জানিস, কালকে কার সঙ্গে বিউটিকে সিনেমায় যেতে দেখলাম?’ তিশার দিকে তাকাল রেহানা।
‘কাকে?’
‘জাফরকে।’
‘ভাব হয়ে গেছে আবার?’
‘ওদের আড়ি হতেই কতক্ষণ, ভাব হতেই কতক্ষণ। এই নিয়ে তো গত দু’মাসে তিন-চারবার হলো। কলেজ খুলতে খুলতে দেখ আরও কতবার হয়।’
হ্যাপি সিটির ছোট্ট একটা শিশু পার্কে বেঞ্চে বসে কথা বলছে দুই বান্ধবী। গাজীপুর বাজার ছাড়িয়ে মেইন রোড ধরে কিছু দূর গেলে পাওয়া যাবে একটা নতুন রাস্তা, দক্ষিণে মোড় নিয়েছে। সেটা ধরে মাইল কয়েক এগোলে পাওয়া যাবে নতুন এক অত্যাধুনিক শহর। সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আছে এখানে। মার্কেট, সিনেমা হল, স্কুল, কলেজ- সব।
শহরটার নাম ‘হ্যাপি সিটি’, অর্থাৎ ‘সুখের শহর’। কিন্তু স্থানীয় লোকের ধারণা, সুখের শহরে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হবে না। তার কারণ পেছনের গজারি গাছের বিশাল, ভয়াবহ জঙ্গলটা। না, বাঘ-ভালুক আর নেই এখন সে-জঙ্গলে। তবে ভূতপ্রেত নাকি আছে প্রচুর। সুখের শহরের বাসিন্দাদের টিকতে দেবে না ওই ভূতেরা।
জঙ্গলটা ছিল এই এলাকার একসময়কার জমিদার করিম শেখের। জঙ্গলটার আসল নাম তাই করিম শেখের জঙ্গল হলেও লোকের মুখে মুখে এখন ‘ভূতের জঙ্গল’ নামটা চালু হয়ে গেছে। জমিদারদের অত্যাচার-নির্যাতনে যত লোক মারা যেত, তাদের প্রেতাত্মা নাকি আজও প্রতিশোধের নেশায় ঘুরে বেড়ায় ওই জঙ্গলে। ভূতের ভয়ে গজারি বনে দিনের বেলায়ও ঢুকতে চায় না লোকে। লোকের বিশ্বাস, ভূতেদের শান্তি ভঙ্গের অপরাধে দল বেঁধে একদিন এসে শহরের ওপর হামলা চালাবে ওরা, তছনছ করে দেবে সব।
‘বাদ দে ওদের কথা,’ বিউটি আর জাফরের কথা বলল তিশা। ‘আমাদের বাড়ি যাবি নাকি চল। আমীর আসবে পড়াতে। এবার পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে বাবার কাছে আর মুখ দেখাতে পারব না।’
আমীরের প্রতি দুর্বলতা আছে তিশার, রেহানা জানে। আর তিশার ধারণা, আমীরকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না রেহানা। ওর কথা উঠলেই তাই গম্ভীর হয়ে যায়।
‘নাহ্, আমার কাজ আছে,’ মানা করে দিল রেহানা।
‘আচ্ছা, আমীরকে তুই সহ্য করতে পারিস না কেন বল তো?’ কপালে এসে পড়া একগোছা কোঁকড়া কালো চুল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল তিশা।
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রেহানা। ‘সাউ-চিঙের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার কথা আজ। ইস, চাকরিটা যদি হয়ে যেত।’
‘চাকরিটা তাহলে নিবিই তুই? শেষমেশ চায়নিজ হোটেলে ওয়েটারের চাকরি করবি?’
‘না করে কী করব? আমার তো আর তোর মতো কোটিপতি বাপ নেই। তোরও ভাগ্য আর আমারও ভাগ্য! সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিস, বাপের একমাত্র সন্তান তুই, আমার মতো গরিবের দুঃখ বুঝবি না!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেহানা। তিশার দিকে তাকাল। ‘হোটেলে ওয়েটারের চাকরি নিলে অসুবিধেটা কী? আজকাল মেয়েরা সব ধরনের কাজই তো করছে। টাকার আমার ভীষণ দরকার। মা’র হাঁটুর অপারেশনটা এবার করাতেই হবে।’
‘তার মানে ক্লিনিকওলারা খরচ ছাড়া অপারেশন করবে না? ওদের কর্মচারী হলেও না?’
‘না।’
‘আশ্চর্য! এতটুকু মানবিকতা নেই!’
‘তা তো নেই-ই, উল্টো আরও হুমকি দেয় চাকরি থেকেই বরখাস্ত করে দেবে। হাঁটুর ব্যথায় মাঝে মাঝেই কাবু হয়ে যান মা। রোগীদের ঠিকমতো দেখাশোনা করতে পারে না তখন। প্রায়ই ধমকায় মালিক। বলে, শরীরে রোগ নিয়ে নার্সের কাজ করা যায় না।’
‘লোকটা মানুষ না পিশাচ!’
আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল দু’জনে। ঠিক এই সময় ঘটল ঘটনাটা। টায়ারের তীক্ষষ্ট আর্তনাদ তুলে মোড় ঘুরে তীব্র বেগে ছুটে এলো একটা গাড়ি। মোড়ের কাছেও গতি কমাল না। পার্কটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে একটা ক্যানভাসের ব্যাগ ছুড়ে দিল একজন লোক। ব্যাগটা পড়ল পার্কের রেলিঙের ভেতরে ঝোপের মধ্যে।
চলে গেল গাড়িটা।
মোড় ঘুরে আরেকটা গাড়িকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। পুলিশের গাড়ি। সামনের গাড়িটাকে তাড়া করে গেল। বোঝা গেল ওটার পিছু নিয়েছে।
কৌতূহল হলো দুই বান্ধবীর। কী ফেলে গেল সামনের গাড়িটা?
ঝোপের কাছে এসে দাঁড়াল দু’জনে। জায়গাটা এমনিতেই নির্জন। তা ছাড়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কেউ নেই পার্কে। শিশু পার্ক হলেও শিশুরা খেলার জন্য তেমন একটা ঢোকে না এখানে। ভূতের জঙ্গলের ভূতের ভয়েতেই কি-না কে জানে! সারাদিন গরু-ছাগল চরায় রাখালেরা।
ঝোপের ভেতর থেকে ব্যাগটা টেনে বের করল দুই বান্ধবী। বেশ ভারী। টান দিয়ে চেনটা খুলল রেহানা। ভেতরে তাকিয়ে থ।
ঠাসাঠাসি ভরা নোটের বান্ডিল। কড়কড়ে নতুন পাঁচশ’ টাকার নোট।
দুই.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকল দু’জনে। তারপর কথা বলল তিশা, ‘ব্যাগটা এখানে ফেলে গেল কেন বল তো?’
‘ব্যাগটা কেন ফেলে গেল, কী করে বলব?’ দ্রুত চারপাশে একবার চোখ বোলাল রেহানা। দূরে রাস্তায় একজন লোককে দেখা গেল। এদিকেই আসছে।
তাড়াতাড়ি ব্যাগটা আড়াল করে ফেলল রেহানা।
‘শিওর ডাকাতি করে এনেছে,’ তিশা বলল। ‘ব্যাংক ডাকাতি। দেখলি না পুলিশের তাড়া খেয়ে কেমন পালাল।’
চিন্তিত মনে হলো রেহানাকে। জবাব দিল না।
‘চল, ব্যাগটা পুলিশের কাছে নিয়ে যাই,’ তিশা বলল। ‘থানায় গেলেই জানা যাবে ডাকাতি করেছে কি-না।’
‘মাথা খারাপ নাকি তোর! এতগুলো টাকা হাতে পেয়েও দিয়ে দেব?’
‘তো কী করব?’ তিশা অবাক।
তিশার দিকে কাত হয়ে এলো রেহানা। ওর নীল চোখে উত্তেজনা জ্বলজ্বল করছে। ফিসফিস করে বলল, ‘রেখে দেব।’
বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে রইল তিশা। তারপর হাসল। ‘যাহ্। ঠাট্টা করছিস।’
‘তা কেন করব? কম করে হলেও পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে। ভেবে দেখ, দু’জনে আধাআধি করে নিলে পঁচিশ লাখ করে পাব। মা’র অপারেশনটা কী সহজেই না করে ফেলতে পারব। তারপর আমাদের বাড়িটা সারাব … চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে …’
‘কিন্তু এত টাকা কোথায় পেয়েছিস খালাম্মাকে বোঝাবি কী করে? নিতে রাজি হবেন?’
‘যে কষ্ট পাচ্ছে, রাজি না হয়ে যাবে কোথায়।’
‘কিন্তু রেহানা, অন্যের টাকা …’
‘কার টাকা সেটা দেখতে যাওয়ার দরকারটা কী আমাদের? চুরিদারি তো আর করিনি। আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি, ব্যস। টাকা-পয়সা যার হাত পড়বে সে-ই মালিক।’
‘কিন্তু …’
‘তোর বাপের টাকা আছে, তুই এর মর্ম বুঝতে পারছিস না তিশা। আমার অবস্থায় পড়লে বুঝতি। বেতনের অভাবে কলেজ থেকে বের করে দেবে আর ক’দিন পর। এই টাকাটা নিলে পড়াটা বন্ধ হবে না। পরনের কাপড়ের কী অবস্থা হয়েছে দেখছিসই তো। পরা যায় আর?’
‘তাই বলে অন্যের টাকা দিয়ে …’
‘ঠিক আছে, তুই নিতে না চাস, নিবি না। কিন্তু আমি নেব। তোর কাছে শুধু একটাই অনুরোধ, কথাটা তুই কাউকে বলবি না। কথা দে।’
চুপ করে রইল তিশা।
‘পিল্গজ, তিশা!’
‘বেশ, বলব না। খালাম্মার অপারেশনটার কথা ভেবেই কেবল রাজি হলাম।’
‘বাঁচালি ভাই,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রেহানা। ‘এই না হলে বন্ধু। চল চল, টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলি।’
‘লুকাবি কেন? বাড়ি নিবি না?’
‘এক্ষুনি নেয়া উচিত হবে না। দিন পনেরো অপেক্ষা করব। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে এলে তারপর বের করব। গরম গরম কিছু করতে গেলেই ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে।’
‘কোথায় লুকাবি?’
‘গজারি বনের ভেতর। ভূতের ভয়ে সহজে কেউ যায় না। সবচেয়ে নিরাপদ। মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখব।’
গজারি বনের মধ্যে বড় একটা পুরনো বটগাছ আছে। মাটি খুঁড়ে সেটার গোড়ায় টাকার ব্যাগটা পুঁতে রাখল ওরা। কাজগুলোর বেশিরভাগ রেহানাই করল। বাড়ি থেকে পুরনো বেলচা আনা, মাটি খোঁড়া, গর্তে টাকার ব্যাগ রেখে আবার মাটিচাপা দেয়া। তিশা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।
কাজ শেষ হলে নিজের গাড়িতে করে রেহানাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এল। দেখে আমীর বসে আছে। তিশার মুখ দেখেই সন্দেহ করে ফেলল সে। কী হয়েছে জানার জন্যে চাপাচাপি শুরু করল। আমীরকে পছন্দ করলেও ওর কিছু কিছু ব্যাপার ঠিক মেনে নিতে পারে না তিশা। যেমন এই নাক গলানো আর কোনো কিছু জানার জন্য চাপাচাপি করার স্বভাব।
নাছোড়বান্দা আমীরের কাছ থেকে নিস্তার পেল না তিশা। চাপাচাপি করে তার মুখ থেকে ঠিকই আদায় করে নিল কথাটা।
বলে দেয়ার পর আমীরের হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করল তিশা, ‘পিল্গজ, আমীর, শুধু তুমি বলেই বললাম। আর কাউকে বোলো না। কি, বলবে না তো?’
‘না, বলব না,’ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল আমীর। ‘তবে রেহানাকে আমি খুন করব!’
চমকে উঠল তিশা। ‘কি বলছ তুমি?’
‘না হলে টাকাগুলো নিতে পারব না ওর কাছ থেকে। চাইলেই কি আর দিয়ে দেবে?’
‘তুমি ওই টাকা কেড়ে নেবে!’
‘ভয় নেই। কেড়ে নেব না। খুন করার পর নেব। লাশ হয়ে গেলে কেউ উঠে এসে আর বাধা দিতে পারে না।’
‘আমীর!’
‘দোষটা কোথায়? টাকাটা রেহানারও না। ও নিতে পারলে আমি কেন পারব না।’
‘ওর টাকার ঠেকা। তোমার কি ঠেকা?’
‘টাকার ঠেকা সবারই থাকে। ধনী-গরিব সবার।’
‘তার মানে টাকার জন্য তুমি লোভী হয়ে উঠছ?’
‘উঠছি। সবাই ওঠে।’
‘না, সবাই ওঠে না!’ চিৎকার করে উঠল তিশা। ‘আমীর, তুমি কিন্তু আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছ।’
‘তার মানে আমি সফল।’
‘মানে?’
হেসে ফেলল আমীর, ‘তোমাকে রাগানোর জন্যই বলছিলাম। আমি কি পাগল? টাকার জন্য রেহানাকে খুন করব- ভাবলে কী করে? রসিকতা করছিলাম।’
‘তাই বল!’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তিশা। ‘উহ্, আমার তো পিলে চমকে দিয়েছিলে।’
তখনকার মতো তিশা স্বস্তি পেলেও পরদিন কলেজে এমন একটা ঘটনা ঘটল, আমীরের প্রতি সন্দেহ মাথাচাড়া দিল তিশার মনে।
তিন.
সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ওরা।
রেলিং ধরে এক সারিতে।
সবার আগে রেহানা, মাঝখানে আমীর, পেছনে তিশা আর আরও কিছু ছেলেমেয়ে। নামার সময় গায়ে গায়ে লেগে যায় এমন অবস্থা। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল রেহানা। বেহুঁশ হয়ে গেল। চোখেমুখে পানির ছিটে দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলো অনেকের কাছেই।
বাড়ি ফেরার আগে এক ফাঁকে তিশাকে জানাল রেহানা, সে নিজে নিজে পড়েনি। আমীর তাকে ধাক্কা মেরেছিল।
রেহানার ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই গম্ভীর হয়ে ছিল তিশা। এ কথা শোনার পর আর গম্ভীর হয়ে গেল। সে যে আমীরকে টাকার কথা বলে দিয়েছে, আর আমীর তাকে খুন করবে বলেছে, এটা এখনও জানায়নি রেহানাকে।
রীতিমতো যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল তিশার মনে। ইস্, কেন যে আমীরকে বলতে গেল!
রেহানা বাড়ি চলে গেলে আমীরকে ধরল তিশা। সরাসরিই জিজ্ঞেস করল, ‘আমীর, রেহানা যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়, ঠিক ওর পেছনে ছিলে তুমি। তুমি ছাড়া কেউ ছিল না। কী করে পড়ল বলো তো?’
হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেল আমীর। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে তাকাল তিশার দিকে। ‘কী বলতে চাও তুমি?’
আমীরের ভঙ্গি দেখে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিশা। আবার পড়ল মানসিক দোটানায়। আমীরকে এভাবে সরাসরি আক্রমণ না করলেও পারত। আমতা আমতা করে বলল, ‘না, তা না…’
‘তা না মানে! তুমি কি বলতে চাও আমি বুঝি না মনে করেছ? তুমি ভাবছ আমিই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। ওই যে কাল রসিকতা করে বললাম, ওকে আমি খুন করব, সেটাই মাথায় গেড়ে বসে গেছে তোমার।’
ধাক্কা দিয়ে ফেলার কথাটা রেহানাই যে বলেছে তিশাকে, সেটা আর আমীরকে বলতে পারল না তিশা। বরং আমীরের রাগ কমানোর চেষ্টা করতে লাগল। বহু কষ্টে আমীরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঠাণ্ডা করলেও নিজের মনের খুঁতখুঁতানিটা গেল না তার।
রাতে ফোন করল রেহানা। ওদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট দোকান আছে। টেলিফোন আছে ওখানে। টাকা দিয়ে ফোন করা যায়।
‘হ্যালো? তিশা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তিশা, একটা কথা বলব তোকে, রাগ করিস না। কলেজ থেকে ফেরার পর থেকে ভেবেই চলেছি ব্যাপারটা নিয়ে। শুধু শুধু কেন আমাকে ধাক্কা মারল আমীর? কিছুই বুঝতে পারছি না। অবাক লাগছে।’
চুপ করে রইল তিশা।
‘কী হলো, তিশা, কথা বলছিস না কেন? আচ্ছা, আমীরকে তুই বলে দিসনি তো?’
ধড়াস করে উঠল তিশার বুকের মধ্যে। ‘কী বলব? কিসের কথা?’
দোকান থেকে ফোন করেছে বলেই বোধহয় লোকের সামনে টাকার কথাটা আর তুলল না রেহানা। ‘জানিস না কিসের কথা?’
‘অ্যাঁ!…হ্যাঁ, জানি তো!’
‘জিজ্ঞেস করলাম এমনি। কিছু মনে করিস না। আসলে জানিই তো, কাউকে তুই বলবি না। আমীরকেও না। হাজার হোক আমাকে কথা দিয়েছিস তুই।’
‘রেহানা …!’
‘শুনছি। বল।’
‘রেহানা, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। তোর বিশ্বাস আমি ভঙ্গ করেছি। সত্যিই আমি আমীরকে বলে দিয়েছি।’
চুপ হয়ে গেল রেহানা।
‘কি হলো? রেহানা?’
জবাব নেই।
‘অ্যাই রেহানা!’
‘বলেই দিলি শেষে? তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম …’
‘কী করব, ভাই। এমন চাপাচাপি শুরু করে দিল। তুই তো আমীরকে চিনিস। আমার মুখ থেকে কথাটা বের করে তবে ছাড়ল।’
‘তার মানে তুই মুখটাকে এমন করেই রেখেছিলি যে সন্দেহ হয়েছিল আমীরের!’ রেহানার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। ‘কিন্তু তাই বলে তোকে আমি দোষ দেব না। জোর করাটা ওর উচিত হয়নি মোটেও। নিশ্চয় এমন চাপাচাপি শুরু করেছিল তোকে …। এই জন্যেই ওকে আমি দেখতে পারি না। এখন বুঝলি তো। আর কোনো সন্দেহ নেই আমার। ও আমাকে খুন করার জন্যেই ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সিঁড়ি থেকে। যাতে টাকাগুলো মেরে দিতে পারে। আমি মরে গেলে সবাই ভাবত সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেছি। দুর্ঘটনা। কেউ কিছু বুঝতে পারত না। চুপচাপ গিয়ে টাকাগুলো তুলে নিত আমীর। তোকেও জানাত না। আর ঘুণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করতে পারতি না তুই।’
আবার এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রেহানা বলল, ‘যাকগে, যা হবার তো হয়েই গেছে। এখন কী করা যায় বল।’
‘পুলিশকে বলে দিই চল। আমার এসব ভালল্গাগছে না। দেখ, অন্যায় কখনও চাপা থাকে না। পাপ মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’
‘টাকা ছাড়া আমার মায়ের অপারেশন হবে না, তিশা।’
‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু …’
‘আমি এখন মা’র অপারেশনের কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না।’
‘হুঁ!’ ঠোঁট কামড়াল তিশা। রেহানার অবস্থাটা বুঝতে পারছে। ওর জায়গায় সে নিজে হলেও হয়তো এ রকম কিছুই করত।
রেহানার কথা শোনা গেল, ‘তিশা, পিল্গজ, পুলিশকে জানাসনে। মা’র কিছু হলে আমি বাঁচব না।’
‘কিন্তু …আমি না হয় না-ই বললাম। আমীর যে জেনে গেল?’
‘তার মুখ বন্ধ করারও একটা উপায় ভেবে রেখেছি।’
‘কী?’
‘খুন করে ফেলব।’
‘রেহানা!’
‘ভয় পেলি? আরে না, এমনি কথার কথা বললাম।’
তিশা চুপ।
‘এই তিশা?’
‘বল।’
‘আমীরকেও একটা ভাগ দিয়ে দিলে কেমন হয়?’
‘তা মন্দ বলিসনি।’
‘তাহলে একটা কাজ কর না, ভাই। আমিরকে কোনোভাবে একটা খবর দে।’
‘কোনোভাবে আর কিভাবে দেব। আমাকেই যেতে হবে ওর বাসায়।’
‘তাহলে তাই যা। ওকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আয়। সামনাসামনি ওর সঙ্গে কথা বলি। মা ডিউটিতে। অসুবিধে হবে না। ব্যাপারটার একটা মীমাংসা দরকার। নইলে ঘুমাতে পারব না আজ রাতে।’
‘দেখ,’ সাবধান করল তিশা, ‘মানুষ খুন করার আরেকটা রসিকতা যেন না হয় এটা।’
মাথা নাড়ল রেহানা। ‘হবে না। কথা দিলাম, যা। কী করব, শোন এখন। আমীরকেও একটা ভাগ দেব।’
‘কিছু টাকা?’
‘কিছু না, সমান সমান। তিন ভাগের এক ভাগ,’ রেহানা বলল। ‘ওকে আমাদের পার্টনার বানাতে হবে, বুঝলি? তাহলে সে-ও আমাদের দলে এসে যাবে, আর কোনো ঝামেলা করবে না।’
তিশাকে জবাব দিতে না দেখে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল রেহানা। ‘কী, বুদ্ধিটা কেমন?’
‘দারুণ! সাংঘাতিক!’
রেহানার মা’র অপারেশনটা হয়ে যাবে এখন, রেহানা ভাবছে।
তিনজনেই কিছু কিছু ভাগে পাবে।
এবং কাউকেই খুন হতে হবে না আর।