সাইকেল চালাচ্ছেন তাজউদ্দীন। সাইকেলে একটা নতুন সিটকভার লাগিয়েছেন। সবুজ রঙের। সেটা এখনো জুতমতো বসে নাই। একধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। নবাবপুর রোডে একটা ঘোড়াগাড়ির পেছনে পড়েছেন তিনি। ঘোড়াগাড়িটাকে ক্রস করতে পারছেন না।
বিপরীত দিক থেকেও গাড়িঘোড়া আসছে। রিকশা আসছে।
সন্ধ্যার পরে দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে। এই সময় সাইকেল চালাতে বড় ভালো লাগে ৩২ বছর বয়সী তাজউদ্দীনের।
তাঁর গায়ে একটা হাফহাতা সুতির শার্ট। পরনে প্যান্ট। পায়ে স্যান্ডেল। চোখে চশমা।
তিনি যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অফিসে। পার্টির সেক্রেটারি মুজিব ভাই তাঁকে জরুরি তলব করেছেন।
তাজউদ্দীন ঘোড়াগাড়িটাকে ওভারটেক করতে পারলেন। ডান হাতে সাইকেলের বেল বাজালেন, ক্রিং ক্রিং।
পার্টি অফিসের সামনে গিয়ে সাইকেল রাখলেন।
তালা দিলেন সাইকেলে। তারপর ভেতরে ঢুকলেন।
মুজিব ভাই বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে আছে কর্মীরা। তিনি আবার মন্ত্রীও। এমনিতেই ভীষণ জনপ্রিয় মানুষ। তার ওপর পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে সারা দেশে সব নেতা-কর্মীর সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। সবার নাম জানেন। ব্যক্তিগত বিষয়ের খোঁজখবরও নেন।
তাঁকে দেখেই তিনি বললেন, ‘তাজউদ্দীন আসছ। আসো।’
তারপর নিজেই উঠলেন। বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে হবে। এই দিকে আসো।’
তাজউদ্দীনকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘তুমি তো জানো মওলানা সাহেব পদত্যাগপত্র দিয়েছেন?’
‘জি জানি। খবরের কাগজে পড়েছি।’
‘হ্যাঁ। আমরাও খবরের কাগজেই পড়ছি। পদত্যাগপত্র তো খবরের কাগজে দেবার জিনিস নয়। এটা পাঠাতে হবে পার্টির সেক্রেটারির কাছে। সেক্রেটারি কমিটিতে তুলবে। তাই না?’
‘জি।’
‘তাঁর পদত্যাগপত্র আমরা গ্রহণ করি নাই। তুমি তো জানো, উনি প্রায়ই পদত্যাগের কথা বলেন। কিন্তু আসলে উনি বলছেন, জীবনেও আওয়ামী লীগ ছাড়বেন না। জানো তো!’
‘জি, উনি বলেছেন এ কথা।’
‘অলি আহাদকে তুমিও পছন্দ করো। আমিও পছন্দ করি। পররাষ্ট্রনীতি নিয়া লিডারের সঙ্গে তোমার মতভেদ আছে, আমারও আছে। কিন্তু এই কারণে তো পার্টি ভাঙা যায় না। আমরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। পার্টি সিদ্ধান্ত নিলে সবাই সেটা মানতে বাধ্য। আমরা ঠিক করেছি, যারা মন্ত্রী থাকবে, তারা আর পার্টিতে থাকবে না। যারা পার্টিতে থাকবে, তারা মন্ত্রী থাকবে না। আমি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করব। বুঝলা?’
‘জি।’
‘কিন্তু অলি আহাদ এটা কী করল? মওলানা সাহেবের পদত্যাগপত্র কেন সে সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরীর কাছে পৌঁছাইয়া দিল? কাজটা কি সে ঠিক করছে?’
‘জি না।’
‘তো এখন তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। মওলানা সাহেব তোমাকে বিশেষভাবে স্নেহ করেন। তুমি বললে উনি না করতে পারবেন না। তাঁর কাছে যেতে হবে তোমাকে। যাওয়ার সময় এক ঝুড়ি ফল নিয়ে যাবা।’
‘জি কোথায় যাব? তিনি তো আত্মগোপন করে আছেন।’
‘হ্যাঁ। উনি লুকায়া আছেন। তবে তাঁর অবস্থান জানা গেছে। তিনি আছেন সিরাজগঞ্জ মহকুমার সোহাগপুর গ্রামের কাছে। যমুনা নদীতে। নৌকায় আছেন। তুমি তাঁর কাছে যাবা। আমি চিঠি দিয়া দিচ্ছি। তাঁকে বলবা, সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে দাওয়াত করছেন। এই প্লেনেই ধরে নিয়া আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তাঁকে এখান থেকে একবারে করাচি পাঠায়া দেব।’
তাজউদ্দীন আহমদ ঠান্ডা মাথার মানুষ। নিজে প্রগতিশীল। বাম পন্থার দিকেও তাঁর খানিকটা ঝোঁক আছে। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তিনিও সমর্থন করেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আওয়ামী লীগে থাকা এবং শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রাখাই কর্তব্য বলে স্থির করে নিয়েছেন।
১৯৫৭ সাল। ওই সময় দেশে বিমানবন্দর কমই ছিল। তখন সি-প্লেন ছিল তাই প্রচলিত এবং নিয়মিত। নদীর বুকে উড়োজাহাজ নেমে যেতে পারত।
তাজউদ্দীন আহমদ উত্তেজিত। সি-প্লেনে চড়া হবে।
তিনি শেখ মুজিবের কথামতো সঙ্গে নিয়েছেন আম, জাম আর লিচু। লিচু ভালো পাওয়া গেছে। তবে আম যা পাওয়া গেছে, তা টক হবে। খেতে টক হলেও বাইরে দেখতে উজ্জ্বল হলুদ। এক ঝুড়ি ফল আর শেখ মুজিবের চিঠি নিয়ে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে ছোট্ট সাদা রঙের প্লেনে উঠে বসলেন।
মুজিব ভাই সবকিছুর ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন। ছোট্ট প্লেনে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিতে হলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তাজউদ্দীন। রানওয়ের চারদিকে সবুজ। বড় বড় কাশঝাড়। প্লেন চলতে শুরু করল। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। আকাশে যখন উড়ল প্লেনটা, তখন চোখ মেললেন। দেখলেন, নিচে সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। তাজউদ্দীন এখন মেঘের ওপরে। কী আশ্চর্য।
তাঁদের প্লেন নামল নদীর মধ্যে।
তারপর একসময় দরজা দেওয়া হলো খুলে। তাজউদ্দীন প্লেন থেকে নেমে একটা বোটে উঠলেন।
আহ্, কী সুন্দর এই নদীবক্ষ, নীল জলে ঢেউয়ের খেলা, কী সুন্দর এই উদার আকাশ, নীল দিগন্ত, সাদা বালুচর, কাশবনে সবুজের ঢেউ।
ভাসানী তাজউদ্দীনকে দেখে বললেন, ‘আইসো। এক নৌকা থাইকা আরেক নৌকায় উঠতে পারো তো মিয়া, নাকি?’
তাজউদ্দীনের হাতে ফলের ঝুড়ি। সেটা তিনি আগে তাঁর বোট থেকে ভাসানীর নৌকার পাটাতনে রাখলেন। তারপর নিজে বোটের পাটাতনে দাঁড়িয়ে এক পা বাড়িয়ে দিলেন ভাসানীর নৌকার পাটাতনে।
তাজউদ্দীনও গ্রামেরই ছেলে। যদিও ছোটবেলায় নদীতে নদীতে সাঁতার কাটা তাঁর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি ভালোই সাঁতার জানেন।
‘কে পাঠাইছে তোমারে? মজিবরে?’
‘জি।’
‘ক্যান পাঠাইছে?’
‘আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
‘কেন?’
মুজিবের চিঠিটা ভাসানীর হাতে দিয়ে তাজউদ্দীন বললেন, ‘দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। সে জন্য আপনি পদত্যাগ করতে পারেন না। তাতে দেশের ক্ষতি হবে। জনগণের ক্ষতি হবে। আপনি দলে থাকুন। তাহলে দলকে ঠিক পথে রাখতে পারবেন। আওয়ামী লীগ সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। এই দলকে ঠিক পথে রাখতে পারলে দেশের ভালো।’
‘আওয়ামী লীগ ঠিক পথে নাই। সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগরে ঠিক পথে রাখতে দিব না। ক্ষমতা মানুষরে অন্ধ বানায়া ফেলে। সোহরাওয়ার্দী অন্ধ হইয়া গেছে। সে বলে, সে প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় পূর্ব বাংলা ৯৮ পারসেন্ট স্বায়ত্তশাসন পাইয়া গেছে। সে বলে, প্যারিটি মাইনা নিতে। আমরা ২১ দফা কোন মুখে ত্যাগ করি। ২১ দফার কথা বইলা আমরা ভোট নিছি।’
‘আপনাকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব করাচিতে দাওয়াত দিয়েছেন। আপনি করাচি যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলে যদি মনে হয় পদত্যাগপত্র উইথড্র করবেন না, করবেন না। আর যদি মনে হয় করবেন, তাহলে করবেন।’
‘তাজউদ্দীন, তুমি দুপুরে কী খাইছ? ভাত খাও। জব্বার, সাহেবরে ভাত দাও।’
‘ভাত খাব না। আপনার জন্য মুজিব ভাই ফল পাঠিয়েছেন।’
‘মজিবররে বইলো সে য্যানো গোস্বা না করে। আলাদা দল করা ছাড়া আমার আর উপায় নাই। অলি আহাদ কী বলে?’
‘অলি আহাদ বলে, আমরা কেন দল ছাড়ব। আমরা দলে থাকব। যারা নীতি বিসর্জন দিয়েছে তাদের বহিষ্কার করব।’
‘ও আর সেইটা ক্যামনে করব? ওরেই তো বহিষ্কার কইরে ফেলছে আওয়ামী লীগ।’
‘আপনি থাকলে সেটা না-ও হতে পারত।’
‘আমি তো নারায়ণগঞ্জে জনসভা আহ্বান করছিলাম।’
‘সেইটা তো গঠনতন্ত্র মোতাবেক পদক্ষেপ হলো না।’
‘তুমি কী করতে বলো?’
‘আমি বলি, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলেন। আপনি এখানে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলে তো পরিস্থিতি পাল্টাবে না। আপনাকে বাস্তবতার মোকাবিলা বাস্তবতা দিয়ে করতে হবে।’
ভাসানী বললেন, ‘দাও দেখি। দুইটা লিচু দাও। আম তো মনে হইতাছে টক।’
‘জি, টক। আপনি কী করে বুঝলেন?’
‘বয়স হইছে না। বয়স দিয়া বুঝলাম। অসময়ের আম। চেহারা ভালো। মিষ্টি আম কখনো রঙিন হয় না। তোমার আম টকটকা হলুদ। এই অসময়ের সুন্দর আম কোনো কামের হওনের কথা না। তাজউদ্দীন, তুমি আমার প্রিয় মানুষ। তোমারে বলি। আমি ঢাকা যামু না। পরিস্থিতি তোমরা যত সহজ ভাবতাছ তত সহজ না। অনেক জটিল। ইত্তেফাক আমারে ইন্ডিয়ার চর বলতাছে। ইন্ডিয়ার কবি-লেখকদের আনা হইছে, এইটাকে খারাপ চোখে দেখা হইতাছে। মানুষ যে এত বড় মিথ্যা কথা রটাইতে পারে, শুইনা মনটা খুব দইমা গেছে। আমি ইত্তেফাক-এর প্রতিষ্ঠাতা আছিলাম। ইয়ার মোহাম্মদ আছিল প্রিন্টার পাবলিশার। অহন সেই ইত্তেফাক আমার বিরুদ্ধে এইসব লেখতাছে। সেই মানিক মিয়া লেখতাছে?’
‘আপনি কী করবেন তাইলে?’
‘দেখি। নয়া দল করতে হইব। সারা পাকিস্তানের প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক ফোর্সরে একত্রিত কইরা একটা বড় প্ল্যাটফরম বানাইতে চাই। তুমি কী করবা?’
‘আমি আওয়ামী লীগেই থেকে যাব। কারণ, পার্টি ফোরামে আপনার পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে কেউ তো আপনার পক্ষে দাঁড়ায় নাই। গণতন্ত্র হলে মেজরিটির মত মেনে নিতে হবে। আর পার্টি ভাঙাটা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। আর…’
‘আর?’
‘আর মুজিব ভাইরে আমি না করতে পারব না।’
একটা মাছরাঙা পাখি ছোঁ মেরে একটা মাছ তুলে নিয়ে আবার আকাশে উড়ে গেল।
যমুনার বক্ষে কী অপরূপ শোভা খেলা করছে। নদীজল কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। একটু একটু বাতাস বইছে। ছোট ছোট ঢেউয়ে দূরে কতগুলো ডিঙি নৌকা দোল খাচ্ছে। আকাশ মেঘমুক্ত। রোদেলা চারপাশ। দূরে চরে গরু চরছে। এই চরের মধ্যে গরুগুলো কোত্থেকে এল? তাজউদ্দীন ভাবতে থাকেন।
মাঝি ভাত বেড়েছে।
তাজউদ্দীন বললেন, ‘ভাত খাব না। আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।’
‘না। খাও। আমি তো আর যাইতাছি না। তাড়াহুড়া কইরা লাভ কী। আমি গেলে না করাচির প্লেন রেডি করতে হইত!’
তাজউদ্দীন নৌকায় বসে ভাত খাচ্ছেন। এক হাতে থালা ধরে আরেক হাতে খেতে হচ্ছে। মাছের ঝোল রাঁধা হয়েছে। আইড় মাছ।
আইড় মাছ তাজউদ্দীনের পছন্দের মাছ নয়। কিন্তু এত স্বাদ হয়েছে যে তাজউদ্দীন বুভুক্ষের মতো খেতে লাগলেন। খেতে গিয়ে হলুদ ঝোল পড়ল তাঁর সাদা শার্টে। তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
ভাসানী খইনি ডলছেন। খইনি টানতে টানতে তিনি বললেন, ‘জামাটা খুইলা নদীর পানিতে ধুইয়া নেও। তারপর তোমার ওই প্লেনে যাইতে যাইতে গায়েই শার্ট শুকাইয়া যাইব।’
তাজউদ্দীন মওলানা সাহেবের এই কথা শুনলেন না। মওলানার সব কথা যে শোনা যাবে না, এটা তিনি ভালো করেই বোঝেন।
তাজউদ্দীনের খাওয়া হয়ে গেছে। নদীর জলে তিনি হাত ধুলেন। এবার ফিরতে হবে।
বিদায়ের পালা। তাজউদ্দীনের মনে হলো, এই বিদায় একটা বড় বিদায়ের সূচনামাত্র। তিনি যখনই এই ছইয়ে ঢাকা নৌকা ছেড়ে তাঁর বোটে উঠবেন, তখনই তিনি একটা যুগ থেকে বেরিয়ে যাবেন। আওয়ামী লীগের ভাসানী যুগ।
সূত্র: প্রথম আলো