শফিক নিজে চিকিৎসক বলে অন্তত চার-পাঁচবার মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি দশ-এগারো বছর ধরে হার্টের রোগে আক্রান্ত। একবার এনজিওপ্লাস্টি করে সময়মতো সঠিক ওষুধ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক দিনের করিতকর্মা সহায়ক শক্তিটি হলো তাঁর স্ত্রী কোহিনুর বানু। ডা. শফিক কোহিনুরকে সব শিখিয়ে-জানিয়ে রেখেছেন। তাঁদের উভয়ের মধ্যকার কথা আদান-প্রদানের মাধ্যম ভিন্ন ধরনের। লিপ রিডিং। তাতে সম্ভব না হলে হাতের, দেহের অঙ্গভঙ্গি। কোহিনুর সেসব বুঝে নিয়ে তাৎক্ষণিক বিধিব্যবস্থা, ওষুধপথ্যের জোগান দিতেন। অসুবিধা হয়নি তেমন। শুধু এবার কেমন করে জানি ভুলভ্রান্তির বোঝটা শফিকের সাধ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেল। কোহিনুর অন্যবারের মতো কোনো শব্দ-ইঙ্গিত পাননি বলে তিনি তাঁর রুটিনমাফিক ফজরের নামাজ সেরে দ্বিতীয়বার ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে কাত হতে যাবেন, তখনই তাঁর স্বামীর বাঁ পায়ের গোড়ালিটি ঘষে উঠে পা-টি নেতিয়ে পড়ে যেতে দেখে তিনি আঁতকে উঠে বেডসুইচ টেপেন। স্পষ্ট আলোয় তিনি দেখেন, শফিক মৃত্যুর দুয়ারে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। চোখ তাঁর সিলিং বরাবর স্থির। নিষ্পলক। ডান হাতে বুকের বাঁ পাশটা সামলে ধরা, অন্য হাত বিছানায় নেতিয়ে আছে। অনেকটাই নিষ্প্রাণ।
এক পলকে কোহিনুর দুয়ার খুলে তাঁর নিজস্ব সুরে যত দূর সম্ভব সরব হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন।
পাশের ঘরে তাঁর ছোট মেয়ে আতিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার পড়া পড়ছে। অনেক সকালে ওঠে। সে লাফ দিয়ে বের হয়। মায়ের ইশারায় বাবার কাছে যায়। দৌড়ে বেরিয়ে আসে। নিচে ছুটে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘তোমরা কে কোথায়? শিগগির বের হও। বাবার অবস্থা ভালো না…। ডাক্তার…হাসপাতাল…। তোমরা তাড়াতাড়ি ওঠো।’
সবার আগে বের হয় ডা. শফিকের চেম্বার-অ্যাসিস্টেন্ট মিজান। আতিয়া চিৎকার করে ওঠে, ‘মিজান ভাই…ডাক্তার আনেন। অ্যাম্বুলেন্স…।’
মিজান দৌড়ে ওপরে যায়। নেমে আসে। গ্যারেজ খুলে গাড়ি বের করে।
‘অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনতে সময় লেগে যাবে।’
নিচের গার্ড আর মিজান কোনোরকমে ধরাধরি করে ডা. শফিককে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে যায় আতিয়াও।
ততক্ষণে পাড়া-পড়শি দু-চারজনও এসে গেছে এই বাড়িতে। কোহিনুর বিছানায় বসে পশ্চিম দিকে সিজদায় উপুড় হয়ে থাকেন।
নারিন্দার পুরোনো আমলের প্রতাপশালী সাব-রেজিস্ট্রারের দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটি তাঁদের ঘরে এসেছিল অনেক সাধ্য-সাধনা, ফকির-বদ্দি, তাবিজ-কবচের পর। কিন্তু প্রসূতি ক্লিনিকের প্রধান ডাক্তার আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী, রূপবতী। কিন্তু তার ভাগ্যে যে কী আছে, এখন বলা যাবে না। অনেক সময় কোনো কোনো শিশু দেরিতে শোনে।
কিছুদিন গেলে বোঝা গেল, শিশু কোহিনুর চিরকালা। কানে শোনে না। কানে শুনতে না পারলে কথাও যে বলা হয় না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘যাক মন্দের ভালো’, মেয়েটির চোখের দৃষ্টি যথেষ্ট প্রখর। হাতের ইশারা ও ঠোঁট-জিহ্বার শব্দে লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। তবে তাকে পদ্ধতিগত শিক্ষা ধরে এগোতে হবে।
কোহিনুর বড় হতে থাকে। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ে। সেই সময় ঢাকায় তেমন কোনো বিশেষ স্কুল না পেয়ে তাঁরা তাকে কলকাতায় এক ‘ডিফ অ্যান্ড ডাম্ব’ বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করান। মেয়ের মন যে সেখানে টেকে না। শুধু কান্নাকাটি করে। তখন কোহিনুরের বাবা-মা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে কিছুদিন থাকেন। একসময় মেয়ের সেখানকার শিক্ষা শেষ হয়। তাদের নির্দেশ, বাড়ি গিয়েও এর চর্চা রাখতে হবে।
ঢাকায় ফিরে কোহিনুরের বাবার প্রধান ও একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল মেয়ের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক জোগাড় করা। কিন্তু ফল তেমন হলো না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেই বিশেষ লিপ রিডিং পদ্ধতির শিক্ষক খুঁজে পাওয়া গেল না।
এদিকে পাড়ারই ছেলে শফিক সুনামের সঙ্গে বিদেশ থেকে ডাক্তারি বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি শহরের বড় মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পাড়ায় চেম্বার খোলেন। সকাল-সন্ধ্যায় তিনি সেখানে বসেন। এই এলাকার লোকজনের চিকিৎসাসেবা দিতে থাকেন। বিনা পয়সায়।
একদিন কোহিনুরের মা-ই তার বাবার কাছে কথাটা তোলেন, ‘চারপাশের সবার মুখে মুখে ডা. শফিকের নাম। তিনি নাকি জাদুকরি ডাক্তার। বহু পুরোনো রোগ নিয়ে ভুগছে এমন সব রোগী ভালো হচ্ছে তাঁর চিকিৎসায়।’
একটু থেমে আবার বলেন, ‘আমি তো অতশত বুঝি না…কিসের ডাক্তার, কেমন তাঁর চিকিৎসার ধরন। তবে আমরা একবার কোহিনুরকে নিয়ে যেতে পারি তাঁর কাছে।’
বাবা মাথা নাড়েন। সেদিনই কোহিনুরকে নিয়ে তাঁরা ডা. শফিকের চেম্বারে গিয়ে আগে থেকে লাইন ধরেন। ডাক্তারের সহকারী তাঁদের চিনতে পারেন। পাড়ার সম্মানিত পরিবার।
ডাক্তার এলে সবার আগে তাঁদের ডাক পড়ে। সহকারী মিজান তাঁদের এগিয়ে নিয়ে যান।
‘স্যার, এ পাড়ার…।’
ডা. শফিক উঠে দাঁড়ান।
‘আপনাদের সামনেই তো আমাদের জন্ম। রেজিস্ট্রার আঙ্কেল কী মনে করে?…’
‘আর বাবা বোলো না…কোহিনুর মা তো জন্মকালা। তার ব্যাপারে ডাক্তার খুঁজছিলাম।’
‘ও…এই!’ ততক্ষণে ডাক্তার কোহিনুরের দিকে তাকিয়ে হেসে তার ঠোঁট-জিহ্বার অপরিচিত শব্দভঙ্গিমায় কী সব বলে গেলেন।
কোহিনুর তার ভাষায় কথা বলতে দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে হাসে। চুপ মেরে থাকে।
ডাক্তার আরও কিছু বলতে থাকেন। হাসতে হাসতে।
এবার কোহিনুর মাথা তোলে। সলজ্জ হাসে! ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দেয়। খানিকটা ঠেকে ঠেকে।
‘আঙ্কেল, আমি বুঝে গেছি আপনি কী জন্য এসেছেন। রোগীই তো আমাকে জানাল।’
কোহিনুরের বাবা-মা বিস্ময় প্রকাশ করেন।
‘তাহলে তুমি জন্মকালা-বোবাদের চিকিৎসাও করো?’
‘হ্যাঁ, বিদেশে আমার স্পেশাল ট্রেনিংয়ের সময় আমি তা-ও মোটামুটি শিখেছি। কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো। তবে সময় দিতে হবে। নিদেনপক্ষে ঘণ্টাখানেক।’
কোহিনুরের বাবা বিনীত হন।
‘তাহলে বাবা একটা ব্যবস্থা করো। আমরা যে বড় অসহায়। একটি মাত্র মেয়ে…।’
ডা. শফিক বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি সপ্তাহে রবি-মঙ্গল-বৃহস্পতি তিন দিন যাব আপনার বাসায়। ঘণ্টাখানেকের জন্য। হলো?’
‘হ্যাঁ…বাবা, তোমার দয়া।’
‘দয়া নয়, এটা আমার ডিউটি।’
বিচিত্র লিপ রিডিং ভাষায় ডাক্তার সাহেব তাদের বিদায় জানালে কোহিনুর লজ্জারাঙা হয়ে হেসে কুটিকুটি।
সময়-জীবন চলতে থাকে। কোহিনুর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দিকে পা বাড়ায়। তার মা-বাবাও বার্ধক্যের রোগ-শোকের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকেন। এর সঙ্গে তাঁদের অন্য এক চিন্তা, মেয়ের যে বিয়ের বয়স হলো। বিষয়টা নিয়ে পাড়ার ময়মুরুব্বি-শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গেও আলাপ করেন। কিন্তু ভালো-পছন্দসই প্রস্তাব তেমন আসে না। না আসার কথাও…মেয়ে কালা-বোবা। দু-চারটে যে আলাপ করতে আসে না তা-ও নয়। সেসব ধনী রেজিস্ট্রারের অঢেল সহায়-সম্পদের জন্য হয়তো আসে। এমন ভাবনার পরও তিনি প্রস্তাবগুলোকে একেবারে ফেলে না দিয়ে অন্তত দু-একটি হাতে রাখার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে পাড়ার পুরোনো খলিফার এক ছেলে অগ্রাধিকার পায়। একদিন সেই কথাটা ডা. শফিককেও জানান তার বাবা। তিনি তখন কোহিনুরকে মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছেন। হয়তো তা তখন মনোযোগ দিয়ে শোনেননি তিনি। তাঁর যাওয়ার আগে আবার আসেন কোহিনুরের বাবা।
‘ডাক্তার সাহেব আমার কথাটার তো কোনো জবাব দিলেন না।’
‘কোন কথাটা জানি?’
‘ওই যে দুলাল খলিফার ছেলের সঙ্গে কোহিনুরের বিয়ের প্রস্তাবটা।’
এবার ডা. শফিক মনোযোগী হয়ে বসে পড়েন। ‘কোহিনুরের বিয়ের এত তাড়াহুড়ার কী আছে? সে পড়াশোনা ভালোই করছে। এই লাইনে কিন্তু উচ্চতর শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে।’
তখন কোহিনুরের বাবা তাঁদের বয়স ও শারীরিক অবস্থার কথা তোলেন।
‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ছেলের খোঁজখবর নিয়েছেন?’
