চোখে-মুখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিছানা ছাড়লো ছন্দ। অন্যান্য দিন হলে এগারো পেরোনো এই জেদী মেয়েটার ধারে-কাছে ঘেষার সাহস পেতনা কেউ। আজকের দিনটা অবশ্য অন্য রকম আনন্দের। বাবা-মা, দাদা-দিদাদের নিয়ে রওনা হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরই। গন্তব্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডারের কাছাকাছি একটা বাংলো। খুব সুন্দর গোছানো একটা গ্রামে যাচ্ছে ওরা। জায়গাটার ছবি দেখে বাড়িসুদ্ধ সবার সেকি আনন্দ! এতদিন পরে সবাই মিলে যাচ্ছে ঘুরতে, সেটাও শীতের মধ্যে। এবছর হাড় কাপানো ঠান্ডা দেশের সব জায়গায়। তবে ঠান্ডাকে ধুর ছাই বলে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় শীতের মিষ্টি রোদের কোমলতা।
কোথাও বেড়াতে গেলে রাস্তা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে ছন্দর। আজও তাই! সবাই গল্পে ব্যস্ত। ছন্দ ওর মতো করে আশপাশ দেখছে। কি চমৎকার একটা রাস্তা! মনে মনে বলে সে। দু্ইপাশে সারি সারি গাছ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার পুরো রাস্তা জুড়ে যেন গাছেরা নিজেদের মাঝেই তোরণ সাজিয়ে নিয়েছে। দিনের পর দিন ঠায় দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আগত অতিথিদের। ছন্দ নিজের মনে গাছদের নিয়ে গল্প বানায়, পিচঢালা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের নিয়ে গল্প বানায়, পাখিদের দেখে গান গায়!
গাড়ির ঝাঁকিতে বাস্তবে ফেরে ছন্দ। এবার মনোযোগ দিয়ে শোনে বড়দের কর্থবার্তা। হঠাৎই ওর দাদু বলে ওঠে, আহা! কি সুন্দর রাস্তা। আর কয়েকদিন পরেই পাল্টে যাবে জায়গাটা। দাদুর কথা শেষ না হতেই বড়বড় চোখে ছন্দর প্রশ্ন, কেন দাদু? আরও সুন্দর করা হবে জায়গাটাকে? দাদু হেসে ওঠে। বলে, না রে পাগলী! আশপাশের গাছগুলো কেটে ফেলা হবে। রাস্তা বড় করতে হবে। রোড এক্সিডেন্ট হয় এদিকটায় প্রচুর। যানবাহনের চাপ বাড়ছে। ছন্দ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বলো কি!! এতো বড় গাছগুলো কেটে ফেলবে? উত্তরটা ওর কাছে ভীষণ কষ্টের মনে হয়। ঢাকাতেই তো দেখেছে। আগে বনানী থেকে উত্তরা এয়ারপোর্ট রোডের আশেপাশে কতো গাছ ছিলো। জ্যাম ঠেলে গাড়ির পেট্রোলের গন্ধের পর ওই জায়গাটুকু এনে দিতো শান্তির নিশ্বাস। এখন গাছগুলোর পরিমাণ কমে গেছে।
বাবা বলেছিলো প্রয়োজনের তাগিদেই নেওয়া হয়েছিল এলাকাটা সাফ-সুতরো করার সিদ্ধান্ত। ঢাকায় না হয় জায়গা কম, তাই বলে ঢাকার এতদূরে এই রাস্তার গাছগুলোও কাটতে হবে? প্রশ্ন শুনে দাদুর উত্তর, পৃথিবীর অনেক দেশেই আইল্যান্ডে গাছ রেখে পাশ দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কোথাও আজ পর্যন্ত সেটা দেখা গেলো না। দাদু বলে ওঠে, জানিস রে ছন্দ, এই রাস্তার পাশে কোনো কোনো গাছ দেড়শো বছরেরও পুরনো। কালের সাক্ষী। তোর এই বুড়ো দাদুর মতোই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে গাছগুলো। তারও আগে দেখেছে দেশভাগ! ব্রিটিশদের কনভয় যেত এ রাস্তা ধরে।
বড় হওয়ার সাথে সাথে ছন্দর মানসিকতায় আসছে পরিবর্তন। ও বুঝতে শিখছে, মানুষের জীবন শুধু আবেগ দিয়ে চলে না। বাস্তবতা বুঝতে হয়। কিন্তু তবুও কিছুতেই রাস্তা বড় করার অজুহাতে গাছগুলো কেটে ফেলায় সায় দেয় না মন। বেড়ানোর আনন্দটুকু মাটি হয়ে গেল ছন্দর। ভাবছে আর ভাবছে কেনো কাটতে হবে গাছগুলো? কোনোভাবেই গাছ বাঁচিয়ে রাস্তার করা যায় না? বাবা-মা, দাদুর ওপর সব রাগ যেয়ে পড়ে ছন্দর। এতো বড় বড় লোকজন সবাই। কিন্তু আহ, উহ করেই শেষ! বাধা দেয়ায় যত গড়িমসি। অবশ্য দাদু বলছিলো, গাছগুলোকে রেখে দিয়ে রাস্তা করতে হলে আরও জমি লাগবে। ওই জমি গুলো আবার হাজার-হাজার মানুষের ভিটে-মাটি। তারা কোথায় যাবে?!! কেউ কি চাইবে তার জমি অন্য কেউ নিয়ে নিক? বড়দের এতো বাস্তব চিন্তা ছন্দর ছোট মাথায় ঢোকে না। ওর একটাই প্রশ্ন, কেটে ফেলবে গাছগুলো?!!
কিছুদিন আগে “দা লর্ড অব দা রিংস” নামে একটা মুভি দেখেছিলো ছন্দ। সেখানে শয়তানী দল নির্বিচারে গাছ কেটে মরুভূমি করে দেয় বিস্তীর্ণ এলাকা। অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে গাছেরা প্রতিবাদী হয়। জাদুমন্ত্রে গড়া সেই দুনিয়ায় হাত-পা চোখ গজিয়ে ওঠে গাছ গুলোর। গাছেদের রোষানলে দুমড়ে-মুচড়ে যায় শয়তানী পক্ষ। কয়েক বছর বাদে দেখা যায় সবুজ আর সবুজ। ছন্দর মনে ইচ্ছা জাগে আজ সকালে দেখা রাস্তার আশপাশের গাছগুলোও নিজেদের বিপদ ঠেকাতে হাতে হাত মেলাক। বলে দিক, এ জায়গা আমাদের। নাক গলাতে এসো না তোমরা। আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ছন্দ। ওই রাতেই এক বুড়ো গাছ ওর স্বপ্নে আসে। খুবই আন্তরিক গলায় ছন্দকে ডেকে তোলে। প্রথমে ভড়কে গেলেও এত পুরনো এক গাছকে নিজের সাথে কথা বলতে দেখে খুবই উৎসাহী হয়ে পড়ে ছন্দ। জিজ্ঞেস করে
তোমার নাম কি?
উত্তরে গাছটা বলে উঠে তোমাদের সমাজে আমাদের ডাকা হয় রেইনট্রি!
কত বছরের পুরনো তুমি?
তা তো বাছা বলতে পারবো না। তবে জমিদার কালি পোদ্দারের সময় থেকে আছি আমি। তা ধরো দেড়শো বছরের বেশী তো হবেই।
তুমিই ব্রিটিশ শাসনামল দেখেছো? তু-তু-তুমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছো?
এবারের উত্তরে দাম্ভিকতার ছোঁয়া….তা আবার দেখিনি! আমি আর আমার বন্ধুরা যুদ্ধেও অংশ নিয়েছি! বিস্ময়ের ঘোরে ছন্দ প্রায় অজ্ঞান হয় হয় অবস্থা! কোনো মতে বলে, বলো! আমাকে এখনি বলো। শুনতে চাই আমি সেই গল্প!
হেসে ওঠে বুড়ো গাছ! মানুষের সাথে কথা বলার লোভ সামলাতে পারে না। বলতে শুরু করে।
যুদ্ধের ভয়াবহতম অবস্থা তখন! দুর্দম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। যশোরে পাকিস্তানি আর্মির ঘাঁটি শক্ত করতে ট্যাঙ্ক নিয়ে কনভয় যাচ্ছিল এ রাস্তা ধরে। আগেই খবর পেয়ে যায় মুক্তিবাহিনী। অ্যামবুশের জন্য গা ঢাকা দেয়। আমরা তখন বেশ তাগড়া। গাছেদের বয়সের হিসেবে আমরা তরুণ। আমাদের আড়ালে মধ্যরাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ওঁত পেতে রয়েছিল। ভোর রাতের কিছু পরেই আসে ওরা। কি যুদ্ধটাই না হয়েছিল! আমার গায়েও আছড়ে, গর্ত করে জায়গা করে নিয়েছিলো অজস্র বুলেট। টলিনি আমি। দাঁড়িয়ে রয়েছিলাম। আড়াল করে রেখেছিলাম আমার পেছনে থাকা অকুতোভয় ছেলেটাকে। একের পর এক গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছিল। তবে আমরা ছায়া দেয়া শিখেছি, জায়গা বদল করা শিখিনি! যদি পারতাম তাহলে আড়াল করতাম আমার এক বন্ধু গাছকে। ওর আড়ালে ছিলো আরও তিনজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। ওখানে সংখ্যায় মুক্তিরা বেশি দেখেই হয়তোবা পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের নিশানায় ঝাঁঝড়া হয়ে যায় আমার বন্ধু। গোলার আঁঘাতে লুটিয়ে পড়েছিলো! তার পাশে পড়ে ছিলো টুকরো তিন মানব দেহ। তবে ওই যুদ্ধে জয় হয়েছিলো মুক্তিবাহিনীরই। তাইতো জিতেছিলাম আমরাও। তবে ক্ষতটা রয়েই গেছে।
ঘুম ভেঙে যায় ছন্দর। আবিষ্কার করে কাঁদছে ও।
পঁচিশ বছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে ছন্দ। বাংলাদেশ এখন উন্নত। বিশ্বে রোল মডেল সাত বছরের ভীষণ দুষ্টু ছেলেকে নিয়ে কি এক কাজে যশোর যেতে হবে তাকে। শুনেই মনটা বিষিয়ে উঠেছিলো। তারপরও কাজ বলে কথা। যেতে তো হবেই!
পঁচিশ বছর হয়ে গেলেও পুরনো সে এলাকাটা ঠিকই চিনতে পেরেছে ছন্দ। আমূল বদলে গেছে সবকিছু। গাছ আছে, তবে সেগুলো বেশ সুন্দর করে ছাঁটা! ছবির মতো পরিষ্কার রাস্তা। দেখে ভালো লাগে তবে একটা কথা ওর কানে বাজে পুরোটা রাস্তা কানে বাজতেই থাকে-
“আমরা ছায়া দেয়া শিখেছি, জায়গা বদল করা শিখিনি!”