গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম, আমার বিয়ে হচ্ছে। বাবা নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ের পুরো ব্যাপারটা তদারকি করছেন। ঘটনা দেখে স্বপ্নের ভেতরেই কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলাম। বিয়ের ব্যাপারে কার না আগ্রহ থাকে! কিন্তু এই মুহূর্তে বাড়িতে আমার যে অবস্থা ও অবস্থান, তাতে বিয়ে নিয়ে ভাবা বা স্বপ্ন দেখা বেশ হিম্মতের ব্যাপার। সে না হয় হলো। কিন্তু বিয়ে যে দিচ্ছেন আমার সর্বদোষ-বিশারদ পিতৃদেব স্বয়ং! সেটাই হচ্ছে সব থেকে বিস্ময়ের বিষয়। ও মাবুদ, এ যে দেখি বাসর ঘরও দেখা যায়। হলাম না হয় বাপের অপদার্থ ছেলে, কিন্তু যৌবনকে তো অস্বীকার করা যায় না। তাই খাটের উপর ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় নববধূকে দেখামাত্রই কালবিলম্ব না করে বাসরঘরে ঢুকতে গেলাম। ঘরের ভেতর পা দিয়েছি কি দিইনি, তার আগেই কে যেন মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার ফাঁকে আঙ্গুল আটকা পড়ায় আমার যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা; সেদিকে বিয়েবাড়ির মুরুব্বিদের কারও খেয়াল নেই। বরং বর যেহেতু দরজার চিপায়- তাই দেখে আশেপাশে হাসির হুল্লোড়।
হঠাৎ জোর আওয়াজে ওরে বাবারে ওরে মারে চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি আওয়াজ বেরুচ্ছে আমারই গলা দিয়ে। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল কোন সময় যে আটকা পড়েছে খাট আর মশারি টাঙানোর স্ট্যান্ডের মাঝখানে, তা টেরই পাইনি। হাতটা টানতে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ব্যাথা। হঠাৎ ঘরের বাইরে মায়ের আওয়াজ- ‘আসেন, ভাবি আসেন। এটা আমার মেজো ছেলের ঘর।’ বলতে বলতে মা একটা ছোটখাটো কাফেলা সমেত আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েন। আচম্বিতে উপস্থিত এই বহর দেখে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে আমার একটু বিলম্ব হয়। এমন মুহূর্তে লুঙ্গি সামলাব, না আমার আটকা পড়া হাতটা স্ট্যান্ড থেকে ছোটাব; ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ততক্ষণে কলে আটকা পড়া ইঁদুর-সদৃশ আমার অবস্থাদৃষ্টে জনৈক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আসা কাফেলা দলের ক্ষুুদে সদস্যবৃন্দ খিলখিল হাসিতে বদ্ধ ঘর সরব করে তোলে। আমার কলে আটকা পড়া অবস্থা দেখে অপ্রস্তুত জননী অতিথিদের নিয়ে বেরিয়ে যান। কাফেলার সদস্যরা সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখার মতো যেতে যেতে আরও এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। ওদের হাসির শব্দে কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকা আমার মনে হলো, কোথায় আমার বাসরঘর, আর কোথায় আমার বিয়ে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা ১১টা। নিশ্চিত হলাম- ইহা ছিল দিবাস্বপ্ন!
অতিথিরা কখন বিদায় নিলেন বুঝতে পারলাম না। তবে আমাকে নিয়ে যে বাড়ির অন্য সদস্যদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। থেকে থেকে হাসির শব্দ বিষয়টাকে আরও নিশ্চিত করছে- ‘ও তো একটা রাসকেল, উজবুক কোথাকার!’
পিতৃদেবের গলা। বাড়িতে তার গলার আওয়াজ! মানে আজ ছুটির দিন। এই মুহূর্তে আমি সম্পূর্ণ হতাশ। এখন আমার কী করা উচিত, সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় আমার জননীর পুনরায় ঝড়ের বেগে কক্ষে প্রবেশমাত্রই- ‘এই টুলু, তুই এখনও বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিস! তোর কাণ্ডজ্ঞান কি কখনও হবে না? এই লিস্টটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজারে যা। আজ টুম্পাকে দেখতে লোকজন আসবে। পাত্রের খালা আগেই এসেছেন। ওরা এখন রহিম ভাইদের বাসায় গেলেন। ওরা তোর রহিম কাকার কেমন যেন আত্মীয় হন। রহিম ভাই-ই সম্বন্ধটা এনেছেন। এখন একটু জলদি যা। আমাকে আবার টুম্পাকে নিয়ে বসতে হবে। দেরি করিস না।’
এক নিঃশ্বাসে আদেশ সমাপনমাত্র জননী যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলেন তেমনি ঝড়ের বেগেই বেরিয়ে গেলেন। আমি হতাশ হয়ে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই যে আমি এতক্ষণ ধরে আমার ডান হাতটা বাঁ হাতে চেপে ধরে বসে আছি, সেটা কি আমার মা দেখতেই পেলেন না! সে না হয় যাক, তিনি তো আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে কথা বললেন। আমার মুখটা যে ব্যথায় কুঁচকে রয়েছে, সেটাও কি তার নজরে পড়ল না! ঘুম ভাঙার পর সকালের নাশতাটা এখন পর্যন্ত পেটে পড়েনি, তার আগেই কাজের ফিরিস্তি। এমনি কপাল আমার। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, আমি এ বাড়ির ছেলে তো! একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি টুম্পা আর বড় ভাবি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন খলবল করে হাসছে। আচ্ছা, বিয়ের কথায় মেয়েরা এত পুলকিত হয় কেন? টুম্পাকে দেখে আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়ায় মনটাই কেমন খারাপ হয়ে গেল! স্বপ্ন দেখলাম আমার বিয়ের, আর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে বোনের!
‘এ বান্দারে তুমি একটু দেখিও মাবুদ’- বিড়বিড় করতে করতে ভর দুপুরে নাওয়া-খাওয়াহীন আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। রিকশা ডাকতে যাব এমন সময় পাশের বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে কে যেন বলে উঠল- ‘ঘুমানোর সময় লুঙ্গি না পরে ট্রাউজার পরলেই হয়।’ সাথে সাথেই কয়েক জোড়া তন্ব্বীকণ্ঠের খিল খিল হাসি। ওদের মধ্যে একটি হাসি আমার বিশেষভাবে চেনা। দাঁড়াও, তোমার ব্যবস্থা আমি পরে করছি। রহিম কাকার এই মেয়েটা আমাকে জ্বালাতনের চূড়ান্ত করে ছাড়ছে। ওর কারণে মেয়েমহলে আমি বরাবরই হাসির পাত্র বনে যাই। রাস্তায় পরিচিত মেয়েরা আমাকে দেখলেই কেমন মুখ টিপে হাসে। রাগে গা-টা জ্বলে যাচ্ছে। রিকশা না নিয়ে হনহনিয়ে চললাম। পিছনে হাসির শব্দ গায়ে যেন বিছুটির পাতা লাগিয়ে দিচ্ছে। বুঝলাম, আমার লুঙ্গি হাতে ত্রিভঙ্গ হয়ে থাকার বিষয়টি মহল্লার মেয়েমহলে রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগবে না। ধুস্, এ মেয়েটার যন্ত্রণায় এলাকায় আমার একটা প্রেম পর্যন্ত হলো না।
দুই.
এর দু’দিন পর সুবলদার ডিসপেনসারিতে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমার আড্ডার আখড়া ওই একটাই। আমাদের এলাকাটা না শহর না গ্রাম; শহরতলি বলাই ভালো। জেলা সদরের প্রধান সড়কটা যেন সরু হতে হতে আমাদের মহল্লার মোড়ের রাস্তায় এসে মিহি হয়ে মিশে গেছে। সেখানে দেখার মতো আছে বিশাল বড় এক বটগাছ, যার নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা দোকান। এই বটতলার মোড়টাই আমার মতো অকালকুস্মাণ্ডদের আড্ডার জায়গা। বিপিন, রতন, লিয়াকত, লতিফসহ আমার মতো আরও কয়েকজন যারা অদ্যাবধি পড়ালেখার সুফল ঘরে তুলতে পারিনি, তারাই এসে ভিড় করি সুবলদার ডিসপেনসারিতে। সুবলদা সজ্জন মানুষ। বিয়ে করেছেন অনেক দেরিতে। এখনকার মোবাইল, ফেসবুকের সময়েও উনি মনোযোগ দিয়ে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়েন। তার একটা বিশেষত্ব আছে। সেটা তার গুণ, না দোষ বলব, তা আমরা এখনও ঠিক করতে পারিনি। বিষয়টা হলো, তিনি যখন ফ্রেশ মুডে থাকেন কিংবা যখন ভয়ানক টেন্সড হন, ঠিক তখনই তিনি বিশুদ্ধ সাধু ভাষায় কথা বলা শুরু করেন। আমাকে দেখলে তিনি এ চর্চাটা একটু বেশিই করেন। কারণ আমি আবার বাংলায় অনার্স দিয়েছি কিনা। তবে সুবলদা যে আমাদের যুগযন্ত্রণা ও মনযন্ত্রণা একটু হলেও বোঝেন, তাতেই আমরা বেজায় খুশি।
‘তাহার পর টুলু, কী সংবাদ তোমার? শুনিলাম, তোমার ভগ্নির বিবাহ ঠিক হইয়াছে?’- চেয়ারে বসতে বসতে সুবলদা শুধান। ‘হ্যাঁ দাদা, প্রায়’- আমি উত্তর শেষ করার আগেই একজনকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেলাম। প্রায় চমকে যাওয়া গলায় সুবলদাকে বললাম-
‘মেয়েটা কে দাদা?’
‘কাহার কথা শুধাইছ বৎস?’
‘ওই যে, নীল কামিজ পরা মেয়েটা রিকশা করে যাচ্ছে।’
‘কেন, বল তো ভায়া?’
‘আপনাকে যে স্বপ্নের কথা বলেছিলাম না..।’
‘হাঁ, বলিয়াছিলে। তাহাতে আজকের ঘটনার কী সম্পর্ক ?’
‘বিশ্বাস করেন দাদা, সেদিন স্বপ্নে আমার বাসর রাতে এই মেয়েটাকেই খাটের উপর দেখেছিলাম।’ আমার কথা শুনে সুবলদা মুচকি হেসে মন্তব্য করেন-
‘টুলু সাহেব, বিষয়টা একটু বেশি রকমের সিনেমাটিক হইয়া গেল না?’
‘না দাদা, আপনি বিশ্বাস করেন। এই সেই…।’ এক আজলা উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে আর কি। আমার অবস্থা দেখে সুবলদা হো হো করে হেসে ওঠেন। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে থাকেন- ‘শোনো হে ছোকরা, তোমায় দোষ দিয়া লাভ নাই। দোষটা হইল বয়সের। এই বয়সে মেয়েছেলে দেখিলে ও-রকম হইয়াই থাকে। কিন্তু তুমি যে মেয়েদের নিয়া ইদানীং একেবারে বাসর পর্যন্ত ভাবিতে লাগিলে, ইহা কী রকম কথা ভায়া?’
