গন্ধলেবুর ঝোপ

বাজারখরচার পর হাতে কয়টা টাকা রয়ে গেছিলো তার। তাই দিয়ে কাল দুধ রেখেছেন দুই কেজি। পায়েস রাঁধবেন। কিন্তু উপরে ছিটানোর মতো কিশমিশ নেই। এমন নয় যে, পায়েসে কিশমিশ লাগবেই, মুনিয়ার জন্য দিতে হয়। খুঁটে খুঁটে খায়।

ছোটবেলায়ও কিশমিশ খেতে বাড়াবাড়ি রকম পছন্দ করত মেয়েটা। রাখাই যেত না ঘরে। ওর মেজো কাকা তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। বাড়ি আসত ছুটিছাটায়। বগলবোঝাই রেশন সামগ্রীর মধ্যে কেমন করে জানি থাকত কিশমিশ। এমনকি থাকত আশ্চর্য চমনবাহার! কেউ ডাকত না, কুশল জিজ্ঞেস করত না। তবু কাকার আসার সংবাদ পেয়েই ফ্রক বাতাসে উড়িয়ে কদবেলতলা দিয়ে এক ছুট দিত সে। বেটাইমে গিয়ে হাজির হতো, এক্কেবারে হয়তো দুপুরের খাওয়ার সময়। মেজো কাকীমা তার স্বামী আর তিন ছেলের পাতে বড় বড় মাছের পেটি তুলে দিতে দিতে অনেকক্ষণ বাদে চোখ তুলে মুনিয়াকে দেখতেন। তখন সে মুঠো ভরে কিশমিশ চেয়ে নিত কাকীর কাছে। মা দেখলে পিঠে শলার বাড়ি পড়বে, জানত। তাই ছোট কাকাদের জবাঝাড়ের আড়ালে বসে সেগুলো গিলত। ঘরে ঢুকত মেনিবিড়ালের মতো মুখ করে।

সেই দিনগুলোতে পুকুরঘাট থেকে জায়ের কাছে মেয়ের কিশমিশ চেয়ে খাওয়ার কেচ্ছা শুনে নিজের উঠোনে এসে যেভাবে চিৎকার দিতেন, এখন ঠিক ওইভাবে চেঁচিয়ে বাপান্ত করে উঠতে যান আফরোজা। নিজেকে কোনোমতে সামলান। নামাজ শেষ করেই পুবদিকের জানালা খোলেন এক টান মেরে। তার বোধ-বুদ্ধির চৌহদ্দিতেও কুলায় না ব্যাপারটা। ফজরের ওয়াক্তে লেবুচোর আসে কোত্থেকে! তাও এই হাড়কাঁপুনে শীতের ভেতরে! উঁকি দিয়ে দেখেন আধন্যাড়া কিছু গাছে লটকে আছে ঘন কুয়াশা। জনপ্রাণী কিচ্ছু নেই। যেমন লেবুঝোপ তেমনি আছে, একটা পাতাও ছোঁয়নি কেউ। অথচ একটু আগেই স্পষ্ট খচমচ তার মনোযোগ নষ্ট করেছে। গজগজ করতে করতেই তিনি জানালার কপাট সশব্দে আটকান। ধুপ করে গা ছেড়ে দেন ঠা া বিছানায়। হাঁপাতে থাকেন। মুনিয়াদের বাবা মারা যাওয়ার পর এই পাঁচ বছরে তার শরীর ভেঙেছে খুব, সাথে অবশ্য চেঁচামেচিও বেড়ে গেছে সমানুপাতিক হারে।

তখন পাশের খাটে মুনিয়া নড়েচড়ে বোনের দিকে পাশ ফেরে। মিতুর ঘুম বোমা পড়লেও ভাঙবে না এখন। টিনের চালে কুয়াশার টপ টপ শব্দ শুনতে শুনতে আর চটে যাওয়া ঘুমটা জোড়া দিতে দিতে লেপ-কাঁথা জড়ায়।

মাঘের এই শীতে জর্জর ভোরে ৭টা বেজে গেলেও সূর্য ওঠে না ঠিকমতো। তার মধ্যেই রাজুর মা এসে বাসন মাজা শুরু করে; মাছ কেনা থাকলে কুটে দিয়ে যায়। মিতু কলেজের জন্য তৈরি হয়। আজকাল আফরোজা চুলার পাড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। তাই মুনিয়া ঝটপট ভাত আর দুই পদ তরকারি রাঁধে। আফরোজা ধীরেসুস্থে ডাল রাঁধবেন দুপুরে। রান্না গুছিয়ে, তৈরি হয়ে, খেয়েদেয়ে ১০টার দিকে দুটো ব্যাগ হাতে বের হবে মুনিয়া। গিয়ে ঢুকবে শপিং মলের ছোট্ট বিউটি পার্লারে। সেখানে একটা ব্যাগ থেকে পোশাক আর জুতো বের করে বদলাবে, সাজবে। বিউটি পার্লারের সাথে কসমেটিক্স কোম্পানির মাসকাবারি বন্দোবস্ত। তার পরে খালি ব্যাগটা সেখানেই রেখে অন্য ব্যাগটা নিয়ে ডিউটিতে গিয়ে দাঁড়াবে ১১টার দিকে।

ছোট্ট জেলা শহর। লোক বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। অফিস-আদালত বেড়েছে, কেনাকাটা বেড়েছে। সন্ধ্যার পরপরই এখন মশারি টাঙানো শুরু করে না। রাত ১০টার পরও আলো ঝকমক করে বাজার এলাকায়, রাস্তায়, খানাদানার দোকানে। নতুন শপিং মলটা মুনিয়াদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে মাত্র ১০ মিনিট। তাতে ঝকঝকে নতুন এক কসমেটিকসের দোকান; এই শহরে আলাদা করে শুধু কসমেটিকস বিক্রির দোকান এটাই প্রথম। ঢাকার দোকানের মতোই সাজানো। তারা তিনটি মেয়ে সেজেগুজে, বেগুনিরঙা স্যুট আর সাদা শার্ট পরে রোজ দাঁড়ায় কসমেটিকস পসরার সামনে। প্রসাধনে চকচকে মুখ, লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট আর হিল জুতার খটখট দেখিয়ে তাদের ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিতে হয়, এসব পণ্য কত সুশ্রী করে তোলে মেয়েদের।

দুপুরে বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে আসবে, সে উপায় আর নেই। চাকরির প্রথমদিকেই তাকে এই অচেনা পোশাকে যেতে আসতে দেখে শাসিয়ে গেছে চাচাতো ভাইয়েরা। তাই আর সাহস হয় না। সকালে রেঁধেবেড়ে ভাত খেয়েই আসে মুনিয়া। তার বাকি দুই সাথীও তাই। দুপুরে শপিং মলের উপরে যে নতুন কায়দার রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে, সেখানে বসে তারা তিনজনে চায়ে ভিজিয়ে পাউরুটি খায়। কখনও কখনও সাথে থাকে শিঙ্গাড়া। রাস্তার টং থেকে নিয়ে আসে। টং-এ দাঁড়িয়ে খেলে লোকে হাঁ করে দেখে তাদের প্রসাধনচর্চিত মুখ আর অচেনা পোশাক, তাই এ ব্যবস্থা। রেস্টুরেন্টের লোকেরাও ওরা বসলে কিছু মনে করে না ফাঁকা সময়টায়, নিজেরাও টিভি দেখে বসে বসে। তাপানুকূল যন্ত্র বসানো রেস্টুরেন্ট। বিকেলে ছেলেমেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় বসে এখানে। সসে চুবিয়ে মুরগি ভাজা খায়, কোকা-কোলা খায়, মোবাইল ফোনে ছবি তোলে। সবই নতুন এই ছোট্ট শহরে। বছর পাঁচ-সাতেক আগে অব্দি ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে এসব দেখে এসে গল্প করত সবাই। চাইত, নিজের শহরেও আসুক সবকিছু।

সন্ধ্যা ৭টায় আবার সেই বিউটি পার্লারে গিয়ে ঝটপট পোশাক বদলে নেয় মুনিয়া। তার পর সেই একই গলিপথ দিয়ে বাড়ি ফেরা। গলিতে নতুন ওঠা গিজগিজে সব পাঁচতলা, সাততলা দালান। তার ফাঁকফোকর দিয়ে তাদের বাড়িতে ঢোকার সরু মাটির রাস্তা। ঘন গাছপালায় ঘেরা টিনের পুরনো ছাপরা ঘরগুলো চারপাশের দরদালানের সাথে বেমানানই বলা যায়। ভাড়াটিয়াদের ছাপরা আর বাড়িওলার ছাপরার ভেদ বোঝানোর একমাত্র উপায় মাঝখানের পাটখড়ির বেড়া। তাতে যথেচ্ছ বেয়ে উঠেছে মিতুর বোনা শৌখিন নীলমণি লতা। এও এক রকম বেমানান এই বাড়ির সাথে। ভাড়াটিয়াদের ছাপরা পার হয়ে নিজেদের উঠোনে ঢোকার টিনের গেটের শিকল খুলতে খুলতে শোনে শামীমের ঘরে রেডিও বাজছে। শামীম এই মাসেও ঘর ভাড়া দেয়নি। গিয়ে চাইবে নাকি? নাহ! আজ থাক। কিশমিশের ছোট্ট ঠোঙাটা আফরোজার হাতে দিয়ে গায়ের শালটা দড়িতে মেলে দিল সে। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া খুলে ঘরে পরার স্পঞ্জ জোড়া তালাশ করে নিল। স্পঞ্জের খুলে আসা ফিতেটা গুঁজে নিয়ে বাথরুমের দিকে যাওয়ার সময় আফরোজা এসে খবরের জরুরি হেডলাইন পড়ার মতো পরপর বলে গেলেন,

‘বাজার-সদাই ঘরে কিছুই নাই। কারেন্টের বিল দিবি না? মিতুর সরস্বতী পূজার বন্ধ আছে কয়দিন পর, ওরে দিস। দিয়া আসবে।’

‘হুম’ বলে ফের বাথরুমের দিকে এগোতেই আফরোজা আবারও জানালেন,

‘বাথরুমের লাইটটা ফিউজ হইছে। টর্চ বাতি নিয়া যা।’

বাথরুমটার বয়স হয়েছে মুনিয়াদের চেয়েও বেশি। গোসলখানার চৌবাচ্চা আজকাল ভরে না সাপ্লাইয়ের পানিতে। পানিই আসে না আগের মতো। চারপাশের দালানের লোকেরা মোটর বসিয়ে মূল লাইন থেকেই টেনে নেয় পানি, ছাদের উপর বড় বড় ট্যাঙ্ক ভরে রাখে। তাদের চকচকে শহুরে গেরস্তালিতে পানির কষ্ট মানায় না। এই বাড়িতে মোটর নাই, ইট-সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া ছাদ নাই, ট্যাঙ্কও নাই। পায়খানার বালতিগুলো টিউবওয়েল চেপেই ভরে নিয়ে যেতে হয়। মিতুকে দশবার বললে তবে সে এক বালতি পানি আনে। বেড়ার ওপাশেই ছয় ঘর ভাড়াটিয়ার বাস। তাদের বাথরুম, টিউবওয়েল সব আলাদা। তারা খাবার পানি নিতে আসে এই টিউবওয়েল থেকেই। এর পানি নাকি বেশি মিষ্টি। মাঝে মাঝে তাদের কাউকে কাউকে অনুরোধ করে গোসলখানার চৌবাচ্চা ভরিয়ে নেন আফরোজা। বাতি নষ্ট বলে আজ কলপাড়ে দাঁড়িয়েই ঘষে ঘষে মুখের প্রসাধন তোলে মুনিয়া। রোজ রোজ এই করতে বড় সময় নষ্ট হয়।

গোসল সেরে বের হয়ে এক গ্লাস পানি ঢালতে ঢালতে শোনে আফরোজা ফের সেই খবর পড়ার সুরেই তাকে বলছেন, ‘আজকে মাসুদ একগাট্টি লোক নিয়া আইছিল। আমার সাথে কথা কয় নাই। ঘুইরা ঘুইরা জমি দেখাইছে। গাছ দেখাইছে।’

এইসব সময়ে মুনিয়া সাধারণত সংলাপ-বিমুখ। পা লেপের ভিতর ঢুকিয়ে একমনে সে সিরিয়াল দেখতে থাকে। ভাড়াটিয়ার ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ জানালায় ঝুলে ঝুলে টিভি দেখে। আফরোজাও চোখ দুটো টিভির দিকেই ফিরিয়ে রাখেন।

সিরিয়ালের সুন্দরী বউটা ছুরি দিয়ে ফল কাটছে। কী ফল কাটে? চশমা ছাড়া ঠাহর করতে পারেন না। শ্বশুরের ভিটে ভাগাভাগি হওয়ার আগে কোনোদিন তাদের ফলপাকুড় কিনে খেতে হয়নি। আমলকী, সবেদা, কদবেল। পুকুরের পাড়িতে ছিল তাল, খেজুর, জামরুল। সবই কাটা হয়ে গেছে। কেউ গাছ কেটে, পুকুর ভরাট করে দালান তুলেছে। কেউ জমি বাইরের লোকের কাছে বেচে ঢাকায় গিয়ে বাড়িঘর করেছে। এখন শীতে তাই আমলকী খাওয়া যায় না। লিচুগাছ, জামগাছও আর নেই। তারা নিজেদের ভাগের জমিতে যা গাছ লাগিয়েছে সেসব আর ওইসব পুরনো গাছের মতো ফল দেয় না। তিনি প্রতিদিন এইভাবে সব পুরনো কথা ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে আজ কতক জোর দিয়েই মুনিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘লেবুঝোপটায় বেড়া দেওয়া দরকার! সকালে লেবু চুরি হয়!’

‘এই শীতে কেউ লেবু চুরি করতে আসে না। এইটা কমলা গাছ না। আপনি রাইতে ঘুমানোর চেষ্টা করেন তাইলে আর চোরের চিন্তা মাথায় আসবে না।’

‘আমার চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না রে! মাসুদ খালি বাড়ির চাইরপাশে ঘুরে। তার উপর আসে চোর! তুই বিয়া কর। তোর আনোয়ারা খালারে বলি?’

‘কিসের মধ্যে কী কন! জানেন যে, এক কথা প্রতিদিন শুনতে ভাল্লাগে না। বলেন ক্যান?’

‘তোর বিয়া দিয়া নড়াইল চইলা যাব। মিতুর বিয়া ওইখান থেকে দিবো। আমার ভয় লাগে! ওরা কত কিছুই তো কয়! যদি ঘরে আগুন দিয়া দেয়? পুইড়া মরব নাকি তোদের নিয়া? টাকাপয়সা যা কয়ডা দেয় নিয়া মিটমাট কইরা নড়াইল চইলা যাই, চল!’

‘আপনারে তো কইছিই মা! আপনার বাপের বাড়ি আপনি যান। আমার বাপের বাড়ি আমি ছাড়ুম না।’

‘তোগোরে বেশি পাস করাইয়া আমার ভুল হইছে। তোরা কথা শুনিস না। তোগোর বাপ তোগোরে আগেভাগে বিয়া দিয়া দিলেই আমি বাঁচতাম!’

‘থাক মা! প্যাঁচাল পাইড়েন না! যান, মিতুরে ডাকেন। ভাত বাড়ি।’

‘পুলাপান গেছে নাকি, দ্যাখ।’

‘আপনারে তো কইলাম দেখতে। গিয়া দেইখা আসেন। কথা বন্ধ করেন।’

তাদের উঠোনে তিনখানা দ্বীপের মতো ঘর। পশ্চিমের ঘরের দিকে রওনা হলেন আফরোজা। একটু হাঁটলেই তার মাজার ব্যথাটা জানান দেয়, শীত বেড়েছে। দেখলেন, খাবার ঘরের ঠিক সিঁড়ির সামনেই পানি জমে কাদা হয়ে আছে। রাজুর মা যেখানে সেখানে পানি ফেলে। শীতের এই টান ধরার দিনেও সেই পানি শুকোয়নি। রাজুর মাকে বকাঝকা করলে মেয়েরা উল্টো তার দোষ ধরে। বলে, তার জন্যেই কাজের লোক থাকে না।

এই ঘরখানায় আগে মেয়েরা থাকত। স্বামী মারা যাওয়ার পর এদের আলাদা ঘরে রাখতে সাহস হয় না। তাই এখন ওদের খাট পাতিয়েছেন নিজের ঘরে। তাছাড়া চাল মেরামতিও হয় না অনেক বছর। বর্ষায় এই ঘরে খুব পানি পড়ে। তাদের ছাপরার ভাড়াটিয়াদের কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে সন্ধ্যায়। পাশের গলির দোকানদার, রিকশাওয়ালাদের ছেলেমেয়েরাও আসে দুই-একজন। কেউ মাস শেষে কয়েকশো টাকা দেয়, কেউ দেয় না। তাতে মিতুর কিচ্ছু এসে যায় না। মুনিয়া বুঝদার শক্ত মেয়ে, মিতু সংসারের জটিলতা বোঝে না, মুখে তার হাসি লেগেই থাকে সব সময়। গুচ্ছের গাছগাছড়া চেয়েচিন্তে নিয়ে আসে, বাগান করে, কলেজের বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ায় দেদার। …আহারে! এদের একজন যদি ছেলে হয়ে জন্মাতো!… শুধু একজন! এদের বাপের মৃত্যুর পরেও বারো কাঠা জমির পুরোটাই রইতো। মাসুদদের আফসাও দিতে হতো না অর্ধেক জমি। ওরাও অর্ধেকটা নেওয়ার ছলে পুরোটা দখল করার সাহস পেতো না তাদের খেদিয়ে! মেয়েরা তার এসব দুশ্চিন্তা বোঝে না।

মিতুকে নিয়ে খাবার ঘরে ফিরে দেখেন মুনিয়া ভাত বেড়ে মোবাইল দেখছে। ভিতরের ঘরে টিভিতে সিরিয়াল চলছেই। পালং শাকে ট্যাংরা মাছের ট্যালটেলে ঝোল, আলু-শিমে চচ্চড়ি আর পাতলা মশুর ডাল। সাথে মূল খাবারের সাথে বেমানান দুই কেজি দুধ জ্বালিয়ে ঘন করে এক কেজি বানিয়ে রাঁধা পায়েস। বহুদিন পরে শখ করে রাঁধা একটু পায়েস।

‘জলপাই ছিল না মা? ডাইলে জলপাই দিলেন না ক্যান?’

ভুলে গেছেন। মিতু জলপাই বড় ভালোবাসে। ফ্রিজে বরফ করে জমিয়ে রাখতে হয় ওর জন্য। গাছও একটা লাগিয়েছে কোত্থেকে এনে। গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা অপূর্ব সব ফুলে ছেয়ে যায় ভাদ্র মাসে। তার পর ঝরে যায়। ফল ধরে না একটাও।

খাওয়া শেষে মিতু এঁটোকাঁটা দিয়ে ভাত মেখে দেয় কুকুরটাকে। বাসন গোছায় মুনিয়া। ভাত-তরকারি বেঁচে গেছে অনেক। সকালে রাঁধতে হবে না। পায়েসের বাটিতে চামচ ডুবায় সে। আফরোজা গিয়ে দুই খাটে মশারি টাঙিয়ে ফের টিভি দেখতে বসেন। টিভিতে বিজ্ঞাপন হয় একের পর এক। তিনি সব দেখেন। হরলিক্স, নবরত্ন তেল, রাঁধুনী সরিষার তেল, মোবাইলে কথা বলার বিজ্ঞাপন, লাক্স সাবান, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি… সব তার চোখের সামনে দিয়ে চলতে থাকে, প্রতিদিন। এর শেষ নাই।

পরের কাকভোরেও লেবুচোরেরা আসে একই নিয়মে। তারপর রোদ না উঠতেই এসে ঢোকেন আফরোজার ভাসুর-বেটা আর জা। পাটখড়ির বেড়ায় টিনের গেট। কুকুর, বিড়াল, মানুষ- কারোরই তেমন অনুমতি লাগে না ঢুকতে। এত সকালেও পান চিবুচ্ছে মাজেদা। আফরোজা সারাজীবন দেখেছেন গলা উঁচু-নিচু করে নানান সুরে কথা বলতে পারে তার এই জা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোয়েন্দাদের মতো নজর করতে পারেন সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সবকিছু। তিলকে অবলীলায় বানাতে পারেন তাল। এ তার জায়ের এক রকম প্রতিভা বলা যায়। কিন্তু বড় কথা হলো, মাজেদাকে দেখলেই কেমন জানি ভয় ভয় লাগতে থাকে আফরোজার। তাই শিশিরভেজা উঠোনে মোড়া দুটো পেতে দেন ভয়ে ভয়ে।

‘এত স্যান্ডেল-জুতা ক্যান বারান্দায়? তোমার ভাই-ভাবি আইছে নাকি? অবশ্য তোমার মেয়েরা আইজকাল নিত্যনতুন স্যান্ডেল-জুতা পরে শুনছি।’

চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিরিখ করতে করতে হুল ফোটান মাজেদা।

‘ফুল তো মেলা ফুটছে দেখা যায়! মুনিয়ার বাপেও তো খুব ফুলগাছ লাগাইত। হিন্দু বিটিরা আইসা ঝুড়ি ভইরা নিয়া যাইত। এখন তো কেউ নেয় না। ফুলগাছ অ্যাহন কোন কামে লাগে তোমাগো? জংলা হইয়া আছে চাইরপাশ!’

‘মেয়েটা পছন্দ করে। ওর ফুপুরাও তো ফুলগাছ পছন্দ করত। আপনার মনে নাই ভাবি?’

তড়িঘড়ি উত্তর দেন আফরোজা। আশা করেন ফুফুদের স্বভাব পেয়েছে বললে এবারের মতো মেয়ের দোষ কাটবে জায়ের কাছে।

‘কোনটা? বড়টা? বড়টা তো সারাদিন বাজারেই থাকে। ছোটটাও তোমার ব্যাটা মাইনষের মতন ঘুরেফিরে। নামাজ-কালাম, পর্দা-পুশিদা কিছুই তো শিখাও নাই। বাড়িঘর পয়-পরিস্কার করাও শিখে নাই।… থাক! কাজের কথায় আসি। … অ মাসুদ! কী কবি ক… ও কইতেছিল, তোমরা মামলা তুইলা ন্যাও। জমিটা বেচি। ভালো খদ্দের আছে হাতে। তোমার মেয়ে তোমারে কিছু কয় নাই?’

‘না; কয় নাই।’

‘ওগোরে বিয়া-শাদি দ্যাও। তুমি তোমার ভাইগো বাড়ি যাও গিয়া। তোমার কোন চাচাত বইন না কে আছে জানি, মুনিয়ারে তার বিটার জন্য নিবার চায়?’

‘হ।’

‘দিয়া দ্যাও। মাথার উপর কেউ নাই। দিনকাল ভালো না। কত লোক কত মতলব নিয়া ঘুরেফেরে!’

মাসুদের মা তাকায় মাসুদের দিকে। মাসুদ তার বাম চোখটা নিবিষ্ট রেখেছে নিজের স্যান্ডেলের ফিতেয়। এলাকার কোনো এক মারামারিতে ডান চোখটা সে হারিয়েছিল বছর দশেক আগে।

আফরোজা চা করতে যান রান্নাঘরে। লাকড়ির চুলা ধরাতে সময় লাগে। সেই ফাঁকে মাজেদা উঁকিঝুঁকি মারেন এই ঘরে ওই ঘরে, উঠে গিয়ে পানের পিক ফেলে আসেন উঠোনের কোণে, কুকুরটাকে ধাওয়ান। আফরোজা মিতুকে চা ঢালতে বলে ফের উঠোনে এসে বসেন জড়োসড়ো হয়ে। জানেন, মাজেদা আবারও সেই একই কথা বলবেন। তার বড় ক্লান্তি ধরে যায়। যেন তিনি কাল সারা রাত্তির ধরে ঘুমোননি। এই পুরো ফরিদপুর শহরটা হেঁটে বেড়িয়েছেন।

‘তোমরা মামলা তুইলা ন্যাও মুনিয়ার মা। জমি আমাদের দ্যাও। দিনকাল ভালো না। একা একা থাকো। পুরুষ লোক নাই।’

ক্লান্ত গলায় আফরোজা যেন নিজেকে শোনানোর জন্য উচ্চারণ করেন- ‘আপনারা তো পাশেই আছেন ভাবি।’

ইতিউতি তাকাতে তাকাতেই কথা চালিয়ে যান মাজেদা। ‘আমরা আছি বইলাই কি বিপদ কাইটা যাবে? মেয়েমানুষ জন্ম দেওয়াই তো বিপদ… অ মিতু! কয়ডা লেবু দে তো! তোগো গন্ধলেবু অনেক দিন খাই না। বারমাস্যা না?… আছে তো গাছে?’

লেবুর নামে আফরোজার বুকটা ধক্‌? করে ওঠে।… লেবু চায়! লেবু! কত সাধের গন্ধলেবু তার!

ত্রিশ বছর আগে, সেই বিয়ের পর থেকেই, এই লেবুঝোপ সে আগলে রেখেছে। তার স্বামীর কত সাধের গাছ! তার স্বামীর ছিল শুধু গাছ লাগানোর নেশা! গাছেদের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদর করত রোজ বাড়ি ফিরে। কোথা থেকে পেয়েছিল এই লেবুর বীজ, তার গল্প কতবার করেছে কত রঙ্গ করে! ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায় তেলমুড়ি মেখে দিলেই তার এই গল্প মনে পড়ত! কবেকার সব কথা! কোন এক বছর জানি মাগুরায় কাত্যায়নী পূজার মেলা দেখতে গিয়ে কোন এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিল। মন্দিরের গায়ে হওয়া গাছের এই লেবু কেটে খাইয়েছিল নাকি সেই বাড়ির দুই বিধবা দিদি! এমন আশ্চর্য সুবাস দেখে পাকা লেবু চেয়ে নিয়ে এসেছিল সে বীজ করবে বলে।… এক্কেবারে গোল গোল লেবু, গাঢ় সবুজ রঙ। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকে! আশ্চর্য তার সুবাস! ভারী তার নামডাক! কিন্তু বড্ড টক। কেটে পাতে রেখে দিলেই সুখ বেশি, খেয়ে সুখ নেই অত। আহ! আগে লোকজন কম ছিল শহরে। দূর দূর পাড়া থেকে আসত লোকে লেবু চাইতে। এখনও আশপাশের বাড়ির লোকেরা আসে। কত পোয়াতি ভাত খেতে পারে না! এই লেবুর গন্ধে দুটি ভাত পেটে ঢুকবে বলে চাইতে আসে। কত রোগীর বাড়ির লোক আসে, জ্বরের মুখে এই লেবুর গন্ধে বমি আটকানোর কথা বলে। লেবু চাইতে এসে উঠোনে বসে কত রকম সুখ-দুঃখের আলাপ করে যায় বউ-ঝিরা! রোজা-রমজানে তারা একটা লেবুর গন্ধে পুরো বাড়ির লোক শরবত খায়। আজ কি সেই গোটা লেবুঝোপটাই কেড়ে নিতে এসেছে মায়ে-বেটায়?

মাসুদের কথায় আফরোজার ঘোর ভাঙে।

‘চাচি, শোনেন! উকিলের সাথে কথা হইছে। বছরের পর বছর যাবে তবু এই জমি আপনারা পাবেন না। পুত্র সন্তান না থাকলে ভাইয়ের বেটারাই মালিক। আপনি মুনিয়ারে বুঝাইয়া কন।’

‘আমি বুঝাইলে বুঝবে না রে বাবা! ওরা পড়ালেখা করা মেয়ে।’

‘আমারে পড়ালেখা শিখাইয়েন না চাচি। পড়ালেখা দিয়া কিচ্ছু হয় না। আইনে কি পড়ালেখা করা মেয়েমানুষ আলাদা নাকি? পড়ালেখা কইরা হইছে তো বেশ্যা! বাজারে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। ১০ টাকা ফেললেই ওরে উঠায়ে নেওয়া যায়। এই কাম করতে পড়ালেখা লাগে?’

‘তুই খারাপ কথা কইস না মাসুদ! ও ঢাকায় চাকরির চেষ্টা করতেছে।’

‘ঢাকা বড় শহর। বেশ্যারাও বেশি টাকা কামায়। ওরে বলবেন, এই বাড়ির মান-সম্মান আর ও ডুবাইতে পারবে না। এই বাড়ি ছাইড়া তারপরে ও চাকরিবাকরি যা খুশি করুক।’

‘ও চাকরি না করলে আমরা খাব কী?’

‘কী খাবেন, আমি কী জানি? এই জন্যেই তো কইতেছি নড়াইল চইলা যান। বড়জন তো নিজেই বাজারে গিয়া খাড়াইছে। এখন কি চান ছোটজনরে কেউ তুইলা নিয়া যাক? পুরুষের মতো চুল কাটে! পুরুষের মতো ঘুরেফিরে! কেউ তুইলা নিয়া গেলে বুঝা যাবে ও পুরুষ, না মাগী!… পাগল-ছাগল মেয়েমানুষ! শিক্ষিত হইছে রে! ওরে আমার শিক্ষিত!’

এই সময় মুনিয়া বের হয়ে আসে ঘর থেকে। আফরোজা ভয়ে ভয়ে তাকান মেয়ের দিকে। মুনিয়া মাসুদ আর মাজেদার দিকে তাকায় না। রান্নাঘরের দিকে যায়। কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে যায় ওর পেছন পেছন। সরপোশ ঢাকা দেওয়া গতরাতের ঠাণ্ডা ভাত-তরকারি একের পর এক গরম করে খাওয়ার টেবিলে আনে। মিতুকে বলে একটা লেবু ছিঁড়ে আনতে। টেবিলে চায়ের কাপগুলো পাশাপাশি সাজানো। চা দেওয়াই হয়নি। মিতু লেবু খুঁজতে যায়। তারপর মাসুদ আর মাজেদার সামনে দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে আসে সেই আশ্চর্য গন্ধলেবু! শিশিরে ভেজা, সবুজ মসৃণ গোল। বঁটি ছোঁয়ানোর সাথে সাথে তার সুবাস ছড়িয়ে যায় বাসি ভাত-তরকারির পাত্র ছাপিয়ে। তারপর মুনিয়া ডাকে, ‘মা! ভাত খাবেন আসেন!’

আফরোজার ভেঙে পড়ার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নাই। তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢোকেন। ভাত মাখেন ডালে গন্ধলেবু দিয়ে।… আহ! কত অসুইখ্যা… কত পোয়াতির মুখে সুখ দেওয়া লেবু! কত লোকের দোয়ার বরকত এই গাছের উপর! এই লেবুঝোপ ওরা রাখবে না! ওরা গাছ রাখতে জানে না! ফলন্ত সব গাছ ওরা কেটে ফেলেছে চোখের সামনে! আহারে!

কুয়াশার দিন পেরিয়ে আমের বউলের দিন আসে। মুনিয়া কাজে যায় আসে একইভাবে। কোনো এক সন্ধ্যায় ম্যানেজার তাকে ডাকে। লম্বা লম্বা বাক্য বলে।

‘কানা-মাসুদ আইছিলো আমার বাসায়। কইলো, তোমারে যেন কাজে না রাখি। তুমি নাকি তার বোন হও? তার সম্মান নষ্ট হয়। আমি কানা-মাসুদরে অত ডরাই না… তয়… ওর কোপাকুপি করানোর লোক আছে। আমি ঝামেলা চাই না।…’

মুনিয়া যন্ত্রের মতো ঘরে ফেরে। ঢুকতেই আফরোজা সেই রোজকার খবর পড়ার সুরে জানান ভাড়াটেদের ছাপরার খবর। দক্ষিণ কোণার ছাপরার পোয়াতি বৌটাকে তার স্বামী ইচ্ছামতো পিটিয়ে ভ্যান চালাতে বেরিয়ে গেছে। শামীমকে একটা অটোরিকশা ডাকতে বলে। আধমরা বউটা আর তার শাশুড়িকে অটোতে তুলে আবারও যন্ত্রের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় মুনিয়া। খাবাশপুর থেকে সদর হাসপাতাল আজ যেন কয়েকশো মাইল পথ। এর মাঝেই না মেয়েটা মরে! হাসপাতালে ভর্তি করে, বারান্দায় পাটি পেতে মেয়েটাকে রেখে, শাশুড়িকে ওষুধ বুঝিয়ে-সুজিয়ে দিয়ে ফিরতি আরেক অটোরিকশায় চড়ে বসে সে। বড় হতে থাকা ছোট্ট শহরটা আমের বউলের ঘ্রাণে মাতাল। বাড়ি ফেরার রাস্তাটা যেন আজ আরও বেশি লম্বা।

তার পর সেই একই রকম আরেকটা কাকভোর। একই নিয়মে ফজরের ওয়াক্তে আসা আফরোজার লেবুচোর। সেই পুবদিকের জানালা সশব্দে আটকানোর একই রকম শব্দ।… কোনোদিন এই সময়ে কথা বলেনি মুনিয়া। আফরোজার একান্ত প্রিয় উদ্বেগে ভাগ বসায়নি। পাশ ফিরে মিতুর ঘুমন্ত গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরেছে ফের। আজ বলে ওঠে, ‘খালাম্মারে বিয়ার দিন-তারিখ ঠিক করতে বলেন, মা! আর… সাতসকালে এইভাবে লেবু লেবু কইরা চিল্লাইয়েন না। এই লেবুগাছ আপনার না। এতকাল যে নিজের কইয়া খাইতে পারছেন, তাই-ই অনেক।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত