মাটির মায়া

শ্রীমঙ্গলের নির্বাহী কর্মকর্তা কাহহার এ. খন্দকার সরকারি কাজে ঢাকায় এসে খবরটা পায়। তার বিশেষ বন্ধু সুশীল অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। গ্রিন রোডের হাসপাতাল থেকে তাকে দেখে বেরোতে বেরোতে রাত হয়ে যায় তার।

কাহহার বড় হয়েছে মতলব থানার নদীঘেঁষা এক গ্রামে। বন, ঝোপঝাড়ে ঘেরা সেই পল্লী গ্রামে কেটেছে তার বাল্যকাল। মেঝ চাচার বাড়িতে। তিনি মোটামুটি সচ্ছল ছিলেন; কিন্তু তার ঘরে সন্তান আসেনি। তাই পিতা-মাতাহীন এক শিশুর দায়িত্ব তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। চাচিও তাই।

তার বড় ভাই ও ভাবি সারা গাঁয়ের নিরীহ মানুষের এক কাতারে বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে আসা গুলিতে প্রাণ হারিয়ে ট্রাকভর্তি লাশ হয়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছেন। তা তিনি ভুলতে পারেননি। কাহহারের বাবা-মা একাত্তরে শহীদ হয়েছেন। তার বয়স তখন তিন বছর হবে হয়তো। চাচা-চাচি অফুরান ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড় করেছেন। তারা তাকে স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন। সে ছাত্র ভালো ছিল। সেও একে একে ক্লাসের সিঁড়ির পর সিঁড়ি ডিঙিয়ে গেছে। সম্মানজনক রেজাল্ট নিয়ে। তার সামনে টার্গেট ছিল বিসিএস পরীক্ষা। বিসিএস পাস দিয়ে দাপুটে প্রশাসক হবে বলে সে পণ করেছিল। পরের অধ্যায়ে সে তার জীবনকে পরিপূর্ণ সুখের-শখের আদলে ভরিয়ে তোলার এক নকশা এঁকেছিল। এমনি সুখ-স্বপ্নের পেছনে হয়তোবা একটা সুপ্ত কষ্ট-চেতনা তাকে সজাগ করে রেখেছিল। যদিও তার চাচা-চাচি কোনোদিন তাকে তার মৃত বাবা-মার সূত্র ধরে তেমন কিছু বলেননি।

কিন্তু গাঁয়ের দশজনার সেই দুঃখ-কষ্টের বয়ান-ফিরিস্তিতে সে আহত হয়েছে অনেকবার। হাসপাতাল গেটে আরও কিছুটা সময় সে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। একসময় গেস্টহাউসের বয়-বাবুর্চিরা যে তার অপেক্ষায় আছে তা ভেবে সে রিকশা নেয়। রিকশা কিছুদূর এগিয়ে যানজটে পড়ে। রিকশাওয়ালা মাথার গামছা খুলে ঘেমে থাকা মুখ মুছে। হাত-পা টান টান করে। যানজটে পড়ে গিয়েও তার নির্লিপ্ততা কাহহারকে আকর্ষণ করে। তার রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়।

‘এই রিকশাওয়ালা ভাই, আজকে কত কামাইলা?’

‘ঠিক মতো চালাইতে পারলে কামাই ভালোই অয়। কিন্তু ঐ যে সময় যায় বইয়া বইয়া…

‘কেমন আয় অইল?’

‘খারাপ না … আট-নয় শ’।

‘বাহ্‌ বেশ তো…মন্দ কী!

‘হ থাহা-খাওয়া মহাজনের চালান সব দিয়াও ছ-সাত থাহে।’

‘টাকা কী কর?’

‘মাসে আট-নয় হাজার বাড়িতে দিতি অয়।’

‘এত না দিয়ে জমাইতে পার না?’

‘এইডাত আমি অ চাই… কিন্তু ঐ যে চাল কিনতি লাগে। বাড়িতে চার-পাঁচডা মুখ। এইডাই-ত সমস্যা। জমাইতে পারলে ত আমার রেহানের জমিডাঐ ছাড়াইতে পারতাম… চেষ্টা করতাছি… একবার জমিডা ছাড়াইতে পারলে আর আইতাম না এই শহরে।’

কাহহার কৌতূহলী হয়।

‘তোমার দেশ কোথায়’

‘কুড়িগ্রাম। চতুরা…

‘এতদূর থেকে ঢাকায় আস কেন?’

‘দেশে যে কামকাজ নাই… তবে জমিডা হাতে পাইলে দেশেও কাজের অভাব অইবো না।’

‘জমিডা ছাড়াইতে পারলেই হয়ে যায় তোমার?’

‘হ্যাঁ… কৃষক একবার বছরের চাল ঘরে তুলতে পারলে তার আর কিছু লাগে না। … আমার ঘরে গরু আছে একটা। দাম চল্লিশ হাজার পর্যন্ত উঠছে। দিনে এর লাগে একশ’ টাকার খোরাকি। গরুডার দাম পঞ্চাশ তুলতে পারলে আমার হইয়া যায়। বাকি দশ হাজার গতরে খাইট্টা, ধারকর্জ কইরা জোগাড় কইরা নিতে পারতাম।’

‘জমিটার দেনা ষাইট হাজার।’

‘জি হয়।’

যানজট আস্তে আস্তে ছুটতে থাকে। রিকশাওয়ালা প্যাডেলে পা রেখে রেডি হয়। সে গাড়ি-ঘোড়ার ফাঁকফোকর বের করে চুটিয়ে রিকশা চালায়। অল্প সময়ের মধ্যে সে ধানমণ্ডি ৮ নম্বরে পৌঁছে যায়। কাহহার তাকে গেস্টহাউসের সামনে থামতে বলে। সে রিকশাওয়ালাকে ৫০ টাকা দেয়। টাকা হাতে সে ছালাম জানায়।

‘স্যার, দাওয়াত রইল আমার নাম রইস আলী। গ্রাম চতুরা, কুড়িগ্রাম…। এবার বাড়ি ফিরেই আবার গরুডার দাম তুলমু। ৪৫-৫০ পাইয়া গেলে আমার আর পায় কে? জমি খালাস… বছরের চাল ঘরে উঠবো।’

কাহহারের প্রথম পোস্টিং হয়েছিল সিলেটে। জায়গাটা মোটামুটি তার ভালো লেগে গিয়েছিল। ভেবেছিল, আরও কিছুদিন সে এখানে থাকবে। ভালোলাগার আর একটা প্রধান কারণ হলো, রেবেকা। রেবেকা স্থানীয় সরকারি মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা ও সঙ্গীতের শিক্ষক। তার সঙ্গে কাহহারের দেখা ওই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। প্রধান অতিথির আসনে বসে অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তিনি শুনছিলেন রেবেকার কণ্ঠে রজনীকান্তের বিরল এক গান। গানের মোহমুগ্ধকর কথা-সুরমূর্ছনার বিষাদ ও মিষ্টিমধুর তান তাকে আকৃষ্ট করেছিল।

অনুষ্ঠান সমাপ্তির চায়ের আসরের পরিবেশনকারীদের একজন ছিল রেবেকাও। কাহহার আড়ে আড়ে তাকে লক্ষ্য করছিল। রেবেকার আনুষ্ঠানিক পোশাক-আশাকের কোথাও অতিরঞ্জন ছিল না। বরং অন্যদের তুলনায় তা সাধারণের পর্যায়েই পড়ে। তবে তার শ্যামলা-সুশ্রী মুখমণ্ডলে কাজল টানা চোখের প্রশান্ত আমেজ, শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে সুস্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য, ধীর ছন্দিল চলাফেরা কাহহারকে মুগ্ধ করেছিল।

এরপর মাঝে মাঝে কাহহারের রেবেকার কথা মনে হয়েছে। সপ্তাহখানেক পর আকস্মিক রেবেকার ফোন আসে।

‘স্যার আমি রেবেকা।… বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক।’

‘হ্যাঁ, খুব ভালো মনে আছে।’

‘আমি একটু আসতে চেয়েছিলাম। আপনার সময় হবে?’

‘অবশ্যই… আসনু।’

অফিসের দারোয়ানকে বলা ছিল।

সে সোজা রেবেকাকে তার ঘরে নিয়ে আসে।

কাহহার দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে তার পিএস আসে।

‘স্যার চা-নাশতা দেব?’

‘না… পরে…।’

ততক্ষণে বিকেলের রোদ মিইয়ে আসতে শুরু করেছে।

কাহহার কথা বলতে শুরু করে।

‘এরপর, আছেন কেমন?’

‘ভালো স্যার। তবে ক্লাস লোড বড় বেশি। প্রয়োজনের চেয়ে শিক্ষক কম।’

কাহহার ধরে নিয়েছিল, রেবেকা এসেছে সৌজন্য সাক্ষাৎ বা বিশেষ কোনো টান-আকর্ষণে।

সারাদিন ক্লাস নেওয়ার ক্লান্তি তার চোখেমুখে… কথা বলার ভাব-ভঙ্গিতে, দেহের ভাষায়।

কিছুটা যেন লাজ-নম্র বিনীত হয়েই রেবেকা কথাটা তোলে।

‘আপনি ব্যস্ত মানুষ। তারপরও আপনাকে বিরক্ত না করে পারলাম না। উপায়হীন হয়ে…।’

কাহহার তাকে নির্ভয় দেয়।…

‘আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।’

‘জি বলছি।’ এর পরও সে কিছুটা সময় নেয়।

‘স্যার, আমার বাবার একমাত্র সন্তান আমি। তার সহায়-সম্পত্তি কম না। এখন তার বয়স হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই মুসলিম ল’ জানেন, শুধু কন্যা থাকলে ভাই-বেরাদরের সন্তানরা সম্পত্তির ওয়ারিসান হয়। আমার চাচাতো ভাইবোনরা মানুষ ভালো না। তাই তিনি তার সম্পত্তি আমাকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন।’

কাহহার ভাবতে পারেনি, রেবেকা এমন একটা বৈষয়িক সমস্যা নিয়ে আসবে। তারপরও সে এসেছে দূর থেকে কষ্ট করে। তার সমস্যার কথা… লোক দেখানো হলেও তাকে শুনতে হয়।

‘ভালো কথা, বাবা আপনাকে তার সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন। আপনার বাবা সাবধানী-বৈষয়িক মানুষ।’

‘কিন্তু স্যার, তিনি যে কাজটা শেষ করতে পারছেন না।’

‘কেন?’

‘ঐ যে মিউটেশন না নামজারি কী একটা বলে, সেটাতো করতে পারছেন না।’

‘কেন?’

‘নামজারি অফিসের কর্তারা অনেক টাকা চাইছে। আমি উকিল লাগিয়েছি … তারপরও…।’

কাহহার পিএসকে ফোন দেয়।

‘রেজিস্ট্রারকে ফোনে লাগান।’

রেজিস্ট্রার তার ব্যাচ-মেট।

তারা খানিকক্ষণ আলাপ-সালাপ, হাসাহাসি করে। শেষের দিকে কাহহার রেবেকার সমস্যার কথাটা ওঠায়।

ফোন রেখে রেবেকার কাগজপত্র দেখে কাহহার।

‘সমস্যা তো তেমন কিছু দেখছি না।’

সে পিএসকে ডাকে ‘এই কাগজগুলোর এক সেট কপি করে রেখে দেন।’

‘আর শুনুন, আগামীকাল দুপুরে আমি রেজিস্ট্রারের ওখানে খাবো। যাওয়ার আগে ওনার কাগজগুলো ফাইল করে আমাকে দেবেন। ভুলেন না যেন।’

‘জি স্যার।’

কাহহার হাসে।

‘আপনার কাজ হয়ে গেছে। কালই সই হবে।’

রেবেকার প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম।

‘বলেন কী স্যার? প্রায় এক বছর যাবত…।’

‘ঐ চ্যাপ্টার শেষ। এখন চলুন বের হই।’

‘কোথায়?’

‘আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।’

‘আপনি আমাকে…।’ সলজ্জ হেসে রেবেকা শাড়ির আঁচলে খানিক মুখ ঢাকে।

‘হ্যাঁ, আসাটা আপনার, যাওয়াটা আমার। এইটুকু সমাদর অন্তত আপনার পাওনা। উঠুন…।’

কাহহারের ড্রাইভার অফিস বারান্দায় অপেক্ষা করছিল।

সে গাড়ি নিয়ে আসে।

তারা পাশাপাশি বসে। কাহহার রেবেকার বাড়ির ঠিকানা জেনে ড্রাইভারকে জানিয়ে দেয়।

কাহহার রেবেকার লাজুক অবস্থা বুঝে তাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য পারিবারিক প্রসঙ্গ তোলে।

‘আপনার বাসায় আর কে আছে?’

‘মা মারা গেছেন বছর দুই।’

‘আপনার স্বামী-সন্তান?’

রেবেকা খানিকক্ষণ লজ্জারাঙা হয়ে মাথা নুইয়ে বসে থাকে।

‘আমি তো বিয়ে করিনি স্যার। বাবা-মেয়ের সংসার। একজন পুরনো বুয়া আছে আর একজন বয়স্ক লোক। বাবার অফিসের। বাইরে যেতে হলে সেই তার সঙ্গে যায়।’

‘ছোট্ট সংসার আপনাদের।’

‘হ্যাঁ’। রেবেকা শাড়ির আধা ঘোমটাটা মাথা ছুঁয়ে পড়ে গেলে তা সে তুলে দেয়। রেবেকা শান্ত নিচু গলায় কৌতূহল প্রকাশ করে।

‘আপনার বাড়িতে কে আছে?’

‘কেউ না।’

‘মানে?’

‘মানে, কেউ না।’

‘আপনার বাবা-মা-সংসার?’

‘বললাম তো কেউ নেই।’

উত্তরগুলো একটু রূঢ় হয়ে যাচ্ছে মনে করে কাহহার নিচুস্বরে আবার বলে, ‘সত্যি কথা হলো, বাবা-মাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। তাই তাদের সম্পর্কে শোনা কথা আমি কাউকে বলি না। আর আমি বিয়ে করিনি।’

রেবেকার সামনে কাহহার এক রহস্যঘন মানুষ হয়ে থাকে। এ নিয়ে সে আর কথা বাড়াতে সাহস পায় না।

তাদের গাড়ি এগিয়ে চলে।

আঁকাবাঁকা পথ, কখনও তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ বনভূমি। কখনও দু’পাশ ধরে উঠে গেছে টিলা-পাহাড়।

কাহহার অন্যমনস্ক হয়ে নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো বলতে থাকে, ‘জায়গাটা ভালোই লেগে গিয়েছিল। এর মধ্যে বদলি হয়ে গেলাম।’

রেবেকা চমকে ওঠে।

‘কী বললেন? বদলি হয়ে গেছেন… কোথায়?’

‘কুড়িগ্রাম… সাত দিন পর সেখানে জয়েন করতে হবে।’

এরপর সারাপথ রেবেকা একটাও কথা বলতে পারেনি। বজ্রাহতের মতো চুপটি মেরে থাকে। রেবেকা তার বাড়ির সামনে নেমে সামান্য একটু হাত উঁচিয়ে শুধু বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’

রেবেকার বিদায়ী শেষ কথাটি কাহহারের কাছে কান্নার মতো শোনায়।

কাহহার রাতে শুতে গেলে ঘুম আসে না। সে উঠে বসে। বাতি জ্বালিয়ে পানি খায়। সে টের পায়, তার পুরো অস্তিত্বজুড়ে রজনীকান্তের গানের একটি মিষ্টিমধুর সুর, কাজলটানা একটা বড় চোখের শ্যামলা মেয়ে, তার সংশয়-বিনয়-দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাকে অস্থির করে তুলেছে। সে যে এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি চাইছে তাও নয়। সে রেবেকাকে তার মনের-হৃদয়ের কাছাকাছি বসিয়ে তাকে নিয়ে ভাবনার গভীরে তলিয়ে যেতে চাইছে আজ।

কাহহার পুরো ব্যাপারটার জটিলতা ছাড়িয়ে নিজেকে সহজ অবস্থানে বসানোর চেষ্টা করে। সে রেবেকাকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে আবার ভাবে- এমনতো হতে পারে, রেবেকা অন্য কাউকে ভালোবাসে। সে ক্ষেত্রে তার আর কিছু করার নেই। তখন তার নিজের কাছে নিজের ছুট্টি। গত জীবনে সে তো কম নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হয়নি। নিখোঁজ বাবা-মায়েরও সন্ধান নেওয়ার চেষ্টা করেনি সে। সুতরাং রেবেকাকে ঘিরে আগামী কয়েক দিনের বাস্তব প্রোগ্রামের একটা ছক এঁকে ফেলে সে।

পরের দিন গুরুত্ব সহকারে সে রেবেকার দেওয়া কাজটা গুছিয়ে ফেলে। এর পরের দিন বেলা ১১টায় তাকে ফোন দেয়। রেবেকা কল রিসিভ করেনি। এর ঘণ্টাখানেক পর রেবেকা রিটার্ন কল দেয়, ‘স্যার আমি খুব লজ্জিত। আপনার কলটা রিসিভ করতে পারিনি… আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি গানের ক্লাসে ছিলাম।’

‘ও…কিছু না। যাক, খবর ভালো। আপনার মিউটেশনের কাজটা হয়ে গেছে। আপনি সময় করে নিয়ে যাবেন। না-কি আপনার স্কুলে পাঠিয়ে দেবো?’

‘না…স্যার… না আমি আজই আসবো আপনার ওখানে। তবে ৩টার পর … ক্লাস শেষ করে।’

‘আসুন দেখা হবে।’

রেবেকা আড়াইটার দিকেই কাহহারের অফিসে চলে আসে।

কাহহার ঘড়ি দেখে,

‘আপনি ৩টার পর আসবেন বলেছিলেন।’

‘হ্যাঁ, ম্যানেজ করে ফেললাম। ক্লাসটা আসমাকে গছিয়ে দিয়ে এলাম।’

‘দরকার তো ছিল না।’

‘আমার দরকার ছিল। এখানে আসবো… আমার তর সইছিল না।’

কাহহার মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গ তোলে, আপনি খেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ… বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসি।’

কাহহার লক্ষ্য করে, রেবেকা আজ হালকা সেজেছে। তার নাকে সাদা পাথরের নাকফুল, দু’হাতে দুটো মোটা সোনার বালা, কানে লম্বা দুল। পাটভাঙা শাড়িটাও নীল রঙে সোনালি কাজ। চুল গোছানো নয়, এলোমেলো। বাতাসের ঝাপটায়…।

রেবেকার তার উড়ূ উড়ূ চুল হাতে গোছানোর চেষ্টা করে সন্তুষ্ট হতে পারে না। সেই উশখুশ করে, ‘আমি কি আপনার ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারি?’

কাহহার সজাগ হয়ে পিয়নকে ডাকে।

‘দেখ তো বাথরুম পরিস্কার কি-না? সেটা গুছিয়ে ধোয়া টাওয়েল রাখ।’

অনেকটা সময় নিয়ে চুল, সাজগোজ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, শাড়ি গুছিয়ে খানিকটা পারফিউমের সুগন্ধ ছড়িয়ে রেবেকা ওয়াশরুম থেকে বের হয়। হাসতে হাসতে চেয়ারে এসে বসে। রেবেকাকে পরিচ্ছন্ন, প্রাণবন্ত দেখায়।

কাহহার তার দিকে চেয়ে হাসে।

‘চা খাবেন তো।’

কাহহার পিয়নকে ডাকে।

‘দু’জনের জন্য চা নিয়ে এসো। দুধ-চিনি আলাদা আলাদা।’

তারা সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে চা খায়। এর মধ্যে দুটি টেলিফোন কল আসে। কাহহার পিএসকে জানিয়ে দিতে বলে, ‘পরে ফোন করতে… আমি ব্যস্ত।’

রেবেকা হাসে।

‘আপনি ব্যস্ত? দিব্বি বসে বসে চা খাচ্ছেন।’

‘হ্যাঁ ব্যস্তই তো…আপনার মতো মেহমান আমার কয়টা আসে?’

‘এমন মেহমান আসে না?’ বলে রেবেকা কেমনতর একটু বিষণ্ণ হয়ে থাকে। চুপচাপ হয়ে যায়। এর আগে তারা দিব্বি নানা বিষয়ে কথা বলছিল।

এবার কাহহার ভেবে রাখা প্রাসঙ্গিক কথার দিকে এগোয়।

‘আপনার কাজটা হয়ে গেছে। আপনাদের জমিজমার বকেয়া খাজনাও দেওয়া হয়েছে।’

‘নিশ্চয়ই অনেক টাকা লেগেছে? আমি দিয়ে দেব।’

‘সামান্যই… দিতে হবে না।’

কাহহার রেবেকার চোখে চোখ রেখে গত রাতে পরিকল্পনাটার কথা ভাবে এবং তার মনে হতে থাকে, রেবেকার সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়ার এটাই উপযুক্ত সময়।

রেবেকার মিউটেশন-সংক্রান্ত কাগজপত্রের ফাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সে প্রসঙ্গটা কায়দা করে ওঠায়।

‘আপনার বাবা বৈষয়িক দূরদর্শী মানুষ। তার উত্তরাধিকারের দায়-দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু যাকে তিনি সব বুঝিয়ে দিলেন, তার ভূত-ভবিষ্যৎ, সংসারে তার সঠিক অবস্থান কী, তা কি তিনি ঠিক করেছেন?’

‘ঠিক বুঝলাম না স্যার।’

‘মানে সরাসরি বলতে গেলে বলতে হয়, আপনার বিয়ে সম্পর্কে তিনি কী করেছেন?’

রেবেকা সলজ্জ হেসে দ্রুত মাথা নামিয়ে নেয়। মাথা থেকে খসে পড়া শাড়ি টেনে তোলে।

সে ধরা গলায় কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যায়। বলতে পারে না। আবার সচেষ্ট হয়ে আমতা আমতা করে।

‘বাবা নিজের মতো করে চেষ্টা তো কম করেননি… সুবিধা হয়নি। নিকট আপনজন, আত্মীয়স্বজন তেমন না থাকলে যা হয়, আমার বেলায় তাই হয়েছে। তেমন সাহায্যও পাইনি।’

কাহহার এবার তার আসল কথায় এগিয়ে যায়।

‘ধরুন, আমি আপনার নিকট কোনো আত্মীয়স্বজন বা শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি যদি আপনার পাত্রের সন্ধান করি… আপনার আপত্তি আছে?’

রেবেকার মাথা সামনে আরও নুয়ে পড়ে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না।

কাহহার আবার তার কথার জের টেনে আনে।

‘ধরুন সাদাসিদে একজন মানুষ। ভালো চাকরি করে। সংসারের কোনো পিছুটান নাই। … এমন একটা প্রস্তাব আমি যদি আনি… আপনি কি তাতে মনোযোগী হবেন। ভেবে দেখবেন?’

রেবেকা একেবারে চুপ। মুখে কোনো কথা নেই। তার মুখ ঘোমটায় প্রায় ঢাকা।

কাহহার ড্রাইভারকে ডাকে।

‘চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ গাড়ি ছুটে চলেছে।

‘আপনি যখন কিছু বলছেন না, আমি আর একটু খুলে বলি। সেই পাত্রটির নাম কাহহার এ খন্দকার। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।’

ওই একই অবস্থায় বসে থেকে তার পাশে রাখা কাহহারের হাতটা রেবেকা তার হাতে তুলে নেয়।

বাড়িতে পৌঁছে কাহহার রেবেকাকে গাড়ি থেকে হাত ধরে নামায়।

রেবেকা কাঁপা গলায় বলতে চাইলো,

‘স্যার একটু বসে গেলে হয় না?’

‘না কাল আসবো সন্ধ্যালগ্নে… তোমার বাবার সঙ্গে কথা আছে আমার।’

‘আজ থেকে আর আপনি নয় ‘তুমি’। কেমন…’

রেবেকা বিস্ময়াভিভূত হয়ে কাহহারের চলে যাওয়ার পথ ধরে চেয়ে থাকে। আধো অন্ধকারে।

পরের দিন চা খেতে খেতে কাহহার রেবেকাকে ফোন করে।

‘তোমার তো স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এলো।’

‘না… আমি আজ স্কুলে যাবো না।’

‘মিথ্যা কথা বলে বাসায় থাকবো। তোমার জন্য রাঁধবো।’

কাহহার হাসে।

‘কী রাঁধবে।’

‘কেন খাসির মাংস-সাতকরা (সিলেটি ডেলিকেসি)।’

‘হ্যাঁ, বাবার সঙ্গে কথা বলে রেখ।’

‘বলেছি।’

সন্ধ্যার সময় কাহহার আসে। সঙ্গে মওলানা গোছের একজন। রেবেকার বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কাহহার এগিয়ে এসে তার সঙ্গে বুক মেলায়।

‘আপনি নিশ্চয়ই রেবেকার বাবা?

‘হ্যাঁ।’

তারা ঘরে গিয়ে বসে। রেবেকা এসে সবাইকে সালাম দেয়।

কাহহার কিছুটা তাড়াহুড়া করতে চায়।

‘ভদ্রলোকের সময় কম। তার অন্য একটা প্রোগ্রাম আছে।’

একটু থেমে সরাসরি রেবেকার বাবাকে জিজ্ঞেস করে কাহহার, আপনি নিশ্চয়ই সব শুনে থাকবেন রেবেকার কাছে?

‘হ্যাঁ শুনেছি।’

‘আপনার আপত্তি নেই তো?’

‘আপত্তির কী আছে?’ তিনি কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন।

‘তাহলে শুরু করেন কাজী সাহেব।’

রেবেকা ভেতর বাড়িতে চলে যায়।

কাজী সাহেব নিকাহনামার কাগজপত্র রেডি করে এনেছিলেন। নামধাম বসিয়ে দু’জনকেই ডাকেন তিনি। ‘আপনারা সই করুন।’

রেবেকাকে তার বাবা ডাকেন, ‘মা আসো।’

তারা উভয়ই সই করে। বিয়ের পর্ব এ পর্যায়ে শেষ। কাজী সাহেব মুখে একটু মিষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়ান।

কাহহার ড্রাইভারকে ডাকে।

কাজী সাহেবকে নিয়ে সে চলে যায়।

তাদের খাওয়া শেষ হতে হতে রাত বাড়ে। কাহহার উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে বলেন, ‘আমি তিন দিন পর চলে যাবো কুড়িগ্রাম।’

‘সেখানে জয়েন করে এসে রেবেকাকে নিয়ে যাবো।’

বিদায় দিতে গিয়ে কাহহারের হাত ধরে অনেকটা পথ হাঁটে রেবেকা। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে গিয়ে সে কাহহারের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘এমন একটা রাত আমার জীবনে আসবে…।’

কাহহারও তার হাত ধরে রাখে… ‘রেবেকা আমাকে ছেড়ে যাবে না তো কোনোদিন? আমি বড় একা…।’

কাহহার কুড়িগ্রামে বদলি হয়ে যায়। সরকারি রেস্টহাউসে রাত কাটিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতে বেয়ারা-বাবুর্চি এসে সালাম জানায়।

‘স্যার কফি, না চা?’

‘চা দাও। ভালো বিস্কুট থাকলে দিতে পারো।’

অল্পক্ষণের মধ্যে তারা আবার ফিরে আসে। ট্রেতে সাজানো চা-বিস্কুট নিয়ে।

গোসল সেরে সে বের হতে না হতে বেয়ারা এসে জানায়, ‘স্যার এ.ও. সাহেব গাড়ি নিয়ে এসেছেন।’

নাশতা সেরে কাহহার অফিসে চলে যায়। তার বসার ঘর, টেবিল-চেয়ার, কেবিনেট ওয়াশরুম ততক্ষণে ধোয়া-মোছা ও সাজানো হয়ে গেছে। অফিসের নতুন বড় সাহেবের মেজাজ-তরিকা কারও জানা নেই। তাই সবাই সন্ত্রস্ত-তটস্থ।

তার টেবিলের সামনেই ছিল আজকের দৈনিক পত্রপত্রিকা। সেগুলো সে উল্টেপাল্টে দেখছিল। হঠাৎ স্থানীয় পত্রিকার একটা ছবি ও খবরের দিকে সে মনোযোগী হয়। হেডিং ‘গরুর ওপর মানুষের আক্রমণ।’ তাতে সে চোখ বুলিয়ে যা বুঝল, তা হলো… আক্রোশের বশবর্তী হয়ে চতুরা গ্রামের এক নিরীহ গরিব কৃষকের একমাত্র গরুটি রাতের বেলায় কে বা কারা দা-কুড়াল দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়েছে। গরুটির অবস্থা সংকটজনক।

‘চতুরা’ নামটা কাহহারের কাছে পরিচিত মনে হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায়, হ্যাঁ তার বন্ধু সুশীলকে যে ঢাকায় গ্রিন রোডের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল, সেদিন জ্যামে পড়া এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ে, সেই রিকশাওয়ালা বলেছিল, তার নাম রইস আলী, গ্রাম চতুরা, কুড়িগ্রাম। আরও জানিয়েছিল, তার একটা দামি গরু আছে… তা বিক্রি করে সে স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। সেই গ্রামে তার বাড়িতে সে তাকে নিমন্ত্রণও করেছিল।

কাহহার কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে এ.ও. কে ডাকে।

‘আপনি কি চতুরা গ্রাম চেনেন?’

‘হ্যাঁ… স্যার এখান থেকে বেশিদূর নয়। আধা ঘণ্টার পথ।’

খবরটা এ.ও. কে দেখায় সে।

এ.ও. খবরটা খুব সাধারণভাবে নেয়।

‘এসব অঞ্চলে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। স্থানীয় লোকগুলো বেশি সুবিধার নয়।’

‘গাড়ি রেডি করেন তো… একটু ঘুরে আসি। প্রয়োজনে একটা জিডি করা দরকার।’

এ.ও. খানিকটা যেন বিরক্ত হলো। সকাল সকাল গরু মরার তদন্ত…।

চতুরা গ্রামে গিয়ে সহজেই ঐ বাড়িতে পৌঁছে যায় তারা। সে বাড়ি লোকজনের জমায়েত হয়েছে।

কাহহার গোয়ালঘরে গিয়ে দেখে, মৃতপ্রায় গরুর ঘরে একজন বিলাপ করছে ‘তুই চইল্লা গেলি, হায় রে… আমার রেহানের জমি আর পাইলাম না।’

কাহহার আরও নিশ্চিত হয়। এটা সেই দিনকার ওই রিকশাওয়ালাই। এখন তার নামটাও আবছা আবছা মনে পড়ে যেতে থাকে।

এ.ও. সাহেবের মাধ্যমে সে জানতে পারে, ওই কৃষকের নাম রইস আলী।

কাহহার মর্মাহত হয়। সে এ.ও. কে নির্দেশ দেয়, স্থানীয় লোকজন যেন একটা ডায়েরি করে। অফিসে ফিরে কাহহার আর কোনো কাজে মন বসাতে পারল না। রাতটাও তার ভালো কাটেনি। রাতে সে চিন্তা করে রাখে, টিএনও হিসেবে বিপদে পড়া স্থানীয় লোকজনকে সাহায্য করার এখতিয়ার তার রয়েছে এবং রইস আলীকে সে সাহায্য করবে। কিস্তিতে হলেও ৩০-৪০ হাজার টাকার ব্যবস্থা সে করতে পারবে।

পরের দিন অফিসে গিয়ে কাহহার এ.ও. কে চতুরা গ্রামে যেতে বলেন।

‘গাড়ি নিয়ে যান। সেই গরুর মালিক রইস আলীকে নিয়ে আসবেন।’

এ.ও. তখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসে। হন্তদন্ত হয়ে সে কাহহারকে জানায়, ‘স্যার গতকাল ঐ রইস আলী মরা গরুর গোয়ালঘরেই শুয়ে ছিল। কারা জানি তার গলা কেটে রেখে গেছে।’

‘কী!’

কাহহার লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

পরে ধীরে ধীরে বসে পড়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত