ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে হবো ফুটবলার সান্টু। তিনি মোহামেডানে খেলেন, গোলকিপিং করেন; বিচিত্রায় তিনি হরলিক্স নাকি লাইফবয়ের মডেল। আমরা তখন রংপুরে থাকি, বিকাল হওয়ার আগেই মাঠে ছুটে যাই, পাভেলের বাবা পাভেলকে নতুন ফুটবল কিনে দিয়েছেন, তা দিয়ে ফুটবল খেলি; ৩ নম্বর বল। আমাদের ইচ্ছা একটা ৫ নম্বর বল কিনব, পয়সা নেই। সবাই আট আনা করে চাঁদা দেব, তবুও ফুটবল কেনার ৩৫ টাকা উঠবে না; কে দেবে এত টাকা চাঁদা? পুরোনো ফুটবল ফেটে যায়, তার কমলা রঙের ব্লাডার, ধাপের মোড়ে সাইকেল মেকানিকের কাছে গিয়ে আমরা ব্লাডারে তালি লাগাই। সলুশন লাগানোর জন্য ব্লাডারে ঝামা ইট ঘষতে হয়। তারপর মুচির দোকানে গিয়ে আমরা বলের চামড়ায় সেলাই লাগাই। বলটা বেঢপ আকার ধারণ করে। তবুও সেই বল নিয়েই আমরা মাঠ কাঁপাই, ম্যাচ খেলি। আর আমি গোলকিপিং প্র্যাকটিস করি। সান্টু আমাকে হতেই হবে।
আবার ভাবি, ইঞ্জিনিয়ার হবো। মামা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তিনি কোনো প্রজেক্টে ভবন বানানো তদারকি করেন, সেই ভবন দেখিয়ে আমরা গর্ব করে বলি, আমার মামা এই ভবন বানিয়েছেন। তাই যত বাইন্ডিং করা খাতার মোটা মলাট জোগাড় করে জোড়া দিয়ে দিয়ে আমি পাঁচতলা ভবন বানাই। তারপর একবার বিজ্ঞান মেলাতে বায়োলজি বিভাগে প্রথম পুরস্কার পাই। রংপুর রেডিও আমার সাক্ষাৎকার নেয়। জিগ্যেস করে, বড় হয়ে কী হবে? বলি, ডাক্তার হবো। কারণ বায়োলজিতে পুরস্কার পেয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হবো তো আর বলা যায় না।
মেট্রিকে থার্ড স্ট্যান্ড করি। সাংবাদিকদের বলি, আর্কিটেক্ট হবো। ইন্টারমিডিয়েটে অষ্টম স্থান পাই।
ঢাকায় আসি। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিই। কোনো কোচিং ক্লাস তখনো করতে হতো না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পরীক্ষা দিই, আর্কিটেকচারেও দিই। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়, মেজভাই সেই রেজাল্ট জানিয়ে ঢাকা থেকে রংপুরে চিঠি লেখেন- মিটুন ১০২ নম্বর হয়েছে। ও সিভিল চেয়েছিল, সিভিল পাবে। তবে বিস্ময়কর হলো, মিটুন আর্কিটেকচারের ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছে এইট্থ। এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। কারণ আর্কিটেকচারের ভর্তি পরীক্ষার আগে ডিপার্টমেন্টেই কোচিং করতে হয়, গাইড বই কিনতে হয়, ও তো কিছু?ই করেনি, তার পরেও সে ৪২০০ ছাত্রের মধ্যে এইট্থ হয়েছে। মানে, এ বিষয়ে তার প্রতিভা আছে। ওকে অবশ্যই আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে বলবেন।
বাসায় মিটিং বসে- মিটুন কী পড়বে। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও চান্স পেয়েছি। ওটা ধর্তব্যের মধ্যে না। কারণ দুই ভাইবোন মেডিকেলে পড়ে। মেজভাই শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে। কাজেই আমি বুয়েটে পড়ব- এটা জানা কথা। এখন সাব্যস্ত করতে হবে- সিভিল, নাকি আর্কিটেকচার।
রংপুরে বসে বিশেষজ্ঞগণ মত দিলেন, আর্কিটেকচারে কোনো চাকরি নাই, সবাইকে নিজের ব্যবসা নিজে পরিচালনা করতে হয়, ফার্ম দিতে হয়। মিটুন বোকাসোকা ছেলে, রংপুর থেকে গিয়ে সে এটা করতে পারবে না। কাজেই সিভিল পড়ুক, সরকারি চাকরি করবে।
কাজেই আমি সিভিল পড়তেই ঢাকা আসি। ক্লাস শুরু হতে এক বছর দেরি হবে। ঢাকায় এসে প্রথমে আমি আর্কিটেকচারে মেডিকেল টেস্ট দিতে যাই। ওরা আমার সার্টিফিকেটগুলো রেখে দেন। আমি বলি, কালকে আমার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েরও মেডিকেল টেস্ট। সার্টিফিকেটগুলো ফেরত দেবেন না?
ওরা বলে, না।
আমি বলি, আমি তাহলে আরেকটু ভেবে আসছি।
ওরা বলে, তুমি এখানে এইট্থ হয়েছ, এটাই তোমার পড়া উচিত। আমি বলি, সার্টিফিকেটগুলো দেন।
আমি আর্কিটেকচার ভবন ত্যাগ করি।
পরের দিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেডিকেল টেস্ট দিতে যাই। আমাকে কাপড় খুলতে বলা হলে আমি বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে কাপড় খুলে ফেলি।
ব্যস, আমার ভবিতব্য স্থির হয়ে যায়?
হা হা।
ভবিতব্য মুচকি হাসছেন।
কারণ এর আগে, ক্লাস শুরুর আগের এক বছরে আমাকে করাপ্ট করেছে নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিতা। এরও আগে আমি সঞ্চয়িতা পড়েছি, রূপসী বাংলা পড়েছি, কাজী নজরুল ইসলাম মুখস্থ করেছি। গল্পগুচ্ছ, শরৎচন্দ্র, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, উভচর মানুষ, ইস্পাত পড়েছি। নীহাররঞ্জন গুপ্ত পড়েছি। সুকান্ত, ফররুখ পড়েছি। কিন্তু নির্বাচিতা হাতে পেয়ে মনে হলো, এ তো আমার মনের কথা।
পিতা নয় মাতা নয় শিশু নয় কেবল নারীর মৃত্যু সারাক্ষণ জুড়ে থাকে আমার হৃদয়।
কিংবা
সারাদিন তবু কাটে, সন্ধ্যা ঠেকে যায়, ভালোবাসাহীন তবু বাঁচি, ভালোবাসা পেলে মরে যাই।
কিংবা
সমবেত সকলের মতো আমি গোলাপ ফুল ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
আমাকে কবিতায় পেয়ে বসে। আমি নিজে কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। অনীক রেজা তখন রংপুরে হৃদয় নামে লিটল ম্যাগাজিন বের করে, আমি তাকে গল্প আর কবিতা লিখে দিই।
প্রথম গল্পটায় ছাপ ছিল ইমদাদুল হক মিলনের, দ্বিতীয়টায় সৈয়দ শামসুল হকের। দ্বিতীয় গল্পটা বইয়ে আছে, অনেক কার্তিক একক অগ্রহায়ণ।
আমি বুয়েটে পড়ি। কিন্তু কবিতার কামড়ে অস্থির যুবা। কবিতার সন্ধানে ঘুরি।
এই সময় আমি যেতাম কবি মহাদেব সাহার বাসায়, নির্মলেন্দু গুণের পলাশীর মেসবাড়িতে।
আর মোজাম্মেল বাবু আসেন আমার রুমে।
তিনি আমাকে রাজনীতিতে ডাকেন।
আমি তার হাতে দেখতে পাই তার সম্পাদিত পত্রিকা- স্পর্শ। অপরূপ একটা সংকলন। তিনি আমাকে বলেন, তুই কাগজ বের কর। তুই সম্পাদক, খাজা সাহান প্রকাশক। পত্রিকার নাম কাগজ। আমি কাগজ বের করতে শুরু করি।
এবং কবিতা লিখি।
এবং মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গে মিছিলে যাই।
আমার ৩৩ জন বন্ধু আমার কথামতো আমার দলে যোগ দেয়। এরা কেউ রাজনীতি বোঝে না, কিন্তু আমরা একসাথে চলি, তাই আমার কথায় না করে না। আমরা শহীদ মিনারে যাই মিছিল নিয়ে, একুশে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার পর, স্লোগান ধরি- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, প্রতিরোধে বসুনিয়া। পঙ্কজ আসেন, বলেন, কী রাউফুন বসুনিয়াকে নিয়ে স্লোগান দেন, নেন, ধরেন- জয় বাংলা, আমরা বলি, জয় বঙ্গবন্ধু। ছাত্রদলের ছেলেরা জগন্নাথ হলের মোড়ে পলিথিনের ব্যাগে ককটেল নিয়ে বসে ছিল। তারা ককটেল ছুড়ে মারে, কানফাটানো শব্দ, আর আগুন। আগুনে অন্ধকার রাজপথ আলোয় ভরে ওঠে, আমার রাজনীতি না বোঝা বন্ধুরা রাস্তায় পড়ে যাই। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, আমরা উঠে দাঁড়াই এবং সকল ভয়ডরের ঊর্ধ্বে উঠে স্লোগান ধরি- জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
আমি হলের সাংস্কৃতিক সপ্তাহে সব আইটেমে অংশ নিই। আমি চ্যাম্পিয়ন হই। গল্পে ফার্স্ট, কবিতায় ফার্স্ট, প্রবন্ধে ফার্স্ট। আরো কিছু পুরস্কার পাই।
আমি ঘোষণা করি- আমাকে কবি হতে হবে। যদি ফার্স্ট ক্লাস নাও পাই, ক্ষতি নাই।
আমার কবিবন্ধু শাহিন হাসান ঘোষণা করেন- আমাকে কবি হতে হবে, তবে আমার ফার্স্টক্লাসও চাই।
আমি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসি। ছবি আঁকি। ক্লাসের লেকচারে মন বসে না।
এর মধ্যে ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টারের পরীক্ষার ফাঁকে আমার মামা আসেন হলে।
তিনি বলেন, রংপুর যাচ্ছি, যাবি?
আমি বলি, মাথা খারাপ! পরীক্ষা চলছে।
তিনি বলেন, চল বাহে, তোর বাপের অসুখ।
আমি বলি, যাব।
আমি তার সঙ্গে বিআরটিসি নাইট কোচে উঠে বসি। বাসে বসে আমার মনে হয়, পরীক্ষার মধ্যে আমাকে রংপুর নিয়ে যাচ্ছে; এর একটাই মানে- আব্বা মারা গেছেন। আমি কাঁদতে থাকি।
রংপুরে গিয়ে দেখি, আব্বাকে কাফনে মুড়িয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
তিন দিন পরে আমি ঢাকা আসি।
ফিজিক্স পরীক্ষা। প্রথম সেমিস্টারে ৭৮ পেয়েছি। এই সেমিস্টারে আর ২ পেলে পাস। আমি একটা অঙ্ক করে ২ পাওয়া নিশ্চিত করে বলি, স্যার চলে যাব।
স্যার বলেন, বসে থাকো, এক ঘণ্টার আগে যাওয়ার নিয়ম নাই।
বসে থাকি।
ঘণ্টা পড়ে।
আমি হল থেকে বেরিয়ে আসি।
আমার ফার্স্টক্লাস পাওয়ার সম্ভাবনা চিরকালের জন্য মিলিয়ে যায়।
আমার বন্ধুরা বলে, মিটুন, তুমি যে পড়ছ না, তুমি কী করবে?
আমি বলি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং করব না। দাদাভাইয়ের কাছে যাব। সংবাদপত্রে চাকরি নেব, আর কবি হবো।
দাদাভাই আমার ছড়া ছাপেন ইত্তেফাকে। কচি-কাঁচার আসরে।
রাত্রি আসে
শহরজুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে
চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে
দাদাভাই বলেন, এই লাইনটা কবিতা হয়েছে। এটা ছড়া না। এটা কিশোরকবিতা।
১৯৮৯ সালে আমি পড়ি ফোর্থ ইয়ারে। আমার কবিতার বই বের হয়, খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে।
মুহম্মদ নূরুল হুদা খুব একটা উচ্ছ্বসিত সমালোচনা লেখেন দিকচিহ্নে।
আমি বুয়েটে কবিতাপাঠের আসর করি। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাসহ গুরুত্বপূর্ণ কবিরা আসেন। কবিতা পড়েন।
বুয়েটে ইউকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
আমিও দাঁড়াই।
আমার ছোট প্যানেল।
মিছিলে লোক হয় না।
আমি ছাত্রীহলে যাই। বলি, বক্তৃতা দেব না। কবিতা পড়ব।
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা
আহত দারুণ বটে, আর্ত সব শিরা-উপশিরা।
মেয়েদের হলে ১৫৮টা ভোট ছিল। আমি পাই ১৫০টা। নির্বাচিত হই।
আমার জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়েছি।
সেই রাতে হলে গাড়ি চালিয়ে আসেন মোজাম্মেল বাবু। বলেন, মিটুন, চল। পত্রিকা করব। নাম পূর্বাভাস।
আমি তার অফিসে যাই। ঘোষণা করি, আমার পদের নাম সহকারী সম্পাদক। আমার বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা।
আমার সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয়। সেখান থেকে যাই খবরের কাগজে। সেখান থেকে কাগজে। সেখান থেকে ভোরের কাগজে। সেখান থেকে প্রথম আলোয়।
ভোরের কাগজে আমার সহকর্মী ছিলেন মেরিনা। আমি তাকে বলি, তোমারো বয়স হয়েছে, আমারো বয়স হয়েছে, প্রেম করার বয়স নেই, এসো বিয়ে করে ফেলি।
তিনি বলেন, আমার বড় দু’বোনের বিয়ে হয়েছে ডাক্তারের সঙ্গে। তুমি যদি ইঞ্জিনিয়ার হও, তাহলে বিয়ে হতে পারে।
আমি বিসিএস পরীক্ষায় বসি।
রেলওয়েতে চাকরি হয়। চট্টগ্রামে পোস্টিং হয়। রেলওয়ে একাডেমিতে ট্রেনিংয়ে যাই। এক মাসের বেতন তুলে নিয়ে আমি চলে আসি।
ততদিনে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
আর কোনোদিনও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমি যাইনি।
আমার বন্ধুরা বলে, তুমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে যাচ্ছ, করবেটা কী? আমাদের বড় গাড়ি হবে, বাড়ি হবে…
আমি তখন ছিলাম ভীষণ বোকা। বলে ফেলি, আমি নাটক লিখব, উপন্যাস লিখব…
নাটক লিখলেই কি প্রচারিত হয়? উপন্যাস লিখলেই কি প্রকাশিত হয়? আমার ধারণা ছিল না। কারণ আমি ছিলাম ভীষণ বোকা। বুদ্ধিমানেরা যেখানে যাবার আগে সাতবার ভাবে, বোকারা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে না বুঝে-শুনেই…
কিন্তু এই জীবনে আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি- সেটা স্বীকার না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে। যেখানেই যাই, দেশে কিংবা বিদেশে, মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। আবেগাপ্লুত করে।
একদিন ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে এসেছিলাম এক মায়ার টানে, শিল্পের ছলনাময়ী মরীচিকার হাতছানিতে। কবি মিরোস্লাভ হোলুব বলেন-
শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া আর শিল্পমাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ- যেমনটা বলেছেন স্যামুয়েল বেকেট। কবিতা তবু মানুষের শেষ কাজগুলোর নয়, প্রথম কাজগুলোর অন্যতম।
শিল্পী হতে চেয়েছি, ব্যর্থতাই আমার বিধিলিপি। ব্যর্থ না হলে তো আমার দ্বারা শিল্প হবে না।