সাফওয়ানের বোলিং

হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটল। মাঠ থেকে খেলা শেষে বাসায় ফিরছিল সাফওয়ান। রাস্তার পাশে একটা প্রদীপ পড়ে থাকতে দেখে প্রদীপটা হাতে তুলে নিল সে। বাবার কাছে শুনেছে, আগে এ দেশে প্রদীপ, লন্ঠন—এসবের খুব প্রচলন ছিল। বিদ্যুৎ চলে আসায় এখন আর এসবের ব্যবহার নেই। তাই প্রদীপটা দেখে সাফওয়ান একটু অবাকই হলো। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে প্রদীপে মরচে পড়ে গেছে। নইলে এটা ঘরে সাজিয়ে রাখা যেত।

মরিচাটা তুলে ফেলা যায় কি না, পরীক্ষা করে দেখার জন্য সাফওয়ান প্রদীপের গায়ে দিল এক ঘষা। আর তখনই ভোজবাজির মতো ঘটনাটা ঘটে গেল। চারপাশ ভরে গেল ধোঁয়ায়। কিছুক্ষণ পরই বিশালাকার একটা দৈত্য বলে উঠল, ‘বস, কিছু লাগবে?’

সাফওয়ান প্রথমে ভয়ে জমেই যাচ্ছিল। কিন্তু ‘বস’ সম্বোধন শুনে সে কিছুটা সাহস পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? কী চাও?’

‘আলাদিনের চেরাগের কথা শোনেননি বস? আপনি হাতে যে প্রদীপটা ধরে আছেন, এটাই হচ্ছে সেই চেরাগ। আর এই চেরাগটা যখন যার হাতে থাকে, আমি তার গোলাম হয়ে যাই।’

আলাদিনের চেরাগের গল্প বাবার মুখে সাফওয়ান অনেকবার শুনেছে। এতগুলো বছর পর সাফওয়ানের হাতে সেই প্রদীপটা ফিরে এল, এই ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না। তাই সে যাচাই করার জন্য দৈত্যকে বলল, ‘ওকে। আমার অনেক দিনের শখ একটা ময়না পুষব। আমাকে একটা ময়না পাখি এনে দিতে পারবে?’

‘এটা বস কোনো কাজ হলো? এক মিনিট সময় দেন।’

দৈত্যটা মুহূর্তের মধ্যে কোথাও যেন উধাও হয়ে গেল, আবার ফিরেও এল। হাতে খাঁচাসমেত একটা ময়না পাখি!

‘ওয়াও!’ সাফওয়ান সত্যিই ভীষণ খুশি হয়ে গেল।

‘আর কিছু লাগবে বস?’

‘উমমম, নাহ! এখন লাগবে না।’

‘ওকে। আমি তবে প্রদীপের ভেতর ঘুমুতে গেলাম। দরকার হলে ডাকবেন। বাই বাই।’

দৈত্যটা আবার প্রদীপের ভেতরে ঢুকে পড়ল।

সাফওয়ানও ঝটপট প্রদীপটা তার ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে ময়না পাখি নিয়ে মহানন্দে বাড়ি ফিরল।

রাতে ঘুমুতে এসে সাফওয়ান টের পেল তার ঘুম আসছে না। এমনিতেই দৈত্যের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ওপর আবার কাল থেকে শুরু হচ্ছে আন্তজেলা স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ক্লাস সেভেনে পড়া সত্ত্বেও ভালো খেলার কারণে সাফওয়ান তার স্কুলের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছে। ক্রিকেট সাফওয়ানের খুব প্রিয়। তাই খেলার আগের রাতে তার কিছুতেই ঘুম হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে প্রদীপটা ব্যাগ থেকে বের করল। ঘষা দিতেই বেরিয়ে এল দৈত্য। দৈত্যের সঙ্গে একটা গোপন পরামর্শ সেরে নিয়ে আবার ঘুমাতে গেল সাফওয়ান।

পরদিন খেলার মাঠে গিয়ে সে দেখল, ছোট ক্লাসের ছাত্র বলে তাকে ব্যাটিংয়ে রাখা হয়েছে সবার শেষে। সাফওয়ান মাঠে নামার আগেই প্রথম ইনিংস শেষ। সাফওয়ানদের স্কলারস স্কুল করল সাকল্যে ২৩০ রান। প্রত্যুত্তরে ব্যাট করতে নেমে শাহীন স্কুল যখন ৬ উইকেটে ২০০-র ওপরে রান করে ফেলল, তখনো সাফওয়ানের দিকে কারও কোনো নজর নেই। লজ্জার মাথা খেয়ে সে একটা ওভার বোলিং চেয়েই বসল ক্যাপ্টেনের কাছে। বিপক্ষ দল তখন ৫ রান পিছিয়ে আছে। হাতে আছে চার উইকেট। কী ভেবে কে জানে, ক্যাপ্টেন বল তুলে দিল সাফওয়ানের হাতে।

প্রদীপটা ছিল সাফওয়ানের পকেটে। সবার অলক্ষ্যে সে বল হাতে নেওয়ার আগেই প্রদীপটা ঘষে নিল।

ছোট্ট রানআপ নিয়ে একটা ফুলটস বল ছুড়ল সাফওয়ান। এমন সময়

ফুলটস পেয়ে ব্যাটসম্যান তো মহা খুশি। ছক্কা মারার আশায় সজোরে ব্যাট ঘুরিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। ব্যাটের খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ বলের গতিপথ বদলে গেল। টুপ করে মাটিতে একটা ড্রপ খেয়ে বলটা সোজা চলে গেল স্ট্যাম্পের দিকে। বোল্ড! স্কলারস স্কুলের সবাই হাততালি দিয়ে চিত্কার করতে থাকল। ফিল্ডাররা ছুটে এসে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরল। আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানের চোখেমুখে বিস্ময়। দুপাশে মাথা নাড়তে নাড়তে প্যাভিলিয়নে ফিরল সে।

পরের বলেও ফুলটস ছুড়ল সাফওয়ান। অমন বল পেয়ে যেকোনো ব্যাটসম্যানই ব্যাট ঘোরাবে। কিন্তু একই ঘটনা ঘটল আবার। হঠাৎ করে বলটা বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে ব্যাট থেকে এক ইঞ্চি ওপরে উঠে গেল, তারপর ধপ করে গিয়ে পড়ল স্ট্যাম্পের ওপর। আউট! জিততে হলে বিপক্ষ দলের দরকার ৫ রান, হাতে আছে দুই উইকেট। পুরো স্টেডিয়ামে তখন ‘হ্যাটট্রিক হ্যাটট্রিক’ চিত্কার।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরের দুই বলেও দুটি উইকেট তুলে নিল সাফওয়ান। জিতে গেল স্কলারস স্কুল। সাংবাদিকেরা ছুটে এল ওর ছবি তুলতে। তার অদ্ভুত বোলিংয়ের গল্প ছড়িয়ে পড়ল পুরো স্কুলে। প্রিন্সিপাল স্যার স্বয়ং সাফওয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুলের তোড়া উপহার দিলেন।

বাড়ি ফেরার পর মা-বাবাও সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে দিলেন। ফাহিম ভাইয়া ও ফারিতা আপু বাসায় এল চকলেট নিয়ে। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে আদিবান ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল করে সাফওয়ানকে অভিনন্দন জানাল।

এত আনন্দের মধ্যেও সাফওয়ানের মন খারাপ। ব্যাপারটা বাবা ঠিকই বুঝে ফেললেন। বললেন, ‘কি রে বাবা, মন খারাপ কেন?’

শুরুতে সাফওয়ান কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকল। তারপর সে বাবাকে বিষয়টা খুলেই বলল। বলল, ভালো বোলিংয়ের কৃতিত্ব আসলে তার নয়। দৈত্যের।

‘সবাই না জানলেও আমি তো জানি বাবা, ও রকম বল আমি করতে পারি না। দৈত্য না থাকলে কখনো পারতামও না। তুমি যে সব সময় বলো, কখনো চিটিং করতে নেই। সত্যি বাবা, চিটিং করে কিছু পাওয়াতে কোনো আনন্দ নেই। এটা আমি এখন বুঝতে পারছি। তোমার কথা শুনিনি বলে দুঃখিত বাবা। আর কখনো এমন করব না। নিজে যতটুকু পারি, ততটুকুই করব। কাউকে বোকা বানিয়ে আর কখনো কিছু করব না, বাবা। প্রমিজ!’

বাবা সাফওয়ানকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে দিলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত