প্রতিদিন এই জায়গার পরিবর্তন খেয়াল করে নান্না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার গা ঘেঁষে সাইনবোর্ড। হলুদ কালিতে কালো জমিনে লেখা নির্মাণাধীন ১৩৫ কেভি ভোল্ট উপবিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্র। নিচে জানান আছে কাদের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে, কত টাকার প্রকল্প। তারপরে স্থানের নাম ও অন্যান্য। সরকারি কাজে যেমন থাকে।
নান্না সাইনবোর্ডটার সামনে দাঁড়ায়। সাহেবি ইঞ্জিনিয়ারিং শব্দগুলো বানান করে পড়ে। চারধারে তাকায়। সুরমা নদী থেকে মোটা লোহার পাইপে মাটি আর বালু এনে কত দ্রুত প্রায় আড়াই একর জায়গা ভরাট করা হলো, আর তাতেই কেমন বদলে গেল এই এলাকার চেহারা! ওদিকে চাকদাই বাজার সুরমার প্রায় কোলে। রাস্তার এপাশে-ওপাশে ব্যাংক-বিমার অফিস। তারপর থরে থরে সাজানো দোকান। আজকাল ফল-পাকুড়, পেপার-পত্রিকা—সব পাওয়া যায়। নদী-লাগোয়া একটা রাস্তা জকিগঞ্জের দিকে গেছে। বন্যায় সেই রাস্তার প্রায় কিছুই হয়নি। মানুষ বলে, সুরমা শান্ত নদী, কিন্তু কুশিয়ারা তা নয়। কুশিয়ারার দিকে যাওয়ার রাস্তাটার কী দশা! নদী তার খরস্রোতে ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলেছে। এই পূর্বমুখী রাস্তায় প্রায় আধা মাইল গেলে নান্নার বাড়ি। সোতার খালের গোড়ায়। কুশিয়ারার এই শাখা খালটাই তো প্রায় একটা নদী। পানির কী রাগ! ব্রিজ কত উঁচুতে। ওপরে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে মনে হয়, পানি ছাড়া এই এলাকায় আর কিছু নেই। আবার শুকনোর সময় ওই ব্রিজে উঠতে উঠতে মনে হবে, চারদিকে শুধু খাঁড়ি আর খাঁড়ি। সোতার খালের এই খাঁড়িতে যে কত পানি ধরে, তা এক আল্লাহ জানেন। দুদিকের দুটো হাওর তো এই পানিতেই বর্ষাকালে একেবারে তলিয়ে থাকে। ব্রিজে ওঠার রাস্তার ঠিক নিচের ঢালে নান্নার ছাপরাঘরটাকে তখন মনে হয় নদীর কূলে একটা ছোট্ট টং, মাছমারা লোকদের ঘর। সে-ও সোতার খালের কূল বলে রক্ষা, একটু এগোলে যে কুশিয়ারা, তার কূলে এমন ঘর তোলা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কোন সময় ভাসিয়ে নিয়ে যেত, তা সে বুঝতেই পারত না!
প্রতিদিন কাজ শুরু করার আগে, এই বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে এই এলাকার প্রকৃতি-পরিবেশ ইত্যাদি যা-ই বুঝুক, এর অদলবদল নিয়ে এই সমস্ত ভাবে নান্না। আচ্ছা, এই যে ঘরখানা সে তুলেছে, এ তো মালিকের জায়গায়। আবার মালিকই তাকে এই কারেন্ট সেন্টারের কাজে লাগিয়ে দিল, না-হয় সারাটা বর্ষাকাল নান্না মাছ ধরেই কাটাত। সোতার খাল থেকে রাস্তার দক্ষিণ কূল ধরে যে খালটা হাওরে মিশেছে, সেখানে প্রতিবছর ভেইল জাল বাঁধে সে। এবার এ কাজে যোগ দেওয়ায় আর তা করেনি। করছে তার প্রতিবেশী সাদ্দাম। যদিও এবারের দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিতে সাদ্দামেরও তেমন কোনো লাভ হয়নি। এত পানি! কুশিয়ারায় যখন-তখন ঢল। মাছ তো জালে আটকায় না, জালের ওপর দিয়ে যায়। তবে এই যে আশ্বিনের শেষাশেষি পানিতে টান, বৃষ্টি কমেছে, এখন সাদ্দাম যদি কিছু মাছ পায়।
এদিকে এই আশ্বিনের শুরু থেকেই নান্নাও বুঝতে পারছে, এত দিনে এই জায়গায় সে কী করেছে। এখানে কাজ শুরুর পর থেকেই তো লক্ষ করছে। প্রায় দিনই সকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একবার দেখে। দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবদের ভাষায় সে-ও বলে, লঞ্চ আউয়ার! সেই লাঞ্চ আওয়ারে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে গুলতানি মারতে কি লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকার সময়ও চারধার দেখে। আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগেও।
হ্যাঁ, ইঞ্জিনিয়ার স্যাররা বলেছে, এটা হলে এই এলাকা বদলে যাবে। কাজ শুরুর আগে যেদিন ওই চাকদাই বাজারের পাশের স্কুলের সামনে আলোচনা হলো, সেখানেও ছিল নান্না। সেদিনও শুনেছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই এলাকা বদলে যাবে। আর ঘন ঘন কারেন্ট যাবে না। এলাকার মানুষের আর কোনো কষ্ট থাকবে না।
সত্যি, বদলে তো গেছেই। আগে বাড়ির সীমানায় ভেইল জাল বাওয়া নান্না টানত বিড়ি, এখন সিগারেট টানে। মেরিস অথবা শেখ। কখনো পলমল। নিজে কিনলে মেরিস। আগে মা-বউ নিয়ে তার সংসারের মাছ এই ভেইল জাল থেকেই আসত অথবা অন্য সময় চাঁই পাতত, পানি টানলে পোলোতে ধরত। এখন চাকদাই বাজার থেকে নানান মাছও কেনে সে। নান্না মিয়া জীবনে মাছ কিনে খাবে, এ কথা ভেবেছে নাকি? মালিকের বদৌলতে এখন এভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে নগদ টাকার মুখ দেখে। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পরেও কাজ, চারদিকে তীব্র আলো জ্বলে, নান্না ওভারটাইম পায়। তা-ও নগদ। একটা ভালো মোবাইল কিনবে, যাতে ছবি দেখা যায়। এই টেপাটেপির মোবাইলটা তখন বউকে দিয়ে দেবে।
এই গেল নান্নার নিজের বদল। আর চারধারের বদল নান্না দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে; দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়েও। কাজ শুরুর আগে দেখে প্রতিদিন, সেই বদলটাই বরং নান্নার হিসাবে মেলে কম।
চাকদাই বাজার থেকে এদিকে, খাসিয়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আর হাওরের গা-লাগোয়া এই রাস্তা ধরে তো নান্না আজন্ম চলে। তখন এদিকে সোতার খালের গায়ে এপারের হাওরের কূলে একখানা কুঁড়েঘরে বাপ-মায়ের সঙ্গে থাকত। এই দিকের গোটা হাওরে নৌকায় কতবার সারা দিন কাটিয়েছে। ওই পাহাড়ের প্রায় কোলে চলে যেত বাপের সঙ্গে। বর্ষায় সারাটা হাওরে শাপলা-শালুক! বকের ঝাঁক একটু ডাঙা পেলে বসে থাকত। এখানে-ওখানে পানকৌড়ি। এসব এখনো আসে, কিন্তু তারা ঘর তুলে রাস্তার উলটো পাশে চলে আসার পরে, ওই বড় খালের কূল থেকে তাকালে আর সেই দৃশ্য তেমন চোখে পড়ে না। অথবা নান্না ভাবে, দেখার সেই বয়স আর তার নেই। বরং এখন এই কারেন্ট প্রজেক্টের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে দূরে পাহাড় দেখে। পাহাড়ে বৃষ্টি শেষ হলে পেঁজা পেঁজা মেঘ। একেবারে যেন দলা দিয়ে থাকে। এই যে সুরমার মাটি আর বালু ফেলে জায়গাটা উঁচু করা হলো, এখন পেছনের হাওরে আর বক আসে না। তবে বাদবাকি সব প্রায় একই আছে, পেছনের দিকে গেলে বোঝা যায়। তা-ওবা কদিন? এই এলাকা যদি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়, তাহলে এর কিছুই আর দেখা যাবে না। তখন ম্যাঘ (বৃষ্টি) আসলে দালানে ঢুকে পড়ো। পাশে বড় বড় লোহার খুঁটি। ওপরে একেবারে চোত মাসের জঙ্গলের গাছের পাতাছাড়া ডালের মাথার মতন রাশি রাশি তার।
এই সমস্ত নান্না যেভাবে দেখে আর নিজের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়, তাতে তার চোখে এত পরিবর্তনের একটা আলাদা ছবি দাঁড়ায়। সেই ছবি আজকের আর মনের ভেতরে কোনো ছবি ছয় মাস আগের, কোনোটা এক বছর আগের, কোনোটা আরও আগের। কোনোটা একেবারে ছোটবেলার। একটার সঙ্গে একটা জোড়া দেওয়ার স্বভাব তার গেল না। যাবেও না।
নান্না তা-ই জানে, যা সে শোনে। নান্না তা-ই শোনে, যা এখানে তার ইঞ্জিনিয়ার স্যারেরা বলে। সে কথার যেটুকু তার কানে আসে, যেটুকু তাদের ম্যানেজার বলে। আবার ম্যানেজার যা বলে, তার সবটা বোঝে না। তাদের ভেতরে আলোচনাও হয়, তাতে আরও কিছু বোঝে। কী আলোচনা হয়, তা নান্নাকে বলতে বললে কোনোভাবে গুছিয়ে বলতে পারবে না। তা ছাড়া সে জানে, তার মালিকের অনেক ক্ষমতা। নইলে এই এলাকায় তার মতো আরও কতজনই তো ছিল, কিন্তু কাজ পেল মাত্র তারা তিনজন। বাকি সবাই বাইরের। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবেরা নিয়ে এসেছে।
নান্না কাজ পেত না। মালিকদের বড় দালানটা তোলার সময় সে বিভিন্ন কাজে হাত লাগিয়েছিল, তখন এই কাজের কিছু শিখেছে। তারপর করল মালিকের চাচার ঘরের ভাইয়ের (চাচাতো ভাই) কাজ। তাতে অভিজ্ঞতা বাড়ল। তারপর চাকদাই বাজারে বড় ব্যাংকের দালানটায়ও সে কদিন কাজে ছিল। তখন যদি বাপ অসুখে না পড়ত, আর তাকে নিয়ে দিন কয়েক ওসমানী হাসপাতালে পড়ে থাকতে না হতো, তাহলে ওই কাজেও সে পুরো সময় থাকতে পারত। পুরোটা থাকত কি না, তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে, কারণ সেবার সাদ্দাম ভেইল জালে এত মাছ পেয়েছিল যে পরেরবার সাদ্দাম নিজেই জাল কেনে। এবার সাদ্দাম জাল ভাড়ায় খাটিয়েছে। সে বায় নান্নার জাল। সোতার খালের ভেইল জাল, ও জায়গার মতো এত মাছ আশপাশের কোনো খালে ধরা পড়ে না।
নান্না ভাবে এই সব। সে চারধার দেখে আর নিজের ভেতরে কথা জমায়। সহযোগীদের বলে। এই কারেন্ট প্রজেক্টের কাজে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরে। যদিও সহযোগীদের ভেতরে কনেশ তাকে অত পাত্তা দেয় না। কারণ সে নান্নার চেয়ে কাজে দ্রুত আর কথা কম বলে। আর এই কাজের লাভ-লোকসানও বোঝে।
এই যে দোতলা, প্লাস্টারহীন ইটের দালানের দোতলার ছাদে ঢালাইয়ের কাজের আগে, লোহার খুঁটির ওপরে স্টিলের পাটাতন ঠিক করতে করতে নান্না উত্তরে পাহাড়ের দিকে তাকায়, সেখানে এই দুপুরের শেষ ভাগে ধোঁয়ার কুণ্ডুলী যেন। অর্থাৎ মেঘ জমে আছে। যদিও চাকদাইয়ের আকাশে মেঘ নেই। রোদের তাপ মরে গেছে। বাতাস আসছে ওই উত্তর থেকে। কিন্তু ওই মেঘ কোনোভাবেই এদিকে ভেসে আসবে না। নান্না সেদিকে তাকিয়ে, এত দিনের টানা আবার নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে হঠাৎ বৃষ্টির পরে, যেন এবার ওই মেঘ তাদের দেখাই হতো না, তাই কনেশকে দেখানোর জন্য ওদিকে তাকাতে বলে।
কনেশ তাকায়। তারপর নান্নাকে বলে, ‘কাম কর। হাত চালাই।’
নান্না একটু দমে যায়। কনেশের কি মুড নেই? নাকি কনেশ আজ ম্যানেজারকে দেখাবে সে কত কাজের। তারপর একটা ওভারটাইম বাগাবে। বাড়িতে বউ নেই। একটু বেশি রাত করে গেলেই-বা কী? সে কনেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর জানতে চায়, ‘কামে কামে তোর জান-পরান সব লোহা হই গোচোইন? ওই ম্যাঘ তুই আর আমি সোতার খালের কান্দায় উবাই (দাঁড়িয়ে) কত দেকচোইন।’
কনেশ কিছু বলে না। একটা লোহার পাত উঁচু করে ধরে পাশেরজনকে কী যেন বলে বিড়বিড় করে। নান্না তাতে আবারও দমে যায়। কাজে মন দেয়। আড়চোখে কনেশের দিকে তাকায়। দেখে কনেশ তার দিকে তাকায় কি না। তাহলে কনেশকে আবারও একই কথা বলবে।
সেই সুযোগ অবশ্য পায় না নান্না। একবার কনেশ তার কাছে এসে নিচু গলায় বলে, ‘ওই পাহাড় আর ম্যাঘ দেইক্কা তুই জীবন শেষ করচোস!
‘কেন?’
‘কিছু শোনো?’
কনেশের এই কথায় নান্না ধাক্কা খায়। সত্যি তাহলে গুরুতর কিছু ঘটেছে! কাল থেকে আর কাজ থাকবে না, এমন কিছু? এই প্রজেক্টের কাজ তো প্রায় শেষই। এই দোতলা দালানটা হবে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবদের বসার জায়গা। আর নিচের পাশের রুমটায় কী সব যন্ত্রপাতি বসবে। এরপর বাইরের তার প্যাঁচানো ও টানা লোহার বড় বড় খাম্বাগুলোর সঙ্গে লাইন লাগিয়ে দিলেই হলো। তারপর এই এলাকার সব বাড়িঘরে কারেন্ট। এখন তো কয়েকটা বাড়িতে আছে। চাকদাইয়ের দোকানে, ব্যাংকে, পোস্ট অফিস আর মেডিকেল সেন্টারে আছে। আছে হোটেলে কি মাছওয়ালাদের প্রতিটি ডালার ওপরে। সোতার খালের দিকে এগোলে শুধু রাস্তার পাশে বড় বড় বাড়িতে। যেমন তার মালিকের বাড়িতে। কিন্তু এবার নাকি সব বাড়িতেই কারেন্ট যাবে। সোতার খালের নিচের দিকে, প্রায় হাওরের ভেতরে তার আর সাদ্দামের বাড়িতে নিশ্চয়ই কারেন্ট যাবে। উল্টো দিকে শরিকি গেরস্তসমেত কনেশের বাড়িতেও। ব্রিজের গোড়ায় এই কয়টা বাড়ি বড় অন্ধকার। তারা শুনেছে, রাস্তার উল্টো দিকে প্রায় হাওরের ভেতরে এই বাড়িগুলোয় পল্লিবিদ্যুৎ আপাতত লাইন দিতে পারবে না।
তাহলে এই কারেন্ট প্রজেক্ট হলে, মালিক নিশ্চয়ই নান্নার ঘরখানায় লাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তখন সে আর কনেশ এলাকাবাসীকে মনে করিয়ে দিতে পারবে, তারা ওই কারেন্টের প্রজেক্টে কাজ করেছে, তাই তাদের ঘরে লাইট জ্বলছে। কিন্তু তার আগে যদি এই কাজ থেকে ছাঁটাই হয়? পানি টানছে। সাদ্দাম সারা দিন ভেইল জালে। নান্না জানে, এবার তাকে আর জালের কাছে যেতে দেবে না সাদ্দাম।
সন্ধ্যার মুখে একটুক্ষণ তাদের বিরতি। চা-বিস্কুট খাওয়ার সময়। তা শেষ হলে পেছনের অন্ধকারে গিয়ে নান্না সিগারেট ধরাবে। ও কাজে কনেশ নেই। তবে বাকিদের সঙ্গে কনেশও যাবে। সেই সময় জানতে চাইবে তার মেজাজ অত কড়া কেন। বউ একদিন বাপের বাড়ি গেলে মেজাজ চড়াতে হয়? তোর তো টাচ ফোন। ফোনে চাকদাই বাজার দিয়ে আরও কিছু ছবি ভর, আর সারা রাত্তির পারলে হাওরের কূলে বসে দেখ। যতক্ষণ ফোনে চার্জ থাকে ততক্ষণ দেখ। বউ থাকলে দেখতে পারতি?
কনেশ নান্নার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাইনে-বাঁয়ে দেখে। চারদিকের সার্চলাইটের আলোয় তাদের মুখ উজ্জ্বল। চোখের পাতায় সেই আলোর ঝিলিক। কনেশের মুখখানা প্রায় একই। সেখানে বিরক্তি। তাই চোখের তারায় এত আলোর পরেও কোনো নাচন নেই। ওই চোখ একবার নান্নাকে দেখে। ফস করে তার হাত ধরে আরও একটু পেছনের দিকে নিয়ে যায়। চারপাশ দেখে। নান্না সিগারেটে টান দিয়ে কনেশের মুখে চায়। কনেশ তখন বলে, ‘শোনচোস নি, কীতা কয় ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটায়?’
‘কীতা?’
‘তুই শোনোস না-নি? তুই আচোস তোর ধান্দায়, হালার হালা!’
‘কীতা হইচে, ক…’
‘এই যে কারেন্ট-প্রজেক্ট, এই লাইনোর কারেন্ট আমরার গ্রামের এতা-ওতা কোনো দিকের নায়।’
‘কেনে? তুই শুনচোস হাচানি?’
‘অয় অয়। ইতা কারেন্ট ওতা রানাপিং, সুতারকান্দি, ওতা বৈরাগীবাজার গ্রামের লাগি। এডা সাপ্লাই স্টেশোন। আমরার গ্রামের সাপ্লাইর লগে ইতার কোনোতায় কোনো সম্পর্ক নাই।’
নান্না চোখ সরু করে তাকায়। সিগারেটে টান দেয়। তারপর তা গায়ের জোরে ছুড়ে ফেলে। এই প্রজেক্টের সীমানার বাইরে হাওরের পানিতে পড়ল কি না, তা অবশ্য বোঝা গেল না। কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যায়, কনেশের কথা পুরোটাই বিশ্বাস করেছে। কনেশকে নান্না গুরুত্ব দেয়। আবজাব কথায় কান দেওয়ার মানুষ কনেশ না। শোনা কথা যাচাই করতে জানে। তাই হয়তো বাকিদের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কনেশ তার ব্যাখ্যাও দেয়, ‘আমি আগেও শুনচোইন, বাদে আইজ ম্যানেজারের জিগাই দেখলাম। হে কয়, ইঞ্জিনিয়ার সাব হগোল ইতা তো আগেই কইচোইন!’
‘সামনের বোর্ডে যে এ জায়গার নাম লেখচোইন!’
‘আরে সামনের বোর্ডে কাজের জায়গার নাম। কাগজে লেহা আছে এই কারেন্ট কোন জায়গায় কোন জায়গায় সাপ্লাই হইত।’
‘তয় আমরার হাওরের ক্ষতি করি, এই জায়গার মানুষের ই’লা ক্ষতি করি এমন পারমিশন দেল কেনে?’
‘তোর মালিক মেম্বার মানুষ, তাইন দিচোইন।’
‘ও। তাই নি?’
‘যা, সাদ্দামের লগে যাই ভেইল জাল বা। কয় তাই নি? শালা ছাগলের ছাগল!’
কনেশের এই শেষ কথাটায় নান্না কিছুই মনে করে না। এত আলোতে তাকায়ও না কনেশের মুখের দিকে। বরং সে জানে এবং দেখতে পাচ্ছে, তাদের বাড়িতে এখন অন্ধকার! কারও বাড়ির সামনে আঁচ নামানো হারিকেন। কারও ঘরে ছোট চার্জার লাইট। মালিকের বাড়ি থেকে দিনে চার্জ দিয়ে আনা। এই যে একটু বাদে এখান থেকে কাজ শেষ করে পিচ-ওঠা রাস্তায় ধীরে চলা বাসের আলো কি উল্টো দিকের বাড়িগুলোর পিছলে-পড়া আলোয় পথ চিনে তারা বাড়ির দিকে যাবে, তখন অন্ধকারে একটা হারিকেন জালের গোড়ায় বেঁধে বসে থাকবে সাদ্দাম। সাদ্দাম ভেইল জাল টেনে তুলছে। সোতার খালের কিনারে অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখছে নান্না আর কনেশ। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যেমন দেখে।