বন্ধুর সমূহ বিচ্ছেদের খবরে মনটা বিষণ্ণ হলো। একজন লড়াই করা মানুষ। জীবন তাকে নানা সময় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।কখনো দক্ষ হাতে মোকাবেলা করেছে। কখনো জীবনের রূঢ় বাস্তবতা তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মানুষটি সাময়িকভাবে ভেঙে পড়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি তার লড়াই দেখেছি। লড়াইয়ে জিততে যেমন দেখেছি, হেরে যেতেও দেখেছি। সংসারে একা হতে দেখেছি। যৌথ জীবনের উল্লাসও দেখেছি।একাকিত্বের সমুহ সম্ভাবনায় একজন পঞ্চাশ পেরুনো মানুষের হাহাকারের একমাত্র সাক্ষী বোধহয় আমিই।
বন্ধুটি যখন অসহায়ের মতো বলে– “তোমার তো অনেক সাহস, অনেক বুদ্ধি।আমাকে বলে দাও আমি কি করবো।” আমি তাকে কী বলতে পারি! কী বলা উচিত? কী বললে মানুষটি শান্ত হবে, একটু শান্তি পাবে! আমার এতো সাহস কই যে, ঈশ্বরের ছুঁড়ে দেয়া সমনের সামনে দাঁড়িয়ে বলবো– ফিরিয়ে নাও তোমার পরওয়ানা! আমি ভীতু মানুষ। ওর কাঁধে আস্তে করে হাত রাখি, নিজের কাছে নিজের হাতটি বড় বেমানান লাগে। বলি, “সব ঠিক হয়ে যাবে।” নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই শুকনো খটখটে লাগে। আমি জানি কিছুই ঠিক হবে না। আমার বন্ধু একা হয়ে যাবে। ভীষণ একা।
আমার বন্ধুটি একা হয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত একা হয়ে যাচ্ছে। গত বৈশাখে আশেপাশের কারো তোয়াক্কা না করেই যে-মানুষটি বেসুরো গলায় গেয়ে উঠেছিলো– ‘দেবো খোঁপায় তারার ফুল’, আগামী বৈশাখে সে আর প্রিয়ার খোঁপায় তারার ফুল গুঁজে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করবে না। প্রিয়া যে ওকে একা করে চলে যাচ্ছে অনেকদূর। এই তো গেলো ডিসেম্বরে মোমবাতির নিভু আলোতে একজনের কণ্ঠে ‘পরাণের গহীন ভিতর’ তো, আরেকজনের কন্ঠে ‘ওগো কমলিকা, তুমি বুঝিলে না আমি কতো অসহায়’।আগামী ডিসেম্বরে আমার বন্ধুটি একা হয়ে যাবে। কমলিকার কি কিছুই করার নেই!!
বিবাহ বার্ষিকীতে বউকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছিলো আমার বন্ধুটি। বিবাহবার্ষিকী আসবে ঠিকই, ওদের একসাথে আর সমুদ্র দেখা হবে না। বন্ধুটি আমার ভীষণ খামখেয়ালি। ড্রাইভ করার সময় একটু পর পর ফোন থেকে ফেসবুকে ঢুঁ মারার কারণে ওর বউ খুব রাগ করতো। একদিন নাকি বলেছিলো, “তুমি যদি এমন করো তো আমার মাথা খাও।” কপাল চাপড়ে বার বার নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছিলো। অসহায় মানুষের মন অন্যরকম হয়ে যায় বোধহয়। অপরাধবোধ ওকে কুরে কুরে খায়। অপরাধবোধ ওকে ঘুমোতে দেয়না। যে বাড়ি ফুলের গন্ধে ভরে থাকতো, আজ সেখানে অসুখের গন্ধ। রাত হলেই আমার বন্ধুটি নাকি মৃত্যুর গন্ধ পায়।তাই ও সারারাত জেগে পাহারা দেয়। ওকি জানে না মৃত্যু এক নীরব আততায়ী!!
ওর সামনে আমি খুব সংকোচে থাকি। নিজের জীবনের কোনো প্রাপ্তির কথা যদি ওর সামনে প্রকাশ করে ফেলি! আনন্দের কোনো ঘটনা বলে যদি হেসে ফেলি! আমি গুটিয়ে থাকি। কাঁচুমাচু হয়ে থাকি। আমার খুব ভয় করে। গান শোনার সময় ফোন করলে চট করে গান বন্ধ করে দিই। বউয়ের সাথে বাইরে ডিনার করার সময় ওর ফোন পেলে মিথ্যে করে জরুরি কোনো কাজের গল্প ফেঁদে বসি। এবার ঈদের দিনটি বন্ধুকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। আমি যখন চাঁদরাতে বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার বন্ধু তার বউকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছে। আমার বউ যখন মেহেদির রঙে হাত রাঙাচ্ছে, আমার বন্ধুর বউয়ের হাতে তখন আইভি লাগানো হচ্ছে। নতুন পাঞ্জাবি পরে ছেলের বন্ধুর বাসায় যখন দাওয়াত খেতে যাচ্ছি, আমার বন্ধুটি তখন একা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমার বউ যখন আহ্লাদ করে মেহেদির রঙ গাঢ় হলো কিনা জিজ্ঞেস করছে, আমি তখন আরো কুঁচকে যাচ্ছি।অথচ এটাই তো জীবন!! এ জীবনে কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। তবু আমি বন্ধুর সামনে বিব্রতবোধ করি। আমাকে অপরাধবোধ পেয়ে বসে। আমি যতই বেরিয়ে আসতে চাই, ততই এক অদ্ভুত গ্লানি আমাকে গ্রাস করে।
আমার বন্ধুটি একা হয়ে যাচ্ছে, খুব দ্রুত একা হয়ে যাচ্ছে। আসছে ঈদে ও একা হয়ে যাচ্ছে। আসছে বিবাহবার্ষিকীতেও একা হয়ে যাচ্ছে। নতুন বছরে ও একা হয়ে যাচ্ছে। একুশে, পহেলা ফাল্গুনে, পহেলা বৈশাখেও একদম একা হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে বলছিলো, আর যদি কয়েকটা দিন বেশি পাওয়া যেতো! আর দুটো সপ্তাহ পেলে অনেক না বলা কথা বলা যেতো। আর তিনটে সপ্তাহ পেলে একটা দিন হয়তো একটু ভালো থাকতো, আর সেই দিনটিতে ওকে আকাশ দেখানো যেতো। তিরিশটি দিন চাইলে কি খুব বেশি চাওয়া হবে!! আর তিরিশটা দিন কি পাবে না! তিরিশদিনের জন্যে কি তৃষ্ণা!! যেন তিরিশ দিনে সারা জীবনের অপূর্ণ সাধ পূরণ করা যায়।
আমার বন্ধুটি জানে ও একা হয়ে যাচ্ছে। ওকে ফেলে ওর কমলিকা চলে যাচ্ছে। আমি ওকে ওয়েটিং রুমে রেখে রাস্তায় নামি। আমি আকাশের দিকে তাকাই। এই যে আমি বেঁচে আছি, আকাশ দেখছি, খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, এই যে আমি বাড়ি ফিরছি, প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরছি!! আমি তো নাও ফিরতে পারতাম! কেমন করে এই অমুল্য বেঁচে থাকাটাকে ‘ফর গ্র্যান্টেড’ ভেবে বসে আছি!! কেমন করে জীবনটাকে আমার অধিকার ভেবে বসে আছি। কীভাবে প্রতিদিনের সুর্যটাকে আমার পাওনা ভেবে বসে আছি!! কখনো তো কৃতজ্ঞতা জানাইনি!!
আমার বন্ধুটি একা হয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত একা হয়ে যাচ্ছে। ওর কমলিকা চলে যাচ্ছে যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তে।হে পরম করুণাময়, তোমার তো অপার ক্ষমতা। তুমি পারো না এমন কিছুই নেই। বেশি না, তিরিশটি দিন তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। তিরিশ দিন না হলে অন্তত দুটো সপ্তাহ ভিক্ষা দাও । আমার বন্ধুটি শেষবারের মতো তার প্রিয় মানুষটিকে সাথে নিয়ে আকাশ দেখুক। সারা জীবনের না বলা কথাগুলো বলুক। ‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, যে শাখায় ফল ধরে না’, সেই জীর্ণ শাখাটিও তো তোমার ইচ্ছায় জেগে ওঠে। আমাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করো, হে প্রভু। ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ তোমার করুণাধারায় সিক্ত করো। সিক্ত করো।