নিবিড় ভালোবাসা

নিবিড় ভালোবাসা
আমেনা বেগমের মন প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। তিনি দেখলেন, সারা দিন পরে আজমল শেখ খালি হাতে বাসায় ফিরেছেন। একদমই যে খালি হাত তা নয়। তার হাতে একটি খিলান আছে। কিছুক্ষণ পর পর সেটা দিয়ে তিনি দাঁত খিলান করছেন।
আমেনা বেগম শান্ত কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি খেয়ে আসলে?’ দাঁত খিলান করতে করতেই আজমল শেখ বললেন- ‘বুঝলে বউ, খাওয়ার আয়োজন ভালোই ছিল। গরুর মাংস টা এতো মজা হয়েছিল যে, আমি তো গরুর মাংস দিয়েই সব ভাত খেয়ে ফেলেছি। শোনো, মাংস টা কিভাবে রান্না করেছে আমি তোমাকে বলি। প্রথমে করবা কি মাংসগুলো কে।’ আমেনা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন। তার সামনে থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘একদম আমাকে রান্না শেখাতে এসো না। যেখান থেকে খেয়েছ সেখানে গিয়েই আবার খেয়ো।’ আজমল শেখ অবাক হয়ে বললেন, ‘কি আশ্চর্য! তুমি এতো রেগে যাচ্ছ কেন? একজন এতো করে দাওয়াত দিয়েছে। তার দাওয়াত টা আমি রক্ষা করব না? এটা কি কোন ভদ্রতার ভেতর পড়ে?’
‘আমি তো তোমাকে অভদ্রতা করতে বলিনি। কিন্তু আজকের একটা দিন! তুমি ভুলে গেলে? কি করে পারলে?’
আজমল শেখের কোনো ভাবান্তর হল না। তিনি শান্ত ভাবে উত্তর দিলেন, ‘ভুলে যাব কেন? সেই যে বিয়ের দ্বিতীয় বছর ভুলে গিয়েছিলাম বলে তুমি রাগ করে আমার সাথে সাড়ে তিন দিন কথা বলনি। দেখেছ আমার কতো মনে আছে? তার পর থেকে কি আমি আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর কথা কখনো ভুলে গিয়েছি বলো? ত্রিশটা বছর পূর্ণ হয়েছে আমাদের বিয়ের। দেখেছ আমার হিসাব আছে?’
আমেনা বেগম কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘এই তোমার হিসাবের নমুনা? আমি সারাদিন তোমার জন্য না খেয়ে বসে থাকলাম এক সাথে খাব বলে। তোমার বাসায় চলে আসার কথা দুপুরে আর তুমি ফিরলে সন্ধ্যায়। পেট ভরে খেয়েদেয়ে বন্ধুর সাথে ঢলাঢলি করে দিন পার করলে। ঘরে কোন বাজার নেই সেই হিসাব ও তোমার নেই। আবার তুমি হিসাব দেখাতে এসেছ?’ আজমল শেখ ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘তুমি কিছু রান্না করনি বউ?’ আমেনা বেগম আবার চেঁচিয়ে উঠলেন। ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিলেন, ‘একদম ভাব ধরবে না। ঘাটের শাক, জাংলার কুমড়ো আর ঘরে এক গাদা আলু ছাড়া আর কি আছে? আজকের দিনেও কি আমার এই সব খেতে হবে? আর একটাও কথা বলতে চাই না আমি তোমার সাথে।’ কথা গুলো বলেই তিনি হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আজমল শেখ তাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে। এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে তারপর যাও। বউ, এক কাপ চা আমেনা বেগম মোটেও তার ডাক শুনলেন না। তিনি তার ভেজা চোখ মুছতে মুছতে হাঁটতে লাগলেন। মনেমনে স্বামীর প্রতি আকাশ- পাতাল রাগ অভিমান জড়ো করলেন। সাহেব কে এখন চা দাও। ভর পেট খেয়েদেয়ে এখন পায়ের উপর পা তুলে চা ও খাবেন। কতো পাশান! কতো পাশান হলে সারা দিন না খেয়ে থাকা বউ এর কাছে মানুষ চা খেতে চায়। ভাবা যায়! আজকের এই বিশেষ দিনটার কোন মূল্য নেই তার কাছে। বাড়ির পেছনের সরু মেটে রাস্তাটা পার হয়ে বিশাল মাঠ। আমেনা বেগম প্রায়ই মাঠের পাশের এই শিমুল গাছটার নিচে এসে বসেন। বসে বসে কাঁথা সেলাই করেন আর বাচ্চাদের খেলা দেখেন। আজকে সেখানে অন্য একজন মেয়ে বসে আছে। আমেনা বেগম তারই এক পাশে গিয়ে বসে পড়লেন।
মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসি দিল। তার মানে তিনি পাশে বসাতে মেয়েটির খারাপ লাগেনি। আমেনা বেগম কোন ভূমিকায় গেলেন না। এমনিতে তার মন মেজাজের ঠিক নেই এখন। তিনি সরাসরি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আগে তো তোমাকে কখনো দেখিনি। কাদের বাসায় বেড়াতে এসেছ?’ মেয়েটি মিষ্টি হেসে জবাব দিল, ‘রফিকদের বাসায় বেড়াতে এসেছি খালা’। আমেনা বেগম খানিকটা বিস্মিত হলেন মেয়েটির কথা শুনে। আজ কালের ছেলে মেয়েরা তো খালা- খালু, চাচা- চাচী এই গুলো ডাকা তো এক রকম ভুলেই গিয়েছে।এ তো আবার শহরের মেয়ে। ‘তুমি শহর থেকে এসেছ তাই না?’
মেয়েটি মাথা নাড়ল, ‘হ্যা শহর থেকে এসেছি। আজ রাতের গাড়িতে চলে যাব। গ্রামের এই খোলা পরিবেশ ভীষণ ভাললাগে তাই বসে আছি।’ ‘ও। তা তোমার স্বামী আসেনি তোমার সাথে?’ মেয়েটি কোন দ্বিধা ছাড়াই চট করে উত্তর দিল, ‘স্বামী কিভাবে আসবে খালা? আমি তো বিয়ে করিনি।’ ওমা! বিয়ে করনি মানে কি? মনে তো হয় বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে।’ হ্যাঁ, তা তো হয়েছে। ২৮ বছর মানে একটা মেয়ের মোটামুটি ভালোই বয়স, বিশেষ করে বিয়ের জন্য। কিন্তু আমার নিজেরই কোনো ইচ্ছা নেই বিয়ে করার। এই তো সামনের মাসেই বাহিরে চলে যাচ্ছি। তারপরে আর এই ঝামেলা পোহাতে হবে না। নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নিব।’
আমেনা বেগম মেয়েটির কথায় সায় দিলেন। খানিকটা ক্ষোভের স্বরে বললেন, ‘ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। বিয়ে মানেই জীবন টা ঝালাপালা। সারা জীবন যার জন্য এতো কিছু করে গেলাম, বিশেষ একটা দিনে ও তার কাছে আমার মূল্য নেই। ভালো করেছ। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা না পেতে চাইলে বিয়ে করার কোন দরকার নেই।’ মেয়েটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। তার ভেতর বিজ্ঞ বিজ্ঞ একটি ভাব। ‘সংসার জীবনের এই বাজে অভিজ্ঞতা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি খালা। সারা জীবন মানুষের সেবা করে দাসীর মতো বাঁচার থেকে, একা একা স্বাধীন ভাবে চলা অনেক ভাল। এতে নিজেরও একটা পরিচয় হয়। অন্যের পরিচয়ে চলতে হয় না।’
আমেনা বেগমের চোখ আবার ভিজে উঠল। তিনি ধরা গলায় বললেন, ‘দেখলে, কতক্ষণ হল এসেছি একবার ডাকতে এলো না। সে তো জানে আমি রাগ করেছি। তারপরে ও…’ তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। পুরুষ মানুষের মন। তারা থাকে তাদের নিজেদের খেয়ালে। অপনার এই মন খারাপের কথা কি আর তার মনে আছে?’ আমেনা বেগম কোন কথা বললেন না। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। আমেনা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিল। মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আমি যাই খালা। একটু পরেই রওনা দিব। না হলে গাড়ি ধরতে পারব না।’ আমেনা বেগম মাথা নাড়লেন। তার ইচ্ছা হচ্ছে মেয়েটার সাথে সাথে বিদেশ চলে যেতে। দুঃখে আমেনা বেগমের মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এমন জীবন রাখার থেকে মরে যাওয়া ভাল। শুধু ভাল না, অনেক অনেক ভাল।
অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় এখন আর তিনি বসে থাকতে পারছেন না। পেটের ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে বমি চলে আসবে আসবে ভাব। তৃষ্ণা ও পেয়েছে খুব। মনে হচ্ছে এক জগ পানি খেয়ে ফেলতে পারবেন। তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। ঘরে গিয়েই আগে এক জগ পানি খাবেন। জগ ধরেই চুমুক দিবেন, গ্লাসে ঢালবেন না। ঘরে এসে কোন সাড়া শব্দ পেলেন না তিনি। পুরো ঘর খুঁজলেন কিন্তু আজমল শেখ কোথাও নেই। তার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। পানি খাওয়ার কথা তিনি ভুলে গেলেন। উঠানে এসে দেখেন পুকুর পাড়ে হারিকেনের আলো। তিনি দ্রুত পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলেন। একি! আজমল শেখ এক বুক পানিতে নেমে চালন দিয়ে মাছ ধরছেন। মানুষটার কি কোন আক্কেল নেই। এই রাতের বেলা পানি ঘাটাঘাটি করছে। তার আবার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে।
আমেনা বেগম পানির কাছে নেমে এলেন। ভীতু গলায় আজমল শেখ কে বললেন, ‘এই রাতে তুমি পানিতে নেমেছ কেন? তাড়াতাড়ি উঠে এসো।’ আজমল শেখ চালন থেকে হাঁড়িতে মাছ তুলতে তুলতে বললেন, ‘বুঝলে বউ, ভালোই মাছ পেয়েছি। অনেক বড় বড় চিংড়ি উঠেছে। হয়ে গেছে, চলো যাই।’ ‘শোনো, আজ রাতের আইটেম কি।’ উহু, এখন কোনো কথা শুনব না। তুমি আগে ভাল করে মুছে কাপড় পাল্টে এসো।’ আমেনা বেগম মাছের হাড়ি নিয়ে রান্না ঘরে গেলেন। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা আস্ত মুরগি কেটেকুটে পরিষ্কার করে রাখা। দুধের হাঁড়িতে এক পাতিল দুধ জ্বালানো। মসলা পাতি, তরকারি সব গুছিয়ে রাখা।
আজমল শেখ এসে বললেন, ‘বউ, তুমি মাংস টা তাড়াতাড়ি চুলায় চাপিয়ে দাও। আমি মাছ গুলো বেছে ফেলি। আমাদের রাতের খাবার হল চিংড়ি দিয়ে মিষ্টি কুমড়োর ঘণ্ট, মুরগির মাংস ভুনা আর পোলাও। আর শেষ পাতে পায়েস। এমন একটা বিশেষ দিনে পায়েস খাব না তাই কি হয়। তাও আবার তোমার হাতের পায়েস।’ আমেনা বেগম কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি সদরে গিয়েছিলে নাকি? এতো কিছু জোগাড় করলে কিভাবে?’ ‘এই রাতে সদরে গিয়ে কি আর তাড়াতাড়ি ফেরত আসা যায়? চাল এনেছি রফিকদের আড়ত থেকে। মুরগি আর দুধ এনেছি হেনাদের বাড়ি থেকে। হেনার মায়ের তো পালের মুগির অভাব নেই। আর আমি বলতেই ওর বাবা আমাকে  তাড়াতাড়ি করে দুধ দুয়ে দিলো।’
ভাতের প্রথম লোকমা আজমল শেখ আমেনা বেগমের মুখে তুলে দিলেন। আমেনা বেগমের চোখ ভেজা। তিনি মুখ নিচু করে খেতে লাগলেন। আজমল শেখ তাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি আমাকে এক লোকমা খায়িয়ে দাও বউ। সারা দিনের ক্ষুধা যেন এখন একেবারে চেপে ধরেছে।’ আমেনা বেগম অবাক হয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সারা দিন মানে? তুমি দাওয়াত খেতে যাওনি?’ ‘আজমল শেখ দরদ ভরা গলায় বললেন, ‘তুমি পাগল বউ? আজকের দিনে তোমাকে ছেড়ে আমি খেতে পারি। তুমি জানো না, তোমার হাতের রান্না ছাড়া আমি ঠিক মতো খেতে পারি না? স্কুল ছুটির পরে হেড স্যার একটা কাজে আমাকে সদরে পাঠালেন। কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে তাই সন্ধ্যা হয়ে গেলো।’ ‘কিন্ত তুমি যে দাঁত খিলান করছিলে? আর আমাকে মিথ্যা বললে কেন?’
‘খুব ক্ষুধা পেয়েছিল তাই একটা কচি পেয়ারা চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফিরছিলাম। পেয়ারার বিচি দাঁতে আটকে গেল তাই। আর তোমাকে মিথ্যা বলেছি কারণ সারাদিন খাইনি শুনলে যদি তুমি কষ্ট পাও।’ আমেনা বেগমের বুকটা হুহু করে উঠল। তিনি দ্রুত স্বামীর মুখে ভাত তুলে দিলেন। অপরাধ বোধ নাকি আফসোসে কিসে যেন তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। স্বামী তার কাছে চা খেতে চেয়েছিল। ক্ষুধার্ত স্বামীকে তিনি এক কাপ চা না দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। রাগের জ্বালায় আমেনা বেগম ভুলেই গিয়েছিলেন যে, তার হাতের রান্না ছাড়া তার স্বামী খেতে পারেন না। ওই মেয়েটাকে কতো কথা বললেন কিন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বলা হল না। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের জীবনে তাদের নিবিড় ভালবাসার কথাটাই বলা হল না। তার আফসোস হতে লাগল।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত