যে তুমি আমার স্বপ্ন, রূপময়ী, সর্বস্ব আমার-
রবিবারের সকালটা ছিল জ্যোতির্ময়। ফুলের মত প্রস্ফুটিত ভোরবেলা বারবার কিছু দৃশ্য তৈরি করেছিল আমার ভাবনায়। ভাষা দিয়ে সেই দৃশ্যাবলী বর্ণনা করা মুশকিল, শুধু অনুভব করতে হয়। শুধু এটুকু জানি, সেসব দৃশ্য মনোমুগ্ধকর, বাস্তবতার আড়ালে ভিন্ন এক বাস্তবতা, যা আমার কল্পনায় নির্মিত। প্রত্যুষ থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমাকে দেখার জন্য। যখন আকাশে রোদ হেসে উঠল, বয়ে গেল সিল্কের মতো বাতাস, একটা নাম না-জানা পাখি আমার উঠোনে নেচে উঠল। মনে হলো তুমি আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে; যে চেয়ারে বসে আমি বই পড়ি, কবিতা লিখি, কখনো কখনো আকাশ-পাতাল চিন্তা করি। পা দোলাচ্ছ আলতো ভাবে। গুনগুন করে গাইছো পুরনো কোনো গান, আমি শুনছি মুগ্ধ আবেশে। আমি তোমাকে কাছে ডাকলাম, তুমি উঠে এলে, বসলে আমার পাশে। আলিঙ্গনে লিপ্ত হলাম আমরা দুজন, তৈরি হলো এক মোহন দৃশ্য।
সকালের নির্জন আলোয় দেখা হবে তোমার সঙ্গে, তুমি প্রতীক্ষা করছ আমার জন্যে, তোমার ছবি আমাকে খুঁজছে- এসব কথা গান হয়ে গুঞ্জরিত হচ্ছিল আমার মনে। ব্যাকুল আমি সারাক্ষণ ভাবছিলাম, কখন সাড়ে দশটা বাজবে, কখন রেডিওতে আমার কবিতাপাঠ শেষ হবে আর আমি ছুটবো তোমার উদ্দেশে। আমি দেখবো তুমি দাঁড়িয়ে আছো সকালবেলার মধুর আলোয় একলা; তোমার পরনে স্বপ্নের মতো শাড়ি, তোমার কপালে গীতিকবিতার মতো জ্বলজ্বলে টিপ। আর তুমি নিজে অনিন্দ্য প্রতিমার মতোই সুন্দরী।
আর কী আশ্চর্য! সকালবেলা তোমাকে দেখলামও ঠিক তাই। তোমার অমন হৃদয়-আলোড়নকারী সৌন্দর্য্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো বারান্দায় আমার পথ চেয়ে। তখন কী যে ভালো লাগল আমার; তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা রঙধনু জেগে উঠল আমার মনের ভেতর। জায়গাটা দুজনে বসে নিভৃতে আলাপ করবার মতো ছিল না জানি; কিন্তু নিরুপায় আমরা, অন্য কোথাও যাবার সুযোগ ছিল না আমাদের। তাই বাধ্যতামূলকভাবেই সেই ধূলিম্লান কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম পাশাপাশি লম্বা বারান্দায়। সেই বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল কেউ কেউ, শব্দ হচ্ছিল গুটগাট। মানুষের আসা-যাওয়া, নানা ধরনের শব্দ, কিছুূই দমাতে পারেনি আমাদের। আমরা শুনতে পেলাম একে অন্যের হৃদয়ের ধ্বনি। আমার হাতের ভাষা বুঝে নিল তোমার হাত। এরই মধ্যে তুমি ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে হাত অত্যন্ত সাবধানে। তোমার স্পর্শ পেয়ে আমি ভুলে গেলাম সেই পরিবেশ, শুধু তুমি জেগে রইলে আমার দৃষ্টিতে আমার ভাবনায়। অন্য সবকিছু লুপ্ত হয়ে গেল নিমেষে।
সেই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে মিলনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিলাম আমি। আমার অস্তিত্বের তন্তুজালে জেগে উঠেছিল এক অলৌকিক শিহরণ। আমি তোমার মধ্যে লীন হয়ে যেতে চেয়েছিলাম, তাই আমার মুখে উচ্চারিত হয়েছিল সেই বাক্য যা শুনে লজ্জায় চোখ নত করেছিলে তুমি। মৃদু হাসিতে আরো সুন্দর ও মধুর হয়ে উঠেছিল তোমার মুখ। আমার মতো দৃষ্টিতে কেউ কি কখনো দেখেছে তোমাকে? তুমি সুন্দরী, তোমার সৌন্দর্য্যরে খ্যাতি আছে, অনেকেই লুব্ধ দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়েছে জানি। কিন্তু ওরা কী করে পাবে তোমার দৃষ্টি? তোমার সত্তার আড়ালে ভিন্ন যে সত্তা আছে, তাকেও তো দেখতে পেয়েছি আমি, দেখে মুগ্ধ হয়েছি। না, আমার মতো চোখ নিয়ে কেউ তোমাকে দেখতে পারবে না কোনোদিন। যখন কোনো দৃশ্যের দিকে আমার চোখ পড়ে, তখন আমার চোখ চোখই থাকে; যখন আকাশের নীলিমায় আমার দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায়, যখন জ্যোৎস্নাপ্লাবিত উদ্যান দেখি, তখন আমার চোখ আর চোখে থাকে না, হয়ে যায় থরথর কম্পিত হৃদয়। এজন্যই কি তুমি স্মিত হেসে বলো ‘কী আছে তোমার চোখে?’ যখন তোমার দিকে দৃষ্টি মেলে দেই, তখন আমার দুচোখ রূপান্তরিত হয় ভালোবাসায়।
আমি কিন্তু আজো তোমার চিঠি পেলাম না। জানি, তোমার অনেক অসুবিধা; নিশ্চিন্ত মনে একটা কিছু লেখার মতো জায়গা এখন তোমার নেই। তবু মন তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে তোমার চিঠি পাওয়ার জন্য। শিগগিরই পাবো তোমার চিঠি ও একটি ফটোগ্রাফ। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার মন অনেকটা হালকা লাগছে; সারাদিন মন ভীষণ খারাপ ছিল তোমার টেলিফোন না পেয়ে। এমন হয়? তুমিহীনতায় দমবন্ধ হয়ে আসে আমার আর তোমাকে দেখলেই আমার হৃদয়ে জন্ম নেয় বসন্ত ঋতু। ভালোবাসা।
তোমারই কবি
শামসুর রাহমান। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ। ভালোবাসা দিবস উদযাপনে কবি স্মরণে তাঁরই লেখা এই পত্রসাহিত্য প্রকাশ করা হলো। এমন একাধিক পত্রসাহিত্য কবি রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে ১৯৮০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে রচিত এই পাণ্ডুলিপি সম্প্রতি কবির পুত্রবধূর মাধ্যমে আমরা সংগ্রহ করেছি। তাঁর প্রতি আমাদের শুভ কামনা।