‘যত দূর জানলাম, এই পাড়ার আদি বাসিন্দা তারা। তাদের নিজস্ব বাড়িঘর আছে। বাপ-বেটা একত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য করে।’
ডা. শফিক উঠে যেতে যেতে বলেন, ‘একটু সময় নেন। আমিও ছেলের খোঁজখবর করি।’
পরের সপ্তাহে ডা. শফিক কোহিনুরকে পড়াতে এলে তার বাবাই আগে এগিয়ে আসেন।
‘ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন? ছেলের কোনো খোঁজখবর নিতে পেরেছিলেন? আপনি ব্যস্ত মানুষ…।’
‘হ্যাঁ নিয়েছিলাম। ছেলেটি বেশি সুবিধার না। কাজকর্ম তেমন কিছু করে না। পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা দিয়ে বেড়ায়।’
বাবা হতাশ হয়ে পড়েন।
‘তাহলে এখন উপায়?’
‘ভেবে দেখি। যাওয়ার সময় নাহয় আলাপ করা যাবে।’
‘আচ্ছা বাবা।’
পড়াশোনা শেষে কোহিনুর চলে যায়। বাবা আসরের নামাজ শেষ করে ফিরে আসেন।
‘আপনি একা একা বসে আছেন। চা খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি বলে ফেলি কথাটা। আমি কোহিনুরকে বিয়ে করতে চাই। আপনার আপত্তি আছে?
কোহিনুরের বাবা শফিকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে তাঁকে হাত ধরে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ‘এ-ও কি সম্ভব বাবা!’
সপ্তাহখানেকের মধ্যে প্রচুর ধুমধামের মধ্য দিয়ে ডা. শফিক ও কোহিনুরের বিয়ে হয়ে যায়। আর দিন দুয়েকের প্রস্তুতিতে স্বামী-স্ত্রী মধুচন্দ্রিমায় বালি দ্বীপপুঞ্জে চলে যান।
শফিক হাসে, ‘আমি তো জানতাম।’
বছর গড়িয়ে যায়। একে একে শফিক-কোহিনুরের সুখের ঘর উজ্জ্বল করে আসে ছেলে—কবীর, কায়েস, রাশেদ ও মেয়ে আতিয়া। তারা সবাই ছোটবেলা থেকেই মায়ের কথা বলা-শোনার বিশেষ ধরন রপ্ত করে নেয়। তাদের পারিবারিক বৃত্তে তাদের বলা-কওয়া-শোনা কোনো কিছুর সমস্যা হয়নি। শফিক ও কোহিনুরের সংসার চলছিল সুখে-স্বচ্ছন্দে।
ডা. শফিকের মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে দুপুর প্রায় বারোটা বেজে যায়। তাঁর মরদেহ রাখা হলো বাসার উঠানে। বহুদিনের নিষ্ফলা পেয়ারাগাছের নিচে। সকাল থেকেই পুরো এলাকায় খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এই বাড়িতে নেমে আসে মানুষের ঢল। তাদের প্রিয় ডাক্তার দাদাকে একবার দেখার জন্য, শেষবারের মতো।
পাড়ার ময়মুরুব্বি ও মসজিদের পেশ ইমামকে নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, বাদ আসর জানাজা শেষে শফিককে কবরস্থ করা হবে আজিমপুর কবরস্থানে।
জানাজার জন্য মসজিদে নিয়ে যাওয়ার আগে বাড়ির সবাই শেষবারের মতো তাঁকে একনজর দেখে যায়। শুধু নেমে আসেননি তাঁর স্ত্রী কোহিনুর। তাঁর ছেলেমেয়েদের অনুরোধ, কাকুতি-মিনতি সবই ব্যর্থ হলো। কোহিনুর যেমন ছিলেন, তেমনি বসে রইলেন। নিষ্পলক। তিনি একফোঁটা চোখের জলও ফেলেননি।
এরই মধ্যে আতিয়ার ছোট চাচির নেতৃত্বে পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক নারী আসেন কোহিনুরের কাছে। তাঁরা প্রথমে তাঁকে বিছানায় রেখেই রঙিন শাড়ি খুলে তাঁর দেহে বৈধব্যের সাদা শাড়ি পেঁচিয়ে দেন। তখনো তিনি শান্ত। তাঁর পাশে মেয়ে আতিয়া। কিন্তু যখন তাঁরা তাঁর হাত ধরে চুড়ি-বালা খুলতে গেলেন, তখন কোহিনুর প্রবল আপত্তি ও বাধা দিলেন। কিছুতেই তিনি হাতের চুড়ি-বালা খুলতে দেবেন না। কিন্তু নিয়ম-কানুন যে মানতেই হবে। আতিয়াও চেষ্টা করল। ফল হলো না। অগত্যা তাঁরা বল প্রয়োগ করে তাঁর হাত থেকে সেসব খুলতে থাকেন। মোটামুটি খুলেও ফেলেন। কিন্তু সমস্যা হলো শেষের মোটা সোনার বালাটা নিয়ে। সেটা যে কোহিনুরের হাতে আঁটসাঁট হয়ে দাগ কেটে বসে গেছে। ছোট চাচি এর ব্যবস্থা নিলেন। হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে এলেন। এবার কোহিনুর দাঁড়িয়ে উঠে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর চিৎকার ও আপত্তির কথাগুলো কে কতটুকু বুঝল, বোঝা গেল না। তবে আতিয়া ঠিকই সব বুঝল। মা বলছেন, ‘এই বালা আমি কিছুতেই খুলব না। এটা আমার স্বামী বিয়ের দিন নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।’ একসময় জোরাজুরিতে তাঁরা সফল হলেন। হাতুড়ি-বাটালির আঘাতে বালাটা কেটে যায়। কোহিনুরের হাত একেবারে খালি হয়ে যায়।
তখন কোহিনুর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই বাড়িতে এইমাত্র যেন দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে গেল। পাশে বসে কাঁদে আতিয়া। কান্নায় তার হেঁচকি উঠে যায়।
ছেলেমেয়েরা অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তার ডাকে। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দেন। এই অবস্থায় মুখে ওষুধ দেওয়ার উপায় নেই। প্রায় মাঝরাতের দিকে কোহিনুরের জ্ঞান ফেরে। তিনি তাঁর দুহাত খালি দেখে আবার বিলাপ শুরু করেন। তা থামার কোনো লক্ষণ নেই।
পরদিন সকালে আবার ডাক্তার আসেন। ওষুধপথ্য দেন। কিন্তু কোহিনুর যে নিয়ন্ত্রণহারা। তাঁর পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ নেই। নিয়মিত ডাক্তার দেখে যান। কোনো দিন ছেলেমেয়েরা মাকে এক-আধটু কিছু খাওয়াতে পারে, কোনো দিন পারে না। আতিয়া মায়ের পাশে শোয়।
একদিন রাতে কোহিনুর মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠান। ‘তোমার বাবা এসেছিল। তাকে খুব হাসি-খুশি লাগছিল।’
ছেলেরা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও আতিয়া মাকে সামলানোর চেষ্টা করে যায়। এর মধ্যে আবার তার পরীক্ষা চলছে। মাকে কোনোমতে ঘুম পাড়াতে পারলে আতিয়া উঠে তার পড়ার ঘরে চলে যায়। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়।
একদিন পরীক্ষার পড়া কিছুটা গুছিয়ে মায়ের কাছে শুতে এসে দেখে দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ছিটকিনি ওঠানো। সে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে জোরে দরজা ধাক্কা দিলে তা খুলে যায়। ঘরে বাতি জ্বালানো। উজ্জ্বল আলোয় আতিয়া দেখে, বাবার কাশ্মীরি শালে সারা দেহ ঢেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মা। সে খানিকটা এগিয়ে গেলে দেখতে পায়, তার বাবা নিয়মিত যে ঘুমের বড়ি খেতেন, সেই কৌটাটা বিছানায় খালি পড়ে আছে। সে একটানে চাদর সরিয়ে দেখে, মায়ের খালি হাতে শোভা পাচ্ছে কাটা সোনার বালা দুটি। তাঁর সুন্দর হাত দুটি সযত্নে বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখা।
মায়ের গায়ে হাত দিয়ে সে চমকে ওঠে। ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে বারান্দায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায় আতিয়া।