মোহনা

গেটের পাশে বাগানের বেড়াটা কাত হয়ে পড়ো-পড়ো। মন্টু মামা থাকলে কবেই ঝটপট মেরামত করে দিত! এদিকে আবার গেট পেরিয়ে ঢোকার মুখে বৃষ্টির পানি শুকিয়ে ব্রিকসোলিং-এ কালচে সবুজ শ্যাওলা, দূর থেকে দেখতে ঘাসের পুরু কার্পেটের মতো, পা পিছলে টালমাটাল হলে পায়ের কিছু না হলেও কোমরটা যাবে। কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার না কী যেন বলে, তাও বিচিত্র না।

মন্টু মামা চার-পাঁচ দিন লাপাত্তা। না হলে কোদাল মেরে বালু ছিটিয়ে কোমর ভাঙার বিপদটা দূর করে দিত।

পা বাঁচিয়ে খুব সাবধানে হাঁটতে হয়। শায়লা সাবধানেই চলে-ফেরে। সমস্যা নীতু খালাকে নিয়ে। একবার যদি ধপাস করে পড়ে, টেনে ওঠাবে কে! কোমর ভাঙাভাঙির কথা পরে, ওঠাবে কে! একশ’ বিশ কেজির বস্তা। শায়লার কাজ না, আর সে তো সারাক্ষণ বাসায় থাকেও না। মরিয়ম টানাহ্যাঁচড়া করবে ঠিকই, চিল্লিয়ে লোকও জড়ো করতে পারে।

ঘরে ঢুকে বাথরুমে পা ধুয়ে খাটে বসতে না বসতেই নীতু খালা।

-আজও এলো না!

না বোঝার কথা নয়, তবু শায়লা কার কথা বলছ বলে কুঁজো হয়ে ভেজা দুই পায়ে তোয়ালে ঘষে মাথা তুলল।

-মন্টু মামা?

-আর কে! বলল, বাড়ি যাচ্ছে, ভাগ্নির বিয়ের পানচিনি। এত দিন হয়ে গেল!

-এতদিন কই, মাত্র চার দিন। যেতে আসতেই তো বেচারার দুই দিন। বাঁশখালী না কোথায় যেন…

-আছাড় একটা যখন খাবি তখন বুঝবি।

-আমি আছাড় খাব না। তোমাকে নিয়েই ভয়, একবার যদি পড়ো, টেনে যে কে তুলবে!

এটাই আমার চিন্তা। আমি পারব না।

-কেন? পারবি না কেন?

-বোঝো না? আড়াইমণি চালের বস্তা, আগাগোড়া সমান, ধরবটা কোথায়!

শায়লার একবারের কথা খুব মনে পড়ে। থলথলে শরীর নিয়েও নীতু খালা নিজের রূপের বাহারে বরাবরই মোহিত। এমন নার্সিসিস্ট মহিলা, শায়লা ভাবতে পারে না। তবে সেবার যা ঘটেছিল, ট্র্যাজিক বৈকি। বিয়েবাড়িতে যাবে, ঘণ্টাদুয়েক ধরে সাজুগুজু সেরে যেই পেন্সিল হিলে পা ঢোকাতে যাবে, শায়লা মানা করেছিল, বলেছিল একটা ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরো। শোনেনি। পরপরই শায়লা যতটা ভাবেনি, সিঁড়িতে পা দিতে না দিতে চিৎপটাং। আর চিৎকার, মন্টু রে…। ভাগ্যিস মন্টু মামা কী কাজে বাসায় ছিল, সে সময় তার থাকার কথা না। টেনেটুনে তুলল। ঘরে এনে বসাতে গোড়ালি চেপে কান্না, কান্না। বরফ-টরফ দিয়ে কোনোমতে রক্ষা।

বিয়েবাড়িতে যাওয়া গোল্লায় গেল, তবে দোষ গিয়ে পড়ল শায়লার ওপর। সে যে মানা করেছিল পেন্সিল হিল পরতে তাতেই নাকি কুফা লেগে গিয়েছিল। মোটাসোটা, নাদুসনুদুস মহিলারা কি পেন্সিল হিল পরে না, ওর মতো শাঁকচুন্নিরাই পরে!

সম্পর্কটা শায়লা এনজয় করে। নীতু খালাও নিশ্চয় করে। সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শায়লা এ বাড়িতে। অনেকটা নীতু খালার জোরাজুরিতে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর হোস্টেলে সিট পাওয়ার পরও যেতে দেবে না। তুই আমার সঙ্গে থাকবি, আমি কি খুব খারাপ সঙ্গী? কোথায় পাবি আমার মতো বন্ধু!

বন্ধু বটে। শায়লা অস্বীকার করবে কোন যুক্তিতে! বয়সের ফারাক সত্ত্বেও কী নিয়ে না সে আর নীতু খালা কথা বলে! আপন খালা না, মায়ের মামাতো বোন এই অবিবাহিত মহিলা এলিফ্যান্ট রোডের একতলা পৈতৃক পুরনো বাড়ি আগলে যে কী সুখে আছে, চোখ না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একসঙ্গে এত বছর না থাকলে শায়লাও করত না। পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই থলথলে জাম্বু মহিলা- কী এমন আনন্দ তার একাকী জীবনে যে সারাক্ষণই এক আশ্চর্য তৃপ্তিবোধ মধুর আলস্যের মতো তাকে ঘিরে থাকে! সঙ্গী বলতে ঘরে শায়লা আর কাজের মেয়ে মরিয়ম। আর হ্যাঁ, মন্টু মামা। মন্টু মামাকে অবশ্য সঙ্গী বলা যায় না। প্রায় দিনই এক আধবার হুটহাট আসে, কাজ-কর্ম কিছু থাকলে করেই হাওয়া। মন্টু মামা নীতু খালার দূরসম্পকের্র ভাই, বয়সে তার থেকে বছর কয়েকের ছোট। নিজের একটা ইলেক্ট্রনিক্স মেরামতির দোকান আছে এই এলিফ্যান্ট রোডেই। কেউ ভুলেও ওখানে পা দেয় বলে শায়লার মনে হয় না। তবে কাজ জানে মন্টু মামা। একবার তার ল্যাপটপের কি বোর্ড বিকল হলো, মন্টু মামাই ঠিকঠাক করে দিল। কাছাকাছি দোকান বলে, আসল কথা খদ্দের-টদ্দের নেই বলে, আলসেমি কাটাতে এ বাড়িতে এসে মন্টু মামা ফেঁসে যায়। নীতু খালা একটা না একটা কাজ ধরিয়ে দেবেই। বিয়ে-টিয়ে করেনি, নীতু খালা অবশ্য বলে, ওর বিয়ের বয়স এখনও পার হয়নি। করে ফেলবে দেখিস, যে কোনোদিন। পুরুষ মানুষ, এদের ঠিক আছে কিছু!

-বিয়ে খারাপ?

-আমি বললাম খারাপ?

-এই না বললে।

-বললাম আর কী। মুখে সারাক্ষণ লাগাম পরে থাকা যায় নাকি! তবে মন্টু দেখিস ঠিকই একটা কমবয়সী হিজাবি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে।

-খারাপ কী! অল্পবয়সী মেয়েটা একজন রেসপন্সিবল গার্জিয়ান পাবে।

-তোর মাথা পাবে। মন্টু মেয়েদের কী বোঝে! তবে সত্যি যদি হিজাবি হয়, শাড়ি-টাড়ি দিলে তো পরবে না। গয়না কি পরবে? পরুক না পরুক, গয়নাই দেব। তোর কী মত? আচ্ছা, ওদের যদি এখানে এসে থাকতে বলি, রাজি হবে?

পাঁচ বছরের ওপর শায়লা এ বাড়িতে। নিজের বাড়িই মনে হয়। এর মূলে অবশ্যই নীতু খালার সঙ্গে তার সম্পর্ক। প্রথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তিতে থাকত। খাওয়াদাওয়া নিয়ে জোরাজুরি তো ছিলই, আর সন্ধ্যার পর সিরিয়াল দেখতে এমন টানাটানি জুড়ত, শায়লা ধরে নিয়েছিল তাকে এ বাড়িতে রাখার উদ্দেশ্য সিরিয়াল দেখার সঙ্গী পাওয়া। মরিয়ম যদিও সিরিয়ালের পোকা, তবে একজন উন্নত সঙ্গী হিসেবে শায়লা নিশ্চয় নীতু খালার পয়লা-পছন্দ ছিল। তবে কিছুদিন যেতে যখন দেখা গেল গাঁজাখুরি সিরিয়ালের চরম হৃদয়বিদারক মুহূর্তেও শায়লা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, নীতু খালা তাকে রেহাই দিয়েছিল। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

তো সিরিয়াল নিয়ে মজে থাকুক বা আর যা-ই করুক, মনটা এত খোলামেলা, শায়লার মাঝে মাঝে মনে হয় নীতু খালা শৈশবের ইনোসেন্সের ফেজটা পার হতে পারেনি। আবার যেহেতু বয়সে বেশ বড়, নিজেকে শায়লার পাহারাদার ভেবেও মজা পায়। মজা শায়লাও কম পায় না যখন তার বন্ধুদের নিয়ে, বিশেষ করে ছেলেবন্ধুদের নিয়ে কৌতূহলী হয়ে একথা-সেকথা জানতে চায়। শায়লা বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে, নীতু খালা কান ভরে শোনে। মনে হয় না শায়লা যা বলে তার একটা কথাও অবিশ্বাস করে। দেখে মায়া হয়, মহিলা একা-একলাই রয়ে গেল! না হয় বেজায় মোটাসোটা, কিন্তু চেহারাটা কী ঢলো-ঢলো! আর কথা যখন বলে- শায়লার একেক সময় মনে হয় কথা না, নীতু খালা রসে ডুবুডুবু আমৃতি খাচ্ছে।

শায়লার ইচ্ছা হয় না ছেলেবন্ধুদের বিষয়ে নীতু খালার সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করে। বেচারির জীবনে তো এসব ঘটেনি। শায়লা অনেকবার জানতে চেয়েছে, বলো না খালা, কাউকে ভালো লেগেছিল? ছ্যাঁকা দিয়ে চলে গেছে? ছ্যাঁকা তো ছেলেরা না; মেয়েরাই দেয়, তুমি দাওনি?

নীতু খালা দুলে দুলে হাসে আর হাসে। আর তখনই হয়তো শায়লার ওপর খবরদারি করার কথা তার মনে পড়ে যায়। বলে, এত যে মেলামেশা করিস ছেলেবন্ধুদের সাথে, কখন কোনটার প্রেমে পড়ে যাস বলা তো যায় না। সাবধানে থাকিস। কোনো সময় আরো ভেঙে বলে, তোর যা বয়স, কখন কোন উজবুককে ভালো লেগে যাবে, নিজেও জানতে পারবি না। বেকুবের মতো প্রেমে পড়ে পরে ডুববি।

-তুমি ডুবেছিলে? ঠিক ডুবেছিলে, না হলে বলো কী করে!

-আমি তোর মতো গাধা!

-না মোটেও না। বলো না, কে?

-আসলেই তুই গাধা। আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই

-তোমার কথাই ঠিক, গাধা বলেই উল্টো চিন্তা করছি। আরে তুমি ডুববে কেন? যারা তোমার নাগাল পেয়েছে তারা ডুবেছে। এই চোখ, এই মুখ দুনিয়ায় আর একটা আছে! বাজি ধরে বলতে পারি- নাই।

হাসি-ঠাট্টা এ পর্যায়েই ছিল এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত। তবে অমিত যখন রেগুলার এ বাড়িতে আসা শুরু করল, নীতু খালার হাবভাবে একটা পরিবর্তন শায়লা খেয়াল না করে পারল না। অমিতকে নীতু খালা যে অপছন্দ করে তা-না, তবে সময়-সুযোগ পেলে বলে, ছেলেটা ভালো। সব ছেলেকেই একটা বয়সে ভালো মনে হয়, তবে খেয়াল রাখিস …

কী খেয়াল রাখবে! অমিত আর সে এক ক্লাসে পড়ে, তুই-তোকারি করে। ইতরামি-ফাজলামি যার যেমন খুশি চালায়। নীতু খালার এসবে আপত্তি নেই বরং যেন মজাই পায়, আবার খেয়াল রাখিসও বলে। অপার কৌতূহলের সঙ্গে ভয়। কিসের ভয়, শায়লা ভেবে পায় না। কখনও ভাবে, নীতু খালাকে ভড়কে দিয়ে বলবে, কী খেয়াল রাখব! ও আমার কে হয় জানো- আমার প্রেমিক। প্রতিক্রিয়াটা কেমন হয় দেখতে তার খুব লোভ- ভড়কে গিয়ে নীতু খালা কী করে!

সেদিন অমিতের আসার কথা বিকাল-বিকাল। কী কাজে আটকে গিয়ে এলো সন্ধ্যার পর। শায়লা ওকে বসার ঘরে নিয়ে সবে ঠাণ্ডা পানি দিয়েছে খেতে- অনেকটা পথ হয়তো হেঁটে এসেছে, ঘামছিল খুব। এমন সময় নীতু খালা এলো ঘরে। হাবভাব পরিস্কার- আড্ডা দেবে ওদের সাথে। কিছুক্ষণ কাটল এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে। শায়লা জানত নীতু খালা আড্ডা দিতে এসেছে ঠিকই, তবে মূল উদ্দেশ্য ওদের কথা শোনা আর মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটা; নয়তো গা দুলিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি হাসা। কিন্তু যতই সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হোক, বয়সে অনেক বড় একজন মহিলার সামনে তাদের নিজেদের কথাবার্তা কী করে এগোয়! অমিত উসখুস করছিল; শায়লাও। টের পেয়ে কি-না কে জানে, আমি যাই বলে নীতু খালা উঠে পড়েছিল।

রাতে, বেশ রাতে শায়লার ঘরে এলো নীতু খালা। শায়লা বুঝতে পারছিল কিছু একটা বলবে, আর সেটা যে অমিতকে নিয়ে- এও আন্দাজ করেছিল। বেশ খানিকক্ষণ বসে থেকেও কথাটা কীভাবে তুলবে ভেবে উঠতে না পেরেই যেন নীতু খালা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। এক সময় বলার মতো কিছু না পেয়ে মশারি ফেলিস না কেন, কয়েল তো ভালো না বলে উঠে পড়ল।

পরদিন সকালে ঠিকই আগের রাতে তুলে রাখা কথাটা গোছগাছ করে পাড়ল- তুই বুঝতে পারছিস, কী করতে যাচ্ছিস? অমিত দেখতে ভালো, কথাবার্তায় ভালো, কিন্তু ওর বাবা তো একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। বুঝতে পারছিস, ঘটনা কোনদিকে গড়াবে?

-কোনদিকে, বলো তো?

-অর্থাভাবে। ও তো তোকে মেনটেন করতে পারবে না।

-মেনটেন?

-হ্যাঁ মেনটেন। তুই কি ওকে ভালোবাসিস?

-তোমার কী মনে হয়?

-কী জানি …

-তাহলে বলছ কেন?

-ওকে বিয়ে করবি?

-যদি করি?

-মানে?

-মানে-টানে আবার কী? করতেও তো পারি। অমিতকে আমি ভালোবাসি, অমিতও আমাকে…।

কথাটা শোনামাত্র কী হলো, নীতু খালা কয়েক সেকেন্ড অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন নিজে যতই এ নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে কথা বের করার চেষ্টা করুক, সত্যি সত্যি যখন শায়লার মুখ থেকে কথাটা বের হলো, মহিলা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

পরদিন মন্টু মামা এসে পড়তেই হুলস্থূল। দেখামাত্র নীতু খালা যেন বেচারাকে হামামদিস্তায় পিষে ছাতু বানিয়ে ছাড়বে। তোর কাণ্ডজ্ঞান বলতে যদি কিছু থাকত! কোথায় দুই দিনের কথা বলে গেলি, একটা খবর নাই এ কয় দিন। ফোন করি, ধরার দরকার মনে করিস না। ধরবি কেন? কী মধু ওখানে? নিজে বিয়ে করে আসিসনি তো। হারামজাদা!

শয়তান, পাজি বললে শায়লার আপত্তির কিছু থাকত না। কিন্তু হারামজাদা, তাও অন্যদের সামনে! এমন না যে সে কাজের লোক, মাস গেলে মাইনা দিয়ে হারামজাদাকে জায়েজ করে ফেলবে। গালাগালের চোটে যদি আসা বন্ধ করে দেয় উচিত শিক্ষা হবে। কিসের কী! বকাঝকা খেয়ে মন্টু মামা কিছু সময় নীতু খালার সামনে ঘাড় গুঁজে থেকে চটের থলে থেকে বের করল মাটির চ্যাপ্টা হাঁড়িতে মোষের দুধের ঘন দৈ। একনজর তাকিয়েই শায়লার ঘিনঘিন করতে লাগল। আর আশ্চর্য, দুপুরবেলা নীতু খালাকে হাঁড়ি থেকেই চামচের পর চামচ দৈ মুখে পুরতে দেখে কী বলবে ভেবে পেল না। মহিলার রাক্ষুুসে স্বভাবই তাকে শেষ করবে। ঘন দুধের দৈ, আবার মোষের। বিয়ে দূরের, প্রেম-ট্রেমও যে হয়নি তা নিশ্চয় তার এই খাই-খাই এর জন্য। বরাববরই নাকি খাওয়ার লোভ। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ও ওজন কখনও একশ’ কেজির নিচে নামেনি। আর এ বয়সে যখন কোনো আশা-ভরসা নেই, সে যেন ঠিক করেছে খাওয়ার ওপরই থাকবে।

শায়লা যেমন ভেবেছিল, মন্টু মামা ঘণ্টাদুয়েকেই বাগানের বেড়া ঠিক করে ফেলল। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বেড়ার খুঁটি-টুটি পচে গিয়েছিল। পচন ধরা খুঁটিগুলোকেই কীভাবে যেন ঠেক দিয়ে দাঁড় করাল। এর পর নামল কোদাল হাতে শ্যাওলা সাফ্‌ করতে। খালি গা, খাটো লুঙ্গিতে তাকে কাজের লোক ছাড়া অন্য কিছু ভাবার উপায় নেই। এসবের মধ্যে আবার ঘন ঘন মন্টু রে, ও মন্টু হাঁক-ডাক। শোবার ঘরে ইলেকট্রিকের তার ঝুলে প্যাঁচ খেয়ে আছে, যে কেনো সময় শর্টসার্কিট হয়ে যেতে পারে। এদিকে আবার বাজার নেই। চাল লাগবে, মুগ ডাল, পেঁয়াজ, তেল, ঘি, পোস্তদানা, অষ্টগ্রামের কটেজ চিজ। নীতু খালা ফর্দ বানাচ্ছে তো বানাচ্ছেই।

এই লোকটার কি কোনো কাজ নেই? শায়লা না ভেবে পারে না। দোকান একটা আছে নামকা ওয়াস্তে, কর্মচারী একজন বসে, ওই পর্যন্তই। রুজি-রোজগার কিছু হয় শায়লার বিশ্বাস হতে চায় না। আর এই যে এ বাড়িতে রোজ কয়েক ঘণ্টা চাকরের মতো খাটে আর গালমন্দ খায়, নীতু খালার কাছ থেকে কিছু নেয় বলে তো মনে হয় না। খেতে-টেতেও দেখেনি কোনোদিন, বড়জোর চা।

অমিতকে নিয়ে সেদিন সকালে কথাবার্তার পর শায়লা ভেবেছে, কাজটা কি ঠিক করল! খামোখা বেচারির মনে একটা ভয় ধরিয়ে দিল। কৌতূহল তো ছিলই, ভালোবাসার কথা শুনে নীতু খালার চোখ-মুখ কেমন হয় দেখবে। তাই বলে মিথ্যাটা কেন বলতে গেল? অমিত স্রেফ বন্ধু, এক সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে এখন শায়লার খাতাপত্র, অ্যাসাইনমেন্ট পেপার ঘাঁটাঘাঁটি করে। এদিকে নীতু খালা কোথায় চলে গেল- ও তোকে মেনটেন করতে পারবে না। এত হাসি পেয়েছিল শুনে! তবে হ্যাঁ, কথাটা নিশ্চয় নীতু খালার বেলায় খাটে। তাকে মেনটেন করতে গেলে রোজই হাতির খোরাক জোগাতে হবে, মানে হতো- যদি কেউ ভুলেও ভাবত হোক না বেঢপ মোটাসোটা, কিন্তু মুখটা, চোখ দুটো এত মায়াভরা আর চুল …।

সে যাক, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, মহিলার রসবোধ উঁচুমানের। শায়লা যখন তাকে নিয়ে নানা রকম টিটকিরি দেয়, আড়াইমণি বস্তা বলে, নীতু খালা গা দুলিয়ে হাসে আর হাসে। এত হাসো কেন বলো তো? হাসির কী হলো!

জবাবে আরও দুলে দুলে হেসে বলে, স্কুলে পড়তে আমাকে ফাজিল ছেলেরা কী ডাকত জানিস? কুমড়া। কুমড়া নিয়ে একটা ধাঁধাঁ আছে- ঘাড় নাই গর্দান নাই, পেট নাই পিঠ নাই, মা গো বলি দেই ঘপ্পাৎ। ওরা অবশ্য কুমড়া না, আমাকেই মিন করত।

মাঝে মাঝে আবার অদ্ভুত কথা বলে- আমার সঙ্গে বেরুতে তোর লজ্জা লাগে, না? দুর, লজ্জা-টজ্জা পাবি না। মনে করবি কুমড়ার পেছনে তুই একটা চিকন ছিলকা। হাঃ হাঃ।

নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা, তাও এত মজা করে, এ নিশ্চয় একটা ক্ষমতা। আর ঠাট্টা-তামাশার মূল বিষয় তার বেঢপ শরীর। শায়লা এত করে বলে- খাওয়াটা কমাও। এই যে রুটির ওপর তিন ইঞ্চি বাটার আর চিজ লেপে খাচ্ছ, বাটিভর্তি খাসির পায়া, সুতি কাবাব আর কাচ্চি বিরিয়ানি পেটে চালান করছ; মরে যে যাবে দুম করে। হার্টের আর্টারি সবক’টাই হয়তো ব্লক হয়ে আছে। বলা যায় না, খাওয়ার টেবিলেই পট করে মরে যেতে পার; ভয় করে না?

মরা নিয়ে ভয়-ডর বাদ দিয়ে নীতু খালার জবাব- না খেয়ে তোদের মতো শাঁকচুন্নি হওয়ার শখ নাই আমার। খাওয়ার তুই কী বুঝবি? খেয়ে কী শান্তি, যে খেতে জানে সে বোঝে।

অমিত আসেনি কয়েক দিন। সেমিস্টার ব্রেক, বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবান গেছে বেড়াতে। শায়লাকে বলেছিল, যাবে নাকি। লোভ হয়েছিল প্রস্তাব শুনে; পরে ভেবেচিন্তে ‘না’ করেছে। নীতু খালার কথা ভেবেই করেছে। এমনিতেই নীতু খালার মনে একটা খচ্‌খচ্‌ অমিত ও তাকে নিয়ে। অকারণে খচ্‌খচানিটা বাড়তে দিয়ে কী লাভ! আর দলেবলে হৈ-হুল্লোড় বেশিক্ষণ তার ভালোও লাগে না।

কিন্তু নীতু খালার মাথায় অমিত ঠিকই আছে। ছেলেটা আসছে না কেন রে?

-কে?

-ন্যাকামি করবি না, তোর প্রেমিক।

-তুমি না বললে- ও আমাকে মেনটেন করতে পারবে না?

-তো …

-তালাক দিয়ে দিলাম। মেনটেনই যে করতে পারবে না, শাড়ি-গয়না পরাতে পারবে না, পেট ঠেসে খাওয়াতে পারবে না, তার সঙ্গে আবার কী! কাটাকুটি হয়ে গেছে। ভালো করিনি?

নীতু খালা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কী না কী বললাম, আর তুই সত্যি ধরে নিলি?

-ধরব না মানে! তোমার মতো আমার আপনজন কে আছে যে এভাবে বুদ্ধি দেবে! আমাকে যে ভালোমতো খাওয়াতে পরাতে পারবে, তার সঙ্গেই তো সম্পর্ক পাতব; ঠিক কী না?

-ফাজলামি রাখ। কী হয়েছে বল।

-বললাম তো- তালাক।

– ফাজিল ছেমড়ি।

নীতু খালা এত বোকা না যে তার কথা বিশ্বাস করবে। আর শায়লাও আস্ত গবেট না যে ভাববে, নীতু খালা তার কথা আমলে নেবে। সে জন্যই নীতু খালা কি তাকে সহজে ছাড়ে! বল্‌ না, ও আসে না কেন? অভিমান করেছে? নাকি তুই করেছিস? বল্‌ না, কী নিয়ে তোরা অভিমান করিস?

প্রশ্নটা এত আন্তরিক, ঠাট্টা ভুলে শায়লা থতমত খেয়ে তাকায়। একি কেবলি কৌতূহল, না এর আড়ালে রয়েছে চাপা দীর্ঘশ্বাসও?

শায়লা নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বুঝতে পারে না, নীতু খালা তার মুখ থেকে কী শুনতে চায়। অমিতের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তাতে মান-অভিমান জাতীয় ব্যাপারস্যাপার নেই। কিন্তু সেই যে সে বলেছে- ভালোবাসে; এর কারণেই কি নীতু খালা আগ্রহী হয়ে পড়েছে তাদের সম্পর্কের অন্ধিসন্ধি খুঁজতে? একটা বানোয়াট সম্পর্ক নিয়ে তার ইচ্ছা হয় না নীতু খালাকে অযথা ফাঁপরে ফেলে।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শায়লা চমকে ওঠে। আশ্চর্য! নীতু খালা কেন তার কাছ থেকে জানতে চাইবে? কৌতূহলীই বা কেন হবে? সে একটা গবেট বলেই নীতু খালা যে তাকে নিয়ে খেলছে, বুঝতে পারেনি।

-বলবি না কী নিয়ে তোদের মান-অভিমান?

-তাহলে শোনো, অমিতের ব্যাপারে তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। ওর সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ক্লাসমেট, আর হ্যাঁ বন্ধুও, ব্যস্‌। আমার সে রকম কেউ থাকলে কি তোমাকে লুকাতাম? আমার কেউ নেই নীতু খালা। বিশ্বাস কর, কেউ নেই। যদি থাকত, তোমার মতো হতে পারতাম, তোমার মতো সুখী, তোমার আছে তাই।

-কী বললি!

-ভুল বললাম?

– রাগ করো না। মন্টু মামা আছে না তোমার!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত