বারবাড়ির বাংলাঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আলহাজ মীর মোর্তুজা সাহেব চিন্তিত মুখে তাঁর বসতবাড়ির চারপাশে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দুকধারী পুলিশদের দিকে নজর করে তাকান। তাঁকে একটু অধৈর্য দেখায়। প্রায় আধা ঘণ্টা আগে পারিবারিক কর্মচারী নুরুল্লাকে সাইকেলে বাজারে পাঠিয়েছেন দারোগার জন্য দুই প্যাকেট ক্যাপস্টেন সিগারেট আনাতে। বেকুবটা এখনো ফিরে আসেনি দেখে বিরক্ত লাগে। বেলা তেমন হয়নি। বাড়ির চারদিকে ফসলের মাঠে ধানের সোনালি-সবুজ শিষে লেগে থাকা শিশিরবিন্দুতে ছড়াচ্ছে রংধনুর অলীক আভা। ছাতিমহাটা গ্রামের মানুষজন কেবল জেগে উঠেছে। টেকো মাথার দুজন চাষিকে দেখা যাচ্ছে আলপথ ধরে হেঁটে যেতে। শিরীষগাছের তলায় সাদা রঙের হিলম্যান হান্টার গাড়িটি ভোরের আলোয় ঝলমল করছে। তাতে বাড়ির ঝি-বেটি শুকাতে দিয়েছে বেগুনি রঙের ভেজা শাড়ি। এই দৃশ্যে হাজি সাহেবের মনে বলকে ওঠে ক্রোধ, বেটি কাপড় মেলে দেওয়ার আর কোনো জায়গা পায়নি। ইচ্ছা হয় তার ঘেটি ধরে ঝাড়ুপেটা করতে।
হাজি সাহেব হজ সমাপন করে দাঁড়ি রেখে ধবধবে সাদা পায়জামার সঙ্গে ঘিয়ে রঙের আচকান পরতে শুরু করেছেন কাস্টমসের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর থেকে। কাস্টমসে ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্টের পদ অব্দি উঠেছিলেন। আখাউড়ার সীমান্ত তাঁর জুরিসডিকশনে এলে আলহাজ মীর মোর্তুজা বিস্তর সয়-সম্পত্তির মালিক হন। থানা শহরে কেনেন পেট্রলপাম্প। দুখানা বাসের মালিক হাজি সাহেব বাস মালিক সমিতির সভাপতি হিসেবে এলাকায় প্রচুর প্রভাবপত্তি রাখেন। রিটায়ার্ড হালতে গ্রামের বাড়িতে বাস করলেও কখনো কোথাও যাওয়ার দরকার পড়লে নিজের গাড়িতে চলাচল করতে পছন্দ করেন তিনি। গাড়িখানা ভেতরবাড়ির দোরগোড়ায় শিরীষগাছের তলায় রেখেছেন খানিকটা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। ঝি-বেটি তাতে ভেজা কাপড় মেলুক তা তিনি আদপেই পছন্দ করেন না।
ভেতরবাড়ির দরজার বেড়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ঝি-বেটি তাঁকে জানায়, রান্নাঘরে আন্ডা-পরোটা তৈরি হয়ে গেছে, কেটলিতে চা-ও রেডি। তাঁকে প্রথমে কাটা পেঁপেসহ নাশতা নিয়ে আসতে বলেন তিনি। গরম চা যেন টি-পটে করে নাশতা দেওয়ার ঠিক বিশ মিনিট পর নিয়ে আসা হয়। খুঁটিনাটি বুঝিয়ে বলে ইশারায় হুকুম দেন গাড়ির ওপর থেকে ভেজা কাপড় সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ঝি-বেটি শরম পেয়ে ঘোমটা টেনে ধূসর-ডানা চিল যে রকম ঝাপটা মেরে তুলে নেয় মুরগির বাচ্চা, সেভাবে ভেজা শাড়ি দলামছা করে তুলে নেয় তার হাতে।
হাজি সাহেব দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে আজ ভোরবিহানের ঘটনাটি তর্পণ করেন। বাদ ফজর তিনি তসবি টিপতে টিপতে বারবাড়ির বাংলাঘরের সামনে এসেছিলেন পুকুরপাড়ে পারিবারিক গোরস্থান জিয়ারত করতে। কুয়াশায় ছায়ামূর্তির মতো বন্দুক হাতে এক কনস্টেবলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন। অস্থিরভাবে মোনাজাত শেষ করে বাংলাঘরের দিকে ফিরতেই বারান্দায় দেখতে পান দারোগা ও সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টরকে। তাঁদের সঙ্গে তিনি পরিচিত। তাঁর ঘোরতর বামপন্থী শ্যালক ফজলে রাব্বির বিয়েতে দুজনের সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে মাত্র সপ্তাহ দু-এক আগে। রাব্বি তাঁদের সঙ্গে হাজি সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের মেহমানদারির দায়িত্ব দুলাভাইয়ের ওপর সমর্পণ করেছিলেন। একই টেবিলে বসে খানা খেতে খেতে তিনি খেয়াল করলেন, তরুণ দারোগা ক্রমাগত ক্যাপস্টেন সিগারেট ফোঁকেন। কথাবার্তায় আরও জানতে পারেন যে গাঁও-গেরামে আকছার ঘটে চলা ক্রাইম, যেমন খুন-খারাবি কিংবা সীমান্তের ওপারে ইলিশ মাছ পাচার, গরু চুরি ইত্যাদি সম্পর্কে দারোগার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি পড়ুয়া লোক, জরাসন্ধের লৌহকপাট তাঁর প্রিয় বই, কলেজজীবনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করে একবার রুপার মেডেল পেয়েছিলেন। সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টর অবশ্য চুপচাপ গোছের। খাওয়ার আগে ও পরে তিনি দুবার নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেছওয়াক করেন।
তাঁরা হাজি সাহেবকে সালাম দিলে তিনি তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান। সদ্য বিবাহিত শ্যালক ফজলে রাব্বি গতকাল তাঁর কনেবউ নিয়ে এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। এই মুহূর্তে সস্ত্রীক ভেতরবাড়ির একটি কামরায় ঘুমিয়ে আছেন। সরকারবিরোধী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার কারণে রাব্বি এ নিয়ে তিনবার কারাবরণ করেছেন। শেষবার গ্রেপ্তার হন দেশে জেনারেল ইস্কান্দর মির্জার নেতৃত্বে ৯২/ক ধারা জারি হলে। একনাগাড়ে সাড়ে তিন বছর জেল খেটে মাত্র মাস দেড়েক আগে তিনি খালাস পেয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি তাঁকে আবার জেলে পোরার জন্য কুটুমবাড়িতে বাদ ফজর দারোগা-পুলিশ এসে হাজির হবে, হাজি সাহেব তা প্রত্যাশা করেননি। কিন্তু মুখের ভাবে অবাক হওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে আইনি কর্মকর্তাদের খাতিরযত্ন করে বাংলাঘরের ভেতরে বসান।
দারোগা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, গেল রাতে ওপর থেকে হঠাৎই পরোয়ানা পাঠিয়ে ফজলে রাব্বি সাহেবকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি নাচার, হুকুম না মেনে কোনো উপায় নেই। সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টর শান্তভাবে জানান, গ্রেপ্তারজনিত কারণে যাতে হাজি সাহেবের কোনো ইজ্জতহানি না হয়, এ ব্যাপারটি তিনি স্বয়ং দেখবেন। দারোগা ফস করে এক শলা ক্যাপস্টেন ধরিয়ে বলেন, নিউলি ম্যারিড কাপলকে স্বাভাবিকভাবে ঘুম থেকে উঠতে দেওয়া হোক। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ফজলে রাব্বি সাহেব রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে যাবেন। তিনি নাশতাপানি সেরে স্যুটকেস ইত্যাদি গুছিয়ে ঘণ্টা খানেকের ভেতর বেরিয়ে এলেই হবে। তিনি পুলিশের ফোর্স ভেতরবাড়িতে পাঠিয়ে খানা তল্লাশির কোনো প্রয়োজন দেখছেন না।
বাংলাঘরের বারান্দায় তাঁদের দেখতে পেয়ে প্রথমত মনে মনে দমে গেলেও আইনি কর্মকর্তাদের ভালো ব্যবহারে হাজি সাহেবের কনফিডেন্স ফিরে আসে। ইংরেজিতে তিনি তাঁদের বলেন, ‘জেন্টেলম্যান, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ আর অন গভর্নমেন্ট ডিউটি, কিন্তু এটা আমার বসতবাড়ি, যৎসামান্য গরিবালয়, আমি সামাজিকভাবেও আপনাদের সাথে পরিচিত, মে আই ইনভাইট ইউ টু হ্যাভ আ সিট ইন মাই পার্লার, অ্যান্ড বি মাই গেস্ট।’ এগিয়ে গিয়ে তিনি বাংলাঘরের বৈঠকখানার কাচের দুয়ার খুলে আবার বলেন, ‘কাইন্ডলি ভেতরে এসে বসুন, আর আমার মেহমান হিসেবে এক পেয়ালা চা খেলে জেন্টেলম্যানান আই উড বি ট্রুলি গ্রেটফুল।’ সরকারি কর্মকর্তা দুজন কোনো কথা না বলে বৈঠকখানায় ঢুকে বেতের সোফায় বসেন। টি-টেবিলে রাখা তিন দিনের পুরোনো মর্নিংনিউজ পত্রিকাটি খুলে ধরেন দারোগা। তার প্রথম পৃষ্ঠায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে পিআইএর একটি বোয়িং বিমান থেকে চৌকস স্যুটপরা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার ছবি। দারোগা সংবাদে মনোনিবেশ করলে সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টর মৃদুস্বরে বলেন, ‘আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর ডিসরাপ্টিং ইয়োর লাইফ, হাজি সাহেব, কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না, কাইন্ডলি ভেতরবাড়িতে গিয়ে রাব্বি সাহেবকে আমাদের কথা বলুন। মি. রাব্বি ইজ আ ভেরি রিজনেবল পারসন। হি উড আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই উই হ্যাভ কাম টু ইয়োর হোম।’
ঝরা পাতার ওপর দিয়ে ছরছরিয়ে এসে সাইকেল থেকে নামে বাড়ির কর্মচারী নুরুল্লা। হাজি সাহেব কোনো কথা না বলে তার হাত থেকে নেন ক্যাপস্টেনের প্যাকেট দুটি। ভোরবিহানের ঘটনা ভাবতে ভাবতে একটু কনসেনট্রেট করেন তিনি। দীর্ঘ পেশাদারি জীবনে অসংখ্যবার এন্তার সংকট মোকাবিলা করেছেন। তাঁর বসতবাড়িতে দারোগা-পুলিশের আসা উপলক্ষে আজ যা ঘটতে যাচ্ছে, তা-ও তিনি ম্যানেজ করতে পারবেন—এ ধরনের কনফিডেন্স নিয়ে অতঃপর কাঁধের ওপর কাশ্মীরি শালটি অ্যাডজাস্ট করতে করতে বাংলাঘরের বৈঠকখানায় ঢোকেন হাজি সাহেব। কামরার এক কোণে জায়নামাজ বিছিয়ে সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টর সেরে নিচ্ছেন ফজরের কাজা নামাজ। দারোগা পুরোনো একটি মাহে নও পত্রিকার পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে নড়েচড়ে বসেন। হাজি সাহেব তাঁকে জানান, তাঁর শ্যালক ফজলে রাব্বি ঘুম থেকে উঠেছেন। আধঘণ্টা, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসবেন। দারোগা হাত তুলে এমন ভঙ্গি করেন, যেন এ বিষয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। সিগারেটে কষে টান দিয়ে তা অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে তিনি বলেন, ‘রাব্বি সাহেবের গানের গলা কিন্তু চমৎকার। ওনাকে প্রথম দেখি বরিশালের বিএম কলেজে এফএ পড়ার সময়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বছর দু-এক পরের কথা, তিনি ছাত্রদের এক জমায়েতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন।’
ততক্ষণে সিআইডি সাব-ইন্সপেক্টরের নামাজ পড়া শেষ হয়েছে। সালাম ফিরিয়ে দরোগার মন্তব্যের জের ধরে তিনি বলেন, ‘রাব্বি সাহেবের সাথে আমার দেখা হয় বায়ান্নরও অনেক আগে, উনি ঢাকা মেইলে চড়ে অনেক লোকলস্কর নিয়ে কাগমারী সম্মেলনে যাচ্ছিলেন। ইনফরমার হিসেবে আমি একই কামরায় বসে বসে নজর রাখছিলাম তাঁর ওপর।’ ঝি-বেটি আন্ডা-পরোটা ও কাটা পেঁপের ট্রে নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলে আলোচনায় ছেদ পড়ে।
ফজলে রাব্বি সাহেব ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে একটি চেয়ারে বসেছেন। দারোগা-পুলিশ আসার বিষয়টি শুনেছেন তিনি। এক শলা কিংস্টর্ক ধরিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালার বাইরে তাকান তিনি। তাঁকে শান্ত দেখায়। তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী রেহানা চা নিয়ে আসে। পিরিচে ছলকে পড়া চা রেহানা নিজের আঁচল দিয়ে মুছে তাঁর হাতে তুলে দিলে বউয়ের মুখের দিকে তাকান রাব্বি। নিশ্চুপ এই তরুণীর মুখে এখনো লেগে আছে গেল রাতের প্রসাধনের ছাপ। বেশ রাত করে রাব্বি তাকে নিয়ে এই জানালার পাশে বসে ছিলেন। রেডিওতে আকাশবাণী থেকে সুবিনয় রায়ের গলায় বাজছিল রবিঠাকুরের গান, ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না’।
তাঁদের বিয়ে হয়েছে মাত্র চৌদ্দ দিন আগে। দুলাভাই হাজি সাহেবের খালাতো বোন রেহানার সঙ্গে রাব্বির যৎসামান্য জানাশোনাও ছিল। অনেক বছর আগে কিশোরী রেহানার যক্ষ্মারোগে গলা দিয়ে রক্ত উঠলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যাপারে বেশ ছোটাছুটি করেছিলেন। সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করলেও রেহানা অবিবাহিত থেকে যায় একত্রিশ বছর বয়স অব্দি। মা-বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন কমপক্ষে তিনবার। কিন্তু প্রতিবারই গাঁয়ের কোনো না কোনো চোগোলখোর বরপক্ষকে যক্ষ্মারোগের তথ্য দিয়ে কানভাঙানি দিলে ভেস্তে যায় বিয়ে।
এবার কারাগার থেকে বেরোনোর পরদিন থানা শহরে রাব্বিকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে পুরোনো দিনের স্বদেশি করা প্রৌঢ়া পূরবী দিদির পাশে বসে ছিল রেহানা। বক্তৃতা দিতে উঠে সাদা রঙের তাঁতের শাড়ি ও কপালে টিপ পরা এক তরুণীর দিকে চোখ পড়েছিল রাব্বির। অনেক দিনের ব্যবধান বলে তাকে রেহানা বলে ঠিক চিনতে পারেননি। তবে তরুণীর নিরাভরণ বিষণ্ন দৃষ্টি তাঁর মধ্যে তৈরি করেছিল কিছু একটা না পাওয়ার হাহাকার। পূরবী দিদিই তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন রেহানাকে। তিনি আরও জেনেছিলেন যে তাঁকে দেওয়া সাইক্লোস্টাইলে মুদ্রিত সংবর্ধনাপত্রটিও রেহানার লেখা। বাড়ি ফিরে গল্পচ্ছলে বিষয়টি দুলাভাইয়ের কাছে বলতেই তৎক্ষণাৎ রেহানার সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব পাড়েন তিনি। কিশোর বয়সে স্বদেশি আন্দোলনে দীক্ষা নেওয়া ফজলে রব্বির কাছে মাতৃভূমি প্রণয়িনীস্বরূপা। অনেক বছর ধরে তিনি যে ধরনের জীবনযাপন করছেন, তাতে রাজনৈতিক কারণে মাঝেমধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে আত্মগোপন করা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিয়ের অবকাশই বা কোথায়? তাঁর বয়সও পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। কোনো কমবয়স্ক তরুণীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করাও তিনি আপত্তিকর বিবেচনা করেন।
কিন্তু দুলাভাইয়ের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করতে গিয়ে তাঁর মনশ্চক্ষে ঝিক করে ভেসে ওঠে রেহানার সেই বিষণ্ন দৃষ্টি। জবাব দেওয়ার জন্য এক দিন সময় চান। পরদিন বিষয়টি মাথা থেকে সরাতে কষ্ট হয় তাঁর। তো অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে পার্টির এক মুরব্বির সঙ্গে পরামর্শ করেন। মুরব্বি তাঁর দুলাভাইয়ের পরিচিত। আলোচনাক্রমে বুঝতে পারেন, দুলাভাই মুরব্বির সঙ্গে কথা বলেই তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছেন। বিয়েতে পার্টির সম্মতি জানিয়ে মুরব্বি তাঁকে পলিটিক্যাল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। ময়মনসিংহের মোনায়েম খান নামে এক বটতলার উকিলকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়েছে। ক্ষমতায় এসে সেই উকিল পরিকল্পনা করছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের তাবৎ কার্যক্রম সাপ্রেসেড করার। আগামী মাস কয়েকে দেশে ধরপাকড় হবে প্রচুর। পার্টি চাইছে না ফজলে রাব্বি আবার কারাগারে ফিরে যান। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ হচ্ছে, তিনি যেন রেহানার মতো একজন পার্টি সিমপেথাইজারকে বিয়ে করে থিতু হন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে তিনি যেন শুধু আড়ালে-আবডালে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করতে শুরু করেন। কারণ দেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে। তাই কালচারাল ফ্রন্টে কাজ করা পার্টির প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ধারণা, রাজনীতিতে ডাইরেক্টলি যুক্ত না থেকে নরমাল জীবনযাপন করলে তাঁর ওপর হুলিয়া জারি হবে না। এতে সদ্যবিবাহিত হালতে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সেট-আপে তিনি অপ্রত্যক্ষ থেকে সমর্থন করতে পারবেন পার্টির আগামী দিনের কর্মকাণ্ড।
পার্টির পরামর্শে দুলাভাইকে বিবাহের এন্তেজাম করতে বলেন রাব্বি। এই সিদ্ধান্তে নিজের ভেতর থেকে সায় আছে বুঝতে পেরে তাঁর মাঝে ছড়ায় পঙ্কজ মল্লিকের চমৎকার একটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার মতো প্রশান্ত অনুভূতি। বিবাহ আয়োজনের নানাবিধ তৎপরতার ফাঁকে সংগোপনে তিনি লিপ্ত হন এলাকায় বড় করে রবীন্দ্রসংগীতের একটি সম্মেলনের আয়োজনে।
চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরতে পরতে একটি বিষয় তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কোনো না কোনোভাবে সরকার তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং রবীন্দ্রসংগীতের সম্মেলন বন্ধ করতে তারা বদ্ধপরিকর। রেহানা নীরবে তাঁর জন্য একটি ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। তার চোখমুখে খেলছে বিষাদ ও বিভ্রান্তি। দরজায় মৃদু করাঘাত করে গলা খাঁকারি দিয়ে হাজি সাহেব বাইরে থেকে জানতে চান রাব্বি প্রস্তুত হচ্ছেন কি না।
পাম্পসু পায়ে গলিয়ে ব্যাগ হাতে নিতেই তাঁর খুব কাছে আসে রেহানা। জনসভায় ক্রোধ ও প্রতিবাদ ছড়ানোতে পারঙ্গম এই রাজনীতিবিদ ঠিক বুঝতে পারেন না সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে কীভাবে প্রকাশ করবেন অন্তরঙ্গ অনুভূতি। তিনি তার হাত মুঠো করে ধরতেই অনুভব করেন ঝেঁপে জ্বর এসেছে রেহানার শরীরে। কিছু না বলে ব্যাগ হাতে তিনি বেরোন ঘর থেকে। বড় বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বারবাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে রেহানার জ্বরের বিষয়টি তাঁর সচেতনতায় ফিরে আসে। কয়েক দিন থেকে খেয়াল করছেন, শেষ রাতের দিকে মেয়েটির শরীরে ফিরে আসছে ঘুসঘুসে জ্বর। ভেবেছিলেন সদ্যবিবাহের দাওয়াত-জিয়াফত ইত্যাদি কমলে তাকে নিয়ে যাবেন পার্টি চ্যানেলে জানাশোনা এক ডাক্তারের কাছে। কাজটি সমাপন করে যেতে পারেননি বলে অনুশোচনাও হয়। আর আকাশের ঈশানকোণে জমে ওঠা মেঘের মতো তাঁর গহন গভীরে জড়ো হয় উদ্বেগের ঘন কালো মেঘ। তবে কি রেহানার দেহে আবার ফিরে আসছে যক্ষ্মার জীবাণু? এ যাত্রায় তিনি কত বছর কারাবাস করবেন? আবার যখন বেরিয়ে আসবেন, সংবর্ধনা সভায় সাদা শাড়ি পরে কপালে টিপ দিয়ে বসে থাকার মতো সুস্থতা রেহানার থাকবে কি?
তরজার বেড়া অতিক্রম করে বারবাড়িতে আসার সময় পেছনে ফিরে তাকান রাব্বি। অস্পষ্টভাবে দেখেন, জানালার শিকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে রেহানা। গেলবার তিনি যখন কারাগারে যান, ঠিক এ রকম জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর জননী। কারাবাসের সময় মায়ের মৃত্যু হয়। মুক্তিলাভ করে বাড়ি ফিরে প্রথমেই তিনি যান মায়ের কবরে। আজ আরও খানিকক্ষণ পর তিনি রাজবন্দী হিসেবে অন্তরীণ হবেন কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। মুক্তিলাভ করবেন কোনো সুদূর ভবিষ্যতে।
বারবাড়ির বাংলাঘরের বারান্দায় উঠে সরকারি কর্মকর্তা দুজনের সঙ্গে করমর্দন করেন রাব্বি। তাঁদের সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন, বছর কয়েক পর যখন তাঁর কারামুক্তি ঘটবে, দেশে হয়তো তখন সামরিক শাসন থাকবে না, কিন্তু রেহানা কি তাঁর প্রতীক্ষায় তত দিন সুস্থ হালতে বেঁচে থাকবে?
সূত্র: প্রথম আলো