শরিফ উদ্দিন পীরজাদার মনটা আজ ফুরফুরে, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ হবে, ভেবেছিলেন বাত কি বাত! আজ খুব খুশি লাগছে। সংসারে মাত্র চারজন, সরকারি বাসা, বাবা মারা গেছে অনেক আগে, মা বছর খানেক। ছোট দুই ভাই মধ্যপ্রাচ্যে। বাড়ি থেকেও বছরান্তে ভালোই আসে। মেয়ে এবার অনার্সে প্রথম বর্ষে, ছেলে কলেজে ফাস্ট ইয়ারে। বেশ চলছে।
পীরজাদা অফিসেই আজ লাঞ্চ সেরেছে। মাঝে-মধ্যে এমনই হয়ে থাকে । নন্দনকানন থেকে একটা মিষ্টি পান আনিয়েছে ড্রাইভারকে দিয়ে। পানের দাম পাঁচ টাকা, গাড়িভাড়া ষাট টাকা। পানটা বেশ সুস্বাদু। অফিসে আজ তেমন কাজ নেই। সবাই খেলা দেখতে গেছে। সরকারি অফিসের মজাই আলাদা। ক্রিকেট পীরজাদার কাছে বোরিং। ফুটবল পছন্দের, তবে সেই ফুটবলের জৌলুস এখন নেই। খাওয়ার পর একটা তন্দ্রাভাব কোলাহলহীন পরিবেশে বেশিই মনে হচ্ছে আজ। চোখ বন্ধ করে আছে ও। এসি’র বাতাসে দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের শেষ কটা মাসের পাতা দুলছে। শুনশান নীরবতায় ঘষঘষে শব্দটা এক লয়ে বেজে চলছে।
দরজা খোলার শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায়। পিয়ন চা নিয়ে এসেছে। ঘুমটা ভালোই হয়েছে– ঘড়ির কাঁটা বলছে সোয়া ঘন্টার ঘুম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শেষ চুমুক। বেরিয়ে আসে শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, পেছনে পিয়ন আসছে ব্যাগ নিয়ে। গাড়িতে বসতেই ড্রাইভারের রোজকার প্রশ্ন– স্যার, কোন্ দিকে যাবেন। ইদানিং বাসার পথেই একটা বিশাল শপিং মলে একবার ঢুঁ মারে শরীফ। ওর শৈশবের বন্ধু জহিরের ইলেক্ট্রনিক্স আইটেমের বিশাল শোরুম শপিং মলে। জহির ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সভাপতি। স্কুল-কজের আর শৈশবের সব বন্ধুরা সেখানে প্রায় আড্ডা দেয়। নানা জনের নানা পেশা ও নেশা হলেও, সবার হৃদ্যতায় কোনো খাদ নেই। অফিসারস ক্লাবের আড্ডার চেয়ে এখানেই বেশি সুখ। সরকারি বড়কর্তার ঠাটবাট না দেখানোতে শরীফ এই শপিং মলের অন্য ব্যবসায়ীদের কাছেও বেশ পছন্দের এবং সম্মানীয়।
– ব্যাংকে চল , ম্যানেজার সাহেব অপেক্ষায়।
ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ হয়ে গেলেও শরীফের জন্য ম্যানেজার অপেক্ষায় থাকেন– ড্রাইভার তা জানে। অনেক সময় ড্রাইভার ছুটির পরও টাকা নিয়ে এসেছে।
ব্যাংকের সামনে গাড়ি থামলে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে খালি ব্যাগ নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে মিনিট পাঁচেক পরেই ফিরে আসে শরীফ। ব্যাগভর্তি টাকাটা পাশে রেখেছে। মনে মনে ভাবছে, টাকার অংকটা কত। ও কি আবার গুণে দেখবে? টাকাগুলো পেয়ে মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে। শরীফ শিস দিয়ে গান গায়। ড্রাইভার শিস শুনে অবাক হয় না। এমন মেজাজে স্যারকে সে এই প্রথম দেখছে না। সামনের আয়নায় একপলক স্যারের মুখের অভিব্যক্তি দেখে ও বিস্মিত। শরীফ বুঝতে পেরে থেমে যায়। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেও পারে না। কোলের উপর রাখা টাকার ব্যাগের উপরে ও তাল ঠোকে। ড্রাইভার সুযোগ পেলেই আয়নায় চোখ রাখে। শরীফ ঠিকই টের পায়, দুটো অনুসন্ধিৎসু নয়ন শরীফের অস্বাভাবিকতাকে বেশ উপভোগ করছে।
বাসার সামনে গাড়ি থামতেই শরীফ টাকাভর্তি ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ে। দোতলার বারান্দায় মিনু দাঁড়িয়েছিল। শরীফকে দেখে দরজা খুলে দেয়। শরীফ দ্রুত ওর বেডরুমে ঢুকে পড়ে। মিনু অবাক হয় শরিফের এই দ্রুততা দেখে। মেয়েটা হোস্টেলে, ছেলে ফিরবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা সেরে রাত আটটায় – দেরিও হতে পারে।
শরীফ টাই খুলে খাটের উপর হেলান দিয়ে রিমোটে ৬৯ নম্বর চ্যানেলটা অন করে। এ চ্যানেলটা একটু অন্যরকম। বাচ্চারা না থাকলেই মিনু আর ও দেখে। তবে এ সময়ে উলট-পালটা নাম্বারটা অন করতে দেখে মিনু অবাক হয়। একটু পরেই শরীফ বেরুবে। শরীফকে বেশ খোশমেজাই মনে হচ্ছে। মিনু শরীফের পাশে বসতেই শরীফ মিনুকে জড়িয়ে ধরে। টিভিতে তখন নাচছে একদল অর্ধউলঙ্গ নর্তকী– ‘ইয়ে মেরা ইন্ডিয়া!’ মিনুও গুনগুন করে সুর মেলায়। মিনুর শরীরে মাখা পারফিউমটা আজ বেশ উত্তেজকই মনে হছে। শরীফ হাউজি খেলার অ্যানাউন্সারের কণ্ঠ নকল করে বলতে থাকে– ‘উল্টাপাল্টা সিক্স এন্ড নাইন।’ মিনু তার উত্তরে বলে, ‘সিক্স টি না ই ন। নাচ চলছে, মিউজিক কানে বাজছে। জড়িয়ে ধরা মিনু টিভির সেই নর্তকী হয়ে উঠেছে যেন। শরীফ হারিয়ে যায় এক অন্য আদিম সুখানুভূতিতে।’
ভীষণ ক্লান্ত শরীফ মিনুর ডাকে চোখ মেলে। ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। সিক্সটি নাইন লেখা বোতল থেকে সোনালি তরল ঢেলে গ্লাসটাকে আরো সোনালি করে তোলে মিনু। মিনুকে বেশ মিষ্টি আর উৎফুল্ল লাগছে। গ্লাসে আইস কিউব গলছে ধীরে ধীরে। কয়েক চুমুকে শরীফও যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
মিশুর অনার্স পরীক্ষার শেষদিনই মিনুর বড়মামা মিশুর বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে আসে। ছেলে আমেরিকায় থাকে, দেশে এসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবে। মিশুরও ইচ্ছে স্বপ্ন বিদেশে সেটেল্ড হওয়ার। শরীফেরও কাগজপত্র প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে। অবসরে যাবার আরো আট বছর। সরকারি চাকুরিজীবন শেষ হওয়ার আগেই শরীফ সপরিবারে দেশান্তরি হতেও পারে।
মামার লোভনীয় প্রস্তাবটা শুনে শরীফ আর মিনু অবাকই হল, দুজন মেয়ের জন্য এমনই পাত্র খুঁজছিলো। কথাবার্তা সব ফাইনাল। পাত্রের সাথে মিশুর আলাপচারিতায় মিশুও সম্মতি জানিয়েছে। দেশের সবচাইতে সেরা বিপণীকেন্দ্র থেকে সামান্য টুকিটাকি কেনা হয়েছে। মা-মেয়ে দুজনের পছন্দ হয়নি অনেককিছুই, তাই বাধ্য হয়ে যেতে হল কোলকাতা। সেখানেও না হওয়ায় অগত্যা মুম্বাই। এতকিছুর মধ্যে শরিফের সরকারি বাসাটা মিশুর কাছে অসহ্য মনে হয়। বাসাটা বড্ড বেমানান। বাবার চাকুরিটা কবে শেষ হবে দুই ভাই-বোন, সে চিন্তায় অস্থির। বিয়ে উপলক্ষে ধনী ব্যক্তিদের পাড়ায় তিন-চারতলা দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে শরীফ। একমাসের জন্য হলেও চলতো, কিন্তু বাড়িওয়ালা ছয়মাস ছাড়া ভাড়া দেবে না। আর কী করা। ছয়মাসের জন্যই ভাড়া নিতেই হল। শরীফের দশমাসের বেতনের সমতুল্য টাকাটা মাইনাস হচ্ছে, সঙ্গে ফার্নিচার আর অন্যান্য জিনিস মিলিয়ে বলা যায় পাঁচ বছরের বেতন হাওয়া হয়ে যাওয়া। ছেলে-মেয়ে দুটোই যেন নিজেদের বিল গেটস ভাবে। অথচ শরীফের ছাত্রজীবনটা কত কষ্টের ছিল।
বরের মামা হঠাৎ করে লন্ডন যাওয়াতে বিয়ের সময়টা পিছিয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে উনি আসবেন, এলেই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবে। তিনি ব্যবসায়ী, দেশ ও বিদেশ দু জায়গাতেই তাঁর ব্যবসা। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে উনি অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বলা যায়। তাঁকে সবাই সমীহ করেন। শরীফের সাথে তাঁর দেখা হয়নি। বর রাজীবকে উনি আমেরিকায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। তার জন্যেই বিলম্বিত হলো।
মিশু বিয়ের কার্ড পছন্দ করে মুম্বাই থেকে নিয়ে এসেছে। বরের মামার কথানুযায়ী ডিসেম্বরের সাতই বিয়ে। দুই ভাই-বোন প্রেস থেকে আনা বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে। চারজনে বসে লিস্ট দেখে কার্ডে নাম লিখছে। কেউ যাতে বাদ না পড়ে। শরীফের বিয়ের সময় ব্যস্ততার কারণে ওর এক ফুফুকে কার্ড দেয়া হয়নি। সে এক লঙ্কাকাণ্ড। সে কথা স্মরণ করে বেশ ধীরে-সুস্থে খুঁজে খুঁজে নামগুলো লিখছে সবাই মিলে। নতুন বাসায় দূর-দূরান্ত থেকে নিকটাত্মীয়রা অনেকে এসে গেছে। বেশ আনন্দেই কাটছে সবার। তিনতলা, চারতলা লোকে গমগম করছে। বিয়েবাড়ি বলে কথা!
সকালে অফিসে যেতে গাড়িতে উঠতেই মিশুর মামা ফোন করে। শরীফ ইচ্ছে করেই ‘ ঘটক ‘ নামে নম্বরটা সেভ করেছে, ‘মামা’ না লিখে। মিনু সেদিন স্ক্রিনে ঘটক লেখা দেখে হাসতে হাসতে শরীফের গায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। ‘বাহ্, কি ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি’ বলে শরীফের তারিফও করেছিল মিনু। সে কথা ভেবে শরীফেরও হাসি পেল। ফোনটা রিসিভ না করে গাড়িতে উঠে বসল। কটা রিং বেজে থেমে গেল, অফিসে গিয়ে মামার সাথে কথা হবে। কী কথা ! এই সাতসকালে?
অফিসে কয়েকটা জরুরি কাজ সেরে মামাকে ফোন করতেই ওপাশ থেকে মামা হু হু করে কেঁদে ওঠেন।
‘কী ব্যপার, মামা? কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?’
মামার কান্না থামছেই না। একসময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শরীফ আবার ল্যান্ডফোনের বোতাম টিপতে থাকে। ও পাশে মামার মোবাইলে রিং বেজেই চলে।
কিছুক্ষণ পর মিনুও ফোন করে। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কথা হয় না। পিয়নকে ডেকে গাড়ি বের করতে বলে শরীফ। ড্রাইভার নিশ্চয় ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে। দেরি হচ্ছে কেন। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার এলে উঠে পড়ে– ‘বাসায় চল!’
ড্রাইভার অবাক হয়। অসময়ে বাসায় যাওয়া আর শরীফের অভিব্যক্তি দেখে। শরীফ এক অজানা আশংকায় শিউরে ওঠে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না কী হয়েছে।
খোলা দরজা। মিনু গাড়ির শব্দ শুনে খুলে রেখেছে। মিনু বেডরুমের বিছানায় বসে কাঁদছে। এমন করে কাঁদতে কখনও দেখেনি মিনুকে শরীফ।
মিশুর বিয়ে ভেঙে গেছে। বরের মামা, যার অপেক্ষায় এত সময়ক্ষেপণ, তিনি শরীফকে চেনেন একজন দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেও আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের মত কোটি টাকা উৎকোচ নিয়েছে শরীফ। তিনি সজ্ঞানে পুত্রতুল্য পিতৃহীন রাজীবকে একজন দুর্নীতিবাজ শ্বশুরের হাতে তুলে দিতে পারেন না।
সিঁড়ি ভেঙে কে যেন উঠে আসছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মিনু। অসহ্য লাগছে সব। সহ্য হচ্ছে না মিনুর কান্না। জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে শরীফ– ‘থামো!’
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেই চিৎকারের শব্দে ভয় পেয়ে যায় মিশু। দুহাত ভর্তি বিয়ের শপিং ব্যাগ হাত থেকে খসে পড়ে। সোনালি রাংতায় মোড়া বাক্স থেকে একটা কাঁচের পারফিউমের শিশি ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায় সেখান থেকে অদ্ভুত একটা মিষ্টি সুবাস সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে, মুছে যেতে থাকা কোনো সুন্দর স্মৃতির মতো।