কারমেনের জন্মদিন ১২ নভেম্বর। আর মাত্র কিছু সময়। একমাত্র মেয়ে অনিকা অনেক দূর থেকে স্বামী- সন্তান নিয়ে মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসার টানেই ছুটে এসেছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা রোজার পাহাড় চূড়ার বাড়িটাতে। বাড়িটা কারমেন আর আরমান্ডো স্বপের মতো করে সাজিয়েছেন। ব্যলকোনিতে দাঁড়িয়ে শহরটা ছবির মতো মনে হয়। পাহাড়, সবুজ অরন্য, ঘর-বাড়ি। জানালা খুললে রাতের শীতল বাতাস প্রাণ ছুঁয়ে যায়। আরমান্ডোর মনে হয় জীবনটাই একটা ছবি। ছবিগুলো চলমান, আজ জীবন্ত, কাল স্থির, মৃত। জীবনের ফেলে আসা সময়গুলো ছবির মতো ভাসে, শেষ রাতের জীবন্ত স্বপ্নের মতো মনে হয়!
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়েছেন প্রায় এক যুগ। নিজের হাতে গড়া ওষুধ কোম্পানির দেখাশোনার মূল ভারটা ৮২ বছর বয়সেও ছাড়েনি আরমান্ডো। কারমেন বেরিজের প্রেরণা ও ভালোবাসায় দীর্ঘ ৫৬ বছরে অনেক সাফল্য এসেছে হাতের মুঠোয়। কারমেনের সাথে পরিচয় অধ্যাপনার সুবাদেই। বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালির্ফোনিয়াতে কারমেনের যোগদান উপলক্ষে ছোট্ট ঘরোয়া আয়োজন ছিল। কারমেনকে প্রথম দেখার সে দিনটি ছাপ্পান্ন বছরেও ভুলতে পারেনি। মায়াবি মুখ, হালকা নীল চোখের অপূর্ব সুন্দর মেয়েটার দিকে ঠিক কতো সময় তাকিয়ে ছিল, সময়ই হয়তো তার হিসাব রেখেছে! কারমেনকে আপন করে পেতে বুকের ভেতর ব্যাকুলতার শুরু সেদিন থেকেই।
যোগদানের পর ওর পেছনে বেশ ক’জন তরুণ শিক্ষক জোঁকের মতো লেগে যায়। কারমেন পাত্তা দেয়নি, সাড়া দেয়নি। কেউ ছোট খাট অপমানিত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত সুন্দরী মেয়েটার স্বপ্নচূড়া কতোদূর এটা ছাড়া বাকিটা জানা ছিল আরমান্ডোর। মনের ভেতর সংশয় নিয়েই একদিন কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কারমেন বেশকিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর বড় একটা শ্বাস নাকি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, এতদিন পর?
– সরি, অনেকে বলেছে আপনি সাড়া দেননি আর এজন্যই ভয়ে …
– আজ বলছেন, ভয় করছে না?
– জ্বি করছে, এই দেখুন হাত কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে।
কারমেন বেরিজ সুন্দরী মেয়েটা শব্দ করে হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ প্রাণোচ্ছ্বল মনকাড়া হাসি চলে। হাসি থামিয়ে বলে, সবাই কি সবার ডাকে সাড়া দেয়?
– না, দেয় না।
– আরমান্ডো।
– জ্বি।
– জানেন সাড়া কেন দেয় না?
– না।
– কাঙ্ক্ষিত ডাকের অপেক্ষায় থাকে বলেই। চলুন।
আরমান্ডো অবাক, প্রাপ্তি আর খুশির ত্রিমুখী আক্রমণে দিশেহারা হয়। কারমেনের চোখ, কণ্ঠ আর ভাষা যেন বলে দেয় সে তার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। সেই তো, ছাপ্পান্ন বছর হাসি-আনন্দ, ব্যথা-বেদনা ভাগাভাগি করে একসাথে পথ চলা।
হঠাৎ অনিকার চিৎকার শোনা যায়। নিচ থেকে চিৎকার করছে, দ্রুত নামো। বাবা-মা। মনিকার চিৎকারে আরমান্ডোর ভাবনা ভাঙে। কিছু একটা হয়েছে, দ্রুত নিচে নামতে নামতে আরমান্ডোর শুধু কারমেনের কথা মনে হয়। কারমেনের কিছু হলো না তো!
নিচতলায় নেমে আরমান্ডো হতবাক। কারমেন, মনিকা ও তার স্বামী লুই ওকন ও দুটো ছোট বাচ্চার মলিন মুখ, জানালার দিকে সবগুলো চোখ। আরমান্ডো আরেকটু এগিয়ে যায়। মাটি থেকে থেকে আকাশ পর্যন্ত আগুনের লেলিহান শিখা। আগুন ছুটছে, আসছে। দূরে নিচের বাড়ি ঘর বাড়িগুলো একটার পর একটা মুহূর্তেই আগুনের গ্রাসে পরিণত হচ্ছে।
‘দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। দ্রুত বের হও।’ চিৎকার করে ওঠে মনিকার স্বামী লুই। সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ে ছ’জন মানুষ। বাড়ির সামনে সুইমিং পুলের পাশেই গাড়ির গ্যারেজ। কতো রাত সুইমিং পুলের পাশে বসে কারমেন ও অনিকার বাচ্চাদের সাথে মজার গল্প হয়েছে। ভুমি থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট ওপরের এ সুইমিংপুলটার সৌর্ন্দযের কারণে ওর সাথে একাও কাটিয়ে দেয়া যেত রাতের পর রাত!
ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যেই দাবানল প্রায় ওদের ঘিরে ফেলে। একটা গাড়িতে মনিকা,লুই আকন তার ছেলে-মেয়ে আরেক গাড়িতে আরমান্ডো ও কারমেন বেরিজ। আগুনের উল্টোদিকে যতদ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। লাল লাল আগুন। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। হঠাৎ করেই আরমান্ডোর গাড়ির সামনে বড় একটা গাছ ভেঙে পড়ে। ডালপালায় গাড়ির সামনের দিকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কারমেনকে নিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আরমান্ডো। গাছপালা ও কাচা পাতা পোড়া পটপট শব্দ, গরম বাতাসের ঝাপটা। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নেয় পড়ে থাকা যাবেনা। আগুন সবদিকে। অনিকারা কোথায় কে জানে! কারমেন অনেকটা শান্ত। ভাবলেশহীন।
-কারমেন কী হবে, সবদিকে আগুন?
– চলো বাড়ি ফিরে যাই, ওই দেখো আমাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে।
আরমান্ডোর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সুইমিং পুলের ভেতর ডুবে থেকে যদি প্রাণে বাঁচা যায়। কারমেনকে নিয়ে অনেক কষ্টে সুইমিং পুল পযর্ন্ত পৌঁছায়। ভাগ্যভাল অনেক দূরে যায়নি। পানিতে ঝাঁপ দেয়। আশেপাশের গরমে পানিটা গরম, আগুনে গরম হয়ে গেছে। তবু ভালো, আগুন তো নয়।
কারমেন।
কারমেন তাকায়। মানুষের আর্তনাদ বাতাসে ভেসে ভেসে আসে। বাতাসে কটু গন্ধ।
বলো।
কষ্ট হচ্ছে খুউব?
নাহ, তুমি আছো। কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। ওদের কী অবস্থা জানতে পারছি না।
কারমেন ওরা ভালো আছে, নিরাপদ আছে।
কারমেন হাসে।
ওদের সাধের বাড়িটাতে আগুন ধরে। চোখের সামনে পুড়তে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন কতো মানুষের ঘর পুড়ছে ঠিক এ মুহূর্তে বোঝা মুশকিল। রাত প্রায় শেষের দিকে। গরম পানির ভেতর কোনরকম নাক বের করে বীভৎস রাতটা অনেক ধীরে ধীরে পার হচ্ছে। অনেক দূরের আকাশ যখন হালকা লাল সাদা আলোর আভায় রঙিন হতে শুরু করেছে ঠিক সে সময় আরমান্ডোর বুকের ভেতর মাথা গোজে কারমেন। দাবানলের তীব্রতা কিছুটা কমেছে এদিকে। ‘ আজ আমার জন্মদিন তাইনা আরমান্ডো?’ মলিন কণ্ঠের কথাগুলো আরমান্ডোর বুক ছিঁড়ে যায়।
হ্যাঁ।
আচ্ছা জন্মদিনে কেউ চলে যায়?
কেন এসব কথা বলছো কারমেন? ব্যাঁথার সাথে অভিমান ঝরে আরমান্ডোর কথায়।
আমার আর সময় নেই আরমান্ডো।
না। না কারমেন, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না।
নিয়তি আমাদের চাওয়া পাওয়ার পরোয়া করে না অনেক সময়। তুমি আমাকে মনে রেখো।
কথা শেষ করেই কারমেন নেতিয়ে পড়ে।কারমের, কারমেন। আরমান্ডোর চিৎকার পাহাড় পেরিয়ে দাবানলে পোড়া সবুজ অরন্যের কালো কালো ছাইয়ের ভেতর হারিয়ে যায়। কারমেন উত্তর দেয় না, নড়ে না, শব্দ করে না। আরমান্ডো মৃদু আওয়াজে বলে, আজই চলে গেলে কারমেন। আলো ফোটার আগেই চলে গেলে অন্ধকারে! আরমান্ডোর কথা কেউ শোনে না।