কীর্তিনাশা

সবই গেছে রাহেলার। স্বামী-সন্তান-সংসার, বাড়ি-ঘর-ঠিকানা। ননদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে; ওদের এই দয়াটুকু না হলে পথেঘাটে পড়ে থাকতে হতো। কেউ কি কখনো দেখেছে যে কারো জীবন তার ননদ-নন্দাইয়ের বাড়িতে কেটে যায়? দেখেনি। সম্ভবত শোনেওনি। অথচ রাহেলার জীবনে সেটিই ঘটেছে। মা-বাবা নাই, শ্বশুর-শাশুড়িও নাই, শ্বশুরবাড়িটা- যে বাড়িতে সে বউ হয়ে এসেছিল অনেক বছর আগে, সেটাও গেছে পদ্মার ভয়াল গর্ভে হারিয়ে। স্বামী আর দুই দেবরকে কেড়ে নিয়েছে পদ্মা, আরো পরে নিয়েছে সন্তানকেও, যেন তার সর্বস্বান্ত করার জন্যই এই নদীটির জন্ম হয়েছিল। এত বিপর্যয় এসেছে তবু সে কখনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করেনি, দিনরাত যার সঙ্গে একা একা কথা বলে সেই পরম করুণাময়ের কাছেও নয়, কখনো জিজ্ঞেস করেনি- ‘কেন সব কেড়ে নিলে? কী দোষ ছিল আমার?’ একেকটা শোক এসেছে, আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা মুরুব্বি শ্রেণীর তারা এসে সান্ত্বনা দিয়েছেন- ‘ধৈর্য ধরো মা। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।’

এত সর্বনাশের মধ্যে মঙ্গল কোথায়, যদিও সে তা খুঁজে পায়নি বা বুঝতে পারেনি, তবু মেনে নিয়েছে। সব যে তাঁর ইচ্ছেতেই ঘটে তাতে তো কোনো সন্দেহ নাই। কেন ঘটে, ঘটনার পেছনে কী কারণ আর সামনে কী যে মঙ্গল-অমঙ্গল সে শুধু তিনিই জানেন! তাঁর লীলা বোঝার সাধ্য কি মানুষের আছে? এতকিছু সয়েও এই পড়ন্ত বেলায় ওই ছোট্ট একটা কবরের জন্য সমগ্র সত্তা দিয়ে প্রার্থনা করছে সে, যেখানে শুয়ে আছে তার বুকের ধন- স্বামী, সন্তান, আর সন্তানতুল্য দেবরদের হারিয়ে যাকে বুকে তুলে নিয়েছিল সে, ননদের সেই শিশুপুত্রটি হয়ে উঠেছিল তারই সন্তান। কবরটি এখন পদ্মার করাল গ্রাসের মুখে, ভাঙতে ভাঙতে এই এতদূর চলে এসেছে নদীটা, তবু থামার লক্ষণ নাই। রাহেলা আকুল হয়ে কাঁদে- ‘নিয়ো না দয়াময়, আর নিয়ো না। এইটুকু জায়গা আমার জন্য রেখে যাও, চাইলে আমারে নাও তুমি, তবু এইটুকু রেখে যাও।’ হয়তো তার কান্নায় সাড়া দিয়েই আকাশ কাঁদে, মুষলধারায় নামে বৃষ্টি, বাতাস কাঁদে, শোঁ শোঁ শব্দে তুমুল বয়ে যায়, সেই বাতাসে নদীতে ঢেউ ওঠে, গর্জন করে ওঠে- রাগে, না বেদনায় বোঝা যায় না। এই নদী, এই পদ্মা তার সব খেয়েছে। তবু সে নদীকে ভালোবাসে। মনে হয় নদী কত আপন, কত কান্নার সঙ্গী, সে তাই নদীর পাড়েই বসে থাকে সারাক্ষণ। এখন অবশ্য নদী আর বাড়ির মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই। বিপুল ক্রোধে সে ভেঙে নিচ্ছে তার পাড়ে থাকা সবকিছু। ভাঙতে ভাঙতে এখন এই বাড়িও ধরে ফেললো, যে বাড়ির এক কোনে তার সোনামানিক ঘুমিয়ে আছে। সে মিনতি করে, আকুল হয়, আর্জি পেশ করে খোদার কাছে, নদীর কাছেও- কেউ শোনে কি না বোঝা যায় না।

সেই কতকাল আগে সে এসেছিল বউ হয়ে! শ্বশুর-শাশুড়ি ছিলেন না। তিন ছেলে আর এক মেয়ে রেখে তাঁরা একটু তাড়াতাড়িই যেন বিদায় নিয়েছিলেন। সে এসেছিল বড় ছেলের বউ হয়ে। তখন তার বয়স কতইবা হবে, বিশ-একুশ, আর স্বামী হাফিজের বয়স প্রায় তিরিশ। বয়সের ফারাক একটু বেশি হলেও মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি রাহেলার, যদিও সে এসেই পেয়েছিল অগোছালো এক সংসার। না, অভাব-দারিদ্র্য ছিল না। জমিজমা ভালোই ছিল, বাজারে দোকান ছিল। সেটা চালাতো হাফিজ নিজেই। কিন্তু মা না থাকায় সংসারের শ্রীছাঁদ কিছু ছিল না। ননদ রানু থাকলেও তিন ভাইয়ের এক বোন, একটু আহদ্মাদী, বয়সে রাহেলার দু-এক বছরের ছোটই হবে, সে এত গুছিয়ে চলতে পারতো না। রাহেলা এসে পরম মমতায় সংসারের ভার তুলে নিয়েছিল।

গরিব ঘরের মেয়ে সে, স্কুল পাস করতে পারেনি, বয়স হয়ে যাচ্ছিল বলে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিলেন বাবা। সে সুখেই ছিল। স্বামী ভালোমানুষ। দেবর-ননদরাও ভারি মিষ্টি। যদিও প্রথমদিকে একটু সন্দেহের চোখেই দেখেছে ওরা। হয়তো ভেবেছে- ভাবি এসে সব দখল করে নেবে, আর তাদের কপালে নেমে আসবে দুর্ভোগ। কিন্তু যখন দেখলো- মেয়েটা মোটেই সেরকম নয়, বরং ভারি মমতাময়ী, তখন তারাও হয়ে উঠলো ভাবির ন্যাওটা। কতই বা বয়স, তবু মাতৃস্নেহে ওদের দেখভাল করতে ভালো লাগতো তার। দুই দেবরের বড়টা নাসির তখন হাইস্কুলে পড়ছে, ম্যাট্রিক দেবে। রানু একবার ম্যাট্রিক ফেল করে ঘোষণা দিয়েছে আর পড়বে না। ছোটটা রমিজ কেবল প্রাইমারিতে পড়ছে। হাফিজের খুব সাধ, দুই ভাই পড়াশোনা করে অনেক বড় অফিসার হবে। তার মতো দোকানদারের জীবন যেন তাদের না হয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করতো সে। দোকান সামলানো, সংসার দেখা, জমিজমার খোঁজখবর রাখা। নিজে চাষবাস করতে পারতো না বলে বর্গা দিয়েছিল সব জমি। ভাগাভাগি করে যা পেতো সেটাও অনেক। ভাই দুটোকে কোনো কাজ করতে দিতো না। আর দেবেই বা কেন? নাসির বেশ ভালো ছাত্র। স্কুলে তার রোল নং ৪, আর রমিজ তো এত ছোট যে ওকে এখনো মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। দুই দেবর আর ননদের আহদ্মাদ-আবদার রক্ষা করতে করতে রাহেলার বেলা বয়ে যেত। স্বামী ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো। কখনো বলতো-

‘তুমি বড়ো ভালো গো বউ, তোমারে ওরা কত জ্বালায়, তবু রাগ করো না।’

‘জ্বালায়? জ্বালা দেখলা কই?’

‘এই যে সবসময় খালি আবদার করে। এইটা খামু না, ওইটা বানায়া দাও, এইটা কিনা দাও, ওইটা আইনা দাও…’

‘এইটা বুঝি জ্বালা হইলো? আমার কত্ত ভালো লাগে! আম্মা তো নাই, ওরা কার কাছে কইবো?’

‘হ। ওরা তো মা পাইছে একখান। ওগো কত ভাগ্যি!’

‘আমারও তো কত ভাগ্যি। আইসাই তিনটা পোলা-মায়া পাইছি। কিন্তু তুমি কী পাইলা?’

‘আমি পাইলাম একখান টুনটুনি পাখি। তুমি টুনটুনির মতো সুন্দর, বউ।’

‘টুনটুনি একটা পাখি হইলো! কত সুন্দর সুন্দর পাখি আছে। টিয়া, কবুতর, ঘুঘু…’

‘টুনটুনি ওইগুলার চেয়ে সুন্দর। দ্যাখো না, এত ছোট্ট একটা পাখি, তাও কত মায়া তার, কত যত্ন কইরা ঘর বানায়! ঠিক তোমার মতো!’

এই রকম ছিল সব। অল্পে খুশি, ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট আনন্দ মিলে গভীর এক আনন্দের বাতাবরণ ঘিরে ছিল পরিবারটিকে। বছর দুয়েকের মধ্যে রানুর বিয়ে হলো। নাসির স্কুল পাস করে কলেজে পড়তে গেল শহরে, রমিজ প্রাইমারি ছেড়ে হাইস্কুলে ভর্তি হলো আর রাহেলার কোলজুড়ে এক চাঁদমুখ ছেলে এলো। তার ব্যস্ততা বাড়লো। ননদের বিয়ে আর দেবরটা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাড়িটা খালি খালি লাগে। হাফিজ সারাদিন দোকান সামলায়, ফিরতে ফিরতে রাত। রমিজ স্কুল থেকে ফেরে বিকেলে। সারদিন ঘরের কাজ আর ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে রাহেলার। মাঝে মাঝে ছুটি পেয়ে বাড়িতে আসে নাসির, খবর পেয়ে নাইওর আসে ননদ। তখন আবার ভরে ওঠে বাড়িটা। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সুখের গল্প বেশি বড় হয় না। কারণ সুখের দিনগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রাহেলা সুখী হয়েছিল, কিন্তু তা সইলো না। এক বর্ষার দিনে তিন ভাইয়ের মাথায় ইলিশ ধরার ভূত চাপলো। এ অবশ্য নতুন নয়। প্রতি বছর এরা অন্তত একবার ইলিশ ধরতে যাবেই। রাহেলা নদীপাড়ের মেয়ে। জানে, পদ্মাপাড়ের মানুষগুলো বর্ষার সময় পদ্মায় গিয়ে ইলিশ ধরবেই। প্রত্যেক বাড়ি থেকেই পুরুষরা ছোট ছোট ডিঙি আর ঝাঁকি জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এ এক নেশা কিংবা হয়তো ইজ্জতের প্রশ্ন। ইলিশ ধরতে না পারলে পুরুষ আবার পুরুষ নাকি? আর পদ্মাও এমন, কাউকেই খালি হাতে ফেরায় না। দু-চারটা, দশটা-বিশটা ইলিশ জালে ধরা পড়বেই। বর্ষায় যেন ইলিশের মেলা বসে পদ্মায়। পেশাদার জেলেরা তো ধরেই, শৌখিন মানুষও ধরে। তবু প্রতিবার রাহেলার বুক কাঁপে। বর্ষায় তো পদ্মার রাগী রূপ, বিরাট বিরাট ঢেউ। ওই ছোট্ট ডিঙি নৌকায় করে গভীর পানিতে যাবে ওরা, নৌকা থেকে জাল ফেলবে, যদি পড়ে যায়? ঢেউ তো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার এইসব ভয়কে পাত্তাই দেয় না কেউ। সেবারও দিলো না। যাওয়ার কথা ছিল হাফিজ আর নাসিরের, কিন্তু রমিজও বায়না ধরলো- যাবেই। রাহেলা কত বোঝালো, কত লোভ দেখালো, কত ভয় দেখালো- লাভ হলো না। উল্টো জেদি ভঙ্গিতে গোঁ ধরে রইলো-

‘তুমি আমারে আদর করো না, খালি সবকিছুতে না করো। ভাই যায়; আমি গেলে কী হইবো?’

রাহেলা বোঝায়- ‘তুই তো ছোট, বড় হইলে যাইস। আর তুই বাড়িতে না থাকলে বাবুর সাথে খেলবো কে?’

রমিজও কম যায় না- ‘না, আমিও বড় হইছি। তুমি আমারে দেখতে পারো না, সেইটা কও।’

নাসির বলে- ‘থাক ভাবি, নিয়াই যাই। কিছু হইবো না।’

‘না, আমার ডর লাগে। ও ছোট মানুষ।’

‘আরে কিছু হইবো না। বাড়িতে থাকলে তোমার মাথার চুল ছিঁড়বো। নিয়া যাই।’

ভাইয়ের সমর্থন পেয়ে রমিজের আবদার আরো বাড়ে। হাফিজ তখন বলে- ‘আইচ্ছা চল যাই। কী আর হইবো! তুমি ওরে যাইতে দাও বউ।’

রাহেলার কাউকেই যেতে দিতে ইচ্ছে করছিল না। মনে কেন যেন কু-ডাক ডাকছে। তবু বাধ্য হয়েই বিদায় দিলো। চিরবিদায় দিলো বলাই ভালো। কারণ সেদিনই বলা নাই কওয়া নাই, ঝড় উঠলো। এমনিতেই বর্ষাকাল, ভরা নদী। উথালপাথাল ঢেউ, প্রবল স্রোত, তার ওপর ঝড়। যা হবার তাই হলো। নৌকা উল্টালো মাঝনদীতে। রমিজকে বাঁচাতে নাসির আর হাফিজও তলিয়ে গেল পানির নিচে। মাঝি হিসাবে গিয়েছিল রাখাল ছেলেটা। সে-ই কেবল নৌকা ধরে ভেসে ছিল, বেঁচেও ছিল। ঝড় থামার পর ভাসতে ভাসতে তীরে পৌঁছে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল সে একাই। তার কাছেই জানা গেল সব কথা। বাকিদের লাশ পাওয়া গেল ভাটিতে, তিন গ্রাম পরে।

রাহেলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পড়লো তো পড়লোই, আর ওপরে ওঠার কথা তার মনেই রইলো না। একসাথে তিনজনের মৃত্যু, বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে কেউ রইলো না। এখন সে এতকিছু সামাল দেবে কীভাবে? বাড়িঘর-সংসার-জমিজমা-ফসল-গবাদি পশু-বাজারের দোকান, আর কোলে দু’বছর বয়সী শিশুসন্তান। এতকিছু একা সামলানো কি সম্ভব? তাও একজন মেয়েমানুষের পক্ষে? আপনজন বলতে এক ননদ, তাও বেশ কয়েক গ্রাম পেরিয়ে তার বাড়ি। সে-ই বা কতটুকু সাহায্য করবে? মা-বাপ তো অন্য এলাকার। তাদেরকে তো আর নিজেদের সংসার ছেড়ে এখানে এসে থাকতে বলা যায় না! আবার বাড়ি ছেড়ে যে মা-বাপের কাছে চলে যাবে, এখানকার সবকিছু দেখবে কে? এমন শোকার্ত সময়, কিন্তু শোক করার সময়ই পেলো না সে, নানা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় মাথা ভার হয়ে রইলো। নিজেকে মনে হতো অকূল সমুদ্রে দাঁড়ভাঙা এক নৌকার মতো। দিক ঠিক করার সুযোগ নাই, বাতাস আর স্রোত যেদিকে বয়ে নিয়ে যায় সেদিকেই যেতে হবে। কিন্তু জীবন তো আসলে সে রকম নয়। এখানে হাল ভেঙে গেলেও শক্ত করে ধরে রাখতে হয়, সঠিক গন্তব্যে না পৌঁছতে পারলেও একেবারে দিকচিহ্নহীন হয়ে যাবার ভয় তাতে একটু কমে। রাহেলাকেও তাই শক্ত হতে হলো। রানু আর তার জামাইয়ের সাথে বুদ্ধিপরামর্শ করে ঠিক হলো- বাজারের দোকানটা জামাই দেখভাল করবে, লাভের অর্ধাঅর্ধি ভাগ হবে। জমিজমা তদারকি করার ভারও স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলো সে। বাড়িতে যদিও রাহেলা একা, সেটা একটা সমস্যাও বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে মা-বাপ এসে থাকতে শুরু করলো। কখনো বা ননদ, কখনো ভাই-বোন। ফলে একটা জোড়াতালি মার্কা সমাধান হলো। বছর পাঁচেক চললো এভাবে, তারপর শুরু হলো নতুন বিপদ। কয়েক বছর থেমে থাকার পর আবার নতুন করে শুরু হলো পদ্মার ভাঙন। লোকজনের আত্মা কেঁপে উঠলো। তারা জানে, একবার শুরু হলে পদ্মার ভাঙন কয়েক বছর ধরে চলতেই থাকে। কত বছর ধরে চলবে তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। গতি পরিবর্তন করে যতদিন না সে নিজের স্রোতের দিক অন্যদিকে ফিরিয়ে না নেবে ততদিন চলবে এই ভাঙন। কোনো এক সময় হয়তো তার মনে হবে- অনেক হলো, এবার ওপারটাও ভাঙা যাক; তখন সে এপার থেকে মুখ ফেরাবে, কপাল পুড়বে ওপারের মানুষদের। ‘একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।’ হ্যাঁ, এ তার খেলা বটে, আর তীরবর্তী গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মরণ। হাহাকার, কান্না, প্রার্থনা, দোয়া-দরুদ, পূজা-অর্চনা, মিনতি-প্রার্থনা কোনো কিছুতেই পদ্মার রাগ কমলো না। এক বছরেই ভেঙে নিয়ে গেল তাদের গ্রাম, বাড়িঘর-জমিজমা সব। রাহেলার সর্বনাশ হলো আরো গভীর। সে একলা মানুষ। এই বিপুল দুর্যোগ তো দশজনে মিলেও সামলানো যায় না, সে একা পারবে কীভাবে? ফলে সবদিকে খেয়াল রাখার সুযোগ হলো না। স্বামী আর দেবরদের মৃত্যুর পর সে নিজে কখনো নদীতে নামেনি, ছেলেটাকেও যেতে দেয়নি। সে এখন ৯ বছরের দুরন্ত কিশোর, সারা গ্রাম চষে বেড়ায়, কিন্তু পদ্মায় যাওয়া নিষেধ। পদ্মাপাড়ের গ্রাম, ছোট ছোট বাচ্চারাও সময়ে-অসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, গোসল করে, সাঁতার কাটে, কিন্তু ওর যাওয়া হয় না। এবার মায়ের অমনোযোগের সুযোগে সে যে গিয়ে সেই পদ্মায় নামবে গোসলের জন্য, তাও এই ভরা বর্ষায়, এই উত্তাল ঢেউয়ে- তা কে ভেবেছিল! যা হবার তাই হলো, সে আর ফিরলো না। খবরটা যখন রাহেলার কাছে এলো, তখন সে বুঝে গেল- নিজে না মরা পর্যন্ত এই সর্বনাশের শেষ হবে না। সেও গিয়ে ঝাঁপ দিলো পদ্মায়, মরার জন্য। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে মরতে দিলো না, ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিয়ে এলো পাড়ে।

রানু, তার জামাই আর তাকে একা রাখার ঝুঁকি নিলো না। জোর করে নিয়ে এলো তাদের বাড়ি। এসে নিজেদের ছেলেটাকে তুলে দিলো তার কোলে। বললো- দাবি ছাইড়া দিলাম, এইটা আইজ থিকা তোমার পোলা।

তার সব গেছে, সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব এক মানুষ সে। আত্মীয়-পরিজন নাই, স্বামী-সন্তান নাই, দেবররা নাই। মা-বাপও ততদিনে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। বাড়ি গেছে পদ্মার পেটে, জমিজমা গেছে, স্বজনরাও গেছে। সে তবু বেঁচে ছিল ওই শিশুটিকে বুকে নিয়ে। আর ছেলেটিও হয়ে উঠেছিল তার ন্যাওটা- আদুরে ও আহদ্মাদী। তাকে ডাকতোও মা বলে, নিজের মাকে ডাকতো ছোটমা। কিন্তু যার যায় তার সবই যায়, সম্পূর্ণ নিঃস্ব না করে তাকে মুক্তি দেয়া হয় না। নইলে সেই শিশুটিও কেন দু’দিনের কলেরায় মরে যাবে? তার মৃত্যুর পর রাহেলা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। একটুও কাঁদেনি, টুঁ শব্দও করেনি, নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে- বাড়ির এক কোনে কবর খোঁড়া হচ্ছে, সেখানে শুইয়ে দেয়া হলো তার বুকের ধনকে। সবাই তাকে টেনে নিয়ে মুঠোভর্তি মাটি দিয়ে কবরে দিতে বললো, সে তাই করলো। আর তার পর থেকেই তার জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল ওই কবর। সে প্রতিদিন কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে, হাত বুলিয়ে আদর করে- ‘আমার জাদুসোনা ঘুমাও, আরামে ঘুমাও’- কবরের চারপাশে ফুলগাছ লাগায়, সাদা সাদা ফুল, ফুল ফুটলে সেগুলো ছিঁড়ে এনে কবর সাজায়, এইসব। রানু ধরেই নিলো- তার ভাবি পাগল হয়ে গেছে। কী আর করা? তারও তো সব গেছে। ভাইরা গেছে, বাপের বাড়ি গেছে, তবু স্বামী-সন্তান আছে বলে এখনো বুকে পাথর বেঁধে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আছে। ভাবির কী বা আছে? কী নিয়ে বাঁচবে সে? এত ভালো একজন মানুষের কপালে আল্লা যে কেন এত দুঃখ লিখে রেখেছেন, কেউ জানে না। রাহেলাকে তারা যত্নেই রেখেছে। রানু সব সময় ভাবে, এই ভাবি তাদেরকে মায়ের স্নেহ দিয়েছিল, ছন্নছাড়া সংসারটাকে আনন্দে ভরে তুলেছিল। কপাল খারাপ না হলে ভাইগুলো এখন কত বড়ো হতো! হয়তো বিয়ে-টিয়ে করতো, বাচ্চাকাচ্চা হতো। ঘর ভরে থাকতো আনন্দ-উৎসবে। ভাগ্যে নাই। বাপের বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন বলতে আছে এই ভাবি। সে তাই ভারি যত্ন করে তার। মাথায় তেল দিয়ে দেয়, খেতে না চাইলে জোর করে মুখে তুলে খাওয়ায়, অসুখ হলে সেবাযত্ন করে। কিন্তু ওই যে পদ্মা! সে তো থেমে নেই। সেই যে ভাঙতে শুরু করেছিল, গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিয়েছে, তবু তার খাঁই মেটেনি। ভাঙতে ভাঙতে তাদের বাড়ি ধরে ফেলেছে, এবার তাদেরও নিঃস্ব হতে হবে। তবে স্বামী বুদ্ধিমান। পদ্মার ভাবসাব দেখে কয়েক বছর আগেই অন্য উপজেলায় গিয়ে জমি কিনে রেখেছিল। সেখানেই যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

৩.

পদ্মা এগিয়ে আসে। রাক্ষসী পদ্মা, ভয়াল পদ্মা, ক্ষুধার্ত পদ্মা। রাহেলার মিনতি বাড়ে, আকুল হয়ে কাঁদে- ‘খোদা সবই তো নিছো, কোনোদিন কিছু বলি নাই। এই শেষ চিহ্নটুকু নিয়ো না, নিয়ো না।’ কিন্তু পদ্মা আপনমনে ভেঙে যায়। এইসব হাহাকার-আহাজারিতে কান দিলে তার চলে না। কীর্তিনাশা সে। মানুষে কীর্তি নাশ করাই তার কাজ। ভাঙাগড়ার খেলা তাকে খেলতেই হবে, এই তার স্বভাব। যেদিন মানুষ এসে তার তীরে বাসা বেঁধেছিল, সেদিনই সে জানতো, এই কীর্তি একদিন নাশ হবে। কিছু করার নাই তার। তোমরা আমাকে ব্যবহার করবে, ভালোবাসবে, প্রেমে পড়বে। আমার শান্ত রূপে মুগ্ধ হবে, আর আমার রুদ্র-রাগী রূপ দেখবে না? এটাও তো আমিই। গ্রহণ করলে পুরোটাই করো, নইলে আমার কোলের কাছে এসে বাসা বেঁধো না। মানুষ তার কথা শোনেনি, কিংবা শর্ত মেনেই ঘর বেঁধেছে, ভালোবেসেছে তাকে, প্রেমে মশগুল হয়েছে। সেও তো কম ফেরত দেয়নি! শত শত বছর ধরে জল দিয়েছে, মাছ দিয়েছে, পলি দিয়ে জমিকে উর্বরা করে তুলেছে, ফসল ফলিয়েছে, স্নিগ্ধ বাতাস দিয়েছে। কিন্তু তাকে যে ভাঙতেও হয়- এক পাড় না ভাঙলে অন্য পাড় গড়বে কী করে? ভারসাম্য নষ্ট হবে না? এপারে মানুষের কীর্তি ধংস হবে, তারা হাহাকার করবে, কাঁদবে; একই সঙ্গে ওপারে চর জাগবে, নতুন ফসল ফলবে, বসতি হবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটবে- এসবই তো তাকে দেখে যেতে হবে! এসব দেখার নিয়তি নিয়েই যে তার জন্ম হয়েছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত