জেলেপাড়ার সবচেয়ে দক্ষিণ দিকের ঘরটা যোগেন খুড়োর। আর তা একেবারে রাস্তার কাছে। ওই দিক দিয়েই পাড়ায় ঢুকতে হয়। কেউ পাড়াতে ঢুকলেই খুড়োর ঘরটা ডানে রেখে এগোতে হয়। সারাদিন খুড়ো একটা মাদুর নয়তো চৌকি পেতে ঘরের বারান্দায় বসে থাকে আর কারো পায়ের শব্দ শুনলেই কেশো খরখরে গলায় ‘কিডা আসলি রে’ বলে খেঁকিয়ে ওঠে।
অচেনা কেউ হলে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, আর পরিচিতজনেরা তাদের নাম আর ‘কেমন আছ খুড়ো’ বলে কুশল জিজ্ঞাসা করে যার যার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ ‘কিডা আসলো তা দিয়ে তুমার দরকার কী? সারাদিন ঠ্যাং চ্যারায়ে হাতনেয় বসে হোলে বাতাস লাগাও, নয়তো পাছার দাঁদ খোটো, আর কিডা গেল কিডা আসলো খালি তার হিসেব-কিতেব অরো। তুমার অত দিয়ে দরকার কী?’ বলে বুড়োকে তাতিয়ে দেয়। তবে এ কথাগুলো একান্ত নিজের জনরাই বলে থাকে। কারণ যোগেন খুড়ো চোখে দেখে না, ছানি পড়েছে, বেশ আগে থেকেই সে আর মাছ ধরতে যেতে পারে না। কিন্তু একসময় সে-ই ছিল এই পাড়ার সবচেয়ে দক্ষ জেলে। গায়ে তাকত ছিল কী! হাত-পায়ের গোটাগুলো ছিল কালো আর শক্ত। ধুতি কাছা দিয়ে নৌকার উপর দাঁড়িয়ে জাল ফেলে যখন টেনে তুলত তখন তার হাতের পেশিগুলোর ওঠানামা ছিল দেখার মতো। মনে হতো দুনিয়ার সমস্ত শক্তি তার ওই পেশির মধ্যে সঞ্চিত আছে। নদীতে জাল ফেলে সে ইয়া বড় বড় সব মাছ ধরে আনত। হাটে বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে খেয়েদেয়ে ভালোই চলে যেত। কিন্তু সঞ্চয় বড় একটা থাকত না। আর এইসব মানুষ সঞ্চয় কি তা বোঝেও না। যখন হাতে টাকা থাকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত খরচ করে চলে, আবার যখন থাকে না উপোস করে। খুড়োর ছেলে সদানন্দ এখন সংসারের হাল ধরেছে, কিন্তু সে বাপের দক্ষতা পায় নি। তা নিয়ে খুড়োর আফসোসের সীমা নেই। আবার এ-ও ভাবে, এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। সব কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। তার সময় নদী-খাল-বিলে মাছ বেশি ছিল। শুকনোর সময় তো সদানন্দ মাঝে মাঝে রিকশা চালায়। না হলে সংসার চলে না। নিজে কিছু করতে পারে না বলে খুড়ো মনঃকষ্টে ভোগে। ছেলের ঘাড়ে বসে বসে খেতে তার ভালো লাগে না। ছেলের মা তাকে ছেড়ে গেছে অনেক বছর বৌমার ওপর ছেড়ে দিয়ে। তার মুখঝামটা, কটুকথা হজম করতে হয় বটে তবে দুটো ফুটিয়ে বেড়েও দেয়, কারণ জেলেপাড়ায় তার একটা সম্মান আছে। সবাই তাকে মুরুব্বি মানে, তার কথার একটা দাম দেয়। অনেকটা গোত্রপিতার সম্মান নিয়ে আছে যোগেনখুড়ো।
সেদিনও সন্ধ্যার সময় খুড়ো তার মাটির ঘরের বারান্দায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগে তার বেটার বউ সুলতা এসে সন্ধ্যাবাতি দেখিয়ে গেছে। চোখে ছানির কারণে সেই আলোর ঔজ্জ্বল্য কিছুটা সে বুঝতে পেরেছে কি পারে নি। চুপচাপ বসে থেকেছে, নাতি-নাতনি দুটো এসে পাশে বসেছে, আবার তার মার ডাকে উঠে চলে গেছে। থেকে থেকেই খুড়োর পায়ে মশা কামড়াচ্ছে, আর অন্ধকারে কামড়ের জায়গাটা অনুমান করে সে কষে চড় মারছে। সে চড়ে মশা মরছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, তবে মাঝে মাঝে ঠাস ঠাস শব্দের সাথে খুড়োর উহ-আহ্ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় জেলেপাড়ার বিষ্টু এসে খুড়োর পাশে বসল। একটা বিড়ি ধরিয়ে খুড়োর মুখে গুঁজে দিয়ে পুরো প্যাকেটটা তেল চিটচিটে বালিশের কাছে রেখে বলল, ‘পরে টেনো।’ চোখে না দেখলেও গলা শুনে খুড়ো ঠিক তাকে চিনে ফেলল এবং সেই পরিচিত খরখরে কেশো গলায় অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে বলল, ‘কি রে তুই আবার কি ধান্দা নিয়ে আসলি?’
বিষ্টুকে এ পাড়ার সবাই ধান্দাবাজ বলেই জানে। কাজকাম বলতে ধান্দাবাজি। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল সে করে না, সে বিদ্যেবুদ্ধিও নেই। অবশ্য আজকাল তার আর তেমন দরকারও হয় না। কিন্তু যারাই ক্ষমতায় থাকে সে তাদের আশপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করে। নেতাদের চামচাগিরি করে, তাদের ফুটফরমাশ খেটে টু পাইস কামিয়ে নেওয়াই তার কাজ। তবে ইলেকশনের সময় তার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। কার পাল্লা ভারী আগেভাগে তা আঁচ করে তার পিছন পিছন ঘুরে বেড়ায় আর জেলেপাড়ার সব ভোট পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ভোটের আগে যা পারে হাতিয়ে নেয়। সবসময় তার অনুমান মিলে যায় এমন নয়, তবে না মিললেও ক্ষতি নেই, সে দ্রুতই বিজয়ী প্রার্থীর ঝাঁকের সাথে মিশে যায়। গতবার নির্বাচনে সে যে প্রার্থীকে সাথে নিয়ে ভোট চাইতে এসেছিল সে খুড়োকে সামনে রেখে সমবেত জেলেদের উদ্দেশে বলেছিল, ‘গ্রামের রাস্তা পাকা হবে, বড় রাস্তা থেকে গ্রামে ঢুকতে যে খাল তার ওপর ব্রিজ হবে, গ্রামে বিজলি বাতি আসবে, এই জেলেপল্লীর প্রতিটি খড়ের ঘর টিনের ঘর হবে, নদীতে মাছ ধরতে গেলে যে চাঁদা দিতে হয় তা বন্দ করা হবে; আমরা উন্নয়নে বিশ্বাস করি, আর এ-ও জানি সাধারণ মানুষের উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি হবে না।’ কড়া মাড় দেয়া পাঞ্জাবির হাতা গোটানো নেতার কথা বলার সময় গলার রগ ফুলে ফুলে উঠছিল, চোখদুটো ক্রোধে-উত্তেজনায় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছিল, আর কথা বলার সময় থেকে থেকে তার মুখ দিয়ে পিচকারির মতো থুথু ছুটছিল।
এসব কথা খুড়োর কাছে নতুন কিছু নয়। আগেও অনেক শুনেছে, বরাবরই শুনে থাকে। তাই সে চুপ করে ছিল। তাৎক্ষণিক কিছু বলেনি। খুড়োর মতিগতি বুঝেই কি না কে জানে বিষ্টু তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিল, ‘শোনো খুড়ো, ইলিকশানে যদি আমাগের দল ক্ষমতায় যায় পেথথমেই গিরামে যে চক্ষুশিবির হবে সেহানে নিয়ে যায়ে তুমার ছানি কাটায়ে দিবানি। ভাবোদি একবার, শহরে যায়ে বড় ডাক্তারের কাছে ছানি কাটানোর ক্ষেমতা কি তুমার আছে? এইবার সবাইরে আমাগের ভোট দিতি কয়ে দ্যাও। দেহো, কথার কোনো নড়চড় হবে না।’
খানিকটা ব্যক্তিগত প্রাপ্তির লোভেই পড়েছিল খুড়ো। চোখ দুটো নিয়ে অনেকদিনই সে ভুগছিল। গ্রামের সুধীর ডাক্তার বলেছিল, ‘কোনো ওষুধপত্তরে কাজ হবে নানে, চালশে পড়িছে, পাকেও গেছে, কাটতি হবে, শহরে যাও, চোহির বড় ডাক্তার দেহাও।’
যাও বললেই কি আর যাওয়া যায়? টাকা-পয়সা কই যে শহরে বড় ডাক্তারের কাছে যেয়ে অপারেশন করাবে? এদিকে ধীরে ধীরে তার চোখের জ্যোতি কমে আসছিল , তাই টোপটা সে গিলে ফেলল। বিষ্টুর কথায় সবাইকে ডেকে ওই প্রার্থীকে ভোট দিতে বলল। আর নির্বাচনে সে জিতেও গেল। কিন্তু তারপর থেকে এই পাঁচবছরে বিষ্টুর টিকিটিও ধরতে পারেনি যোগেন খুড়ো। মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে বটে, কিন্তু বিষ্টু ‘এইতো শিতির সুমায় চক্ষুশিবির হবে, তহন তুমার চোখ অপারেশন করায়ে দিবানি।’ আবার শীত আসলে বলেছে, ‘এ বচ্ছর আর হলো না, সামনেবার দেখফানি।’ এই করে করে যোগেন খুড়োর চোখের আলো প্রায় নিভেই গেছে বলা চলে। আজ বিষ্টুকে পেয়ে খুড়ো যেন তেতে উঠল, ‘গেলবার কত কথা কয়ে গিলি, পাকারাস্তা হবে, খালের উপর পোল হবে, গিরামে বিজলি বাতি জ্বলবে, সে সব কি হলোরে, বিষ্টু? পোষ মাসে এই পথে হাটে বড় রাস্তার ওঠার আগে খালপাড়ে নামে পাটের মতো থাবায় থাবায় হোলের কাদা ধুতি হয়, তা তুইতো আর সাহেব হোসনি যে গাড়িতি যাস, রাস্তাডা পাকা করতি পারলি না? আর খালের ওপরে পোল? তার কি হলো, বাঁশের সাকোর অবস্থাতো আমার মতো হাড় জিরজিরে। ওডা ভাঙে খালের জলে পড়ে এক-আধজন মরলিও কি তোগের নেতাগের হুস হবেনে? বিজলি বাতি জ্বালায় দিবি বলে গিরামে? কয়খান খাম্বা পুতেইতো তোগের কাজ শেষ হয়ে গেল, খাম্বাগুলোন সব বালচাছা ধোনের মতো থিয়ে হয়ে রইছে, আর ওগুলোনের গুড়া হইছে সব্বার মুতার জাগা, মানষিও মোতে, কুকুরিও ঠ্যাং উচো করে মোতে, তার লাগালি না, লাইট লাগালি না, তোগের নেতারা কি আইসে ওর উপর চড়ে ধোন ফুটোয়ে আলো দেবে?’
‘খুড়ো, তুমি ম্যালা রাগে গেছ, মুখ ছুটে গেছে তুমার, বুড়ো বয়সে এতো কাজাও ক্যা? বেশি কাজালি আয়ু নষ্ট হয়, জানো না?’
‘ওরে আমার মুরুব্বি রে, গিয়ান দেচ্ছে, গিয়ান দিতি আইছে, আরে যা যা, এবার আর ওরে ভোট দেব না।’
‘দিয়ে না,’ চট করে বলে বিষ্টু, ‘ওরে কিডা দিতি কচ্ছে, উরা এসব কত্তি পারল না বলেই তো এবার অন্য লোকের জন্যি আইছি, উরা বাদ। তুমি কথা শুনার আগেই সব কথা কয়ে ফেলাও। উরা যেসব কাজ করবে বলে কথা দেছেল তার কিচ্ছুই করিনি বলেই তো এবার ভোটের সুমায় ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে দিতি হবে। কালকে আমাগের নেতা আসফেনে, স্কুলির মাঠে মিটিং হবে, তুমি থাকফা।’
‘তুমি থাকফা,’ বিদ্রুপ করে বলে খুড়ো, ‘আমি কি চোহি দেহে চলাফিরা করতি পারি রে হারামজাদা যে মিটিনি যাব? তুই কি আমার ছানি কাটার ব্যবস্থা করিছিলি?’ খুড়ো ক্ষেপে যায়।
‘তুমার রাগটা ঠিকগো খুড়ো, তুমার চোখির ছানি কাটা হলো না, তুমি বিশ্বাস করবা না জানি, কিন্তু আমি চিষ্টা করিলাম, কিন্তু কোনো চক্ষুশিবির বসাতি পারলাম না, তয় ইবার আমি নেতার কাছেরতে কড়াল করায়ে নিছি, ভোট শেষ তো তিন মাসের মদ্যি শিবির, আর তুমার চোখির সমিস্যার সমাধানও হয়ে যাবে।’ বিড়ি ফুঁকতি ফুঁকতি বিষ্টু একেবারে খুড়োর গায়ের মধ্যে চলে আসে।
‘কি জানিরে বাপু, পেত্তেকবার ভোট আসলি সব নিতারাইতো এইসব কয়, তারপর ৫ বছরের মদ্যি আর এদিকবরো হয় না। গরিব মাইনষে বাঁচে কি করে রে বাপ? তুই ক? নদীনালা সব শুকোয়ে গেল, এহন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না, আর গাঙে গিলি সাতঘাটে সেলামি দিতি হয়, আর মাছের ব্যবসাতো এহন পয়সাওয়ালাগের, যাগের টাহা আছে জাগা কিনে ঘের বানায়ে মাছ চাষ করতিছে, আমরা জালেরা সব হারায়ে গিলাম, কোনহানে গিলাম?’
খুড়োর কথা স্বগতোক্তির মতো শোনায়, ‘মায়েরা ঝিগিরি করতিছে, আর ব্যাটারা হয় রিসকা চালাচ্ছে, নয় মজুরদারি, জুগালেগিরি, কুলিগিরি করতিছে। হায়রে জালেপাড়া! জালেপাড়া কি আর সেই জালেপাড়া আছে!’
‘খুড়ো, তুমি কিচ্ছু ভাবে না, এবার কিছু এটটা হবেই, শুধু তুমি কাইল এটটু স্কুলির মাঠে যাবা, আমি আসে তুমারে নিয়ে যাব, ভ্যানে চড়ায়ে, এবার ভোটটা খালি আমার নেতারে দিতি কবা, আমার নেতা জিতে গেল মানে মনে করো সব হয়ে গেল,’ বিষ্টু বলে। তারপর খুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে খুড়ো দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, আসিস।’
বিষ্ণুর জ্বালিয়ে দেওয়া বিড়িটা টানতে থাকে আর খকখক করে জোরে জোরে কাশতে থাকে। বারান্দা থেকে নিচে নেমে বিষ্ণু হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরিয়ে আয়েশে টান মারে। খুড়োর দিকে তির্যকদৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
পরদিন ঠিক সময়মতো বিষ্ণু এসে খুড়োকে ভ্যানে তুলে স্কুলের মাঠে নিয়ে যায়। চোখ খারাপ হওয়ার পর খুড়ো বাইরে একদমই বের হতে পারে না। ঘরের বারান্দায় বসেই সময় কাটায়। আজ অনেকদিন পর বাইরে এসে তার খুব খারাপ লাগছে না। তাও আবার ভ্যানে চড়ে বের হয়েছে। মনে মনে সে বিষ্ণুকে এর জন্য ধন্যবাদই দেয়। না এখনো ছোড়াটা তাকে বেশ মানে। ভ্যানটা থেমে যেতেই সে বুঝতে পারে স্কুলের মাঠে এসে গেছে। লোকজনের হইচই শোনা যাচ্ছে, মাইকে একটি ছেলে চিৎকার করে ফ্যাসফেসে গলায় ‘ভাইসব ভাইসব, আমাদের মিটিং আর কিছুক্ষণের মদ্যিই শুরু হবে, যারা এদিক সেদিক ঘুরাফিরা করতিছেন তারা শিগগির স্কুলির মাঠে আসে জড়ো হন। আমাগের নেতা এখনি আসে পৌছোবেন, ভাইসব, ভাইসব…’ বলে মাঠ গরম করে রাখার চেষ্টা করেছে, আর ঘোষণার ফাঁকে ফাঁকে গান বাজছে। বিষ্ণু তাকে ধরে বিরাট মঞ্চের এক কোণায় বসিয়ে দিল। পাড়ার যতীন বলল, ‘কী যোগেনদা আইছ? ভালো ভালো। এবার এগের যে জুয়ার দেখতিছি তাতে ভোটে এরাই জেতফেনে।’
এমন সময় শ্লোগান আর অজস্র মোটর সাইকেলের গোঙানির যুগলবন্দি ভেসে আসতে লাগল বড় রাস্তার দিক থেকে। ‘নেতা আসে গেছে’ বলে বিষ্টু লাফ দিয়ে নামল মঞ্চ থেকে। মোটর সাইকেলগুলো সব মঞ্চের কাছে এসে জোরে জোরে গোঁ গোঁ করতে লাগল, পেট্রোল পোড়া ঝাঁঝালো ধোঁয়া যোগেন খুড়োর নাকে এসে লাগল। ধুতির খুট দিয়ে খুড়ো নাক চেপে ধরে বসে রইল। চোখে দেখে না বলে মাথায় ফেটা বাঁধা, চোখে কালো চশমা, টাইট জিন্স, আর গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট ছোট জামা পরিহিত বিচিত্র সাজের সব পাণ্ডাদের চেহারাটা খুড়ো দেখতে পেল না। একটা মটর সাইকেলের পেছন থেকে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা যে লোকটি নেমে এলো তার সাথে হাত মেলানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কেউ ফুলের মালা, কেউ তোড়া নিয়ে একে ডিঙিয়ে তাকে কনুই মেরে নেতার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করল। কেউ পারল কেউ পারল না। তার মধ্যে মাইকে সেই ছোকরা গগনবিদারী চিৎকার করে যা বলছিল তার কিছু বোঝা যাচ্ছিল, কিছু যাচ্ছিল না। নেতা মঞ্চে উঠে মাঝখানে বসলেন। বিষ্টু খুড়োকে ডেকে নিয়ে নেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পারলে নেতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। খুড়ো অবাক হয়ে গেল। ‘লোকটা গরিব-ধনী পাতথোক্য করে না’, খুড়ো মনে মনে বলে, ‘এমন লোকইতো চাই। একে দিয়েই হবে, বিষ্টু এবার ঠিক লোকটা ধরেছে।’ শুধু বোঝে না ভাবনা আর বাস্তবের মধ্যকার ফারাকটা। বক্তৃতা দিতে উঠে নেতা মাঠ গরম করে ফেললেন, ‘ওরা দেশ চালানুতি এক্কেবারে ব্যর্থ। লুঠপাট করে কিছু থুইনি। এই যে জেলেপাড়া, এখানে না হলো এটটা রাস্তা, না জ্বললো আলো, না হলো খালের ওপর কালভার্ট। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমরা ক্ষমতায় গেলে ছয় মাসের মধ্যে এইসব কাজ শেষ করব ইনশাল্লাহ।’
তুমুল করতালিতে সভাস্থল কেঁপে উঠল। এই পর্যায়ে যোগেন খুঁড়োকে ধরে মাইকের সামনে নিয়ে গিয়ে ওই নেতাকে ভোট দেওয়ার জন্য জেলেদের অনুরোধ করার কথা বললে খুড়ো তা করল। খুব গুছিয়ে কিছু বলতে না পারলেও মূল কথাটা বুঝতে কারো তেমন সমস্যা হলো না। সভা শেষে বিষ্টু আবার খুড়োকে বাড়ি পৌঁছে দিল। ভোটে তার নেতাকে ভোট দেওয়ার জন্য সে বাকি কটা দিন বারান্দায় বসেই প্রচরণা চালাল। কারো পায়ের শব্দ শুনলেই বলে, ‘এই ভোট কিন্তু যেরকম কইছি সেইরকম দিস, কোনো নড়চড় হয় না যেন।’
ভোট হয়ে গেল। বিষ্টুর নেতা জিতল, তাদের দল ক্ষমতায় গেল, আর তারপর থেকে বিষ্টুও উধাও হয়ে গেল। খুড়ো কোনোমতেই আর বিষ্টুর দেখা পায় না। লোক পাঠিয়ে তাকে ডাকলে বলে পাঠায়, ‘খুড়োরে কইস শিবির বসলি ছানি কাটায়ে দিবানি, আমার মনে আছে।’ কিন্তু সেই চক্ষুশিবির আর বসে না; দীর্ঘদিন আগে বসানো খাম্বাগুলোতে তার লাগানো হয় না, বাতি জ্বলে না; খালের ওপর সাঁকো হয় না, বাঁশের পুরনো সাঁকোটা ভেঙে যাওয়ায় সবাইকে নোকায় না হয় পানি ভেঙে পার হতে হয়; রাস্তা পাকা হয় না; পৌষ মাসেও কাদা ভাঙতে হয়; তাদের খড়োঘরের চালা আরো পাতলা হতে থাকে। আর এভাবেই পেরিয়ে যায় দিন-মাস-বছর। যোগেনখুড়ো এখনও বারান্দায় বসে থাকে বিষ্টুর আশায়, কিন্তু বিষ্টু এখন তার সামনে দিয়ে গেলেও খুড়ো টের পায় না। সেদিন তার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বিষ্টু তার বউকে বলছিল, ‘যোগেন খুড়োটা একেবারে গেছে বুঝলে, আগে চোখি দেখত না, আর এখন কানেও শোনে না।’