ষুকের পাশেই এলিয়ে বসে পড়ল। ভিক্ষুক আর সে, পাশাপাশি। তাকে দেখেই ভিক্ষুক বলল, ‘আঁই বেশিদিন নাই।’
‘মরে যাচ্ছেন?’
‘এই দেশত্তুন যাইয়ুম।’
‘বিদেশ যাবেন? ভিক্ষুক ভিসাও চালু হয়েছে নাকি? ট্যাক্স দিতে হবে কত পার্সেন্ট? হা হা।’
‘হউন ন যাইবু। রাজনৈতিক জামেলা আছে। অনেরে আই মিছা কতা ন’ হইয়ুম।’
‘রাজনৈতিক ঝামেলায় আমিও আছি। বিরাট ঝামেলা। আপনার আর আমার মধ্যে এখন কোনো তফাত নাই। বলেন।’
‘আই বডার ফার অই আইস্যি। বার্মা ত্যুন।’
দাদন এবার সোজা হয়ে বসে, ‘রোহিঙ্গা?’
‘জে।’
‘আপনার তো টেকনাফ থাকার কথা।’
‘এন্ডে তাহন ন’ যায়। পশুর নাহান জীবন।’
‘আপনার পায়ের ক্ষত কি তবে নিজেই বানিয়েছেন ভিক্ষার জন্য?’
‘না, পালানোর সময় বার্মার আর্মি গুলি খরসে।’
‘বাংলা শিখলেন কী করে?’
‘ন শিহি। এহন ত আঁরা রিফিউজি। বউত আগে আঁরা বডার ফার গইরতাম। ফড়িত ন’ ফারি, কিন্তু বাংলা বুজিতাম ফারি।’
‘বুঝতে পারেন, কিছুদিন এ দেশে থাকলে বলতেও পারবেন, লিখতেও পারবেন। কিন্তু এই দেশ আপনাকে নেবে না। আবার সীমানার ওই পারে আপনার জন্ম, ওরাও আপনাকে নিচ্ছে না। আমার অবস্থাও তা-ই। আমি আপনার চেয়েও বড় ভিক্ষুক, হাত না-পাতা ভিখারি।’
ভিক্ষুকের কালো চেহারায় দাঁতগুলো বেশ সাদা মনে হলো, ‘হুনন, বিক্ষা গরন হোনো হারাপ হাম নঅ। হোন্ দর্মত নাই বিক্ষা দিবার হতা? হোন দেশত্ বিক্ষা নাই? আর বিক্ষা ন গরিলি দুনিয়া চলিবু কেন্ গরি? আরা অনর দেশত আছ্রয় বিক্ষা চাইয়্যিদি। অনরার দেশ ও কেউত্যুন ন কেউত্যুন কিচু না কিচু বিক্ষা চঅন। হতাশ ন’ অইয়্যুন। আঁরা পরর দেশত মাগি হাই। আন্নের দেশ আচে, নিজর দেশত মাগি খাওনও বালা। আঁর বউ-ফোয়া এহনো টেকনাফ। আঁই এগজনরলাই হতা হয়্যি। আরে বডার ফার গরি দিবু।’
‘কার সাথে কথা বলেছেন? কে বর্ডার পার করে দেবে? রাখাইনে এখন গেলে তো এবার বুকে গুলি করবে আপনার।’
‘রাখাইন ন’ যাইয়্যুম-বর্মা যাইয়্যুম।’
‘কী করতেন ওখানে?’
‘ফুর্বফুরুষের জমি আচিল, চাষ গইরত্যাম।’
‘আমারও পূর্বপুরুষের জমি আছে, চাষ করি না। আমার দাদা নিজের জমি হারিয়ে ব্রিটিশ আমলে দাদন সরকার হয়েছিল। এরপর থেকে আমরা দাদন পরিবার। জমি ফেরত এসেছে, চাষের অভ্যাস আর ফেরত আসে নাই। কিন্তু আপনার ওই জমি তো এখন পাবেন না। পেলেও চাষ করতে পারবেন না। আপনার পায়ের যে অবস্থা!’
‘বিক্ষা গইরগ্যুম নিজের দেশত যাই। আর মন্দিরত ফরি তাইক্কুম।’
‘মন্দিরে কেন? হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে বেশি ভিক্ষা দেয় নাকি?’
‘আঁই হিন্দু। এই দেশত মুসলমানর নাম দইরগি, যেতে কেউ সন্দেহ ন’ গরে, আঁরে যেতে এই দেশর মনে গরে।’
‘কিছুদিন অপেক্ষা করেন। সু চি হয়তো আপনাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হবেন।’
ভিখারির শরণার্থী চোখ জ্বলে ওঠে, ‘আঁই আঁর দেশেত যাইয়ুম। সু চি ম্যাডামের মন গলিবার লাই বই ন’ তাইক্কুম। দেশত যাওনের লাই দুনিয়ার বেয়াকর ফারমিশন লাগিবু নাকি? যে দর্মত গেলি ওই দেশ আঁর অইবু, আঁই হেই দর্মত যাইয়ুম। ফুর্বফুরুষের রাখাইন ছাড়ি দিয়ুম। আঁর দর্মের দরখার নাই, রাখাইন দরখার নাই, আঁই দেশ চাই। দেশ নাই, দর্মও নাই।’
দাদন এবার শরীরটা তুলে বাসার পথে রওনা হয়। ভাবে, কোন ধর্ম ধারণ করলে সে তার দেশে যেতে পারবে! আমি থেকে আমরা হতে পারবে! পেছন থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ভিখারির দিকে চেয়ে থাকে।