প্রেমের সীমা পরিসীমাহীন মনচক্কর

হালকা কুয়াশার প্রচ্ছায়া টেনে সোডিয়াম বাতির জলে স্নাত হতে হতে রূপা ক্যাম্পাসের দিকে এগোতে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে বইমেলায় ঘুরেছে বিস্তর। প্রিয় লেখকের বই কিনে বেরিয়ে আবিস্কার করে, এক সময় সবাই যে যার মতো টাটা করার পর তার সঙ্গে কেবল সোলেমান হাঁটছে।

হালকা বাতাসের ঝাপট ওঠে… তা-ই ঢেউ খেয়ে ঘাই খেয়ে পাশের রমনার বনভূমি থেকে অরণ্যের ঘ্রাণ এনে কিছু সময়ের জন্য রূপাকে বিমূঢ় করে দেয়।

‘শীত লাগছে?’ সোলেমানের কণ্ঠ কাঁপে, ‘আজ শাল আনলে না যে?’

হিম হিম হালকা বাতাসে রূপার ওড়না উড়ে উড়ে কোথায় যে যেতে চায়, কিন্তু আটকা পড়ে থাকে কণ্ঠের সঙ্গেই, রূপারই মতো।

এই ভার্সিটি, এই ক্যাম্পাস, এই হোস্টেল-জীবন নিয়ে একদা অনন্ত কৈশোরে দ্রুত অফুরন্ত স্বপ্নের উল্লল্ফম্ফনে রূপা ফলসাপাতার শিশিরের মতো একই অনুভবে কাঁপত… প্রেম! যেন কোনো মনুষ্য-মায়ের গর্ভে রূপার জন্মই হয়নি। প্রেমদেবী আফ্রিদিতির কন্যা সে। তাই তার সমস্ত জাগতিক কথা তার কাছে নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে থাকত নানা রকম প্রেমানুভূতির মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করে করে। তার এই প্রবণতা তার একান্ত গোপন নিজস্ব এমন এক বিষয়, যার সঙ্গে নিরন্তর একাই লড়ছে; পুড়ছে রূপা।

আজ হোস্টেলে যাবে না। ভার্সিটির কাছেই মামাবাড়িতে থাকবে ক’দিন। বিয়ের জন্য কিছু ছেলের সঙ্গে তার দেখা করার ব্যাপার আছে সেখানে।

হাঁটতে গিয়ে পা শ্নথ হয়ে যায়। ছাতিম ফুলের অথই গন্ধ কোন পাহাড়ের ওপার থেকে যে উড়ে আসে, কলজে মুচড়ে হু হু কান্নায় ভেসে যেতে ইচ্ছা হয় রূপার।

‘কী হয়েছে, থামলে কেন?’ সোলেমানের কণ্ঠ উদ্বিগ্ন।

কিছু না, নিজেকে সন্তর্পণে থামিয়ে রূপা পা বাড়ায়।

‘প্রিয় লেখকদের দেখা পাওনি বলে মন খারাপ?’

‘আরে না না…।’ রূপা হাসে, ‘এর জন্য মন খারাপের কী আছে, চলো রিকশা নিই। নইলে দেরি হবে?’

দুই

সন্ধ্যা হলে কী হয় রূপার, প্রেমের জন্য প্রাণটা উন্মুখ, ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে এক গহিন বেদনার মোচড়ে রূপার আত্মায় আকুল বেদনার জল তোলপাড় শুরু হয়। না, সূর্য ডুবছে, দিন মরছে, এ জন্য কখনোই নয়। সন্ধ্যা এলেই সে ইউক্যালিপটাসের দূরবর্তী গাছের নিচে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। হাতের গিটারটা শিথিল করে নামিয়ে প্রিন্ট শার্ট-টাইট জিনন্স পরা সেই যুবকটির দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি গভীরভাবে রোমাঞ্চিত করে রূপাকে। দৌড়ে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছা করে তার বুকে।

কখনোই সেই যুবকের মুখ একজনের ছিল না।

আজ বিকেলেই প্রকৃতির আজব কুহক-গন্ধ বিলোড়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো রিস্কি জায়গায় সোলেমানের চুম্বন, দেহঘনিষ্ঠ হয়েছে। ফেরিওয়ালাদের অত্যাচারে, বখাটের টিপ্পনীতে দফায় দফায় বিব্রত হয়েও।

সোলেমানকে কখনো মনে ধরেনি রূপার। টানা দীর্ঘ নিঃসঙ্গ দিন-রাত্রি যাচ্ছিল জীবনে। ম্যাড়মেড়ে জীবনে সোলেমানই এসে একমাত্র কাঁপত তার সামনে, ব্যাকুল তাকাতো, আর রূপার সম্মতির জন্য মরি-মরি হতো।

ওর নগর অরণ্যের বিকেল স্পর্শের অনুভূতি চামড়ার ওপর দিয়েই গড়িয়ে গেছে। কান্না পেতে থাকে রূপার। থই থই আকুল প্রেমের ভাসমানতা ছাড়াই আত্মাবর্জিত অনুভূতি নিয়ে এমনই কারও সঙ্গে ফুলশয্যা হবে তার? সে কবে এমন ফুরাতে শুরু করেছে?

ভার্সিটির হোস্টেল ছেড়ে সাময়িকভাবে মামার বাসায় এসে ওঠার পর দিন-রাতগুলো যেন এগোয়ই না। অথচ মফস্বলে থাকতে কী দুর্মর স্বপ্ন-প্রতীক্ষায় দিন কাটত! কৈশোর থেকে ভাবত, যেসব ছেলে কোনো মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেই দেহ-আত্মায় ছুমন্তর অগ্নি তোলপাড় শুরু হয়, তার দেখা একমাত্র রাজধানীতেই মিলবে। ঢাকা ভার্সিটিতে একবার চান্স পেলে তো কেল্লা ফতে। তখন কী করবে সে তার এই এক দেহ আর এক আত্মা নিয়ে?

‘তুই প্রেমিক পাওনের জন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হইতে চাস?’ হি হি হেসেছিল শিউলী, ‘আমি পড়নের লাইগ্যা চান্স পাইলেই জীবনরে ধন্য মনে করতাম। আজব মাইয়া তুই, পড়তে যাওয়াটা অছিলা মাত্র?’

জলের মধ্যে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে আত্মবুঁদ রূপা বলেছিল, ‘তুই বুঝবি না, ব্যাপারটা অত খুল্লামখুল্লা সিধা না।’

‘তুহিন ভাইয়ের কী হইব? তারে তুই ক্যামনে কী বুঝাইবি?’

‘ওর তো এ্যাদ্দিনে বুঝার কথা। প্রেমে পড়ার কিছুদিন যাইতেই স্বামীগিরি শুরু করছে- এই করবা না, ওই করবা না। কথায় কথায় মর্দাঙ্গী। যে-ই উল্টা হাঁটছি, তখন পয়লা হম্বিতম্বি, এরপর এক্কেবারে গইল্যা…। কত অ্যাভয়েড করি, অত ছ্যাঁচড়া জানলে জিন্দেগিতে ওর প্রেমে পড়তাম না।’

‘কী কইতেছস রূপা!’ শিউলীর কণ্ঠে মহাবিস্ময়ের ধ্বনি কলকল করে, ‘অথচ এক সময় তুহিন ভাইরে পাইবার লাইগা তোর যে কী দিন-রাইত আছাড়ি-বিছাড়ি কষ্ট…। আমি ভাবছি, ভার্সিটির ব্যাপারটা ইয়ার্কি। সমস্যা তোর, আর তুই তুহিনরে এই দোষ দিয়া ভাগতেছস যে তার খালাতো বইনের সঙ্গে তার অ্যাফেয়ার? তুই -।’

স্তব্ধ শিশিরে কান পেতে বিমূঢ় হয়ে ছিল রূপা। অস্টম্ফুটে বলেছিল, ‘যা খুইলা বলছ, খুইলা বুঝস, জীবনের গভীর অনুভূতি এ রকম না। এ এক আজব রহস্য, যা আমি নিজেও যখন পুরাটা বুঝি না, ততক্ষণ বেদন, ততক্ষণ স্বপ্ন-হাহাকার। যারে নিয়ে এই মরণ উড়াল পাড়াল কষ্ট, তারে না পাইলে মরণ…।’

‘আর পাইলে?’ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে শিউলী।

‘তারে কখনো পাওয়া যায় না, আমি পাই নাই।’

‘কসম রূপা, মিথ্যা কইবি না। আমি দেখছি তুহিন ভাইরে নিয়া তর মরণ হাহাকার দশা, এখন -।’

‘নির্ঝর ভাইয়ের আবৃত্তির কণ্ঠটা কী চমৎকার, না?’ রূপা প্রসঙ্গ পাল্টায়। ‘আবৃত্তি শিখতে নিজের আঞ্চলিক টান তার কাছে গিয়া ঠিক করতে করতেই নিজেরে পেতপেতা বানায়া ফালাইছি। অহন যত সুন্দর মুগ্ধ কথাই কই তার সঙ্গে, সে যখন গভীর চোখ নিয়া তাকায়, নিজেরে নিঃস্ব লাগে। মনে হয়, একটা গাঁইয়া মেয়ের দৈন্যের দিকে সে তাকাইতেছে। নিজেরে অন্যের সামনে তার চাইতে সুন্দর আর যোগ্যময় না লাগলে প্রেমের নূ্যনতম অনুভব যে নিজের মধ্যেই মইরা যায়।’

‘এর মধ্যে নির্ঝর ভাই কখন আইসা ঢুকল?’

‘তুই বুঝবি না। কেউ ঢোকে না, কেউ বাইর হয় না… কখন ঢোকে, কখন যায়!’

এসবই কথা হয়েছিল ঢাকায় আসার আগে আগে। কিন্তু সে যখন ক্লাস নাইনের পরীক্ষা শেষে একই শহরের ঢাকাগামী রোডের চাচাতো বোন এই শিউলীর বাড়িতেই বেড়াতে এসেছিল, তখন এমনই এক সন্ধ্যায়, শিউলীদের বাড়ির সামনের দুনিয়া বিস্তৃত করে থাকা ছাতিম গাছটার নিচে একাকী দাঁড়িয়ে হেমন্তের প্রচ্ছায়ার রূপ বদলে নিবিষ্ট চোখ মেলেছিল। আসলে সে ভেতরে-বাইরে পাগল করা ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে যতটা না আকুল, তার চেয়ে হাজার গুণ আকুল বোধ করছিল টিভিতে দেখা এক মডেলের জন্য। দুর্দান্ত স্মার্ট নতুন এক মডেল। এমন সুন্দর ছেলে এদেশে আছে? ভাবতে ভাবতে তাতেই অন্তরাত্মা ভূমণ্ডলে এমন টান পড়ল, কান্না পেতে লাগল তার, বাবা-মা মরলেও তাকে ওসব মিডিয়া জগতে পা রাখতে দেবে না ভেবে। তার বড় বোনকে এ নিয়ে কম যুদ্ধ করতে দেখেনি। টিভি অভিনেত্রী হতে চেয়েছিল সে, কিন্তু মা গলায় দড়ি দেওয়ার এমন নাটক করলেন, বোন তিন বাচ্চা নিয়ে এখন দুলাভাইয়ের বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলছে। বাবা-মায়েরা পারেনও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করতে!

ছাতিম গাছে পাখি ডানা ঝাপটাল না কী হলো, আচমকা চমকে ঠিক সন্ধ্যায় রূপা দেখল শাঁই শাঁই শব্দে একটি হোন্ডা আসছে তার শহর থেকে। ছাতিম গাছটার নিচে স্টার্ট থামিয়ে হেলমেট খুলতেই যেন খোলস ভেঙে ঝাঁক ঝাঁক চুলের ফরসা মুখের এক রাজকুমার বেরিয়ে এলো। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল বিন্যস্ত করার চেষ্টা করতে করতেই সে রূপাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এক্সকিউজ মি, সামনে গেলে দুটো পথ। কোন পথটা ঢাকায় গেছে, বলতে পারেন?’

পুরো ব্যাপারটিই সিনেমায় অথবা স্বপ্নে ঘটছে- এই বোধে আচমকা তুমুল শিহরণে উল্লল্ফিম্ফত অন্তরাত্মা এক্কেবারে দমবন্ধ স্তব্ধতায় বেকুব বনে গেল রূপার। হাত উঠিয়ে কিছু বলতে চাইল রূপা, ভাষায় তা মূর্ত হলো না।

‘সরি, বুঝলাম না কী বললেন?’ ধূসর আলোয় ছেলেটির ঘন পাপড়ি চোখ স্বপ্রশ্নে ঘনীভূত হয়, ‘আসলে একটা কাজে আজই প্রথম এলাম এ শহরে। যাওয়ার পথটা গুলিয়ে ফেলেছি।’

কার্তিকের হালকা শিশিরে ছাতিমের গন্ধে স্থবির পায়ে স্ট্যাচু হয়ে যায় রূপা। ইতিমধ্যে অন্য কেউ এসে ছেলেটাকে কী বুঝিয়ে গেলে ফের হেলমেট পরে বিশাল সৌন্দর্যময় বাইকটিতে স্টার্ট দিয়ে পুরো শহরে ধুলো ছড়িয়ে, বাতাস উড়িয়ে যেন অনন্তের পথে চলে যায় ছেলেটি।

মাঝরাত অবধি শিউলী বকবক করেছে আর নিথর পড়ে ছিল রূপা, টিভিও চলছিল। বিজ্ঞাপন এলেই শিউলী ‘তোর হিরো তোর হিরো’ বলে চিল্লালে অসাড় চোখে তাকিয়ে হাঁপ ছেড়েছিল সে। এখন সে নিশ্চিন্তে টিভি দেখতে পারবে।

এর পর টানা ক’দিন ঘরের কাজে ও ক্লাসে যেন বাইকের গর্জন নয়, কানের কাছে হাজারো বাজনের নিকস্ফণ ধ্বনির অনুরণন। চোখ বুজলেই বাইকের পেছনে রূপা কম্পিত, শিহরিত জাপটে ধরে থাকত কোমর… ছেলেটা তাকে নিয়ে দাউ দাউ বাতাসে উড়তে উড়তে কখন কোথায় যে নিয়ে যেতে থাকে! কখনও অরণ্যে, তেপান্তরের মাঠে, সমুদ্দুরের বালিয়াড়িতে রূপাকে শুইয়ে প্রগাঢ় চুম্বনে রূপার শরীরের এক এক ভাঁজ খুলতে থাকে। দিনরাত জ্বর জ্বর বোধে কাঁপতে থাকে রূপা।

এ এক অলৌকিক ব্যাপার। এসবের মধ্যেও ক্লাসে বরাবর ভালো রেজাল্ট করে রূপা। তার মনে হয়, সে নয়, তার মধ্যে বাস করা অন্য এক শক্তি তার পরীক্ষাগুলো দিয়ে দেয়। নিজের ভেতর প্রেম নিয়ে এমন উথাল-পাতাল জোয়ার অনুভব করে ভেতরে ভেতরে লজ্জিত রূপা কীভাবে যেন দিনের পর দিন নিজের বাইরে এক বর্ম তৈরি করে ছদ্মবেশী হতে শিখেছে। কখনও কারও প্রেমে পড়লে সে ভেতরে যত কাঁপে, তত মুখে শক্ত এক তাচ্ছিল্য নিয়ে তার সামনে চলাফেরা করতে পারে। সে নয়, তার ভেতরে বাস করা সেই শক্তি বাবা-মায়ের সব কাজে সাহায্যের হাত বাড়াত। ফলে রূপা বাবা-মায়ের কাছে চিরকাল তাদের ‘লক্ষ্মীকন্যা’ হিসেবে স্বীকৃত।

শৈশব পেরোনো সময়ে নিজের মধ্যে প্রথম প্রেমের এক মহা আগমনধ্বনি টের পায় তখন, যখন জানালা দিয়ে দেখে হু হু পথ পেরিয়ে এক যুবক তার বাড়ির দিকে আসছে। তখনও সন্ধ্যা ছিল। বৃষ্টিতে গোসল শেষে প্রকৃতি তার চুল ঝাড়ছিল। কলেজে একসঙ্গে পড়া বড় আপার ক্লাসমেট সুলতান ভাই এক সময় তার গাল টিপে যখন জিজ্ঞেস করে, ‘খুকি, তোমার নাম কী?’ তক্ষুণি যেন হুঁশ ফিরে পায় রূপা। কী যেন এক বোধে-ক্রোধে-ক্ষোভে চোখ-গাল মুছে সে গটগট পায়ে ভেতর ঘরে পা বাড়িয়েছিল।

বড় আপার প্রেম পরিণতি পায়নি। বিএতে দু’বার ফেল করলে বড় আপার বিয়ে হয়ে যায়।

ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রথমে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে থাকত যত, তত তার ছদ্মবেশী সত্তা গটগট হাঁটত। রূপার নাকে-ইন্দ্রিয়ে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ আর নিরন্তর চোখ ঘূর্ণমান, এই শহরে যদি সেই যুবকের দেখা মেলে! অনন্ত সময় বাইকের শব্দে তার হার্টবিট বন্ধ হয়েছে। এসব চক্রাবর্তে এক সময় ভার্সিটির জীবনে ‘তুই-তুকারি পিঠ-থাপড় মার্কা বন্ধু-বন্ধুময় প্রেম’ দেখতে দেখতে জীবনের সব রহস্য হারিয়ে ভেতরে একাকী হয়ে যায় রূপা। এর মধ্যে দেখতে শ্যামলার মধ্যে মিষ্টি রূপা আচমকা এক সন্ধ্যায় ভার্সিটির প্রোগ্রামে এক যুবককে গান গাইতে দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে। এক সময় ছদ্মবেশে নানা সূত্রে জানা-না জানার ভান করে রূপা তার নিজ আবৃত্তি-জ্ঞানের গুণে ছেলেটির নিকটবর্তী হলে ছেলেটি তাকে আমূল কাঁপিয়ে বলে, ‘ভুল দেখছি না তো? তুমিই অভিনেত্রী নন্দিতা দাশের জুনিয়র ভার্সন, না?’

এর পর হাওয়া।

রূপার দিনজাগরণের মধ্যে ঢুকে যায় পৃথিবীর সব শূন্যতার রোদন। কী ভাগ্য রূপার, আরেকটি অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে ছেলেটির সঙ্গে ফের যোগাযোগ হয় তার। প্রেম হয়, চুম্বন হয়… পিঠ-বুকে উন্মাদময় হাত চালাচালি হয়। উষ্ণ বিদায়ের পরও কখনও চলতে চলতে, হোস্টেলে ঠাসাঠাসি রুমের আঁধারে রাত জেগে ফেসবুকে কথা-চুমু চালাচালি হয়…। কিন্তু দূরবর্তী অলৌকিক ছেলেটি যখন নিজের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে রাত-দিন রূপার মোবাইলে ফোন দিয়ে তার মনযন্ত্রণা ও আর্থিক দৈন্যের কথা জানাতে থাকে, ভেতরে ভেতরে সব অনুভব মরে যেতে থাকে রূপার। অথচ প্রথম যখন সেই ছেলে ‘ইয়েস’ হয়ে রূপার হাত ধরেছিল, রূপার মনে হয়েছিল, এই প্রথম এমন চোখে কেউ তাকে দেখল, তার যা কিছু সুন্দর, সেসব প্রথম আবিস্কার করল কেউ। এটা ঠিক, রূপা যখন যার প্রেমে নিজে আগে অভিভূত হয়েছে, সে রূপার দিকে তাকালে, তার কিছুকে সুন্দর বললে সব অতীত বিস্মৃত হয়ে রূপার মনে হয়েছে, এ-ই প্রথম এত নিখুঁত তার সত্যিকার সৌন্দর্য কেউ দেখল; এর আগে এভাবে তাকে কেউ দেখেনি। এর মধ্যে রূপার কোনো হাত থাকে না, যুক্তি থাকে না। কিন্তু ভার্সিটির সেই গানওয়ালা যুবকের জন্যও এখন তার মায়া লাগছে। রূপা বিরক্তির সঙ্গে সঙ্গে ওর যাতে কষ্ট না হয়, ওর জীবন থেকে সরে আসার জন্য কী বলা যায়, পোক্ত কারণ খুঁজতে থাকে। কী করবে রূপা, অর্থ আর প্রেম টানাপড়েনে গানের প্রতি অমনোযোগী হয়ে অনিয়মের চূড়ান্ত করতে থাকে সে। ওর বিবর্তিত ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠ, ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলে সিগারেট কিনতে রূপার দিকে হাত বাড়ানো, নির্দি্বধায় রিকশা থেকে নেমে রূপার কাছে ভাড়া চাওয়া, এসব রূপাকে টানে না। যেন কাঙ্ক্ষিত দূরবর্তী প্রেমিকগুলোর কাছে এসে মিশতে শুরু করলেই একেবারে ডাল-ভাত ব্যবহার শুরু করে? এখনকার প্রেম কি এমনই? রূপা নিজেই কি তার দশক পেছানো নারী।

রূপা ধীরে ধীরে নিজেকে বিন্যস্ত করে ক্রমেই অসহায় বিপন্নতায় গানওয়ালার হাত ধরে, অস্টম্ফুটে বলে, ‘বাড়ি গেলে তোমার সঙ্গে আমার প্রেমের কথা শুনে মা গলায় দড়ি দিয়েছিল। আমি কসম কাটলে মা দরজা খুলেছিল। বাবার বন্ধুকে বাবা শৈশবেই কথা দিয়েছিল। ছেলেটা বিদেশ থাকে…।’ বলতে বলতে রূপা গানওয়ালার কষ্ট অনুভব করে কাঁদে, ‘বাংলা সিনেমার মতো টিপিক্যাল অবস্থায় আমি পড়ব- কল্পনাও করিনি।’

এর পরও বহু আছাড়ি-বিছাড়ির বেশ বয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সব স্তিমিত হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একদিন রূপা দেখে, গানওয়ালা অন্য মেয়ের কোমর ধরে হাঁটছে। এক সময় পুরনো প্রেমিক ‘দোস্ত’ হয়ে যায়, রূপার অভিজ্ঞতা বাড়ে।

এই জীবনে রূপাও একতরফা এক-দুবার প্রেমে পড়েছে, ছটফট করেছে কিন্তু প্রকাশ করেনি। তবে গত দুই মাস ধরে ভার্সিটির এক টিচার তাকে উন্মাদপ্রায় করে তুলছে। অ্যাক্সিডেন্টে বাবা শয্যাশায়ী। রূপার বিয়ের তাগাদা চলছে। তার সহপাঠী সোলেমান নিজেই তার পরিবারের একমাত্র ভরসা। ওকে রূপা নিজের জীবনের কোনো বিলোড়নই না জানিয়ে যেভাবে চলছে ওর সাথে চলে। কিন্তু টিচারের প্রতি উন্মাদ অনুভূতিতে এখন বইয়ের অক্ষর ঝাপসা লাগে রূপার। জ্বর জ্বর বোধে মনে হয় মরেই যাবে। ক্লাস করবে পরীক্ষা দেবে কী, টিচারের এক ঝলক হেঁটে যাওয়া, একটু কণ্ঠ শোনার প্রত্যাশায় এখন ব্যাকুল থাকে রূপা। এই প্রথম ছদ্মবেশ ভাঙে। সবার সামনে ধরা খেতে থাকে রূপা। নিজেকে নগ্ন বোধ করে, কিন্তু টিচারের তাচ্ছিল্যভরা বিরক্তির চাহনি তাকে মহাকুয়ার জলে দিনরাত চোবাতে থাকে। ফিসফিস কাঁদে সে, ‘এই প্রেম এই অনুভূতি জেনুইন। আমি এখন একজন ম্যাচুর্ড মেয়ে, দু’দিন পর অনার্স পাস করব। এটা কাঁচা আবেগের উল্টিমারি কোনো ব্যাপার না। আমি কোনোদিন কাউকে নিয়ে এই অনুভূতিতে পুড়িনি, কোনোদিন পুড়িনি। কেন যে নিজের কাছেই রাখাল গল্পের নায়ক আমি… টিচারের অগ্রাহ্যে দিনরাত সবার সামনে এখন ধরা খাচ্ছি… ওহ্‌ গড!’

সোলেমান বলে, ভেঙে পোড়ো না। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। মানুষের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, উল্টাপাল্টা কথা বলে।

এর মধ্যে চায়নিজে, আড়ংয়ে কিছু ছেলের সঙ্গে পারিবারিক সোর্সে দেখা হয়েছে। মামি যাচাই-বাছাই করছেন।

জানালার ওপারে রাত নেমে এলে ভার্সিটি, টিএসসির দূর ক্যাম্পাসের ছায়ার দিকে তাকিয়ে সহসা বাইকের ধ্বনি শোনে রূপা। আচমকা আসা ছাতিমের গন্ধ তাকে উন্মাদ করে ফেলতে থাকে- ‘কেন আমি এমন, কেন আমি এমন?’ অসহায় ক্রোধে নিজের মধ্যে গুমরায় রূপা।

‘খুকি, তোমার নাম কী?’

কষে গাল মুছে আচমকা চোখ বাড়ায়। জানালার ওপাশে একটি পথ খুলে যায়, শৈশবের কচিমাটির ঘাস মাড়িয়ে কেউ হেঁটে আসতে থাকে।

কূল-দিশা হারানো রূপা সহসা সুলতান ভাইয়ের জন্য হু হু কেঁদে রাত্রি-অঞ্চল ভাসিয়ে দিতে থাকে।

চারদিকে নৃত্য করে বাইকের সন্’র… ছাতিমের সুতীব্র ঘ্রাণের আচ্ছন্নতা…।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত