অবশেষে নীপা মুখ খুলল।
আজ ক’দিনের মধ্যে সে মোবাইলেও কথা বলেনি কারও সঙ্গে। সত্যি বলতে কি, এ পরিবারে অনভিপ্রেত অঘটনটি ঘটে যাবার পর প্রথমে তার কাছ থেকে নিজস্ব মোবাইল সেটটি কেড়ে নেওয়া হয়, তারপর ল্যাপটপও কৌশলে সরিয়ে নেওয়া হয় তার ঘর থেকে। এই উদ্যোগে প্রত্যাশিত কোনো ফল না পেয়ে কয়েক দিন পর সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় নীপাকে। এসব ফেরত পাবার পর তার ভেতরে নতুন কিছু প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে বাবা-মা দু’জনেই হতাশ। নীপার মনের জগতে প্রবেশের আর কোনো পথই খোলা নেই বলে মনে হয়। তবু সকালে কোর্টে বেরোনোর আগে জামান উকিল এসে মেয়ের সামনে হাঁটু ভেঙে দাঁড়ান। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,
নতুন একটা মোবাইল সেট নিবি মা?
নীপা নিরুত্তর। খেলনা পাবার সম্ভাবনায় খুশিতে নেচে ওঠার বয়স অনেক আগেই সে পেরিয়ে এসেছে। বাবার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারে না, কথা বলবে কী করে! দু’হাতের অঞ্জলিতে মেয়ের মুখ তুলে ধরে বাবা আবারও বলেন,
যাকে ইচ্ছে ফোন করিস, আপত্তি নেই। তুই কথা বল মা; একটা কিছু বল! নীপা কিছুই বলে না, যেন বাজপড়া কাঠপাথর। না না, পাথর হলে চোখের পাপড়ি ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে কেন! সেই অশ্রুদাহ তার বাবাকেই বা নীরবে সংক্রমিত করবে কেন! পকেট থেকে রুমাল বের করে মেয়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে জামান উকিল অনুনয় করে ওঠেন,
আমার সঙ্গে না হোক, তোর মায়ের সঙ্গেই কথা বল নীপু মণি।
নীপার নামের এই আদুরে আদল তার বাবারই দেওয়া। কলেজে ওঠার পর ওই মিষ্টি নামটি কীভাবে যেন আড়ালে চলে যায়। দীপ্তও একদিন আদর করে ডেকেছিল ওই নামে। ভালো লাগেনি নীপার। নিষেধ করেছিল দীপ্তকে। ওটা বাবার ডাকা নাম, অপেক্ষায় থেকেছে নীপা- আবার কোনো ইচ্ছে হলে বাবাই ডাকবে ওই নামে। তো সেই সময় কি এতদিন পর পারিবারিক সংকটের এই দুর্দিনে হলো! নীপার দুর্বল শরীর কেঁপে ওঠে কী এক শিহরণে! বড় বড় দুটি চোখ বিস্টম্ফারিত করে তাকায় বাবার মুখের দিকে। মেয়ের চোখে চোখ পড়তেই তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন- তুই কথা না বললে আমরা বাঁচব কী করে, বল দেখি!
না, তবুও বাবার সঙ্গে কথা বলা হয় না নীপার। দিনের শেষে কথা বলে সে তার মায়ের সঙ্গে। কথা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। খুব ছোট্ট বাক্য। কিন্তু তার ওজন ও শক্তি ইরাক বিধ্বংসী বোমার চেয়ে মোটেও কম ভয়াবহ নয়। অথচ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর কত অবলীলায় মায়ের মুখের উপরে জানিয়ে দেয় নীপা,
আমি ‘সুইসাইড’ করব মা।
আত্মহত্যা না বলে এই ইংরেজি শব্দটিই সে প্রয়োগ করে। তার মায়ের তখন বিদ্যুৎস্পর্শের দশা। কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে। মাথা ঘুরে ওঠে চক্কর দিয়ে। দু’হাতে মেয়েকে জাপটে ধরে আর্তনাদে ফেটে পড়েন-
এ তুই কী বলছিস নীপা!
নীপা খুব সহজে খটখটে গলায় জানায়,
হ্যাঁ, আমি সুইসাইড করব।
যেন সুগভীর চিন্তা-ভাবনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত তার। অন্তর্গত সমস্ত দ্বিধার পাঁচিল অতিক্রম করে এসেছে সে। গত কয়েক দিন সে কথা বলেনি বটে কারও সঙ্গে, কিন্তু ভাবনার প্রবাহ তো রুদ্ধ হয়ে থাকেনি। যথেষ্ট বড় হয়েছে সে। বলা যায়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিজে গ্রহণ করার মতো ঢের সময় সে পেয়েছে। তাই দ্বিধাহীন কণ্ঠে সে ঘোষণা করতে পারে, সে সুইসাইড করবে। আগাম ঘোষণা দিয়ে এ পথে কে কবে নেমেছে! আর এই প্রলয়ঙ্করী ঘোষণা শোনার জন্যই কি তার বাবা-মা এতদিন কান পেতে বসে আছেন?
নীপার মা সহসা যেন কোনো জাদুমন্ত্রে নিজেকে সামলে নেন। মেয়ের পাশে বসে পরম সখ্য ও নির্ভরতায় হাত বাড়িয়ে দেন তার কাঁধে। নীপার চুলের অরণ্যে মমতার আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন,
শোন মা, মানুষের তো একটাই জীবন। মেয়েদের সে জীবন আবার ভীষণ পলকা। সেই জীবন নিয়ে হেলাফেলা করলে চলে?
নীপার মুখে কথা নেই। সব কথার শেষ কথা যেন তার বলা হয়ে গেছে। নীপার মা এবার একটু ঘুরে মুখোমুখি বসেন। মেয়ের মুখটা তুলে ধরেন। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েকে চেপে ধরেন,
আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি নীপা?
নীপা তাকিয়ে থাকে উত্তরহীন, অপলক।
দীপ্তকে তুই ফিরিয়ে দিলি কেন? সাতকাণ্ড কেলেঙ্কারির কথা জানার পরও তো সে এ বিয়ে ভেঙে দিতে চায়নি! বরং আমি তো শুনেছি, তার বাপ-মাকে পর্যন্ত সে কনভিন্স করতে চেষ্টা করেছে। বুঝিয়েছে, অঘটনের পেছনে তোর কোনো হাত ছিল না। সেটা স্রেফ দুর্ঘটনা। তোর জন্য সে নিজের মা-বাপের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। তার পরও তুই আর কী চাস, বল দেখি?
কী আর বলবে নীপা। মায়ের চোখ থেকে নীরবে চোখটা নামিয়ে নেয়। মা- বাবার কষ্টের জায়গাটা সে উপলব্ধি করতে পারে। দীপ্তর মতো সুপাত্র বেহাত হবার ধাক্কা সামলে ওঠা সোজা কথা! বেহাত মানে চূড়ান্ত অর্থে নীপাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। দুই পরিবারের স্বপ্ন-সাধ ভেঙে চুরমার করে একেবারে শেষবেলায় বিয়েতে অসম্মতি জানিয়েছে; জামান উকিলের তো হিতাহিত জ্ঞান হারাবারই কথা। একমাত্র কন্যা আদরের নীপুমণির গায়ে তো আর অল্প দুঃখে হাত ওঠেনি তার! এমনিতেই তার সামাজিক মর্যাদা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যে নোংরা খেলায় মেতেছে, তাতেই তিনি উদ্ভ্রান্ত, বিপর্যস্ত। প্রতিকারের পথ না পেয়ে নিজের মাথার চুল ছেঁড়ার দশা। সেই দুঃসময়ে দীপ্ত এগিয়ে আসে। হাত বাড়িয়ে দেয়। একটু দূর সম্পর্কের চাচাতো বোনের ছেলে। ছেলেতে- মেয়েতে যেমন সম্পর্ক; বলা যায়, দুই পরিবারের অনুচ্চারিত প্রশ্রয়ে তা পরিণয়ের দিকেই এগিয়েছে। এমনকি বিয়ের কথাবার্তাও পারিবারিকভাবে যখন চূড়ান্তপ্রায়, তখনই ঘটে অঘটন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফাঁদে আটকে পড়ে নীপা। অতঃপর একদিন নিরুদ্দিষ্ট রাত্রিবাস। সেই একটি মাত্র রাত্রিই সব ওলট-পালট করে দেয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে দীপ্তর বাবা এ বিয়েতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন; স্বামী-স্ত্রী যুক্তি করে কৌশলে এড়িয়ে যেতে চান। বেঁকে বসে দীপ্ত। বাবা-মায়ের মুখের উপরে যুক্তি দেখায়- কিডন্যাপের শিকার হয়েছে বলে এর জন্য তো নীপাকে দায়ী করা যায় না। তাহলে দুর্ভাগ্যের ভার সেই নীপাকেই কেন বইতে হবে?
সেই দীপ্তকে নীপাই কেন প্রত্যাখ্যান করেছে- এ ব্যাখ্যা কিছুতেই খুঁজে পায়নি তার মা-বাবা। এ প্রশ্ন তারা আগেও করেছেন। এমনকি এই প্রশ্ন করতে গিয়েই তো প্রবল উত্তেজনায় অস্থির হয়ে জামান উকিল জীবনে প্রথমবারের মতো মেয়ের গালে চড় মারেন। সেই থেকে নীপা নিস্তব্ধ, নির্বাক। এতদিন পর মুখ খুলতেই আবার সেই জেরা- দীপ্তকে তুই ফিরিয়ে দিলি কেন? নীপার মা বলে ফেলেন;
তুই একবার ফোনে কথা বললেই দেখিস দীপ্ত আবার এগিয়ে আসবে।
আবার দয়া দেখাবে, তাই না মা?
নীপার মা চমকে ওঠেন,
দয়া! দয়ার কথা উঠছে কেন?
শুধু আমাকে নয় মা; ওরা তোমাদেরও দয়া করতে চায়। দয়া দিয়ে সংসার চলে, মা? তুমি বলো; চলে?
কী জানি বাপু, কী যে বলছিস; তুই-ই জানিস। কেন, একবার ফোন করেই দেখ না! মুখে দু’বার চুকচুক শব্দ করে নীপা বলে,
তার মানে তোমরা দয়ার কাঙাল হয়ে বসে আছ, তাই তো! তোমাদের কিডন্যাপ হওয়া মেয়েকে অনুগ্রহ করে কেউ বিয়ে করলেই তোমরা খুশি!
দয়া হবে কেন? দীপ্ত তোকে ভালোবাসে বলেই এগিয়ে এসেছিল।
ভালো তো আমিও বেসেছি তাকে। ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। কিন্তু সে আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে মা। বিশ্বাস হারানোর পরও কি ভালোবাসা থাকে? সেই ভালোবাসা দিয়ে কি জীবন চলে? তুমিই বলো?
এতক্ষণে ধস নামে নীপার মায়ের কণ্ঠে। আগের সেই জোর খুঁজে পান না। কেমন যেন ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেন,
চলে চলে। কতভাবে যে মেয়ে মানুষের জীবন চলে যায়, তুই তার কী জানিস?
ওই যে তুমি বললে- মানুষের একটাই জীবন!
শুধু আমি বলব কেন? ওটাই সত্যি।
সেই জীবনে বিশ্বাসেরও খুব দরকার মা।
এসব কথা কেন বলছিস, নীপা?
নীপা এবার বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। পায়ে পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দূরে দৃষ্টি ফেলে কী যেন খোঁজে! আবার ফিরে আসে ঘরে। বহুদিন পর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
এই যে তোমরা আমাকে ভালোবাসো; ভালোবাসো বলেই বিশ্বাস কর। তাই না?
হ্যাঁ, সন্তানকে তো বিশ্বাস করতেই হয়।
সন্তান বলে নয় মা; ভালোবাসলেই বিশ্বাস করতে হয়। তোমাদের দীপ্ত বাবু খুব ভালো ছেলে, কিন্তু বিশ্বাস হারিয়েছে।
তার মানে!
সে বারবার জানতে চেয়েছে- গু ারা সেই রাতে আমাকে কতবার রেপ করেছে। এ কথা তোমরা কতবার জিজ্ঞেস করেছ মা?
মায়ের মুখে কথা নেই। চোখে বিস্ময়। নীপা একটু দম নিয়ে বলে, অবশ্য দীপ্ত বাবু অতিশয় দয়ালু ভদ্রজন। আমাকে সে আশ্বস্ত করেছে- তুমি সত্যি কথাটা স্বীকার করলেও এ বিয়ে হবেই। তুমি সত্যিটাই বলো- কতবার এবং কতজন….
নীপার মা এবার চিৎকার করে ওঠেন,
তুই থাম নীপা; থাম।
নীপার তখন কথায় পেয়ে বসেছে। কে থামায় তাকে! সে বলে, থামব কেন মা? কেন থামব! জীবন তো মোটে একটাই। এ জীবনে বিশ্বাসহীন ভালোবাসা আমি চাই না মা।
নীপার মায়ের কণ্ঠে ছলকে ওঠে আর্তনাদ,
নীপা!
সেদিন রাতে যা ঘটেছে তার সবই আমি তোমাদের বলেছি। তাকেও বলেছি। লুকাইনি কিছুই। বলতে পার মা, তবু তার কেন মনে হলো- আমি সত্যি বলিনি?
নীপার মা কোথা থেকে আচানক এক যুক্তি খুঁজে বের করেন-
হয়তো তোকে নয়, সন্দেহ করে সে বাদলদের গ্রুপের সবাইকে। ওদের পক্ষে তো সবই সম্ভব!
কই সব সম্ভব! আমাকে নিয়ে গিয়ে রাতভর আটকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু আর কী করতে পেরেছে?
যুবতী মেয়েকে এক রাত আটকে রাখার খবর জানাজানি হবার পর তোর বাবার কি বেইজ্জত হতে আর কিছু বাকি আছে ভেবেছিস!
না না, ওরা তো ওইটুকুই চেয়েছে। বাদলের বাবা এবার নমিনেশন পাচ্ছে না- এটা প্রায় কনফার্ম। কাজেই আমার বাবাকে ডিস্টার্ব করবেই।
তাই বলে তোকে নিয়ে টানাটানি …..
ওরা তো টের পেয়েছে, আমার বাবার সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা কোথায়। তো সেই দুর্বল জায়গাতেই আঘাত করতে হবে, কেমন?
বর্তমানে রাজনীতি এতটাই নোংরা হয়ে গেছে!
সেই জন্যই তো বাবাকে আমি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে বলি।
হ্যাঁ, তাহলেই হয়েছে। তার চোখে এখন এমপি হবার স্বপ্ন।
আচ্ছা মা, রাজনীতি করবে বাবা, আর তার জন্য বলি হতে হবে আমাকে- এটা কেমন বিচার, বলো দেখি!
নীপার মা এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনে বলেন,
সে কথা তোর বাপকে শুধাস। এখন চল দেখি…
না মা শোনো। এই জন্যই ঠিক করেছি, আমি সুইসাইড করব।
আবার চমকে ওঠেন নীপার মা! দাঁড়িয়ে পড়েন থমকে। এতক্ষণের আলাপচারিতায় তাহলে সুইসাইডের ভূত নামেনি কাঁধ থেকে। ভেতরের আতঙ্ক লুকিয়ে রেখে বলেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে। এখন চল তোকে আমি নিজ হাতে কিছু খাওয়াই। মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বলেন- কী খাবি বল তো মা? কী খেতে ইচ্ছে করছে?
অনেক দিন পর নীপা এক চিলতে হেসে ওঠে। দু’হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার হাতের কিল খেতে ইচ্ছে করছে মা।
কী খাবি!
কিল- কিল। বাবা তো সেদিন চড় দিয়েছিলেন, এবার তুমি একটা কিল দিও।
নীপা এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। বহুদিন পর যেন পাহাড় থেকে ঝর্ণাধারা নেমে আসে। নীপার মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন ঝর্ণার স্টম্ফটিক-স্বচ্ছ জলের আয়নায়। ভেতরে ভেতরে ভারি আশ্বস্ত বোধ করেন- মুখে যা-ই বলুক, এ মেয়ে নিশ্চয় সুইসাইড করবে না।
নীপার বাবা রাতে বাসায় ফেরেন বেশ হই হই করতে করতে।
হাতে এক গোছা রজনীগন্ধা। তিন পদের মিষ্টি। নিজে বাসুদেবের দোকানে গিয়ে মেয়ের পছন্দের মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। ও বেলাতেই নীপার মা মোবাইলে জানিয়েছেন, নীপা মুখ খুলেছে, কথা বলেছে, খাবার খেয়েছে; বুক থেকে পাষাণ পাথর নেমে যাবার স্বস্তি পেয়েছেন। মেয়ের গায়ে হাত তোলার পর থেকে যে আগুনে তিনি দগ্ধ হচ্ছিলেন, তাও যেন সহসা নিভে যায়। মেয়ের খবর পাবার পর সারাটা দিন তার শুভ হয়ে যায়। কোর্টে একাধিক মামলায় রায় আসে তার পক্ষে, মার্ডার কেসের আসামির পক্ষে দাঁড়াতেই জামিন হয়ে যায়। কোর্ট থেকে বেরোতে সহসা দীপ্তর বাবার সঙ্গে দেখা। এক গাল হেসে আশ্বস্ত করেছেন- ছেলেমেয়ের মান-অভিমান ফুরালেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এই তো কিছুক্ষণ আগে পার্টি অফিস থেকে বেরোবার মুহূর্তে ফোন এলো নমিনেশন নিয়ে টেনশন করবেন না। রুট লেভেলে কাজ করে যান, মূল্যায়ন ঠিকই হবে। স্বয়ং কাশেম ভাইয়ের ফোন, সেন্ট্রাল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক; তার কথার দাম আছে না? জামান উকিল তাই বাড়িতে ঢোকেন আনন্দের খই ফোটাতে ফোটাতে-
কই রে আমার নীপুমণি! মামণি কই?
জামান উকিলের এই আনন্দ-উচ্ছ্বাস কিন্তু দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। সামনের ইলেকশনে পার্টির নমিনেশন পাবার গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ শেষ করেই তিনি চলে আসেন দীপ্তর বাবার কথায়। নীপার মাকে তিনি বলেই ফেলেন, টানাপড়েন একটু হয়েছে বটে, তবু তার বিশ্বাস- এ বিয়ে হবেই। মেয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নীপার মা ঘোষণা করে দেন- দীপ্তকে নীপা বিয়ে করবে না।
দীপ্তকে বিয়ে করবে না! মধ্যরাতে আকাশভাঙা মাথায় দপদপ করে জ্বলে ওঠে চাঁদি, চিৎকার করে ওঠেন নীপার বাবা- তাহলে কাকে বিয়ে করবি তুই? কে তোকে বিয়ে করবে?
নীপার ঠোঁটে বিষণ্ণতার প্রলেপ জড়ানো হাসি। সেই হাসির ভাঁজ খুলে সে ধীরে ধীরে বলে, আমি যেখানে বিয়ে করব তারা সবাই সদলবলে তোমার ইলেকশনে কাজ করবে। প্রতিপক্ষ গ্রুপ সপক্ষে চলে এলে আর তোমার এমপি হওয়া ঠেকায় কে!
এসব তুই কী বলছিস নীপা!
হ্যাঁ বাবা, আমি কথা বলে দেখি- বাদল যদি রাজি থাকে তো আমি তাকেই বিয়ে করব।
নীপার বাবা স্তম্ভিত। বাক্যহারা। নীপার মা চিৎকার করে ওঠেন,
এর চেয়ে তোর সুইসাইড করাই ভালো।
নীপার ঠোঁটের হাসি ক্রমশ প্রসৃত হয়। বিষণ্ণতার আবরণও খসে পড়ে; অবলীলায় সে বলতে পারে-
হ্যাঁ, সুইসাইড তো করতেই চাই। বাদলকে বিয়ে করা আর সুইসাইড করার মধ্যে বিশেষ তফাৎ কী মা! দেখো, আমি ঠিক সুইসাইড করব।
এর পর ঘরের ভেতরের বাতাস ভারি হয়ে আসে। প্রশস্ত ঘর। তবু তিনটি মানুষেরই যেন ভয়ানক শ্বাসকষ্ট। তিনজনই ভীষণ হাঁপিয়ে ওঠে।