ঘ্রাণ’

রিকশা থেকে নেমেই প্রথমে দেখি, চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিল। রেস্তোরাঁয় ঢুকে ব্যাগটা রেখে হাত ধুতে গিয়েই আয়নায় লোকটাকে আবার দেখলাম। আমার টেবিলের পাশের টেবিলে লোকটা। দুটো সিংগারা একটা দুধ চায়ের অর্ডার দিয়ে অনেক দিনের পুরানো মাসুদ রানা’র মূল্য এক কোটি টাকা বই টা ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রাখতেই সিংগারা রেখে গেলো ছেলেটা, গরম তাই ধোঁয়া উড়ছে, কয়েকটা বৃত্তাকার পেঁয়াজের টুকরো, সদ্য কাটা কচি শশার টুকরো আর টুথ পেস্টের মত লাল রঙা টমেটো সচ। সচটা আসলে মিষ্টিকুমড়ো আর মিষ্টির দোকানের বাসী পঁচা মিষ্টির সিরা দিয়ে বানানো। গরম সিংগারাটা মুখে দিতেই সেই লোকটা ফশ্ করে ম্যাচে কাঠি ঘষে একটা সিগারেট ধরালো। প্রথমে বারুদ পরে সিগারেটের গন্ধ নাকে এলো। লোকটা কেকের মত কি একটা চায়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে।

খেতে খেতে বইএর কয়েকটা পাতা পড়তেই লাঊড স্পিকারে ঘোষনা শুনতে পেলাম ট্রেন ছাড়ার। আমার বগিটা ইঞ্জিনের এক বগি পরেই। অনেক পথ হাঁটতে হবে তাই উঠে পরলুম। একটা পাঁচ টাকার কয়েন প্লেটে রেখে দাঁড়ালাম, ব্যাগটা পিঠে ঝোলালাম। লোকটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেন আমার অপেক্ষায়, মনে হতেই আমি অবাক হলাম! মনে মনে ভাবলাম লোকটা কি আমাকে ফলো করছে । আগাম বিপদ দেখলেই আমার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ হয়, এটা আমার জন্মের পর থেকেই বিপদ হলেই যেন আগাম নিরাপত্তার পূর্বাভাস। ডান হাতের প্রথম ঘুষিতে লোকটার নাকের হাড় ভাঙা ছাঁড়া আর কোন ইচ্ছে আমার নেই। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলাম।

লোকটা কে এসব ভাবতে ভাবতেই পথচলা। প্ল্যাটফর্ম এসে দেখি লোকটি নেই। একটি ছোট্ট ছেলে আমার পিছু পিছু ব্যাগটা নেয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করছে। আমি বললাম এটাতো আমার পিঠে আমি নিজেই নিতে পারছি তোকে কেন দেব? ছেলেটা আশপাশ দেখছে ভয়ে ভয়ে। বুঝলাম ও ভয় পাচ্ছে বড় কুলিগুলো যেন ওকে না দেখে।
আমাদের দেশের নেতাদের বড়বড় বুলি দেশ থেকে গরিবী মিউজিয়ামে পাঠাবে। অথচ দারিদ্রতা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। ছেলেটাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে বিদেয় করলাম।

অনেক যাত্রীর ভিড়ে হাটছি ট্রেনের পাশে। এ ষ্টেশন আমার কত আপন। এখানে শৈশব থেকে আমার যাওয়া আসা। আমরা পাড়া থেকে দল বেঁধে বন্ধুরা বন্ধের দিন ট্রেনে করে জানআলীর হাট পর্যন্ত যেতাম, ওখানে একটা বটতলী মুখি ট্রেন অপেক্ষা করতো, আমরা সেটায় আবার বাসায় ফিরতাম। এই ছিল আমাদের রবিবারের ছুটির খেলা। তার পর আর্ট কলেজে পড়াকালীন রাত্রি বেলায় প্ল্যাটফরমে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের ছবি আঁকতে আসা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সাতটি বছর। সেই দিনগুলোর কথা এখানে এলে মনে পড়ে আর বুকটা হু হু করে ওঠে।

ট্রেনটা নতুন কিন্তু কেমন নোংরা মনে হোল। আমার সিটটা জানালার পাশে দিতে বলেছিলাম। টিকেট বিক্রেতা বলেছিল দিয়েছে। অথচ টিকেটটা জানালার পাশে নয় আর উল্টোমুখি, মানে ঢাকার দিকে মুখ না হয়ে চাঁটগা মুখি। টিকেট বিক্রেতাকে আমি প্রায় দেখি। ও কি আমাকে চেনেনা? আমার পাড়াটা ষ্টেশন কলোনীর পাশেই। আমার ইচ্ছে করছে কাউন্টারের ছিদ্র দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওকে ওই ছিদ্র দিয়ে টেনে বের করে আনি। খোদার কসম খেয়ে বলছি ঢাকা থেকে ফিরে আমি ওকে রক্তাক্ত করবো। একবার ভাবলাম ট্রেন থেকে নেমে ওকে খুঁজে বের করি।
কিন্তু ঢাকা যাওয়াটাও জরুরি। মেজাজ খারাপ। সকালটাই মাটি। পরিচিত টিটি পেলে সিটটা বদলে নেব। এ আশায় বসে পরি। ভাগ্যের মা মাসি ভাই বোন বউ বাচ্চাকে মনে মনে গালি দিচ্ছি। এতে রাগ কমে তাই।

পিঠের ব্যাগটা উপরে রেখে বসে সামনে তাকাতেই দেখি সেই লোকটা। সে একটা সিগারেটের প্যাকেটে বল পয়েন্ট পেন দিয়ে কি যেন লিখছে। তক্ষনি মেজাজটা কমে এসে লোকটার প্রতি কৌতুহল বেড়ে গেল। লোকটা আমার সামনের সিটে ! অবাক কাণ্ড। লোকটা আমার কাছে কি চায়, কেন অনুসরণ করছে? একটা হুইসেল বেজে উঠতেই ট্রেন চলা শুরু হোল। পাশের সিটগুলো খালি। আমি কি ওখানেই বসব। যাত্রী আর উঠবেনা এটা সোজা ঢাকা গিয়ে থামবে। নাহ্ ট্রেন থেমে গেল । একজন টিটি চারজন ভিআইপি যাত্রী এনে খালি সিটে এনে বসালেন।

একি ! জানালার পাশের যাত্রিণী একদম আমার বউএর কার্বনকপি, এতো দেখছি কপি পেস্ট করার মত। সেও আমাকে দেখছে অন্যদের সাথে কথা বলতে বলতে। কেন জানি মনে হচ্ছে জেসমিনকে ক্লোন করা হয়েছে। এটা হলিউডের ছবিতে সম্ভব কিন্তু বাস্তবে আমি কি দেখছি। কার্বনকপিও বুঝতে পারছে আমি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছি।

আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিতে। জেসমিনের শরীরের ঘাণ আমার চেনা। মানুষের অবয়বে মিল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু শরীরের গন্ধবাহ কি এক? জানালাটা যদি খোলা থাকতো কিছুটা ঘ্রাণ ভেসে আসতো। সামনে বসা অনুসরণকারী হত্যা কিম্বা গুমকারী হলেও আমার ভাবনায় জেসমিন। আমাদের একটা নয় মাসের বাচ্চা আছে। জেসমিন তাকে ফেলে আসার মত মেয়ে নয়। এসব আমি কি ভাবছি। পরনের শাড়ীটাও আমার কেনা মনে হচ্ছে। পিংক কালার আমার প্রিয়, ক্যান্টনমেন্ট এর সাপ্লাইএর কাজটায় আমার প্রচুর প্রফিট হয়েছিল, জেসমিন এর পীড়াপীড়িতে ওকে পাবনা স্টোর থেকে এই শাড়ীটাই কি আমি কিনে দিয়ে ছিলাম। বিয়ের ছ’,বছরের মাথায় ওই একবারই ওকে নিয়ে আমার বিকি কিনি। এ নিয়ে কত খোঁটাখুঁটি। এ নিয়ে আমার বড় দু’বোন, ভাবীদের সে কি শাসন। আমার পরিবারে সবাই ওর পক্ষে, আমার জান্নাতবাসী পিতামাতা ওকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গিয়েছে যেন।

ক্লোন জেসমিনের পাশে বসা লোকটা আমার দিকে শকুনের মত তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পেরে আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। অনুসরণকারী লোকটা বয়সে প্রবীণ হলেও শারিরীক গঠন বেশ কঠিন। বাতাসে তার চুল উড়ছে, গোঁফদাড়ি সাদাকালো, একটা সুইস নাইফ দিয়ে ম্যাচের কাঠিকে সুঁচালো করছে আর সুযোগ পেলেই আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এ কিসের ইংগিত জানিনা। ট্রেনের দুলুনি একইলয়ে শব্দ করে চলছে সে শব্দ আমাদের ভাবনার সাথে মিলে যায়। লাইন আর চাকার ঘর্ষণ যেন বলছে ” জেসমিন একা কই যায় ” ” জেসমিন একা কই যায় “। আমার অসহ্য লাগছে। উপরের তাক থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলাম। আসার সময় জেসমিনের কড়া নির্দেষ সিগারেট যেন না কিনি। টাকার ভাঙতি না পেয়ে মাত্র পাঁচটা গোল্ডফ্ল্যেক সিগারেট নিয়েছি। এক প্যাকেট না নিয়ে পাঁচটা কিনলেই যেন জেসমিন এর কথা রাখা। অনুসরণকারীর সামনেই জানালার পাশে ছোট্ট ফোল্ডিং টেবল সেখানে ওর সিগারেট আর ম্যাচ বক্স। ওকে না বলেই ম্যাচবক্সটা নিয়ে নকল কি আসল জেসমিনকে দেখতে দেখতে উঠে এলাম টয়লেটের দিকে। আমার দু ঠোঁটের মধ্যে অগ্নিবিহীন সিগারেট। অনেক বয়স্ক যাত্রী আমার দিকে চেয়ে আছে খর দৃষ্টিতে, অনুসরণকারীও বেজার, না কয়ে ম্যাচ বক্স নেওয়ায়। জেসমিনের ঠোঁটের কোঁণায়ও দেখলাম একটুকরা হাসির ছটা। বগীর শেষ প্রান্ত থেকে জেসমিন এর মুখটা দেখা যাচ্ছে। দুজন দুজনাকে দেখছি। আর ভাবছি এ শতভাগ জেসমিন, আমার বিয়ে করা বউ। কিন্তু হিসেব মিলাতে পারছিনে বাকী তিনজন কে? আমাকে দেখছে, হাসছে। বিপদ হলে আমাকে কিছু বলছেনা কেন। এ ষ্টেশনে অন্তত ডাকলেই আমার পরিচিত দশ বিশজন লোক মূহর্তেই হাজির হবে।

ট্রেন চলছে জানালা দিয়ে দেখলাম চিনকি আস্তানা ষ্টেশন মূহর্তে উধাও, জেসমিনওকি এমন করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে মাথাটা জানালা দিয়ে বের করে দিলাম যাতে ধোঁয়া ভেতরে না আসে। কেমন বিস্বাদ লাগছে সিগারেট। কখনওতো এমন হয়নি। আসলেই কি মেয়েটা জেসমিন! ওর উপস্থিতিতে সিগারেট বিস্বাদ লাগারই কথা। সুখটান দেবার আগেই জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে দিলাম। মাথাটা ভেতরে নিয়ে এসে আবার জেসমিনের দিকে তাকালাম। ওখানে ও নেই, অন্যজন। আমার হাতে অন্য হাতের স্পর্শ পেয়েই তাকালাম, দেখলাম অনুসরণকারী মৃদু হেসে ম্যাচবক্সটা নিয়ে নিল। হাত থেকে ম্যাচবক্সটা ওর হাতে। ফশ করে কাঠিতে আগুন জ্বলে উঠলো, মাথাটা জানালা গলিয়ে বাইরে। আগুনটা যেন আমার বুকের বা পাশের পরানের গহীনে দাউ দাউ করে আমার সোনার ময়না পাখিটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। অসহ্য যন্ত্রণায় বসে পড়লাম, না পড়ে গেলাম জানিনা। অনুসরণকারী দ্রুতই মাথাটা বের করে এনে আমাকে দাঁড় করালেন এটুকুই মনে আছে। হুশ ফিরে এলে দেখি জেসমিন আমার মুখোমুখি। অনুসরণকারী পরম মমতায় আমাকে ওর সিটে এনে বসালেন। ঢাকামুখি হওয়ায় বাইরের হাওয়া সারা শরীরটা জুড়িয়ে দিল। জেসমিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে এ দৃষ্টি কি কষ্টের? না কিছুই ঠাওর করতে পারছিনে।

গায়ের রঙ চোখ ঠোঁট সব কিছুই মিলছে । ওর শরীরের ঘাণটাই হিসেব মিলিয়ে দেবে আমি তার অপেক্ষায়। ঢাকা আসুক। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম। অনুসরণকারীর ধাক্কায় জেগে উঠলাম। কি খুব তো ঘুমালেন, মিষ্টি হেসে বললেন। কোথায় যাবেন, পারবেন, নাকি দিয়ে আসবো। নাহ্, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। জেসমিনরা নামছে, আমি দ্রুতই জেসমিনের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। একটা দীর্ঘ দম নিয়ে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিলাম। নাহ্ এ জেসমিনের গায়ের সুবাস নয়। একটা অচেনা মেয়ে সিঁড়ি ভেংগে ট্রেন থেকে নীচে নামলো । বড্ড অচেনা।

অনুসরণকারী লোকটা কই? এদিক ওদিক খুঁজলাম। দূরে যাত্রীর ভিড়ে একপলক দেখলাম চোখাচোখি হোল তারপরেই কোথায় মিলিয়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত