স্বাধীনতার সুখ

স্বাধীনতার সুখ

গহিন এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বাঘের গুহার সামনে কে যেন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল। বাঘ গুহা থেকে বের হয়ে বলল, ‘কে রে তুই? আমার গুহার সামনে দাঁড়িয়ে খ্যাঁক-খ্যাঁক করছিস!’

হাসতে হাসতেই ও বলল, ‘খ্যাঁক-খ্যাঁক শুনে বুঝতে পারছেন না আমি কে? আমি হলাম খ্যাঁকশিয়াল।’

বাঘ বলল, ‘তোকে তো আমি আগে কখনো দেখিনি! তা তুই আমার গুহার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছিস কেন? জানিস আমি কে? আমি বাঘ। এই বনের রাজা।’

‘এই বনের রাজা!’ শিয়ালটা খানিক খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে নিল। তারপর বলল,

‘খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক-

বাঘ নাকি রাজা,

দেখ্ দেখ্ দেখ্।’

শিয়ালের এই কথায় বাঘের খুব রাগ হলো। বলল, ‘তোর এত বড় সাহস? আমাকে তাচ্ছিল্য করে ছড়া বলছিস?’

খ্যাঁকশিয়াল জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলল, ‘বইপত্তরে সবাই পড়ে—সিংহ হলো বনের রাজা। বলি, নিজেকে নিজে রাজা বললেই হয় না। আপনার কথা কি সবাই মানে?’

বাঘ চোখ বড় বড় করে খ্যাঁকশিয়ালের দিকে তাকাল। শিয়ালটা বলতে লাগল, ‘আপনি যদি জিরাফকে বলেন গলা নিচু করে ঘাস খেতে, সে কি তাই করবে? আবার যদি হাতিকে বলেন…’ খ্যাঁকশিয়ালটার কথা শেষ করতে দিল না বাঘ। বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া। আমাকে বুঝে উঠতে দে। জিরাফ কি গলা নিচু করে ঘাস খেতে পারবে?’

‘পারবে মানে? আপনি যদি বনের রাজা হন, সবাইকে আপনার কথা মানতে হবে।’

বাঘ খানিক ভেবে বলল, ‘আচ্ছা। কাল সকাল থেকে তাই হবে।’

ওই জঙ্গলেই ছিল একটা পুঁচকে খরগোশ। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ও নাচতে নাচতে সবুজ ঘাসের বনে চলে এল। একটা কচি ঘাসের ডগা মুখে নিয়ে চিবাতে যাবে, এমন সময় দেখল, জিরাফ কাকু গলা নিচু করে ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করছে। খরগোশছানা খুব অবাক হলো। জিরাফটার কাছে এসে বলল, ‘জিরাফ কাকু, তোমার গলা কত লম্বা। তুমি খাবে উঁচু গাছের পাতা।’

জিরাফ কাকু বলল,

‘জানি, আমি জানি-

নয় তো খাটো, লম্বা অনেক

আমার গলাখানি।’

‘তাহলে গলা নিচু করে ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করছ কেন?’ কারণ জানতে চাইল জিরাফের কাছে। জিরাফ কাকু মন খারাপ করে বলল, ‘এ আমাদের রাজার আদেশ।’

পুঁচকে খরগোশ বলল, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না, কাকু। আমি এক্ষুনি যাব রাজার কাছে।’ তারপর সে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল বাঘের গুহার দিকে।

খানিক বাদে পথের পাশে পড়ল একটা নদী। দেখতে পেল, নদীর পানিতে হাতি দাদু পা দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে। হাতির সামনে এসে খরগোশছানা বলল, ‘হাতি দাদু, তুমি পা দিয়ে নদীর পানি ছিটাচ্ছ কেন? এটা তো তুমি শুঁড় দিয়েই করতে পার!’

হাতি দাদু বলল,

‘জানি, আমি জানি-

জেনেশুনেই পা দিয়ে আজ

ছিটাই নদীর পানি।’

খরগোশছানা বলল, ‘এটাও কি রাজার আদেশ?’

হাতি দাদু মন খারাপ করে বলল, ‘হ্যাঁ, আমাদের রাজার আদেশ। বনের রাজা বাঘ আমাকে এভাবেই পানি ছিটাতে বলেছে।’

এটা কেমন কথা? হাতি আর শুঁড় দিয়ে পানি ছিটাতে পারবে না? এর একটা বিহিত করতেই হবে। হাতি দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুঁচকে খরগোশ আবার হাঁটা শুরু করল বাঘের গুহার দিকে।

ওই পথেই ছিল একটা বড় বটগাছ। খরগোশছানা দেখতে পেল, সেই গাছের নিচে অজগর মামি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা বালিশ। খরগোশ কাছে এসে বলল, ‘অজগর মামি, তুমি বালিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?’

অজগর মামি ঢুলু ঢুলু চোখে বলল,

‘কাকে জানাই নালিশ্‌শ্‌শ্‌-

মুরগি খেয়ে বসে আছি

হাতে নিয়ে বালিশ্‌শ্‌শ্‌।’

খরগোশছানা বলল, ‘মুরগি খেয়ে হাতে বালিশ নিয়ে বসে রয়েছ কেন? বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই তো পার!’

অজগর মামি জানাল, এমনটাই রাজার আদেশ। মুরগি খেয়ে এখন থেকে আর ঘুমানো যাবে না। খরগোশছানা এবার খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, ‘আমি যাচ্ছি রাজার কাছে। দেখব, কেন তিনি এমন ইচ্ছেমতো আদেশ দিচ্ছেন।’

অজগর মামি বলল, ‘তুই দেখিস্‌স্‌স্‌, কিছু করতে পারিস্‌স্‌স্‌ কি না। এই রাজ্যে এখন স্‌স্‌স্বাধীনতা বলে কিছু নেই।’

হাঁটতে হাঁটতে বাঘের গুহার সামনে এসে হাজির হলো পুঁচকে খরগোশ। রাজা বাঘের পাশেই ছিল খ্যাঁকশিয়ালটা। খরগোশছানাকে দেখে বাঘ বলল, ‘কী ব্যাপার, পুঁচকে খরগোশ? আমার গুহার সামনে কেন?’

খরগোশছানা একটুও ভয় পেল না। বাঘকে বলল, ‘জিরাফ কাকু উঁচু ডাল থেকে পাতা খেতে পারছে না। হাতি দাদু আর শুঁড় দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে না। অজগর মামি মুরগি খেয়ে না ঘুমিয়ে রয়েছে।’

খ্যাঁকশিয়ালটা কী যেন বলল বাঘের কানে কানে। তারপর বাঘ জানাল, সে হলো এই বনের রাজা। সে যা বলবে, সবাইকে তা শুনতে হবে। ‘তাই বলে স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না?’ জানতে চাইল পুঁচকে খরগোশ।

বাঘ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই খ্যাঁকশিয়ালটা বলল,

‘খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক-

স্বাধীনতা নেই,

দেখ্ দেখ্ দেখ্।’

পুঁচকে খরগোশ খুব বিরক্ত হলো খ্যাঁকশিয়ালের কথায়। বুঝতে পারল, এই দুষ্টু শিয়ালের কথায় বনের রাজা সবার জন্য নতুন নতুন নিয়ম করেছে। খরগোশছানা বলল, ‘তবে এই খ্যাঁকশিয়ালের জন্যও নতুন নিয়ম করুন আপনি। ওকে বলুন মিউ মিউ করে ডাকতে।’

বাঘ খানিক কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ শিয়াল, এখন থেকে তুমি মিউ মিউ করে ডাকবে।’

খ্যাঁকশিয়াল কয়েকবার চেষ্টা করল মিউ মিউ করার। তার গলা দিয়ে শুধু খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ বের হলো।

খরগোশছানা বাঘকে আবার বলল, ‘বলুন রাজা, দুষ্টু শিয়ালকে মিউ মিউ করতে বলুন। রাজার আদেশ তাকেও তো মানতে হবে।’

শিয়াল আরও কয়েকবার মিউ মিউ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ওই খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হলো না। বাঘের রাগ তখন বাড়তে শুরু করেছে। খ্যাঁকশিয়ালটা সব বুঝতে পেরে আর দেরি করল না। একটু পিছিয়ে এসে গা ঝেড়ে দিল দৌড়। খরগোশছানা বলল, ‘ওই দেখুন, রাজা, শিয়াল এখন পালাচ্ছে।’

বাঘটা দেখল, খ্যাঁকশিয়াল দৌড়াতে দৌড়াতে ওই বন পার হয়ে গেল। পুঁচকে খরগোশ তখন বাঘকে বলল, ‘যে যেমন, সে তো তেমনই করবে।’

বাঘ বুঝতে পারল, সবারই নিজের মতো চলার অধিকার রয়েছে। খ্যাঁকশিয়ালটা এসেছিল যত ঝামেলা পাকাতে। তাই রাজা বাঘ অনেক জোরে ঘোষণা দিয়ে দিল, ‘আজ থেকে স-বা-ই স্বা-ধী-ন।’

সূত্র: প্রথম আলো

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত