আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো

আমার যখন বুদ্ধি হলো, তখন থেকে দেখি, আমাদের মা বিধবা! আমরা বলতে মূলত আমি, ছোটপা আর সেজপা। কিন্তু আমাদের আরও বোন ছিল। বড়পা আর মেজপা; ভাইয়ের কথা পরে বলছি। বড়পা ও মেজপার আমার জন্মের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে; তাই ওদেরকে আমার আর ‘আমরা’ মনে হয় না। আর ভাই তো ম্যালা বড়—তাঁর আলাদা উঠোন, তিনি যেন এক প্রতিবেশী। ঘর-সংসার কত-কী তাঁর! মফস্বলে আমাদের পাটকাঠির বেড়াঘেরা বাড়ি। সেমিপাকা ঘরের ভেতর বড় হতে হতে প্রথম দেখলাম, বৃষ্টির শব্দ সব সময় এক রকম হয় না। আষাঢ়ের ইলশেগুঁড়ির একটানা চিঁ-চিঁ শব্দে একসময় কান ধরে আসে। বৈশাখের হঠাৎ বৃষ্টি নামে তো বড় বড় ফোঁটায়, তবলায় বোল তোলার মতো একটু একটু করে বেড়ে একটা লয় তৈরি করে। আর আমাদের আমগুলোকে ফাটিয়ে যে শিলাবৃষ্টি হয়, তা যেন একেবারে কাজী নজরুল ইসলাম, যেন সৃষ্টিসুখের উল্লাস। আমি অবশ্য জানি, এই সব আমার আবিষ্কার-টাবিষ্কার কিছুই না। ছোটপা ভালো বলতে পারত। ওর মতে, আমি একটা গল্পিস। খালি গালগপ্প বানাই।

কথা একেবারে মিথ্যে নয়। আমার সেজপা, কেমন মিস হা-এর মতো! সবকিছু খানিকটা পরে পরে বোঝে, তাই ছোটপা দুঃখ পেয়ে আমার বদনাম করে। কারণ, প্রায় রাতেই সেজপা স্বপ্ন দেখত! তো, সকালে সেই স্বপ্নের শ্রোতা তো আমি আর ছোটপা-ই। ছোটপা স্বপ্ন দেখত না। ও কেবল সেজপার স্বপ্নটাকে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্লেষণ করে বলে দিত, কেন সে এই স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আমি সেজপার স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে মনে মনে একটা স্বপ্ন বানিয়ে ফেলতাম! কেন যেন ছেলেবেলা থেকেই আমি ভাবতে পারতাম, অনেক দূর পর্যন্ত! তাই ওরা আমাকে পাত্তা দিত না। বলত, ‘পুঁচকি, যা নকলবাগিশ কোথাকার।’ সেজপা ম্যাট্রিক দেবে, ছোটপা সবে নাইনে। কিন্তু ও বুদ্ধিতে পাকা বলে আমাকে মানতে চাইত না। সেজপা মানত। সেজপা অবাক হয়ে বলত, ‘দ্যাখ, তুশিটার কত বুদ্ধি! আমাদের টরটরে বুড়িটা।’ ক্লাস থ্রিতে পড়লে কি কেউ বুড়ি হয়? কিন্তু সেজপার কথায় রাগ করতে পারতাম না। এত আদর মেখে মিষ্টি করে বুড়ি বলে ডাকত! অথচ এখন আমার আর কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবল একা একা ভাবি, আমাদের সেই বেড়াডাঙ্গার বাড়ির কথা। উঠোনের জলপাইগাছ। বোনদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা…।

হঠাৎ করেই বৃদ্ধ লোকটি বলে ওঠে, ‘বাংলাদেশ?’

আমি কোনো উত্তর দিই না। যেন শুনতেই পাইনি, পাশ কেটে বেরিয়ে যাই। তাতে লোকটার বেশি ভাবান্তর হয় না। সে লেকের পাড় ঘেঁষে সামনে এগিয়ে যায়, নতুন কোনো তামাটে জাতির খোঁজে। গত ছয় মাসে এই লোকটিকে না হলেও দশ থেকে পনেরোবার দেখেছি আমেরিকার এই প্রবাসজীবনে। হিলসাইডের সব প্রবাসী বাঙালিই তাঁকে চেনে। সবাই লোকটির নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ বুড়ো’। কাউকে পেলে তাঁর একটাই প্রশ্ন, ‘বাংলাদেশ?’ তারপরই কাঙ্ক্ষিত দেশি মানুষের বাংলা কথা শুনে শুরু হয়ে যাবে লালের মোড়ের চা দোকানের মতো আড্ডা। যেন সোজনবাদিয়ার ঘাট!

এই কর্নেল টিলি পার্কে বয়স্ক বাঙালিদের হাঁটাচলা, বসে থাকা কিংবা বাচ্চাকে পার্কে ছেড়ে পাহারা দেওয়ার বাহানায় স্কুলের পাশে মহিলা-মহফিল! সব মিলিয়ে গালগপ্পের এক চারণভূমি। প্রথম প্রথম এখনটায় আমারও ভালো লাগত, ঘরের পাশে এমন পার্কের গাছগুলো, ছোট লেকের হাঁসগুলো…

ফাঁকা বেঞ্চিতে একা বসে থাকার মায়ায় ছুটে আসতাম এখানে। আমার বেসমেন্টের আবাসের মধ্যে থেকে থেকে দমবন্ধ হয়ে এলে ছুটে আসতাম এই পার্কে। তবে কথা বলতে নয়, আমার ওই কবরখানা থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসের আশায়। ঘর থেকে মাত্র পঞ্চাশ কদম দূরত্বে পার্ক। সিঙ্গেল হাউসের বেসমেন্টের সাবলেট বাসিন্দা আমি। যেন নিজেই নিজের কবর খুঁড়তে চাই; তাই শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে নিউইয়ার্কের এই কবরে চলে এসেছি। এ জন্য কেউ বাংলাদেশ…বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে আমার সঙ্গে খায়েশ মিটিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলতে চাইলে আমি সহ্য করতে পারি না।

প্রায় আশির কাছাকাছি বয়সের লোকটির মুখভর্তি চাপ দাড়ি, স্নিগ্ধ উজ্জ্বল চেহারা। আমার স্মৃতিতে থাকা বাবার ছবিটির সঙ্গে খুব মিল! তবুও আমি আনমনে হওয়ার ভাব ধরি, তার ভাঙা ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর দিতে গদগদ হয়ে উঠি না। আর আমি চুপ থাকলে সে আমাকে ঘাঁটায় না। সামনে এগিয়ে যায়। এ দেশে অন্তত সবার এই পরিমিতিবোধ তৈরি হয়ে যায়। আমার বেঁটে উচ্চতা, উজ্জ্বল তামাটে গায়ের রং আর ছোট ববকাট চুলে অনেকের মনে একটু দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সেটাকে আমি ভাঙাতে যাই না। তবে মনে মনে কেবল অনবরত বাংলায় ভেবে যাই, কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না। কেননা আগেই আমার বলার ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সব ইচ্ছে-টিচ্ছে মরে যাচ্ছে যেন! এই লেখা, আমার মতবাদ, আমার স্বাধীন মতামতকেই কেউ মেনে নিতে পারল না। কেন এমন লিখছি? আমার সব হুমকিপ্রাপ্ত দিন।

আমার লেখকবন্ধুকে মেরে ফেলার পর প্রতিবাদী হয়েছিলাম। ফলে একসময় গৃহবন্দী হতে হলো আমাকে। আমি কি কোনো দিন কারও ইচ্ছায় লিখব? লিখব না। এ কি আমার অভিমান? নাকি ক্ষোভ? আমার বন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ভাষাকে নির্দ্বিধায় খুন করেছিল যারা, আমার প্রতিবাদের ভাষাকে আইনের ধারার খপ্পরে ফেলে বাক্‌বন্দী করেছে যারা, তাদের প্রতি ক্ষোভ, নাকি নিজের অসহায়ত্ব? নাকি দুঃখ? বেদনা? আপসকামী হওয়ার অক্ষমতা? আমার প্রতিজ্ঞার স্মৃতিরা কেঁদে ফেরে এই নিউইয়ার্কের ফুটপাতে। মেট্রোরেলে চেপে আমি চলে যাই বর্ণবাদিতায়খ্যাত এবং অস্তিত্বের প্রতিহিংসার পরশপাথর হারলেমে। এটা নাকি কৃষ্ণাঙ্গদের রাজধানী! আমার কী? আমি এগিয়ে যাই মাউন্ট মরিস পার্ক পেরিয়ে ওয়ান টোয়েন্টি ফিফথ স্ট্রিট, তারও এক কোনায় গোলাপের পাপড়ির মতো হেসে থাকা অক্ষর—ডানকিন ডোনান্ট! আমার কর্মক্ষেত্র।

একদা বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী আমি, আজ খুব সকালে গ্যাপের সাদা শার্টের ওপর চকলেট রঙের অ্যাপরোন চাপিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি ডানকিন ডোনান্টের কাউন্টারের পেছনে, সুউচ্চ স্টিলের র‍্যাকের সামনে। গলফস পরা হাতে থরে থরে সাজিয়ে রাখি ডোনান্ট, মানকিন, হাশব্রাউন, হ্যামবার্গার। বরফ কুচি দিয়ে তৈরি করি কফি লাতে, হোয়াইট চকলেট স্মুদি কিংবা চলে যাই বাসকিন রবিন্সের ডিপ ফ্রিজের কাছে। ঘষেমেজে সাফ করি কাউন্টারে পড়ে থাকা আইসক্রিমের আঠালো রস। ক্যাশ কাউন্টারের ডেস্কটপে হাত রাখার অধিকার এখনো হয়নি। আমার রাইটিং কি-বোর্ডটি ফেলে এসেছি। ফাঁকে ফাঁকে মব করি কফি হাউসের মেঝে। আমার আপস কার সঙ্গে? বুঝি না কিছুই। অফটাইমে খেতে পাই ডোনান্ট কিংবা স্যান্ডউইচ। একবার একটা কড়কড়ে ভাজা আলুর তৈরি হ্যাশব্রাউন খাব বলে হাতে নিতেই ডাইভওয়েতে সার্ফ করা সুলতানা নামের মেয়েটি দৌড়ে আসে,

‘আপা, করেন কী? করেন কী?’

আবাক চোখে চেয়ে থাকি। মেয়েটি সহানুভূতিশীল, এই শপে আছে দুই বছর ধরে। বলে, ‘হ্যাশব্রাউন কারখানা থেকে প্রসেস হয়ে আসে। হ্যাম-ট্যামের সঙ্গে মিশে যায়। তাই আমরা খাই না।’

আমি ওর অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না। হ্যাশব্রাউন রেখে একটা চিজ স্যান্ডউইচ চিবোতে থাকি। ও নিশ্চিত হয়ে সুনিপুণ হাতে শূকরের লাল মাংস পুড়িয়ে হ্যামবার্গার তৈরি করে অপেক্ষা করে কাস্টমারের জন্য।

আমার অনুভূতিগুলো মরে যাচ্ছে। আমার কী দায় এই সুদূর আমেরিকায় বাংলাদেশি বলে গলে পড়ার? বাংলাদেশ বুড়োর নিঃসঙ্গ সময় বাংলা কথায় ভরিয়ে তোলার? আমি তো বাংলাই বলতাম, লিখতাম। কিন্তু ওরা বলে, আপনি কেন লিখেছেন, আমাদের গ্রামে মালোপাড়া নাই?

না, আমি কথা বলব না। বুকের বাষ্প জমে উঠে দমবন্ধ হয়ে এলেও বুড়োকে বলব না, ‘চাচা, ভালো আছেন? দেশ ছেড়েছেন কত দিন?’

লোকটি আমাকে ঘাঁটায় না, কিন্তু মনে মনে আমি নিজেকেই ঘাঁটাতে থাকি, হাইল্যান্ডে হাঁটতে হাঁটতে, কাস্টমারের কফির ঢাকনা শক্ত করে বসিয়ে দিতে দিতে। প্রবাসজীবনে আমার ডায়াসপোরা মনকে আরও কতভাবে ঢেকে রাখা যায়। বেসমেন্টের কবরে শুয়ে শুয়ে ইঁদুরের হেঁটে চলার শব্দ পাই। রক্তচোষা ছারপোকার কামড়ে ঘুমহীন রাতে কেবল ভাবতেই থাকি আমি।

আমার পথের অলি-গলিতে ওত পেতে ছিল অজ্ঞাত ঘাতক। আমার বন্ধুর লাশ পড়ে থাকে ছাপাখানার দোরগোড়ায়। না, যারা আমাকে ভুল ভেবে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে অনর্গল, সদ্য মেক্সিকো থেকে আসা কোনো চাকরিপ্রার্থী আপন ভেবে স্প্যানিশ ভাষায় বলে তার প্রয়োজনীতার কথা, তাদের আমি কেবল থামিয়ে দিই। বলি, ‘আম নট স্প্যানিশ। ডু ইউ নো ইংলিশ? আম ফ্রম বাংলাদেশ।’

ওরা নিশ্চিত এবং হতাশ হয়ে ফিরে যায়। আমি কেবল নিশ্চিত করি না বাংলাদেশ বুড়োকে। আমি কেবল নিশ্চিত করি না জ্যাকসন হাইটের বাংলা হোটেলের লোকদের। আমি নিজেই তো আজ নিশ্চিত নই!

মাসখানেক গৃহবন্দী থাকার পর কর্তৃপক্ষ যখন আমার হাতে আমেরিকার ভিসা তুলে দিল, গাড়িতে করে প্লেনে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনার সুরক্ষার জন্যই আপনাকে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছি।’ তখন আজ আর আমার কী দায়, বাঙালি বলে মমতায় জড়িয়ে ধরার? অথচ মাঝে মাঝে আমার বড্ড বিচ্ছিরি মনে হয় ওদের সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব। হারলেমের পালাবদল, ওইখানেই কিছু চাকরি খালি থাকে। খারাপ লাগে ওদের পার্কে ধেড়ে ধূসর কাঠবিড়ালি দেখতে। আমাদের বেড়াডাঙ্গার বাড়িতে একটা নারকেলগাছের ফোকলে থাকত ছোট্ট, হলুদ ডোরাকাটা খয়েরি কাঠবিড়ালি। দেখলেই আদর করে কোলে তুলে নিতে চাইতাম। আহা, আমার সোনালি চড়ুই! ছোটপার জ্ঞান যতই থাকুক, সুন্দর করে, সাহিত্য করে চিঠি লিখতে পারত না। এ প্লাস বি হোলস্কয়ার ভালো বুঝত। সেজপা ছিল ঘুমকাতুরে। বড়পাকে লেখা চিঠিটি অঙ্ক খাতার মধ্যে রেখেই ঘুমিয়ে যেত। মাঝরাতে সেই চিঠি চুরি করে টুকলি করত ছোটপা। আমি দেখে ফেলেছি বলে দিতেই কানমলা খেতাম। ছোটপা এখন ডাক্তারি করছে। আর সেজপা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বাংলা শিখিয়েই যাচ্ছে। ছোটপার এখনো আমার ওপর রাগ, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে কী দরকার অত গল্প লেখার! তোকে কে বলেছে এনকাউন্টার নিয়ে আপত্তি জানাতে। দেশ ছাড়তে আমি চাইনি, সত্যি বলছি। বাসার ভেতরে বোনেরা ঝগড়ার তোড়ে ইংরেজি গালিতে মেতে উঠলে আমার বৃদ্ধ মা ছড়া কাটতেন, ‘আমার পেটে হয়ে রে বাছা, কোথায় শিখলে পার্সি ভাষা।’ মা নেই কিন্তু তাঁর ছড়াগুলো তো আছে, আমার কানের কাছে মা যেন মাঝে মাঝেই ফিসফিস করে বলেন, ‘নিজের টাকা হবে বলে পরকে যে দাও ফাঁকি, পশুর সমান আত্মা তাহার, মানুষ বলে নাকি?’

আমি মানুষ হতে চেয়েছিলাম। পশুর মতো মরতে বা মারতে চাইনি। অথচ একে কি বেঁচে থাকা বলে! সারা দিন খালি কফির কাপ পূর্ণ করে অন্যের তৃষ্ণা মেটানো। বড় ক্লান্ত আমি। নিউইয়ার্কের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখে চোখ পোড়ে, আমার তুলট মেঘ আর ধুলট মেঘের আশায়।

ফিফথ স্ট্রিটে এন ট্রেন ছেড়ে উঠে পড়ি, এফ ট্রেনে সুড়ঙের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাই গন্তব্যে। মেট্রো থেকে নেমে গোথিক ড্রাইভ হয়ে হাইল্যান্ডে হাঁটতে হাঁটতে হিল সাইডে যাই, ঘরে ফেরার টানে। সারা দিনের ধকল, উঁচু-নিচু পথ বেয়ে নেমে যেতে যেতে পার্কের মুখে চলে আসি আমি। থিক হয়ে আসা লেকের পানি ছেড়ে কাঠের গুঁড়িতে ঝিম ধরে বসে থাকে রাজহাঁস জোড়া, মানুষে ভয় নেই তাদের! ঠায় বসে থাকে। এখন আর আমার বলার বা লেখার কিছু নেই। এই দেশে সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব, তাতে আমার কী? আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার তো আর তেমন করে মত প্রকাশই ঘটবে না। ইংরেজিটা আমার অতটা দখলেই নেই যে অনুভূতি-টনুভূতি জানিয়ে ট্রাম্পের রোষানলে পড়ব। ইংরেজিটা আমার মায়ের শেখানো বুলিই নয়, এর ভেতরের স্বাদ-গন্ধ আমি বুঝি না।

হঠাৎ দেখি দুজন বাঙালি নারী ফিরে ফিরে দেখছেন আমাকে। বরাবরের মতো তাঁদের এড়িয়ে যেতে চাই। তবে তাঁদের চাহনিতে ছিল চেনা চেনা ভঙ্গি, আমাকে বাঙালি ভেবেই হয়তো। কিন্তু তাঁরা যেন নিশ্চিত নন, আমার ভাষা বাংলা! আমি দ্রুত পেরিয়ে যেতে চাই তাঁদের, কিন্তু ক্লান্তি আর হাইল্যান্ডে পথচলার শ্রান্তিতে আমার মুখ ফসকেই বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস—‘আহ্‌…হ’; দীর্ঘশ্বাস বোঝে না স্বদেশ-বিদেশ, সে আজন্ম অভ্যাসের মতোই বেরিয়ে এসেছিল, যেন মাতৃভাষা। সামনে কিছুটা এগিয়ে গিয়েও থেমে গেলেন এক মাঝবয়সী নারী, দুই হাত তাঁর হুইলচেয়ারের পেছনে। চেয়ারে বসা বৃদ্ধ মা। নারীটি চকিতে বলে বসলেন, ‘আপনি বাঙালি?’

এরপর আমার দমবন্ধ করা নীরবতা, আরেকটা দীর্ঘশ্বাস! তাতে কি বোঝা যায় এই শ্বাসে জমে ছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনার হু হু করা বাতাস? মানুষ কেন এমন স্নেহের গন্ধ খুঁজে ফেরে? একটা দীর্ঘশ্বাসও কি বোঝে এখন তা বাংলার বাতাসসমেত ধ্বনি! আমার কত দিনের নীরবতা ভেঙে পড়ে, বেরিয়ে আসে, ‘হ্যাঁ।’

হুইলচেয়ারে বসা নারীটির বয়স ৮২ হবে। তাঁর দাঁতহীন মুখের চোয়াল বাতাসে বাড়ি খায়। বলেন, ‘থাকো কই?’

‘ওই চ্যাপিং কোর্ড।’

‘আপনি?’

‘হাওয়াপাড়া।’

‘হাওয়াপাড়া?’

মাঝবয়সী নারী এবার বলেন, ‘সিলেটের হাওয়াপাড়ায় আমাদের বাড়ি আছে। মা ভাবেন, তিনি এখনো সেখানেই থাকেন।’

বৃদ্ধ মা আবার বলেন, ‘হাওয়াপাড়া, চেনো না?’

‘হুম চিনি। সে তো বহুদূর!’

আমাদের চোখ ঝাপসা করে গুঁড়োগুঁড়ো তুষারপাত হতে থাকে। বহু আগেই জেনেছিলাম, তুষারপাতে বৃষ্টির মতো কোনো শব্দ থাকে না। কেবল নীরবে ঝরে পড়ে। আর ক্রমশ আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলোকে ঢেকে দিয়ে যায়।

ক্রমশ নীরবতা ঢেকে দিয়ে যায় সফেদ বরফ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত