এক মন্ত্রীর সাথে জানাশোনা থাকায় পরিচিত মহলে আমি এখন বেশ দামি হয়ে উঠেছি। তাও আবার পূর্ণ মন্ত্রী না, প্রতিমন্ত্রী। তবে কোনো কোনো প্রতিমন্ত্রীর কারিশমা মন্ত্রীর চাইতেও নাকি বেশি। তা এই প্রতিমন্ত্রী কতটুকু কারিশমার, তা অবশ্য জানি না। আর আপনাদের দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি আসলে চাটুকার শ্রেণির মানুষ নই। আমার পকেটে বোতল ভরা কোনো তেলও নেই। ফলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, প্রভাবশালীদের সাথে আমার দহরম-মহরমের কোনো সুযোগই নেই। আর আপনাদের কানে কানে আরও বলি এই যে, প্রতিমন্ত্রীর সাথে খাতির থাকায় বাজারে আমার দাম বাড়লেও আসলে কিন্তু কোনো খাতিরই নেই। মন্ত্রী মহাশয় আমাকে চেনেন। আমি তার এলাকার লোক। তিনি সদাশয় হয়ে আমার একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সশরীরে হাজির হয়েছেন, এটুকুই। তা বাজারে যা রটে গেছে তাতে আমি কোনো রা করি না, দাম যদি কিছু বাড়ে বাড়ূক না!
কিন্তু বাজারে দাম বাড়লে যে সব সময় ‘সাধু সাধু’ হয় না, তা বুঝতে পারি কিছুদিন পর। পরিচিত, অর্ধ-পরিচিত, বন্ধু, কাছের মানুষ, দূরের মানুষ সবাই সারি বেঁধে আসতে থাকে আমার কাছে। তা এই সারি বাঁধা মানুষের নানান সমস্যা। একেকটার চাইতে একেকটা অদ্ভুত। এসব সমস্যার কোনো হাত-পা নেই। কী ব্যাপার! আমি তো একেবারে হতবিহ্বল। তো এই সমস্যা-সংকুল লোকজন এসেই আমার হাতটা ধরে ফেলে। তারপর বলে, ‘আপনি একটু মন্ত্রীর কাছে তদবির করে দেন।’ আমি তো মহাদুর্যোগে। জীবনে তদবির জাতীয় কিছুই করিনি। এসব সমস্যা কেমন করে দূর করতে হয়, তাও জানি না। শুনেছি, তদবিরে তেল অথবা মাল লাগে। এখন মন্ত্রীর কাছে এই তেল কেমন করে মাখতে হয় আর মাল কীভাবে পৌঁছাতে হয়, তাও জানি না। নিরীহ ছা-পোষা মানুষ। চাকরি একটা করি। দিন চলে যায়। নিজের জমি-জিরেত নেই, উপরের পদের কোনো ধান্দা নেই, কোনো ব্যবসা ধরার ইচ্ছেও নেই। তাই আমার কোনো তদবিরও নেই। এখন এসব মানুষকে এ কথা বোঝাতেও পারি না যে, আসলে মন্ত্রীর সাথে আমার কোনো খাতির নেই। এসব কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তারা কিছুতেই মানে না। নাছোড়বান্দার মতো বলে, আপনি একটু ভালো করে মন্ত্রীকে ধরলেই হবে। খুব পাওয়ারফুল মন্ত্রী।
আমি তাদের বোঝাতে পারি না এবং তারা আমাকে ভুল বুঝতেই থাকে। ফলে কাছের মানুষ পর হতে থাকে। আর বাজারে চালু হতে থাকে- মন্ত্রীর সাথে খাতির হওয়ায় আমার দেমাগ বেড়েছে!
আমার যখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, তখন একদিন ফোন পাই- শামীমা, কেমন আছো? আমি আলিমুল হক। চিনতে পেরেছো?
আমি কণ্ঠ শুনে বুঝি না। ‘আলিমুল’- চিন্তা করার আগেই তিনি বলেন, তোমার স্যার আলিমুল হক।
আমার পুরনো বস, যার অধীনে আমি চার বছর কাজ করেছি। ভালোমানুষ। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দু’তিন বছর আগে অবসরে গেছেন। স্যারের সাথে অনেক দিন দেখা নেই। স্যারের কণ্ঠ পেয়ে আমার কণ্ঠে যথাসম্ভব সমীহ এনে বলি-
স্লামালাইকুম স্যার। ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালো আছি। আচ্ছা, তুমি জানি কোন এলাকায় থাকো?
বাসাবো থাকি স্যার।
আমাকে ঠিকানা আর লোকেশনটা এসএমএস করে পাঠিয়ে দিও। আমি একটু তোমার বাসায় আসব।
স্যার আমার বাসায় আসবেন! আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। স্যারের মতো এত বড় ব্যক্তিত্ব হঠাৎ আমার বাসায়! বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে বলি-
অবশ্যই আসবেন স্যার। কবে আসবেন?
আগামীকালই আসতে চাই। তুমি কি সন্ধ্যায় সময় দিতে পারবে?
তা পারব স্যার। কোনো জরুরি কিছু?
আমি এসেই তোমাকে বলব।
পরদিন সন্ধ্যায় স্যার আমার বাসায় আসেন, হাতে মিষ্টির প্যাকেট। স্যারের কি কোনো সুসংবাদ? সুসংবাদ হলেও আমার বাসায় মিষ্টি আনবেন কেন? কিন্তু স্যারকে কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারি না। পুরনো বস; খুবই সম্মানের সাথে আপ্যায়নের চেষ্টা করি।
স্যার খুব বেশি সময় নেন না। চা খেতে খেতে বলেন- শোনো, তোমার কাছে এসেছি একটা কাজে। কাজটা করে দিতে হবে।
কাজ করে দেব! আমি এমন কী ক্ষমতা রাখি যে, স্যারকে কোনো কাজ করে দেব? স্যারের কত রকম জানাশোনা। উঁচু মহলের কত মানুষের সাথে তার ওঠাবসা। আমি বিস্মিত হয়ে বলি-
আমি কাজ করে দেব স্যার!
হ্যাঁ, কাজটা কিন্তু তোমাকে করে দিতেই হবে।
আমার সাধ্য থাকলে অবশ্যই করে দেব। আপনি আমার গুরুজন। আপনার অধীনে এতদিন কাজ করেছি; কেন করে দেব না! কী কাজ, বলেন স্যার?
গাজীপুরে আমার দেড় বিঘা জমি আছে, খুবই ভালো লোকেশনে। জমিটা নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। স্থানীয় কিছু নেতা আর চেলারা জমিটা দখলের নানা পাঁয়তারা করছে। খুবই বাড়াবাড়ি করছে তারা। এখন মন্ত্রীকে একটু ধরতে হবে। তোমার সাথে তো মন্ত্রীর ভালো জানাশোনা আছে। কাজটা তোমার করে দিতে হবে।
বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। আবার মন্ত্রী! শুকনো কণ্ঠে আমি বলি- স্যার, মন্ত্রী তো ওই এলাকার না। উনি কি এটা কিছু করতে পারবেন?
পারবেন। উনি এখন খুব ভালো অবস্থানে আছেন। উনিই পারবেন।
হায় কপাল! মন্ত্রী যে কেন আমার অনুষ্ঠানে আসলেন! যার সাথে দুই বছরে একবারও দেখা হয়নি, কথা হয়নি; সেই স্যার কেমন করে জানলেন আমার সাথে মন্ত্রীর জানাশোনা আছে। কোন শুভাকাঙ্ক্ষী যে এই সংবাদ পৌঁছে দিল! এখন আল্লাহ যদি সহায় হন।
ঠিক আছে স্যার, দেখব কিছু করা যায় কি-না।
খুব ভালোভাবে ধরতে হবে।
আপনি আমার শ্রদ্ধেয়। আমি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।
দু’দিন পরে আবার স্যারের ফোন- শামীমা, কেমন আছো?
জি স্যার, ভালো।
শামীমা, জমিটা নিয়ে খুবই বিপদে আছি। ওই কাজটা তোমাকে খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে।
জি স্যার।
শোনো, তুমি তো আমার নিজের মানুষ; আর তোমাকে তো আমি খুবই স্নেহ করি। এই জমিটা যদি ঠিক হয় তাহলে তোমাকে আমি নিজের মনে করে এক লাখ টাকা দিয়ে দেব।
আমি আঁৎকে উঠি- টাকা! কী বলেন স্যার!
না, না। তুমি অন্যভাবে নিয়ো না। তুমি তো এক অর্থে আমার মেয়েরই মতো। আমি খুশি হয়ে তোমাকে দেব।
টাকা! সত্যি আমি খুবই বিপন্ন বোধ করি। আমার কানকে বিশ্বাস হয় না। স্যার আমাকে টাকা সাধছেন- আর এটাও শুনতে হলো? স্যারের সাথে চার বছর কাজ করেছি। আমার চাকরি জীবনে এক কাপ চা-ও খাই না- এ কথা কে না জানে! স্যারের জন্য একটু কষ্টও লাগে, কতটা অসহায় বোধ করলে জুনিয়র একটা মেয়েকে টাকা সাধা যায়!
না স্যার। টাকা নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আপনার কাজটা হবে কি-না জানি না। হলেই আমি অনেক খুশি।
শোনো, এক কাজ কর। তুমি আমাকে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাও।
মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া যে খুব কঠিন তা নয়। মন্ত্রণালয়ে যাওয়া যায়, আবার মন্ত্রীর বাসাও চিনি। ছুটির দিনে সকালে তিনি লোকজনের সাথে দেখাও করেন। আমি তার এলাকার লোক। এলাকার পাঁচ-দশজন আমাকে চেনে। তিনিও চেনেন আমাকে। মন্ত্রীর সাথে বাসায় দেখা করা লোকদের সময় ঠিক করে দেয় যে ছেলে, সেও আমার পরিচিত। বেকার ঘোরাঘুরি করত। বাবা পানের দোকানদার। আগে ‘আপা আপা’ বলে বিগলিত ছিল। এখন অবশ্য বেশ ভাব-সাব হয়েছে। মাঝে মাঝে সানগ্লাস লাগিয়ে হোন্ডাও চালায়। তবে যা-ই হোক আমার সাথে চোখ উল্টানো ব্যবহার করবে না। সুতরাং নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু মন্ত্রী আমাদের কতটুকু পাত্তা দেবেন, তাই বা কে জানে! আল্লাহ মালুম!
তা, নিয়ে যাওয়া যাবে স্যার। কোথায় দেখা করবেন? মন্ত্রণালয়ে, না বাসায়?
আমার তো মনে হয় বাসায় গেলেই ভালো হয়। মানুষের ভিড় কম থাকবে, সময় নিয়ে কথা বলা যাবে।
ঠিক আছে স্যার, বাসায়ই যাব তাহলে।
সময় নিয়ে পরের সপ্তাহে ছুটির দিনে যখন মন্ত্রীর বাসায় যাই তখন সকাল সাড়ে ১০টা। সময় ছিলো ১০টায়। আমরা আধ ঘণ্টা লেট। স্যার আমাকে তার গাড়ি দিয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়েছেন।
মন্ত্রীর বাসার গেটেই বেশ কিছু লোক দাঁড়ানো। গোল হয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। যাই হোক, দু’একটা সালাম-টালাম পেলাম। স্যার আমাকে একেবারে ফাঁপা ভাববেন না। আমি একটু আত্মবিশ্বাসী হয়েই এগিয়ে যাই। গেটের ভেতরে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু লোক দাঁড়ানো। ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনে-পেছনে চারপাশে প্রচুর জায়গা। সামনের উঠোন পুরোটাই পাকা। এক পাশে গাড়ি রাখার প্রশস্ত জায়গা। পেছনের দিকে বড় বড় গাছ। ঢোকার মুখে একটা আমগাছ। আমের সময় বলে গুচ্ছে গুচ্ছে কিছু কাঁচা আম ঝুলে আছে। ভেতর বাড়িতে ঢুকলে বামদিকে দোতলার সিঁড়ি। সামনের ঘরটা মন্ত্রীর অফিসকক্ষ হিসেবে সাজানো। ডানদিকে ঘরের পর ঘর। একপাশে বেশ বড় ড্রয়িং রুম। এটাই বসার ঘর। ড্রয়িং রুমে ঢুকলেই দেখা যায় মন্ত্রী মহোদয় হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে রক্ত-মাংসের মন্ত্রী নয়। প্রায় ছয় ফুট লম্বা মূর্তির আদলে রাখা ফটোগ্রাফ। রুমজুড়েই অনেক ছবি। বড় করে বাঁধানো দলীয় নেতার ছবি, নেত্রীর ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি এবং বড় করে বাঁধানো আয়াতুল কুরসি। একপাশের বড় শোকেসে অগণিত ক্রেস্ট। ঘরজুড়ে স্কয়ার করে রাখা বেশ কয়েক সেট সুসজ্জিত সোফা। সামনের অংশে দুগ্ধধবল সাটিন মোড়ানো সোনালি কারুকাজের সিংহাসন আকারের এক সেট উঁচু চেয়ার।
বসার ঘরে ঢুকে চমকে উঠি। পুরোটা ঘর মানুষে ঠাসা। এত মানুষ! এরা কি সবাই মন্ত্রীর কাছে এসেছে? বাংলাদেশে কি এখন কোনো মহাদুর্যোগ চলছে? এবার বুঝলাম বাইরে দাঁড়ানো মানুষের জটলার রহস্য। অনেকেরই বসার জায়গা হয়নি।
আমাদের অবশ্য সম্মান দেখানো হলো। মন্ত্রীর বাসার পিএ বসার ব্যবস্থা করলেন। মন্ত্রী এখনও দোতলা থেকে নামেননি। তবে জানা গেল, তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই নামবেন। ঘরটা নারী-পুরুষ আর নানা বয়সী মানুষের নানারকম কথায় গমগম করছে।
মন্ত্রী মহোদয় আবির্ভূত হলেন ১১টা ৪০-এ। তিনি পদে বড়, আকারেও বড়। জুমাবার। সাদা লম্বা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে পবিত্র বদনে ছয় ফুট লম্বা দেহ নিয়ে সিংহাসন টাইপের চেয়ারটাতে বসলেন। মন্ত্রী ঢোকামাত্রই ঘরে ভিড় বৃদ্ধি পেল। দরজার কাছেও জটলার সৃষ্টি হলো। চোখের নিমিষে মন্ত্রীকে ঘিরেও একটা জটলা তৈরি হলো।
মন্ত্রী বিরক্ত হয়ে একটা হুঙ্কার দিলেন। মন্ত্রীর পিএ এসে অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। লোকজন একটু শৃঙ্খলার সাথে দাঁড়ালেন। একজন একজন করে মন্ত্রীর সামনে আসছেন। মন্ত্রী কাউকে ধমক দিচ্ছেন। কাউকে খচখচ করে কাগজে স্বাক্ষর করে দিচ্ছেন। কাউকে রাগত স্বরে বলছেন- ‘তুই আবার আইলি ক্যান? তরে আইতে না করছি না?’ মাঝে মাঝে লাইন ভেঙে যাচ্ছে। দু’তিনজন এক সাথে মন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে কীভাবে এগিয়ে যাব বুঝে উঠতে পারছি না। একটু ভয়ে ভয়েও আছি- যেই হাবভাব দেখছি, এখন এই চেলাচামুণ্ডের সামনে মন্ত্রী যদি বিরক্ত-ভাব দেখান, তাহলে তো আর কোনো মান-ইজ্জত থাকবে না। যাহোক সেখানেও আমাদের সম্মান করা হলো। আমার চেনা সেই পিএ সামনে ডেকে নিয়ে বললো- স্যার, আপা এসেছিলেন।
মন্ত্রী মহোদয় ঘাড় কাত করে আমাকে বললেন, হ্যাঁ বলো তোমার কী বিষয়?
আমি স্যারকে এগিয়ে দিয়ে বলি, আমার স্যার একটা সমস্যায় পড়েছেন। আপনার একটু দেখতে হবে।
দেখি কী সমস্যা?
স্যার হাতের ব্যাগ থেকে দলিল বের করে বললেন, গাজীপুরে এই জমিটা আমি ২০০৩ সালে কিনেছি। এই যে দলিল।
মন্ত্রী মহোদয় হাত উঁচু করে দলিলটা তেরচা করে ধরে মাথা কাত করে একনজর দেখে বললেন, তো ব্রাদার আপনি জমি কিনছেন, আমি কী করতে পারি?
এখন এই জমিটা এলাকার কিছু ছেলে আর নেতারা মিলে দখল করতে চাচ্ছে।
তা তো করবেই। ঢাকা আর গাজীপুরে জমির দাম আসমানে উইঠ্ঠা গেছে। আপনি জমি কিনছেন ১০ লাখ দিয়া; জমি এখন হইয়্যা গেছে দেড় কোটি টাকা। এখন এই জমির প্রতি চোখ তো পড়বেই।
স্যারের কণ্ঠটা একটু নেতিয়ে পড়ে- কিন্তু আমার কেনা জমি। কাগজপত্র একদম ক্লিয়ার।
বাংলাদেশ বোঝেন তো? কাগজ বানাইতে কতক্ষণ?
স্যার একটু আমতা আমতা হয়ে যান- আপনি যদি একটু বলে দিতেন তাহলে হয়তো দখল করার সাহস পাবে না।
কোনো লাভ হবে না। এসব জমি হলো কাঁচা টাকা। স্বর্ণের খনি। এসব ব্যাপারে কেউ কথা শুনতে চায় না। এসব জমির ঝামেলার ব্যাপারে আমি কিছুই করতে পারব না।
এবার আমি কথা বলি- আপনি একটু দেখেন কিছু করা যায় কি-না।
মন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে বলেন- কিচ্ছু করার নাই। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি গাজীপুরের ওসি সাহেবকে বলে দেব।
আমি আর স্যার বের হয়ে আসি। গাড়িতে বসে স্যারের সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে।
আমি কোনো কথা না পেয়ে স্যারকে সাহস দিতে বলি- স্যার, আপনার কাছে জমির সব কাগজ আছে না?
আছে। কাগজে কোনো ভেজাল নাই।
তাহলে কিছু করতে পারবে না স্যার। জমির কাগজ ঠিক থাকলে এখন কেউ আর জমি দখল করতে পারে না। আগে কাগজের দাম ছিল না। এখন জমির কাগজ থাকলে সব ঠিক। ওরা কোন যুক্তিতে দখল করতে চায়?
আমি এক বিধবা মহিলার কাছ থেকে জমিটা ২০০৩ সালে কিনেছিলাম। মহিলাই এই জমির মালিক। আর বোঝ তো, ২০০৩ সালের কেনা। সবই ঠিক আছে। এতদিন কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তার সৎ ছেলে এসে এই জমির মালিকানা দাবি করে ঝামেলা করছে।
দাবি করলেই কী? তার কাছে তো আর মালিকানার প্রমাণ নেই। তাহলে কীভাবে সে জমির মালিক হবে!
কাগজ নেই, সে মালিকও না, কিন্তু ঝামেলা করছে। সেই ছেলে মামলা করেছিল; মামলায় হেরেও গেছে। আর এখন সুযোগ পেয়েছে। সময়টা তো ভালো না। এই ছেলের শয়তানির সুযোগে স্থানীয় নেতা-পাতিনেতা আর ছাত্রনেতারা এটাতে চোখ দিয়েছে। তারা কিছু টাকা খাওয়ার ধান্দা করেছে। একটু আগে মন্ত্রী কী বললেন, শুনলে না। জমি হলো স্বর্ণের খনি, কাঁচা টাকা। জমি নেওয়া তো বিষয় না। উদ্দেশ্য তো টাকা কামাই। আর তাদের টাকার চাহিদা তো অনেক।
মন্ত্রী তো বললেন, ওসিকে বলে দেবেন।
স্যার হতাশ কণ্ঠে বলেন- না, কোনো লাভ হবে না। মন্ত্রী হয়ে উনি তো একদম বদলে গেছেন। অথচ এই লোক যখন ব্যবসা করতেন, তখন আমার কাছে কয়েকবার এসেছেন।
স্যার ক্ষমতা! ক্ষমতা মানুষকে বদলে দেয়।
সৌজন্যের খাতিরে সপ্তাহ দুই পরে আমি আবার স্যারকে ফোন দিই।
স্যার, ভালো আছেন? আপনার খবর নিতে ফোন করলাম। আপনার জমির ঝামেলা মিটেছে স্যার?
ভালো আছি। না, জমির ঝামেলা মেটেনি। এখন আরও সমস্যা হচ্ছে।
কী সমস্যা হলো?
ওরা নকল কাগজ বের করে জমি একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
কী বলেন স্যার? এটা কীভাবে করল?
নকল কাগজ দেখাল, সাথে জমি তাদের দখলে আছে- এ রকম দেখিয়ে বিক্রি করল। আর ওদের তো এখন জোর আছে, বোঝ না?
জমি তো আপনারই দখলে ছিল। ওরা জমি দখল করল কীভাবে?
জমি তো দখলেই ছিল। পুরো জমিতে দেয়াল দিয়েছি, গেট লাগিয়েছি। ভিতরে গাছ আছে। একটা ঘর তুলে দারোয়ানকে দিয়েছি থাকার জন্য। সবই তো ছিল। কিন্তু ওরা জমিতে ঢুকে দারোয়ানকে মেরে বার করে দখল নিয়েছে। স্থানীয় নেতা আর প্রশাসন ওদের পক্ষে কাজ করেছে। আর দারোয়ান; তার ও তো জীবনের ভয় আছে।
এখন কী করবেন স্যার?
যে লোক কিনেছে সে তো কিনে ফেলেছে। কিন্তু পরে কাগজ দেখে বুঝতে পেরেছে জমি এখন দখল করলেও পরে তারও সমস্যা হবে। মামলা হলে হেরে যাবে, কারণ তার কাগজ ঠিক নেই। তাই আমার সাথে যোগযোগ করেছিল। পরে স্থানীয় নেতা আর দুপক্ষের লোকজন নিয়ে একটা সালিশ হয়েছে। তারা বলছে, দু’পক্ষেরই হক আছে।
দু’জনের হক আছে মানে! আপনি জমি আগে কিনেছেন, আপনি জমির মালিক। আর জমি এতদিন আপনার দখলেও ছিল। দু’পক্ষের কী করে হক থাকে? দেশে কি আইন নেই?
সেটা তো ঠিক আছে; জমি আমি আগে কিনেছি। এখন এসব নায্য কথা কে বলবে? আর আইন তো আছে। আইনের মাধ্যমে মিটাতে হলে মামলা করতে হবে। মামলা, সে তো টাকা-পয়সার ব্যাপার। নিজের জানেরও একটা ভয় থাকে। আর আইনও কি আমার পক্ষে কথা বলবে? কে জানে! তাই সমঝোতার মধ্যেই মিটাতে চাইছি। সালিশেই গেলাম।
সালিশে কী বলল?
সালিশ আর কী হবে বোঝ তো! যারা জমি দখলের সাথে আছে তারাই তো সালিশের লোক। তারা তো নিরপেক্ষ না। সালিশ দুই পক্ষের লোকজন ডাকল। দু’জনের কাগজই দেখে বলল- সৎমা একজনের কাছে বেচেছে, আর সৎ ছেলে আরেকজনের কাছে। তাই দু’জনেরই হক আছে। ভালোভাবে ফয়সালা না পর্যন্ত এই জমি কারও না। আপনারও না, ওনারও না। জমি কারও দখলেই দেওয়া হবে না। গেটে তালা থাকবে। এই জমি এখন নো ম্যানস ল্যান্ড।
সূত্র: সমকাল