‘বিশ্বাস করুন দাদা, ইয়ারকি নয়; আমি সত্যি বলছি- ওই মেয়েটাই…।’ সুবলদা আমাকে শেষ করতে না দিয়েই একটা ধমক লাগান-
‘শোনো টুলু, তোমার বাবাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। তাহার উপর এখন ভদ্রলোকের কন্যার বিবাহের কথাবার্তা চলিতেছে। আমার বাপ দীর্ঘদিন বাঁচিয়া ছিলেন না, তাই বোনের বিবাহের সময় বুঝিয়াছিলাম মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার যন্ত্রণা কত! তাই বলিতেছি, এই সময়টা একটু সমঝে চলিও। আর ওই মেয়েটার কথা বলিতেছ তো, তাহার হইতেও সাবধান থাকিও। ও তোমাদের কলেজের নতুন প্রিন্সিপালের কন্যা।’ সুবলদা টানা বক্তৃতা ঝাড়ছেন দেখে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেল। বেশ রাগত স্বরেই উত্তর দিলাম-
‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি সারাদিন পাঁঠার মতো মেয়েদের পিছনে ঘুরে বেড়াই।’
‘কথাগুলিন ভালো লাগিতেছে না তো। জানি, ভালো লাগিবার কথাও নহে। বয়সের দোষ কিনা! তবে হে, বলেছ বেশ। এ বয়সেই কিন্তু পাঁঠার স্বভাবের সঙ্গে ছেলেদের আচরণের বেশ মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায়।’
নাহ্, সুবলদার কথা আর সহ্য হচ্ছে না। ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে আর না।
‘শোনো হে বৎস, চলিয়া যাইতেছ যাও। বলি কি, সঙ্গে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট লইয়া যাও, কাজে লাগিবে। তোমার এখন নির্দোষ ঘুম প্রয়োজন। তোমার ঘুমে দোষ লাগিয়াছে।’ সুবলদা মেজাজটা সত্যি বিগড়ে দিলেন। আর কথা না বাড়িয়ে হনহন করে বাড়ির পথ ধরলাম।
মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আমার দিনরাত্রির নিজস্ব হিসাব কেমন যেন গুলিয়ে গেল! আমি সদ্য অনার্স পাস করা ছেলেটা, মাস্টার্স করার জন্য ঢাকার এক কলেজে গিয়ে ভর্তি হবো কি-না ভাবছি। ব্যাপারটায় বাড়ির সবাই সমানে উপর-নিচে মাথা দুলিয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় গিয়ে নাকি আমার একটু চালাক-চতুর হওয়া দরকার। পিতৃদেবের মতে, এখানে নাকি আমার আড্ডাবাজি ছাড়া কিছুই হবে না। আমিও যাব যাব করছি। এমন সময় এ কী বিপদে পড়লাম! বেশ তো যাচ্ছিল আমার দিনগুলো। বাড়ি থেকে সাইকেলে চেপে ছয় কিলো. দূরের দুটি টিউশনি, সুবলদার ওখানে বৈকালিক কি সান্ধ্যকালীন আড্ডা মেরে দিনগুলো আমার ভালোই কাটছিল। কিন্তু অকস্মাৎ এ কী বিভ্রাটে পড়া গেল! মেয়েটার দেখা না পেলেই বরং ভালো ছিল। কিন্তু মেয়েটা যেদিন সুবলদার দোকানের সামনে দিয়ে রিকশায় তরতর করে চলে গেল, সেদিনেই খাদে পড়ে গেলাম। মেয়েটাকে যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে চেয়ে দেখেছি। রিকশা সমেত মেয়েটি অদৃশ্য হওয়ার পর থেকেই আমার অবস্থা রাধার মতো হলো। পুরো শরীর কেমন যেন অবশ হতে থাকে!
বেশ বুঝতে পারছি, কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই আমার মনের আকাশে মেঘ জমতে শুরু করছে। সেখানে থেকে থেকে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিজের অজান্তেই গানের সুর ভাঁজছি- ‘তুমি যে আমার কবিতা…।’ আমার এ বিরহ দশা বাড়ির কারোরই চোখে পড়ল না। সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য কেউ বুঝতে না পারায় ভালোই হয়েছে। নিজের মৌতাত নিজের মধ্যে রাখাই ভালো। অবশ্য একজনের চোখ এড়ানো গেল না। তিনি হলেন সুবলদা। তার সামনে গেলেই বাঁকা হাসি হেসে জানতে চান-
‘কি হে, চোখের নিচে যে কালি! ঠিকমতো ঘুম-টুম হইতেছে তো? ‘
‘না দাদা, সে রকম কিছু না। তবে ইদানীং কিছুই ভালো লাগছে না।’
‘জানি তো, এমনটাই হওয়ার কথা। লক্ষণ সব মিলিয়া যাইতেছে বেশ। আমাদেরও হইয়াছিল কিনা। তা কন্যাটির সম্পর্কে কিছু জানিতে পারিয়াছ?’
‘সেদিনের পর মোটে আর একবার মাত্র দেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত মেয়েটার নামই জানতে পারিনি।’
‘নাম হইল হেলেন।’
‘হেলেন… বাহ!’ মেয়ের নামটাও কী সুন্দর! কেমন মাদকতায় ভরা। শ্রীরাধা যেভাবে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়েছিলেন, তেমনি মদিরা ভরা আঁখি তুলে সুবলদার দিকে চাইলাম, যেন তিনিই হেলেন। আমার গলার স্বরটাও ইদানীং ভীষণ রকম মিষ্টি হয়ে উঠেছে। সবার সঙ্গেই কেন যেন মিষ্টি কথা বলতে মন চায়। সেই স্বরে আরও খানিক মায়া ঢেলে সুবলদাকে বললাম-
‘ধন্যবাদ দাদা। মেয়ের নামটা কিন্তু ভীষণ সুন্দর; আপনি কী বলেন?’
“নাম লইয়া আমি কী বলিব বল, আমার সে বয়স রহিয়াছে কি? তবে তোমার বন্ধু লতিফ গতকল্য বলিল- ‘সুবলদা, নয়া প্রিন্সিপালের মাইয়াটারে দেখছেননি? কী যেন নাম! হ হ, মনে পড়ছে; হেলেন। হেলেন মাইয়াটা একখান জিনিস গো দাদা।’ তুমি জানো নিশ্চয়, লতিফ কেমন দুর্মুখ বালক। আমি বলিলাম, লতিফ ওইদিকে যাইও না। তোমার বন্ধু টুলু পূর্ব হইতেই মেয়েটাকে পছন্দ করে। প্রত্যুত্তরে সে জানাইল- ‘মাইয়া মাইনষে কি রাস্তায় পইড়া থাকা টাহা, যে আগে দেখব হে লইব? আর টুলু পিরিত করতে চায় কুন সাহসে? হের মাজায় জোর আছেনি? হেয় কুনুদিন মাইয়া মাইনষের হাতখান ভি ধইরবার পারছে? পোলাপান তো হেরে মাজা-ভাঙা টুলু কইয়া ডাকে।’ বলিতে বলিতে লতিফ মোটরসাইকেলে উঠিয়া চলিয়া গেল।”
‘হারামির পোলা, কুট্টির বাচ্চা লতিফ এখন কোন জায়গায় আছে বলতে পারেন সুবলদা? ওর বাপ পুরান ঢাকায় ভাত পায় নাই, এখন আমাদের এলাকায় এসে মাস্তানি। দাঁড়ান, ওরে মাজার জোরটা একটু দেখায় আসি।’
সুবলদা তারস্বরে চেঁচাতে থাকেন- ‘টুলু, শুনিয়া যাও ভাই। মাথা গরম করিও না। তাহাতে বিড়ম্বনা বাড়িবে বৈ কমিবে না। এমনিতে তোমার পিতা ভয়ানক রাগী মানুষ। এই টুলু এই।’
এর পরের ঘটনা সুবল কিংবা টুলুর হাতে থাকে না।
তিন.
সেদিন বিকেলেই সদরের একটি ক্লিনিকে টুলুকে হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় আবিস্কার করা গেল। বাম চোখের উপরেও পট্টি বাঁধা। ডাক্তার জানিয়েছেন, আঘাত গুরুতর নয়, তবে সারতে মাস দেড়েক লাগবে। কেবিনের ভেতর লোকজনে ভরপুর। টুলুর মা ও বড় ভাবি এসে হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাদের পাশে অচেনা কিছু মুখও দেখা যাচ্ছে। তারা থেকে থেকে টুলুর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। বোঝা গেল, তারা টুলুর ছোট বোন টুম্পার হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন। টুম্পার বিয়ে উপলক্ষে রংপুর থেকে আগত ওদের ছোট খালু হাতে একটা ফলের প্যাকেট নিয়ে কেবিনে ঢুকেই বলতে শুরু করেন- ‘এটা কোন কতা হইলে বাহে? বিয়াত্তা মাইয়ার জন্যে পোলাপান নিজেগোর মধ্যে মারামারি করে! এই পিনসিপাল তো আগত রংপুর সরকারি কলেজোত আছিল। হ্যার এই মাইয়ার বিয়াত তো মুই দাওয়াত খাছিনু বাহে। তোমার এটা আক্কেল, হ্যাঁ! দুনিয়াত কি বেটিছইলের আকাল পড়ছে? শোনো বাহে টুুলু, তোমরা ভালো হয়া যত তাড়াতাড়ি পারেন ঢাকা চলি যাও, না হয় মোরে সাথে অমপুর হাটো। তোমার বাপ হেবি ফায়ার হয়া আছে। তোমার চেহারা পযযন্ত দেইখপার ছাওছে না। এটা কোনো শিক্ষিত পোলাপানের কাম, হ্যাঁ!’ এত লোকের সামনে লোকটা এসব কী বলছে! লজ্জায় টুুলু মাটি হয়ে যায় আর কি। নতুন প্রিন্সিপালের পরিবার সম্পর্কে সে এত কিছু জানে! কী এক বিশ্রী ঘটনা ঘটিয়ে বসল সে! সুবলদা তখন এত করে বললেন। এখন এলাকার সবাই তাকে নিয়ে কী ভাবছে? সারা শরীরে ব্যথার সাথে এই এক নতুন আত্মবোধনের যন্ত্রণা টুটুলকে যেন ম্রিয়মাণ করে দেয়। নিজের ভেতর নিজে সেঁধিয়ে যেতে যেতে সে যেন নিজেকেই আর খুঁজে পাচ্ছে না।
চার.
সকলে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় পাশের বাড়ির রতন ওর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘টুলুদা, তোমায় তো এখানে বেশ কয়েকদিন কাটাতে হবে। তাই ছোটদি তোমার জন্য বই পঠিয়েছে, শুয়ে শুয়ে পড়বে। নাও ধর।’ টুলু হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিতে নিতে ভাবে, রহিম কাকার মেয়েটা এবারও খোঁচা দিতে ছাড়বে না নিশ্চয়। সবাই চলে গেলে টুলু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কয়েক সপ্তাহজুড়ে পাগলামির জন্য নিজের কাছে নিজেই সে ক্ষমা প্রার্থনা করে। অনেক কসরত করে সে এক হাতে প্যাকেটটা খোলে। কয়েকটা গোলাপের পাপড়ির সাথে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে ধূসর রঙের একটা বই। বইয়ের নাম ‘ট্রয় ধ্বংসের ইতিকথা’, মূল হোমার। বাম চোখটা ঢাকা পড়ায় অনুবাদকের নামটা ঠিকমতো পড়া যাচ্ছে না। বিছানায় হেলান দিয়ে টুলু প্রথম পাতাটা উল্টায়। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা- ‘টুলুদা, সুস্থ হয়ে গেলে তুমি বোধ হয় ঢাকায় চলে যাবে। সেখানে হয়তো আবারও কোনো হেলেনের দেখা পাবে। তবে জানো তো, চেনা পথটা অনেক সহজ সুরে বাঁধা। তোমায় ছোট থেকে অনেক জ্বালাতন করেছি। পারলে ক্ষমা করো। ইতি মুনিয়া।’
কথা ক’টি পড়ে টুলু কেমন যেন হয়ে যায়। আনমনে জানালা দিয়ে সে দূরের পানে তাকায়। আকাশের জলরঙা মেঘটা যেন কান্না চেপে রয়েছে বিষণ্ণ বিকেলে আসন্ন সন্ধ্যায়। ‘মুনিয়া’ ‘মুনিয়া’ বলে নামটা কয়েকবার আওড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট্ট পাখি যেন ওর মনের মধ্যে হুট করে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই ওর ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। এবার দূরের ওই জলরঙা মেঘটা ওর চোখেই ভেঙে পড়ে কি-না, টুলু ঠিক বুঝতে পারে না।