জনাব আলীর শীতবস্ত্র

যবর নিহের পড়তেচে আইজ, যবর কুয়ো। ইঁঙেল যিনি এহাবারে আড়ের বিন বিঁদে যাবের চায় রে দাদা!’

শীতে কাঁপতে কাঁপতে লাঠিতে ঠুকঠাক শব্দ তুলে বলে ওঠে জনাব আলী। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সেই আট বছরের নাতি সোহাগ আলী তখন দুই হাতে লেপ্টে থাকা দুধচাঁপার কালো কষ তুলতে ব্যস্ত।

ঘরের পেছনের বরই গাছ থেকে একমুঠো বরই পাতা ছিঁড়ে গভীর মনোযোগে সে দুই হাতে পানি মিশিয়ে ডলে। ফেনা ওঠে জব্বর। দুধচাঁপার কষ মারাত্মক তেতো। ভাল করে না তুললে খাবার মুখে তোলা যায় না আর। এমন তেতো লাগে, যেনো বিষ। সে তাই দাদার কথায় কান দেয় না তেমন। বুড়ো মানুষ অনর্থক বকে। অর্থহীন প্যাচাল। মাত্র ক-বছরের জীবনেই এই গূঢ়তম সত্যটা আবিষ্কার করে ফেলেছে সোহাগ আলী। গম্ভীরমুখে সে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।

অদূরে খুঁটোয় বাঁধা ছাগলটা দুধচাঁপা চিবোতে চিবোতেই ম্যা অ্যা অ্যা অ্যা করে সোহাগ আলীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে।

‘অবা ব্যাবাস নে তো! আসতিচি! দেহিস নে কাম করতিচি এটা?’

ছাগলের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয় সোহাগ আলী। সংসারে বুড়ো মানুষের চেয়ে ছাগলের কথা বরং কাজের। সে জানতে সোহাগ আলীর আর বাকি নেই কিছু। ছাগল মানেই মাস পাঁচ-ছয় পরপর হালিখানেক নাদুসনুদুস বাচ্চা, বছরান্তে অনেকগুলো টাকা। আর বুড়ো দাদা? ধুরো! হুদাই খরচ।
‘দাদারে, অতো পানি ছেনে না, ঠান্টা লাগে যাবিনি। লাত্তিরি বুহির বিন যে সাঁ সাঁ হরে তোর! তাড়াতাড়ি আসে তোর মা’র এটা কাপড় জড়া নে গা’য়। দাদা আমার বাআলো, আয়।’

‘এ দাদা, তুমি খালি খালি ফ্যাকফ্যাক করবা না তো! আমার সুময় অলি আমি এহলাই আসপোনে, তুমার কওয়া লাগবি নানে।’

জনাব আলী তবু নড়েচড়ে না। সংসারে ওই একটা মাত্র নাতি তার, যে অল্প হলেও তার ‘দুপদরদ’ বোঝে। নিজের ছেলের কথা আর বলতে চায় না সে। ছেলে তো নয়, শত্রু। দু চোখে দেখতে পারে না বাপকে। দূর দূর, ছাই ছাই করে সারা বেলা। জনাব আলীর কেউ তো নাই আর, যেখানে গিয়ে দাঁড়াবে একবেলা। তার উপর আবার গেছে চোখ। আজকাল চোখে প্রায় দেখেই না সে। দিনে ঝাপসা একটু আধটু যদি বা দেখে, রাতে পুরোই অন্ধকার। ফলে সোহাগ আলীই বলতে গেলে তার চোখের আলো এখন। তার চোখেই সে বিশ্ব দেখে আজকাল। জনাব আলীর বিশ্ব মানে আশেপাশে দু-চার গাঁ, আর প্রায় স্বপ্নের মতো, কানে শোনা, বহুদূরের এক শহর, ঢাকা। সে শহরে নাকি খালি আলো আর আলো, সুখ আর সুখ। সে শহরের মানুষ ম্যেলা ভালো খায়, ঢের ভালো পরে। রেডিওতে গান শুনেছে জনাব আলী, যৌবন বয়সে সুর করে গাইতও,

“লাল, নীল রঙের বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইছে
ঢাকার শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে”

আহা! সত্যি যদি সে শহরে যাওয়া যেত কোনোদিন! মনে মনে ভারী আফসোস হয় জনাব আলীর। তবে সে আফসোস মিলিয়েও যায় কিছুক্ষণ বাদে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে। দোয়া দরূদ তেমন না জানলেও, যা জানে, সেটুকুই তিনবেলা আওড়ায়। কুঁচফল দিয়ে সোহাগকে বলে কয়ে একটা তসবি সে বানিয়ে নিয়েছে। সেটাই সে টেপে এখন নিয়মিত। তসবি টিপতে গিয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে বহুকাল আগে মরে যাওয়া কচি বউটার গা-গতরের কথা মনে এসে যায় তার। নাউযুবিল্লাহ্! সব ওই শয়তানের ধোঁকা! মনে মনে তখন তখনই তওবা পড়ে নেয় জনাব আলী। হুজুরের বয়ানে যা শুনেছে তাতে সে জানে, মরলে খাওয়া পরার আর চিন্তা নাই কারও, শুধু সুখ আর সুখ, আলো আর আলো, একেক জনের সত্তরটা করে হুর, অঢেল সুরাজাতীয় দ্রব্য। আহা! ঢাকা শহর সেখানে নস্যি। অমন হাজারটা ঢাকা শহরের মালিক সে একাই হবে তখন। তবে শেষের দুইটা নিয়ে কিঞ্চিৎ ধন্দ আছে তার মনে। সত্তরটা হুর সে সামলাতে পারবে তো? যৌবন বয়সের যে টুকরো-টাকরা স্মৃতি এখনও আছে তার, তাতে মনে পড়ে জোহরা বেগমকে সামলাতে বেশ বেগই পেতে হতো তাকে। তাছাড়া জোহরা বেগমের মনও ছিলো অতীব ঈর্ষাকাতর। রসিকতা করা যায়, এমন কোনো নারীর সাথে জনাব আলীর কথা বলা দেখলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত বউটা তার। সে বেশ নেককার ছিলো, তা বেহেশতে গেলে তো তার সাথেও দেখা হবে জনাব আলীর, হুজুর তেমনটাই বলেছেন, তখন সে ওই সত্তরটা হুর দেখে না জানি কী তুলকালাম কাণ্ড করবে, ভাবতেই বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করে ওঠে জনাব আলীর। আর ওই সুরা নামক বস্তুটা! সেটাই বা কেমন হবে খেতে? যৌবনকালে একবার গ্রামের এক বখাটে লোকের পাল্লায় পড়ে সে কয়েক চুমুক খেয়েছিল। মাগো মা! মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে এমন ঘুরান দিলো তার, আর কোনো থামা-থামি নাই! শেষে জোহরা বেগমের কাছে এসে তবে শান্তি! ওখানে যদি অমন হয়, তখন?

‘অলি পরে অবিনি! হোনেও তো জোহরা বেগম থাকপিনি! আরও অতগুনু হুর! অ এক ব্যবস্তা অয়াই জাবিনি!’ মনে মনে ভাবে আর দাড়িতে হাত বুলায় জনাব আলী। মিটিমিটি হাসে।

সোহাগ আলী ততোক্ষণে হাত ধুয়ে তার মায়ের শাড়িটা চার ভাঁজ করে জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। নিচে তার নিজের একটা মাত্র পাতলা শার্ট। বাজান বলেছে এই শীতে একটা ভালো শার্ট আর একটা জাম্পার কিনে দেবে তাকে। তা বাজান অমন প্রতি শীতেই বলে। বলতে বলতেই শীত গিয়ে শীত এসে পড়ে আবার। শার্ট আর জাম্পার আর কেনা হয় না শেষতক। মা বলে, ‘ওতা আর কিনা অবিনানে কোনোদিন, বুজিচিস? উয়ো কাচে আচে, বালো আচে, লতুন লয়চে’।
‘কা কাচে, ইঁ মা?’ প্রবল আগ্রহে বলে ওঠে সোহাগ আলী। মা ধমকে ওঠে তখন। বলে,
‘জ্বালাইসনে কলাম। যা হেনতে। যেম্মা ব্যায়া বাপ, তেম্মা ব্যায়া ছাওয়াল।’

মন খারাপ করে সরে আসে সোহাগ আলী। কিন্তু শিশুমনে সে তার অখরিদকৃত শার্ট আর জাম্পারটার চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ভীষণ। কার কাছে আছে সেসব? কার কাছে এতো ভালো আছে তার অখরিদকৃত শার্ট আর জাম্পার? ময়লা করে ফেলছে না তো তারা? অযত্নে ফেলে রাখছে না তো কোথাও? ভেবেই অদেখা জাম্পার আর শার্টের প্রতি মমতায় বুকের মধ্যেটা বাইরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের চেয়েও কনকন করে ওঠে।

খড়-নাড়া বিছিয়ে ছাগলটাকে ঘরে তুলে দেয় সে। উঠোনের একপাশে সামান্য ছনের ছাউনি, সেখানে মাটির চুলা পাতা, বাতি জ্বালিয়ে সেখানে রান্না করে মা। আজ এখনও বাতি জ্বালান হয়নি। আঁধার আরেকটু গাঢ় হলে তবে বাতি জ্বালাবে মা। কেরোসিনের যা দাম বাড়ছে দিনকে দিন। অতো বেশি বাতি জ্বালানোর বিলাসিতা করার যো নেই তাদের।

‘আইজ কী নাদা, ইঁ মা?’ বলে পায়ে পায়ে চুলার পাশে এগিয়ে যায় সোহাগ। বড্ড খিদে পেয়েছে তার। সেই কোন বিকেলে বাসি একটু ভাত খেয়েছে সে, মরিচ আর লবণ দিয়ে চটকে। খিদেয় পেটে যেনো ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। চুলার পাশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে সে। হাত এগিয়ে দেয় আগুনের দিকে। চুলা থেকে বের হওয়া আগুনের তাপে সেঁকে নেয় হাত।

‘দাদা ঠিকই কয়চে। যবর জাড় আইজ।’ বিড়বিড় করে সোহাগ।

‘কী নাদব? শিম বাতে দিচি। দেহি তোর বাপ আটেত্তে কী আনে। আনলি পরে তরকারি নাদব।’ উত্তর দেয় আকলিমা।

‘দাদারে! যবর জাড় লাগে দো! ইটু সাঁজাল জ্বালা দি উটোনের কুণায়!’ জনাব আলীর কণ্ঠে মিনতি ঝরে। শীতে থিরথির কাঁপে দাওয়ায় বসে।

‘তুমার তো জাড় লাগেই থাহে! আসতিচি দাঁড়াও!’

‘ওই দেকগা, ছাগলের গরের ওই কুণায় গুটদি আবাজাবা শুহোয়া জড়ো হরে লাহিচি, ওইগুনু জ্বালাগা, যা।’ নির্দেশ দেয় আকলিমা।

অতঃপর ছাগলের ঘরের কোণায় রাখা শুকনো আবর্জনাগুলো এনে উঠোনের একপাশে জড়ো করে সোহাগ। আগুন জ্বালে ধীরে। লাঠিতে ভর দিয়ে এসে সাঁজালের পাশে পিঁড়ি পেতে বসে জনাব আলী। তার শরীরে সেই কোন আমলের তেল চিটচিটে পুরনো একটা কাঁথা জড়ানো। তার নিচে শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবি। আশেপাশে থাকা খড়কুটো দু-একটা করে সাঁজালের আগুনে ফেলে জনাব আলী। শীতে জমে আসা হাড় জিড়জিড়ে হাত-পাগুলোতে আগুনের উত্তাপ শুষে নিতে থাকে। আগুনের কাছ ঘেঁষে বসে আরও। আগুনে খড়কুটোগুলো ফুটফাট ফোটে, আগুনের উজ্জ্বল আভা এসে পড়ে জনাব আলীর চিমসে যাওয়া, কুঁচকানো, ঝুলে পড়া হাড়-চামড়া সর্বস্বমুখে। সেদিকে তাকিয়ে সোহাগ আলীর মনটা ভারী নরম হয়ে ওঠে হঠাৎ। সে দাদার কাছটিতে সরে বসে খানিকটা। তারপর আস্তে করে বলে,

‘তুমার খিদে লাগেচে, ত্যায় না দাদা?’

‘খিদেতো লাগেইচে রে দাদা। তোর বাপ যে কহুন আসপিনি আইজ, আল্লা জানে।’

বলতে বলতেই দেউড়ির মধ্যে গহর আলীর গলা শোনা যায়।

‘সোহাগ কই রে, ও বাজান?’ বলে হাঁক পাড়ে গহর আলী। সোহাগ দৌড়ে যায়। গহর আলীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে সাঁজালের আলোয় এনে উঁকি মেরে দেখে। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ মুহূর্তেই।

‘এ মা, দেক দেহি, বাজান আইজ মেলা বড় ইঁচে মাচ আনেচে! আমাক কলাম সপচে বড়ডা দিয়া লাগবি, হুঁ!’

খুশি উপচে পড়ে সোহাগের কণ্ঠে। এমন আনন্দ অনেকদিন জোটে না তার। কিন্তু আনন্দে জল ঢেলে দেয় তার বাপ গহর আলী। বিষণ্ন, স্খলিত গলায় সে বলে, ‘ও মাচ খাওয়ার জন্যি আনি নাই, বাজান রে। জাড়ের চোটে আটে লোকজন কম, মাচ বেইচপের পারি নাই। তাই বাইত নিয়ালাম, জাড়ের মাচ কিচু অবি নানে, পানিত রাহে দেবনে, সহালে পাড়ায় নিয়ে বেচপোনে।’

সোহাগের মুখে যেনো একপোঁচ কালি ঢেলে দেয় কেউ। ব্যাজার, কাঁদ-কাঁদ মুখে সে মায়ের দিকে তাকায়। আকলিমা আগুনচোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর থমথমে, ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘এহুন তালি কী ফয়তা নাদব, শুনি?’

‘উয়োর বিন কয়ডা গুঁড়ো ইঁচে আচে দেহ, ওইগুনু বাচে নিয়ে নাদ।’

চোখ দিয়ে আগুন ঢালে আকলিমা। তারপর সোহাগকে বলে, ‘দেহিরে, ব্যাগডা এদিক আন তো দেহি।’

শ্লথ, মন্থর গতিতে নিতান্তই অনিচ্ছাবশত ব্যাগটা নিয়ে এগোয় সোহাগ। মনটা ভীষণ খারাপ। তার বাজান মাছ ধরে ছোট খেও জালে। পদ্মায় এ সময় পানি কমে যায়। তাদের জালও ছোট। জেলের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি। সে কারণে মাছ তেমন একটা ওঠে না আজকাল। বড় মাছ কমই ওঠে। যাও বা ওঠে, গহর আলী সেসব বাড়িতে আনে না। বাজারে বিক্রি করে। মাছ বিক্রির টাকায় চলে তাদের সংসার। ফলে মাছ খুব কমই জোটে তাদের বরাতে। জুটলেও, বিক্রি হয় না, ছোট যে দু-চারটে পড়ে থাকে ঝুড়িতে সেগুলোই পাতে ওঠে তাদের। আজ বড় চিংড়ি ব্যাগে দেখে সোহাগের মনটা তাই নেচে উঠেছিল খুশিতে। আহা! এমন বড় চিংড়ি সে কোনোদিন খায়নি। অন্তত তার তো মনে পড়ে না। ব্যাগটা মার হাতে দিয়ে সে জনাব আলীর কোল ঘেঁষে বসে পুনরায়।

বিমর্ষ, ম্লান মুখে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারের দিকে। তার কচি, মিষ্টি মুখের দিকে জনাব আলী তার অন্ধপ্রায়, ক্ষীণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে। বড় চিংড়ি শুনে জিভে জল এসে গিয়েছিল তারও। নাহ্। তার ছেলেটা সত্যিই চামার। নইলে ছেলের এমন আনন্দটুকুও মাটি করে দেয় কেউ! নিজের কথা ভাবে সে। নিজের যৌবন কালের কথা। জোহরা বেগম তো গহর আলীকে বছর পাঁচেকের করেই পগার পার। তারপর কতো কষ্টে-সৃষ্টে, খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে মানুষ করেছে জনাব আলী, সে শুধু সে-ই জানে। জনাব আলী তখন তাগড়া জোয়ান। কতোজন কতো করে বলেছে বিয়ের জন্য, কতোজন মেয়ে দিতে চেয়েছে জনাব আলীর কাছে, কোনো কিছুতেই রা করেনি জনাব আলী। ওইটুকু মা মরা ছেলেকে সে সৎমায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সাহস পায়নি একদম। সেই কারণেই সে নিজে কষ্ট করেছে, কিন্তু ছেলেকে কষ্ট পেতে দেয়নি কোনোদিন। আগলে রেখেছে ডানার মধ্যে। সে বয়সে তার কি ইচ্ছে হয়নি স্ত্রী-সুখ ভোগের? আলবাত হয়েছে। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চেপে গেছে সে। অথচ সেই ছেলে! সেই গহর! এখন তাকে চিনতেই চায় না আর। দু-বেলা দু-মুঠো খেতে দেয় বটে, কিন্তু সে খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না জনাব আলীর। গহর আলী বাপের সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত কয় না, কখনও কোনো দরকার হলে বুড়ো বলে সম্বোধন করে। আকলিমা মেয়েটা অবশ্য খারাপ না। পরের মেয়ে, তার আর দোষ কী। ছেলেই যখন পর তার। আকলিমার রাগ বেশি কিন্তু মনটা টলটলে। জনাব আলীর জন্য এটুকুই যা স্বস্তি।

কিছুক্ষণ বাদে খেতে ডাকে আকলিমা। সোহাগের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় জনাব আলী। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না আজকাল, কুঁজো হয়ে, সামনের দিকে ঝুঁকে লাঠিতে ভর করে হাঁটে সে। ঘরের দাওয়ায় খেজুরপাতার পাটি পেতে খেতে দেয় আকলিমা। মাঝখানে সোহাগ। তার দু-পাশে বাপ-বেটা। শিম ভর্তা দিয়ে খাওয়া শেষে পাতে তরকারি পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে ওঠে সোহাগ।

‘বড় ইঁচে নাদিচ, ইঁ মা? এতো বড় ইঁচে!’ বিস্ময় উপচে পড়ে তার কণ্ঠ চিরে। চমকে তার পাতে চোখ ফেরায় গহর আলী। জনাব আলীও তাকায়। কিন্তু তার প্রায়ান্ধ চোখে উনিশ-বিশ বিশেষ ধরতে পারে না সে। গহর আলী প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তারপর ঝাঁঝাল গলায় বলে,
‘তুমাক কলাম বড় ইঁচে কয়ডা পানিত ডুবো থুবের! তুমি নাদে ফেলালে? এতো খাওয়ার আউস তুমার? এতো জিবের নোচ?’

‘আর এটা কতা যদি কবা তো সব বাঙেচুরে থুয়ে যেদিক চোক যায় চলে যাব কয়া দিলাম!’ জেদি, একরোখা স্বরে বলে ওঠে আকলিমা। তার কণ্ঠের আঁচ টের পেয়ে চুপ করে যায় গহর। আকলিমা বড় একটা চিংড়ি তুলে দেয় জনাব আলীর পাতে। জনাব আলী হাত দিয়ে স্পর্শ করে, টের পায় তার পাতেও পড়েছে বড় মাপের একটা চিংড়ি। মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করে সে। মেয়েটা ভালো। আহা! মঙ্গল হোক তার।

‘ও দাদা, ইঁচেডা নাদা যবর ফাইন অয়চে, ত্যায় না?’

‘হ রে দাদা, বালো অয়চে খুপ। খা, পরান বরে খা। আর ইটু বাত নিয়ে খা।’

খুশি উপচে পড়ে দাদা-নাতির গলায়। গহর থমথমে মুখে খায়। আকলিমা পাথরের মূর্তি হয়ে বসে থাকে অদূরে।

রাতে ঘুমুতে গেলে এই শীতের রাতে ঠকঠক কাঁপে জনাব আলী। বিছানা বলতে মাটিতে একপুরুত খড় বিছিয়ে তার উপরে খেজুরের পাটি। সেই পাটির উপরে ছেঁড়া একটা কাঁথা। তার উপরে শয়ান। গায়ে দেওয়ার জন্য আরও তিনটে তেল চিটচিটে মোটা ধাঁচের কাঁথা। এ বছর শীত পড়েছে ভীষণ। এই কাঁথায় শীত যায় না। বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। সোহাগ শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে রাতে জনাব আলীর বুকের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। জনাব আলী নাতিটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শীতে থিরথির কাঁপে। তারপর ঘুমিয়েও পড়ে এক সময়। শীতের এই সময়টাতে জোহরা বেগমকে কেন যেনো মনে পড়ে খুব। মনে হয়, গহর আলীর জন্য অতোটা ছাড় না দিলেও চলত। আরেকটা বিয়ে কী করা যেত না তখন? তাহলে, এই শীতের রাতে অন্তত তাকে উষ্ণতা দেওয়ার মতো থাকত কেউ! পরক্ষণেই মনে হয়, দূর! কী আছে জীবনে! এই তো কেটে গেলো জীবন! তার পরেই তো বেহেশত! অনন্ত সুখ! সামান্য এই শীতটুকুই তো! কী আর এমন!

ইদানীং একটা কথা চাউর হয়েছে গ্রামে। বৃদ্ধদের নাকি বয়স্কভাতা দেওয়ার চল করেছে সরকার। শুনে বেশ কদিন সোহাগের হাত ধরে সে ধরনা দিয়েছিল মেম্বার, মাতবরদের কাছে। কল্কে ছেঁড়েনি তার ভাগ্যে। সবারই নগদ চাই। নগদ কোত্থেকে দেবে জনাব আলী? তার নাম খরচের খাতায় উঠে গেছে সেই কবে! তার কাছেও যে নগদ চাইতে পারে কেউ, সেটা ভেবেই প্রথম কয়েকদিন রীতিমত ভিমরি খাবার দশা হয়েছিল তার। প্রথমে ভেবেছিল তামাশা করছে হয়তো। পরে দেখল, না, অতোটা রসিক নয় নেতাগোছের লোকগুলো। ফলে রসিকতা আর জমেনি বেচারা জনাব আলীর। আজকাল আবার শীতবস্ত্র বিতরণের কথাও ঘুরছে বাতাসে। এই শীতে নাকি কম্বল, জাম্পার, ইত্যাদি দেওয়া হবে গরীবদের। শুনে একটু নড়েচড়ে বসেছে সে। রাতে কাঁথার মধ্যে জবুথবু হয়ে, সোহাগকে জড়িয়ে সে গুটুরগুটুর গল্প করে।

‘ইঁরে দাদা, শীতির কাপুড় বলে দিবি ইবার শুনতিচি, সত্যি নাহি?’

‘হ রে দাদা, দিবি বলে, আমু শুনিচি। সেদিন মাটে খেলবের য্যায়া বিলটু আর হাসান কচ্চিলে।’

‘কী কচ্চিলে রে, দাদা?’

‘কচ্চিলে ইবার বলে ফাইন ফাইন কম্বল, জাম্পার আরও সপ মেলা শীতির কাপুড় আয়চে চিয়ারমেনের বাড়িত, সপ বলে গরীপ মানষির জন্যি। ইঁরে দাদা, তালি তো আমরাও পাবনে, ত্যায় না? আমরাও তো গরীপ? পালি করে সেহন কলাম তুমি আর আমি কম্বলডার মুদি আরাম করে গোমাসপের পারবনে, ত্যায় না?’

‘তা তো পারবোনেরে দাদা, কিন্তুক, কতা c অলে গে, সত্যিই কি আমরা পাবনে ওসপ?’

দাদার বুকের মধ্যে আরেকটু ঢুকে আসে সোহাগ। তারপর কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘ক্যা দাদা? পাব না ক্যা? আমরা কি তালি গরীপ না?’
‘গরীপ অলি কী অবিরে দাদা! আমা চ্যায়া গরীপও আছে ম্যেলা যে!’

‘কী কও? কোণে থাহে তারা? আমা গাঁয়?’

‘হ, আমা গাঁয় থাহে, সগল গাঁয়ই থাহে। উরা অলেগে লাজনীতির মানুষ, নিতা সপ। দ্যাশ গিরামের মাতা সপ, বোচ্চ?’

দাদার কথা ভালো বোঝে না সোহাগ। তবে অচিরেই বিতরণ-সম্ভাব্য শীতবস্ত্রে তাদের মতো গরীব ছাড়াও আরও অনেক দাবীদার আছে শুনে দমে যায় সে। হতাশ হয় ভীষণ।

পরদিন থেকে সোহাগের হাত ধরে, অন্য হাতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে আবার নতুন মিশনে নামে জনাব আলী। শতচ্ছিন্ন, তালি দেওয়া তেলচিটচিটে কাঁথা গায়ে দিয়ে কোথাও যেতে রীতিমত লজ্জা হয় তার, কিন্তু এ বছর শীত পড়ছে জব্বর। বুড়ো হাড়ে একবার ঠাণ্ডা বসে গেলে মুশকিল হবে খুব। সোহাগও তার মার শাড়ি পেচিয়েই যায়। এতে অবশ্য কিছু সুবিধাও হতে পারে, মনে মনে ভাবে জনাব আলী।

‘যদি চিয়ারমেন, নিম্বারদের মনে ইটু দয়া অয়, যদি কিচু দেয় তারা, চল, এবাই যাই চল।’ বলে সে এগোয়। কুয়াশায় পথ-ঘাট ঢাকা প্রায়। কদিন হলো সূর্যের দেখা নেই। শীত পড়ছে প্রচণ্ড। চেয়্যারম্যানের বাড়িতে ভীড়ে ভীড়াক্কার। শীতবস্ত্রের জন্য লম্বা লাইন। নাতিকে নিয়ে জনাব আলীও লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে বসে পড়ে না পেরে। বেলা পড়ে এলে সোহাগ তার সাইজের প্রায় দ্বিগুণ, ঢোলা একটা উলের সোয়েটার পায়, কটকটা কমলা রঙের। জনাব আলী পায় কালো রঙের, হাঁটুর নিচে ঝুলে পড়া একটা বাহারি কোট। ফেরার পথে কালো কোট আর কমলা রঙা সোয়েটারে উভয়কে এতো অদ্ভুত দেখায় যে কেউই কাউকে দেখে হাসি চাপতে পারে না। দু-জনই গলা ছেড়ে হেসে ওঠে হো হো।

‘তোক যবর ফাইন দেহা যাচ্চে কলাম, দাদা!’ বলে হিহি হাসে সোহাগ। শীতেও কাঁপে।’

‘তুমাকও কম ফাইন দেহা যাচ্চে না, বুইজলে?’ গলায় ফূর্তি ঢেলে বলে জনাব আলী।

তারপর বলে, ‘যেবা দেহা যাচ্চে যাইকগে, জিনিসটা গরম আচেরে দাদা। জাড় কৈল সেবা লাগতেচে না আর। তোরডা কেবা? গরম আচে?’
‘হ দাদা, গরম আচে। বড় অয়া আরও বালো অয়চে বুইজলে? আমার ঠ্যাং পন্তক জাড় লাগতেচে না আর। খালি গলাডা আটু ছোট অলি বালো অতেনে। মাক কবনে, সিলাই করে ইটু ছোট করে দিবিনি।’

‘হ, কসেনে।’ জনাব আলীর গলায় সন্তুষ্টি স্পষ্ট হয়।

‘তোর বাপ আর মা আলিও পাতেনে কলাম। কতো মানষি নিয়ে গেলো আসে।’

‘হ, তা পাতেনে। আবার তো দিবিনি, সেহন আইসপের কবনে মা আর বাজানেক।’

‘কইস। এইবার এটা কম্বল পালিই অয়। তালি আর লাত্তিরি শুয়ার চিন্তে থাকপি নানেকো।’ খুশি খুশি গলায় বলে জনাব আলী।
‘কম্বলও বলে দিবি, কলে তো।’

‘হ, দেহা যাক।’

সে রাত্তিরে দাদা-নাতি সোয়েটার আর কোট পরেই ঘুমুতে যায়। আহ্! কী আরাম! না জানি কম্বলটা পেলে কেমন আরামের হবে ব্যাপারটা! ভেবে দু-জনেই রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে মনে মনে। পরদিন থেকে জনাব আলীর গা থেকে কোট আর নামে না। ঢলঢলে, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নেমে যাওয়া কালো রঙের কোটটাতে তাকে প্রায় সার্কাসের ক্লাউনের মতো দেখায়। সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই জনাব আলীর। হাড়কাঁপানো শীত তার থেকে কিছুটা হলেও দূরে আছে, এর চেয়ে আনন্দের এ জগতে আর কিছু হতে পারে, সে কথা আর পাত্তাই দেয় না জনাব আলী। সোহাগ আলী মাকে বলে সোয়েটারের গলা ছোট করে নেওয়ায় সেটার অবস্থা দাঁড়ায় আরও অদ্ভুত। গলার দু-পাশে এমন বেখাপ্পাভাবে সেটা ফুলে থাকে যে, দেখে যে কোনো গম্ভীর লোকের পক্ষেও হাসি চেপে রাখা মুশকিল। সোহাগ আলী সে সবের থোড়াই কেয়ার করে। তার শীত লাগছে না, এরচেয়ে সুখের কথা আর কিছু নেই তার কাছে।

কদিন বেশ কাটল তাদের। এর মধ্যেই কম্বল দেওয়ার দিনও চলে এলো। জনাব আলী এবার আকলিমাকে বলে কয়ে রাজি করাল সাথে যেতে। মেয়েরা গেলে কিছুটা অগ্রাধিকার পাওয়া যায়, সেদিন দেখেছে সে।

আজ কম্বল দেবে জেনে ভিড় আরও বেশি। মানুষের যেনো ঢল নেমেছে আজ। শেষ পর্যন্ত মিলবে তো কম্বল? আশংকায় বুকের মধ্যে ঢিবঢিব করে জনাব আলীর। আজ শীতটাও পড়েছে অন্যদিনের চেয়ে বেশি। হাড়ের মধ্যে বিঁধে যাচ্ছে ঠাণ্ডা। শীতে হিহি কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করে তারা। অবশেষে কম্বল মেলে। তিনজনেরই। গহর আসেনি। তার সময় নেই। একদিন কাজে না গেলে সবাই মিলে উপোষ সেদিন। শীতের চেয়ে ক্ষুধার কামড় কম যন্ত্রণার নয়। কম্বল পেয়ে তিনজনেরই মুখ শুকোয়। পাতলা, কয়েক জায়গায় ফুটো। ইঁদুরে কেটেছে, সম্ভবত।

‘নাই মামার চেয়ে কানা বালো বউমা। ফুটো জাগাগুনো ইটু সিলাই করে নিলিই অবিনি।’ বাড়ির পথে ফিরতে ফিরতে সান্ত্বনার সুরে বলে জনাব আলী। বলতে বলতে খকখক কাশে। হাঁটতে তার কষ্ট হয় খুব। কেমন শ্বাসকষ্ট হয়। বুকের মধ্যে হাপরের ওঠানামা।

আকলিমা গম্ভীরমুখে নির্বাক থাকে। সোহাগের মুখটাও ব্যাজার। কম্বল নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো তার, ছিলো অনেক কল্পনা। কম্বলের এই হাল দেখে মুখে আর বাক্য সরে না তার।

রাতে আর কিছু খায় না জনাব আলী। বেদম কাশে। কাশতে কাশতে বমিও করে বুঝি। নিজেদের ছেঁড়া তিনটা কাঁথা আর সদ্য পাওয়া তিনটা কম্বলের দুইটা একসাথে নিয়ে ঘুমুতে যায় জনাব আলী, পাশে সোহাগ। সোহাগ ঘুমিয়ে পড়ে ক্ষণপরেই। জনাব আলীর ঘুম আসে না আজ। বড্ড কষ্ট। শ্বাসকষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এই শীতেও ঘেমে নেয়ে ওঠে সে। গায়ের কাপড় সরিয়ে শুয়ে পড়ে টানটান।

সকালে ঘুম ভেঙে দাদাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে সোহাগ আলী। দৌড়ে আসে আকলিমা, দৌড়ে আসে গহর আলী। জনাব আলী তখন বিস্ফারিত চোখে সম্ভবত বেহেশতের জলুস দেখছে। সেখানে শীত নাই। আরামদায়ক উষ্ণতা। গহর আলী বহুকাল বাদে বুড়োকে ছুঁয়ে দেখে, হাত সরিয়ে নেয় সাথে সাথেই। ভয়ানক শীতল, যেনো মানুষ নয়, বরফ কোনো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত