মাথার উপর গনগনে বৈশাখী সূর্য। পৃথিবীর শরীরজুড়ে পাথুরে রোদ। ভ্যাপসা গরম। গাছের ছায়াতেও যেন সীসা মেশা। এতটুকু সহানুভূতির পরশ নাই, বাতাসেরাও শরীরে তাপের পোশাক পরে এদিক ওদিক স্বৈরাচারীর মতো মাড়িয়ে যাচ্ছে। শরীরে ফোসকা পড়ে যাবে এমন অবস্থা। এ রকম দিনে যখন বেলা দু’পহর তখন কে বেরুবে ঘর ছেড়ে, বৈদ্যুতিক পাখার আদর খাওয়া ছেড়ে!
ফাঁকা রাস্তা। পিচমাখা পথে মরীচিকার খেলা ভেজা মনে করায় পথিকের চোখকে। অসম্ভব ধরনের ফাঁকা এই দুপুর। প্রকৃতি যেন কারফিউ জারি করেছে। কেউ কোনোখানে নেই। চাঁদি ফাটানো রোদ নিঃশব্দে গলিয়ে দিচ্ছে রাস্তার কালো পিচ। এদিক ওদিক চোখ ঘোরালে দেখা যায়, গবাদি পশুরা জাবর কেটে, ফেনা তুলে, শুয়ে-বসে আছে রাস্তার ধারে, অগোছাল ঝোপের ভেতর। কুকুর ঘুমায় দু’পায়ের ফাঁকে ক্লান্ত মাথা রেখে।
গ্রামীণ শহর। আশ্চর্য হতে হয় এই তাপের ফোয়ারা মার্কা দুপুরের পথচারীকে দেখে। মোড়ের ডান দিকের রাস্তা ধরে প্রকৃতির কারফিউ ভঙ্গকারী এক পঁয়ত্রিশি যুবক হাঁটছে। গায়ে সাদা টি-শার্ট, পায়ে চামড়ার চটি, পরনে রঙচটা আকাশি জিন্স। পুরো রাস্তা দখল করে, পুরো রোডে বিলি কাটছে আর হাঁটছে। হাঁটছে যেন প্রতি ধাপ গুনে গুনে। তাকে অনেকটা উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে।
বাতেন খাঁর মোড় ছেড়ে আরো একটু এগিয়ে প্রফেসর পাড়ার গলি। গলিটা ধরে কিছুদূর এগিয়ে বাম দিকের পথ ধরে এগোলো সে। সুজাতাদের বাড়ির সামনে এসে হঠাৎ থেমে গেল। কিছুক্ষণ থেমেই থাকল। কী যেন ভাবল তারপর কলিংবেলের সুইচে চাপ দিল। ভেতর হতে কলিংবেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ ভেসে এলো বাইরে। এই যে, সুজাতাদের বাড়ির গেটে এসে সে দাঁড়িয়েছে, কলিংবেল চেপেছে, মাত্র মিনিট আগেও এই পরিকল্পনা ছিল না। মাথায় হয়তো একটু ছিট আছে, কখন যে কী করে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু একটা যখন করতে যায় তখন তার কোনো বোধই থাকে না। ঝটিকা কাজটি করে দেওয়ার পর চিন্তা করে দেখে – ‘ঠিক হলো কি?’
তাকে দেখেই বোঝা যায়, সে কী চায় তা সে নিজেই জানে না। অবশ্য কোনো এক সময় ছিল, যখন সে এ রকম না। তখন তারও এক জীবন চাওয়া ছিল, সোনালি কিছু আশা ছিল পৃথিবীর সবুজ বুকজুড়ে। ঝিলের জলে কলমিলতার ফাঁকে ফাঁকে হাঁসের চোখে হাঁসিকে খুঁজে বেড়ানোর আকুলতা দেখে ভালো লাগত। শান্ত জলে হাঁসেদের নরম মধুর তোলপাড় দোলা দিত হূৎপিণ্ডে। সেও খুঁজত। এখন আর খোঁজে না। তবে খোঁজার অভ্যেসটা থেকে গেছে। সেই চিত্রচিত্ত সন্ধানের এ নেশা, চিত্রের সজীব রূপ খুঁজে পাওয়ার এ নেশা চাপার দুই বছরের মধ্যে লেখাপড়া মাথা থেকে শেলফে উঠেছে। বাবার ব্যবসার দিকেও ফিরে চায়নি। শুধু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে আর রাজহাঁসের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকায়।
‘তমাল তুমি!?’- সুজাতা দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল আর প্রশ্ন করল একই বাক্যে। তমাল তার চিরাচরিত জ্ঞানী মার্কা হাসি দিয়ে বলল- ‘আশ্চর্য হলে যে, আসা যাবে না?’ ‘তা কেন নয়, তা কেন নয়’- সুজাতার অপ্রস্তুত উত্তর। গত দু’বছর হতে তমালের সাথে তার চলতি সম্পর্ক। এর মধ্যে কতবার কতভাবে ডেকেছে সুজাতা- ‘তমাল, একবার আমাদের বাড়ি এসো।’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাবো’- এতদূর পর্যন্তই পেয়েছে সুজাতা। কোনোদিন আসেনি তমাল। তমালকে দিনে ভাবে, রাতে অনুভব করে, ভালোবাসে। ভালোবাসার কথা কতবার আকারে-প্রকারে, সঙ্গীতে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এসব ইঙ্গিতের আশপাশ দিয়েও হাঁটেনি। সে যে কী ভাবে এত, কী আবিস্কারের নেশায় মত্ত থাকে, তার একবিন্দুও বুঝতে পারে না সুজাতা। তমালকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রহস্য বলে মনে হয় তার। বহু দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টি হয় প্রতিদিন সুজাতার ভেতরে। সুজাতা ওকে নিয়ে একা একা ভাবে, ভালোবাসে, ব্যথা পায় আর দিনের চাকাতে চড়ে দিন গড়িয়ে দেয় পিছনে, আগামী দিনের আশায়। সেই তমাল আজকে নিজেই এসেছে। তার আসাতে সে আশ্চর্য হয়েছে কারণ, এ আগমনের ভেতর কী যে রহস্য আছে, কে জানে! আনন্দিতও সে হয়েছে। তার মনের বাসনা পূর্ণ হবে কি?
সুজাতা তমালকে ভালোবাসে। তার চোখও থাকে সুঠাম দেহটার ওপর। প্রেমের সাথে সাথে সে দেহের আবেদন অস্বীকার করতে পারে না। আজ বাড়িতে কেউ নেই। সবাই গেছে বিয়ে খেতে। সুজাতা কল্পনা করতে থাকে নানা যৌনচিত্র। চোখ চকচক করে। যৌনগন্ধি ভাব বের হয়ে আসে চোখের আকাশ ফুটে, চোখের তারা ফুটে।
তমালকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসায় সুজাতা- ‘তুমি কিছুক্ষণ বস, আমি আসছি’। শরীরে এক নদী ঢেউ তুলে ময়ূরের মতো নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর কেবল এক কাপ চা আর কিছু শুকনা খাবার দিয়েই আবার চলে গেল। বিছানাবিলাসের কল্পিত শত জাল বুনতে বুনতে ড্রেসিংরুমে গিয়ে রঙে-চঙে-ঢঙে, পুষ্পে-পত্রে গাত্র সাজাতে লাগল।
বাইরে শুকনো খটখটে হাড় গলানো দুরন্ত দুপুর খাঁ-খাঁ করছে। নিষ্ঠুর দুপুরটা প্রাণপণে পুড়িয়ে দিচ্ছে কোমল পৃথিবীর কোমলত্ব কিন্তু সুজাতাদের বাড়ির ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা এবং বেশ ভালো লাগছে। তমাল রাস্তায় রাস্তায় অনেক ঘুরেছে কিন্তু আজকের মতো এত ক্লান্ত কোনোদিন হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে হুট করে বহুবার বহু বাড়িতে উঠেছে কিন্তু যে শান্তিটা আজ এখানে পাচ্ছে তা কোনোদিন কোথাও পায়নি। অবাক হয়ে গেল তমাল- ‘কী ব্যাপার! কী এমন শান্তির বীজ পোঁতা আছে এ বাড়িতে!’ অনেক সময় কেটে গেছে, চা খেয়েছে, বিস্কুট খেয়েছে। এর মধ্যে কখন যে ড্রইংরুম ছেড়ে এ ঘর ও ঘর পায়চারি শুরু করেছে তা নিজেও বুঝতে পারেনি। বেশ ধনী সুজাতারা, বাড়িটিও বেশ বড়। একটা ঘরের কাছে এসে দরজায় দাঁড়াল, ভেতরটা বেশ অন্ধকার, সিগারেটে শেষ দম দিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল।
হাতড়ে হাতড়ে সুইচ চেপে ঘরে আলো জ্বালে। ঘরটা টিউবলাইটের সাদা নরম সুগন্ধি আলোয় ভরে গেল। ফ্লোরে ঘাস রঙের গালিচা পাতা। এটা পারিবারিক পাঠাগার। প্রচুর বই শেলফজুড়ে। আলোর বন্যায় ঘর ভাসছে, তমালও ভাসছে। ওর চোখ গিয়ে থামল দক্ষিণ জানালার প্রায় ফুট দুই ওপরে। ঘর ভাসছে, তমাল ভাসছে, পৃথিবী ভাসছে। অবিশ্বাস-ভরা চোখ কচলালো। সে স্পষ্ট শুনতে পেল তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের সাইড পকেটটা খিলখিল করে হাসছে। তার ব্যাগের সাইড পকেটে যেটা আছে সেটা আর যেটা স্থির হয়ে ঝুলছে সুজাতাদের পারিবারিক পাঠাগারের দক্ষিণ দালানে, জানালার দুই ফিট উপরে সেটা- দুটোই একই।
প্রায় দশ বছর আগে থেকে গতকাল পর্যন্ত এমনকি সুজাতাদের বাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কত পতন হয়েছে তার! তাকে লোকে পাগল বলে। অবশ্য এতে তার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু এতদিন যার খোঁজে ফিরছে তাকে না পাওয়ার অদৃশ্য সর্পিল বেদনা ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রতিদিন। কতদিন বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোর গ্যাঞ্জাম, রিকশার হুডের তলায় চাতক পাখির মতো খুঁজে বেড়িয়েছে তার উদ্দেশ্যাকে! কত গ্রাম, কত শহর চষে ফেলেছে! সিগারেট টেনে টেনে ফুসফুসটা পচেই গেছে হয়তো। কত মানুষের গঞ্জনা-াঞ্ছনা সহ্য করেছে। গত বছর রিকশার হুডের নিচে একটা মেয়েকে দেখতে গিয়ে তার স্বামী বা ভাই বা বাবার হাতে মার খেয়েছে। এই তো, মাত্র ক’দিন আগে ট্রেনে কাটা পড়ে মরছিল প্রায়। অবশ্য সে এও বিশ্বাস করে- যতদিন খুঁজে না পাবে তার সোনার হরিণী ততদিন মরবে না। কিন্তু আজ হঠাৎ এমনভাবে সুজাতাদের পারিবারিক পাঠাগার তার সোনার হরিণীকে পাওয়ার আশ্বাস দেবে, তা কোনোকালে কল্পনাও করেনি তমাল। দু’চোখ দিয়ে তার শ্রাবণ ঝরছে। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে গিয়ে কাঁদছে অঝোরে। কিসের এত কান্না? কষ্টের, নাকি দারুণ আনন্দের ফল্কগ্দুধারা ঝরছে তার চোখে!
সুজাতা ড্রইংরুমে গিয়ে তমালকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হলো। সদর গেটের কাছে গিয়ে দেখল সদর গেট এদিক থেকেই বন্ধ। তাহলে ভেতরেই আছে। খুঁজতে লাগল এ ঘর ও ঘর এবং এক সময় পাঠরুমে এসে পৌঁছল। কামজ কামিজ পরা সুজাতা। প্রায় নগ্ন বেশভূষার সুজাতা। উদ্দেশ্য, যৌন উদ্দেশ্য। চোখে ঝলকিত যৌনাগ্নি। ঠোঁটে লাল লাল এক মরুতৃষ্ণা। স্টম্ফীতবক্ষ অবাধ্য গবাদির মতো দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে, বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে। সুজাতা যৌনভরা, যৌনজড়া, খর তৃষ্ণায় বলে উঠল- ‘হাই তমাল!’ পিছন ফিরে চাইল তমাল। এক নিমিষেই দেহের সব আগুন নিভে গেল সুজাতার। চোখের তারায় ফুটে উঠল মৌন ঠাণ্ডা, বিস্ময়ে ভরা হিমালয়ের মতো এক প্রশ্ন- ‘কিসের এত কান্না তোমার দু’চোখে?!’ সুজাতার বিহ্বলতা কাটার আগেই- ‘এ মেয়েটা কোথায় সুজাতা?’ দক্ষিণ জানালার দু’ফিট উপরে তমালের তর্জনীর ইশারা গিয়ে স্থির হলো।
একটা আলোকচিত্র। নারীর আলোকচিত্র। ছবিতে মেয়েটা অপরূপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। সুজাতা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ছবিটা এর আগে এত ভালো করে দেখেনি সে। সুজাতা সাধারণ আর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল- ‘মারা গেছেন’। ‘অ্যাক্সিডেন্টে?’ ভাঙা গলায় তমালের প্রশ্ন। সুজাতা বলল- ‘না না তা হবে কেন? বুড়িয়ে মরেছেন। তিনি আমার দাদি ছিলেন। শুনেছি, এ ছবিটা তার বিয়ের কিছুদিন আগে তোলা। বাবা তার মায়ের একমাত্র স্মৃতি হিসেবে এ ছবিটা রেখে দিয়েছেন। তার মায়ের মানে আমার দাদির আর কোনো ছবি নেই। বিয়ের পরে দাদা কোনোদিন দাদিকে ছবি তুলতে দেননি ধর্মে ছবি তোলা নিষেধ বলে। এ ছবি বাবা তার মায়ের বাবার বাড়ি থেকে কোনো একদিন আনিয়ে নিয়েছিলেন।’ শুধু ভগ্নকণ্ঠে তমাল উচ্চারণ করল- ‘ও’! এবং বের হয়ে গেল সুজাতাদের বাড়ি থেকে। রহস্যজনক লোকটাকে সুজাতা কোনোদিনও চিনতে পারল না। এর মধ্যে আবার কী রহস্য কে জানে! সুজাতা তমালের চলে যাওয়ার যতটুকু দেখতে পেল তার সবটুকু শেষ করে আরও কিছুক্ষণ চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর অবশ হাতে ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে দিল।
হাঁটছে তমাল। নীল আকাশটাকে চাবুক মেরে কে যেন রক্তাক্ত করে দিয়েছে। গাছেরা চুপচাপ। ঘোর লাগা মাতাল সন্ধ্যা, সন্ধ্যার বাতাস। প্রকৃতির শোক সময়, পৃথিবী শোক পোশাক পরতে শুরু করেছে। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে তমাল একটা অ্যালবাম পড়ে পেয়েছিল, যাতে একটি মাত্র লেমিনেটিং করা নারী-ছবি ছিল। এক অপরূপা নারী। স্বর্গস্থ নারীদের যে বর্ণনা, তার চেয়েও সুন্দরী এ ছবি-নারী। ছবি দেখে তমাল ভালোবেসে ফেলে ছবি-নারীকে। সেদিন থেকেই পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়ে এই ছবি-নারীর পিছনে ঘুরেছে; খুঁজেছে সব ক্লান্তি পায়ে দলে। কিন্তু আর খুঁজতে হবে না। সব খোঁজাখুঁজির অবসান হলো সুজাতাদের বাড়িতে। সুজাতাদের পাঠরুমে দক্ষিণ জানালার ফিট দুই ওপরে ঝুলন্ত ছবিতে সব শ্রান্তি, সব ক্লান্তি সে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে উদাহরণহীন বিষাদ ছাড়া আর কিছু রইল না।
কালো সময় ফুঁড়ে চোখের সামনে একটা আলোকচিত্র বেরিয়ে এলো। তমালের জন্মের গতিকে, জীবনের গতিকে, হাঁটার গতিকে পিছনে ফেলে, আলোক খোলস ছিঁড়ে সময়গুলো রাতের গভীর অন্ধকার গহ্বরে তলাতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে তমাল মনে মনে একটা কবর খুঁড়ল। মনে মনে কবরের নাম দিল- ‘প্রেমিকার জন্মের একশ বছর পর প্রেমিকের জন্ম হয়েছিল’। সে মনে মনে কবরের ভেতর ঢুকে গেল। ‘এমন দুর্ভাগা প্রেমিক জগতে আর একটাও নাই’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।