লাল পাতা ভরা একটা গ্রাম। গ্রামের ভেতর দিকে একটা নদী, কেউ বলে দুধনদী। দুধের মতো পানির রঙ। এর মধ্যে লাল পাতা ভেসে যায়। ভেসে যায় লাল পাতিল ভরা নৌকা। সকালে-বিকালে ছোট ছোট নাইয়র নৌকা চোখে পড়বে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, ধানক্ষেতের ভেতরে ডাহুকদের গ্রামে গিয়েছিল তারা, এখন ফিরছে। ডাহুকদের গ্রাম আবার কী? শুনেছি, এই গ্রামের লোকজন সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে। আমি রওনা হওয়ার আগে শুনে এসেছি।
বৃদ্ধেরা এখানে টেপাপুতুল বানানোর মতো আঙুল টিপে টিপে মিথ্যা বানায়; রঙ করে- লাল-নীল। মেয়েরা অবশ্য কুয়াশার পেছনের সূর্যের মতো লাল হয়ে ওঠার বয়সে মিথ্যা শেখে। ছেলেদের কাছে তারা বগলের পচা ফুলকপির মতো ঘ্রাণকে গোলাপ বলে কাছে টেনে নেয়। ছেলেরাও মেয়েদের বিশ্বাস করতে ভালোবাসে- ভালোবাসে শপথ করাতে। এই শপথের ফুল খোঁপায় নিয়ে মেয়েরা প্রতিদিন শপথ ভাঙে আর নতুন হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কাছ থেকে মিঠাই কেনে। দোষ এই গ্রামের মেয়েদের নয়; মায়েদেরও আছে। মায়েরা বড় মাছের মাথা রান্না করার সময় ঝোলের লবণ দেখে। আর বড় ছেলের জন্য তুলে রাখা মাছের মাথাটির দিকে তাকাবে আর জিহ্বা থেকে আফসোস ঝেড়ে ফেলে বলবে, মেয়েদের মাছের মাথা খাওয়া ঠিক না। পরিবারের সবার খাওয়া শেষে তলানিতে থাকা ঝোলের মধ্যে লেজ কিংবা কিছুই না পেয়ে তাদের শুকরিয়া জানাতে জানাতে পরের বেলার রান্নার আয়োজন নিয়ে ভাববে। আরও যারা বয়সে বড়, দাদি-নানিরা, তারা তো গল্প বলার কথা বললেই- কীভাবে একটা কাঠ-কয়লা কবুতর হয়ে উড়াল দিয়েছিল, তা বলতে শুরু করবে। আমার সাথে এমন এক বৃদ্ধার দেখা হয়েছিল। লাল পাতা ভরা পথে হাঁটতে তার সাথে দেখা হয়েছিল।
তাকে আমি বলেছিলাম, আমি রতন মেম্বারের বাড়ি যাব। সেই বৃদ্ধার ছিল সবুজ চোখ। আমাদের দেশে সবুজ চোখের মানুষ কম দেখা যায়। আমি তাই একটু আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলাম। সে বলল, ‘রতন মেম্বার বলতে এই গ্রামে কেউ নাই। তবে হরতন-রুইতন দুই ভাই আছে, মেম্বার দাঁড়াইছিল, দুই জনেই ফেল করছে’। আমি তখন ঠিকানাটা ভালো করে দেখে নিলাম। কোথাও ভুল হচ্ছে কি-না, ভুল গ্রামে এসেছি কি-না। না, ঠিকই আছে। ট্রেন থেকে নেমে যে কোনো ভ্যানওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে রতন মেম্বারের বাড়ি। ভ্যান ভালো লাগে না আমার। আমি সুন্দর লাল পাতার গ্রাম দেখে হেঁটে রওনা হই। এই শত শত শিমুলের লাল ছোপ মারা ল্যান্ডস্কেপের নেশায় নাইকন ক্যামেরা বের করি। খেয়াল করি নাই বৃদ্ধা কোন দিকে চলে গেল। একটা ছোট বালক আমার ক্যামেরাকে তাচ্ছিল্য নিয়ে দেখছে। ফাইভ-সক্সে পড়ার মতো বয়স। কোমরে কলসি নেওয়ার মতো বই নিয়ে আমার পেছন পেছন হাঁটছে। ওকে জিজ্ঞেস করা যায়- রতন মেম্বারের বাড়িটা কোনদিকে। বলল, সামনে একটা নদী পাবেন, নদী পেরুলেই বটগাছঅলা একটা বাড়ি, ওইটা রতন মেম্বারের। অনেক হেঁটে কোনো নদী মিলল না, প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটলাম। আমি শুনেছিলাম, এই গ্রামের সবাই মিথ্যে বলে। এত মিথ্যা বলে- জানা ছিল না। পথে একটা চায়ের দোকানে পাকা সবরি কলা ঝুলে আছে। কলাগুলো অমৃতের মতো। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, নদীর পাশে বটগাছঅলা বাড়িতে কীভাবে যাব? রতন মেম্বারের বাড়ি। দোকানদার বলল, আমিই রতন মেম্বার। আর এই গ্রামে কোনো বটগাছ নাই।
কী বিপদ! গ্রামের সবাই এত নিখুঁত মিথ্যা বলতে পারে! দয়া করে আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না, ঠিকটা বলেন। ট্রেন থেকে নেমে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছি। গ্রামের সবাই ভুল বলে দিচ্ছে। দোকানদার মনে হয় ক্ষেপে গেলেন। তিনি আয়েশ করে চা বানাতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমিই রতন মেম্বার, এই গ্রামের কেউ মিছা বলে না। আপনাকে রউফ স্যার পাঠাইছে না? এবার স্বস্তি পেলাম। ঠিক ব্যক্তির কাছে এসে পড়েছি। কিন্তু আপনি দোকানদারি করতে পারেন, ভাবিনি। আসলে আমার দোকান না, আমার ভাইরার দোকান। ও হজ কইরা আসছে। তাই দোকানে বসে না। এই যে কলাগুলো দেখতে পাচ্ছেন, ওগুলো স্পেশাল কলা, এই কলার গাছ পানির মধ্যে হয়, মাটি লাগে না, বারোমাস কলা হয়। তবে কলা পাকে চান্দের ফরে। আর এগোতে দেওয়া যায় না রতন মেম্বারকে। আপনিও শুরু করে দিলেন! আচ্ছা, আপনারা অকপটে এত মিথ্যে বলতে পারেন কীভাবে! এবার আর রাগলেন না, কিছু বললেনও না। তবে কলার গল্প থামিয়ে দিলেন। চলেন, ভাত খাবেন, আমার বাসাতেই আপনার থাকার ব্যবস্থা, মাটির ঘর, কিন্তু দোতালা!
রতন মেম্বারের বাড়ি সত্যিই মাটির দোতলা। খুব সুন্দর। আমার জায়গা হলো দোতলায়। একটা জানালা দিয়ে দূরের লাল পাতার বন দেখা যায়। এখানে কোনো নদী নেই, বটগাছও নেই। জানালার কাছে একটা বয়সী শিমুল ছড়িয়ে আছে। সবক’টা ডালে সিঁদুরের মতো লাল শিমুলে ছেঁড়া পাপড়ি। পাপড়ির ফাঁকে দুটো দাঁড়কাক এক ডালে বসে। হয়তো ওরা আমাকে দেখছে। হয়তো, আমার কাছে কী মিথ্যা বলবে তা ভাবছে। এর মধ্যেই একটা উড়ে গেল, গোয়ালের একটা গাভীর চিৎকারে ভয় পেল বলে মনে হয়। গাভীর একটা বাছুর দূরে চলে গিয়েছিল। রতন মেম্বার নিজ হাতে দুধ দুয়াচ্ছিলেন। দুধে বালতি উপচে পড়ছে। এই দুধের বালতি এক হাতে, অন্য হাতে একটা থলি নিয়ে আমাকে বললেন, চলেন, বাজারে যাই। আপনার সাথে মাতবর সাবের সাক্ষাৎ করাই দিব। জমি নিয়া ফাইনাল কথা তার মুখেই শুনবেন।
বাজার অনেক দূর। দেড় ঘণ্টার পথ নাকি। পথে যাদের সাথে দেখা হলো, তাদের সবার হাতে দুধের বালতি। এত দুধ দেখে রতন মেম্বারকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, গ্রামের বাজারে দুধের সের কত? এই দুধ বিক্রির না। এই দুধ নদীতে ফেলে দিব, সবাই নদীতে ফেলতে যাচ্ছে। এখন তো ফাল্কগ্দুন মাস, শুকনা মৌসুম। দুধ ঢাললে নদী বইতে থাকব, না ঢাললে নদী শেষ, গ্রামও শেষ। রতন মেম্বার আবার মিথ্যা বলা শুরু করছেন। আমরা নদীটারে দুধ খাওয়াই। বুঝলেন, একবার নদী গেছিল শুকায়ে, আমি তখন বুঝি কি বুঝি না- এমন। নৌকা বন্ধ, যাত্রা বন্ধ, সেচও বন্ধ- এমন বিপদ আগে দেখি নাই। কেউ একজন কইলো, নদীর শুকনা ফাটা মাটিতে দুধ ঢেলে দাও। আর আল্লাহর রহমতে কোত্থেকে যেন পানি উঠতে লাগল! আমরা এর পর থাইক্যা নদীটারে দুধ খাওয়াই। আপনি চা খান, আমি নদীটারে দুধ খাওয়াই আসি।
আমি যে চায়ের স্টলে বসলাম, সেখানে টিভিতে জসীমের ছবি চলছে। গান গাইতে গাইতে চানাচুর বিক্রি করছে জসীম। লোকজন তেমন নাই। চায়ের দোকানদার চা দিতে দিতে বলল, রতন মেম্বর খুব ভালো মানুষ। আপনার কেমন আত্মীয়?
আত্মীয় নন।
অ। জানেন তো, রতন মেম্বরের মেয়েটা কিন্তু মানুষ না, পরী। সবাইরে রতন মেম্বর বলে আপনা মেয়ে। কেউ বিশ্বাস করে না। ও কিন্তু সত্যিকারের পরী। দেখবেন চুল মাটিত গিয়া লাগে। ও যখন গোসল করতে যায়, তখন অনেক শালিক আর টিয়া গাছের ডালে বসে থাকে। বসে বসে কন্যার ডুবন দেওন দেখে। গোসল শেষ তো টিয়াগুলাও ফুরুৎ। তবে মেয়েটার ভাগ্য খারাপ, বিয়া হইছিল ইটালির জামাইর লগে। ইটালি গেছিল ঠিক, কিন্তুক ইটালির জেলে, বুঝছেন? দেশে আইসা মুরগির খামার দিসে আর গাঁজা ধরছে। মেয়েটার নাম জানেন? কাজলরেখা। তার কিন্তু একটা শুকপাখি আছে। শুকপাখিটা কাউরে দেখায় না। ওইটা সবার অতীত-ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমার চা অনেক আগেই শেষ। কতদূর মিথ্যা বলা যায়- আমি খালি শুনছি, এরা দারুণ বানিয়ে বলতে পারে। আপনার নাম কী?
জলিল মোক্তার।
কত বিক্রি হয় ডেইলি?
সত্তর-আশি টাকা।
মোক্তার কেন?
জি, আমি মোক্তারি করি। কাউরে বলা যাবে না। আপনারে রউফ সাহেব পাঠাইছে না?
আপনি কীভাবে জানেন?
খালি আমি না, গ্রামের সবাই জানে। আপনি জমি কিনতে আসছেন। এই গ্রামে কারেন্টের কারখানার জন্য। শুনেন আমার কাছে, ভালো জমি আছে, ওই কলমি ক্ষেতগুলো দেখছেন, এর ভেতর দিয়ে একটা হাঁটা পথ আছে। পথটা শেষ হবে একটা পুকুরের মধ্যে। পুকুরে ডুব দিলেই পাবেন জমি। তবে জমিগুলাতে এখন প্রচুল শ্যাওলা। আর শুনতে চাই না। রতন মেম্বার ফিরে আসছে। তার দুধের বালতি থেকে একটা মাঝবয়সী লাউয়ের মাথা উঁকি দিচ্ছে। দুধ বেচার পয়সা সরিষার তেলের বোতলে রূপ নিয়েছে। রতন মেম্বার মাতবর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন।
মাতবর সাহেব বাজারে একটা মিষ্টির দোকানে বসে আছেন। আমরা গিয়ে বসামাত্র রতন মেম্বার শুরু করেন, এই যে আমাদের মাতবর সাবেরে দেখছেন, বিটিশ আমলের মানুষ, কেজি দুই জিলাপি দুই চাবান দিয়া খাইয়্যা ফেলে। ঘোড়া-দৌড়েও মাতবরের ধারে-কাছে নেই। চোখেরে সামনে মাতবর নামের মানুষটি একটা গুড়ের জিলাপির অংশ ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমান্তরালে রতন মেম্বার মাতবরের বিগত শৌর্যের গৌরব অনবরত বলে যাচ্ছেন। আপনেরা তো এ-যুগের ছেলে-মানুষ, শহরে থাকেন। তামাম মুল্লুক মাতবর সাবের কথা জানে। মাতবর সাব জমি নিয়া ফাইনাল কথা দিবেন। উনি যে দাম কইবেন, সেটাই শেষকথা। কিন্তু মাতবর জিলাপির একটা টুকরা শেষ না করতে পেরে বললেন, দাম পরের কথা, জমি দেয়া যাইব না। জোহরের অক্ত হইছে। পরে কথা হইব। রতন মেম্বারও ফেরার সময় কিছু বললেন না। দুপুরে ফেরার পথে কারও সঙ্গে দেখা হলো না। এমনকি একটা পাখিও না। সবাই কোথায় চলে গেল।
মাটির দোতলা ঘরজুড়ে শান্ত ভাত-ঘুমের ডাক। রতন মেম্বার আপ্যায়ন করলেন বেশ। শোল মাছের ঝোল আর লাউ দিয়ে বেশি খেয়ে ফেলেছি। সরিষার তেলে মোরগের কুচি কুচি মাংসের রান্নাটাও দারুণ। জিহ্বা আর নাকে লেগে আছে। এই গ্রামে আমার দ্বিতীয় দিনটা আরামেই কাটছে। একটাই শর্ত- জমি নিতে হবে এমনভাবে যেন টুঁ শব্দ না হয়। ঘোড়ার গাড়ি আর ঢোল বাজিয়ে জমি অধিগ্রহণ হবে। পাওয়ার হাউজটা এখন একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। কিন্তু মাতবরের গোমড়া মুখ ভালো লাগল না। গ্রামবাসী জমি না ছাড়লে- নেওয়া তো ওয়ান-টুর ব্যাপার।
শিমুল গাছের নিচে একটা মেয়ে, হতে পারে মেয়ে নয়, মহিলা- আচারের বয়ামকে রোদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিকেলের রোদের পেছনে দৌড়ে লাভ নাই। মেয়েটি বয়াম থেকে জলপাই বের করে মুখে দেয় আর আমার দিকে তাকায়। সম্ভবত এইভাবেই প্রেম হয়ে যায়। কিসের আচার? ভাব জমানোর চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলল, খাবেন নাকি, শিমুল ফুলের আচার। এরা সবাই মিথ্যা আর মশকরা নিয়ে থাকে। বলতে বলতে দোতলায় উঠে আসল আচারের বয়াম নিয়ে।
আমি কিন্তু পরী। আমি জানি, আপনি কেন এসেছেন। এই গ্রামের জমি কিন্তু অনেকেই কিনার চেষ্টা করেছে, কেউ পারে নাই। আব্বার মতলব আছে আমার সঙ্গে আপনার বিয়ে দেওয়ার। সাবধান। আমার কিন্তু আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। আমার কি বলা ঠিক হবে- বুঝতে পারছি না। খেয়ে জলপাই না শিমুল ফুল বোঝা গেল না। তবে মেয়েটা পরীর মতোই সুন্দর। হঠাৎ ভয় পেয়ে নেমে গেল।
রতন মেম্বার ফিরে এসেছেন। তার মুখ এবার মাতবরের মতোই ভার। যাই বলেন, আপনি এসেছেন। ভালো, মাতবর সাবের সাফ কথা। এই গ্রামের কোনো জমি বিক্রি হবে না। কোম্পানি হোক, সরকার হোক, নিতে চাইলে আমরা দিব না। যে মাটিতে আমাদের দাদা-নানা শুয়ে আছে- এই গ্রাম দেওয়া যাবে না। এ মাটিতে আমরা আজ মরলে কাল শোব- আপনি সকালেই ফিরে যান। আমাদের কারেন্টের দরকার নাই। এবার রতন মেম্বার সত্য বলছেন, না মিথ্যা বলছেন, বুঝতে পারছি না। একটু নিরাশ মনে হচ্ছে রতন মেম্বারকে। অনেক কষ্ট করে আমরা নদীটারে, এই লাল পাতার বন টিকাই রাখছি। নদীর হৌ মাছগুলার কথা আপনারা জানেন না। এদের সাথে আমরা কথা বলতে পারি। দেশে আর কোথাও হৌ মাছ নাই। কারেন্ট আসলে ওদের যাওয়ার জায়গা কোথায়? তবে চিন্তার কিছু নাই, মরতে মরতে ওরা চলে যাবে উত্তরে। ওখানে সারসেরা থাকে। সারসের দেশে হৌ মাছ, হরিণ আর সব পাখপাখালি থাকব। একবার এখানে একটা ফ্যাক্টরি হইছিল। ফ্যাক্টরির সাবেরা সব সারস মারতে শুরু করল। ধরেন তখন পাকিস্তান আমল। হাজারে হাজারে সারস মারল। হাড়গিলা, ধলাগিলা, আরো কত! এর পরে এরা রাগ করে চলে যায়। এদের অভিশাপেই ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে। বুঝলেন, পাখ-পাখালিরও ক্ষমতা আছে। এদের জবান আছে কিন্তু, বুঝবার শক্তি লাগে। আমাদের মাতবর সাবের সে শক্তি আছে। মাতবর সাব নিষেধ করছেন- গ্রামের কোনো কয়লার নৌকা আসবে না। দুধের নদী কেউ কালো হতে দিবে না। গ্রামের সবাই একমত। আপনি কালই চলে যান।
আর কোনো কথা হয়নি রতন মেম্বারের সাথে। রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সকালে চলে যাব বলে। কে যেন একটা এসে বলল, আপনি খেয়ে ঘুমান, হাতে একটা পিতলের কুপি। ওই মেয়েটা, পরীর মতো, হয়তো পরী। আমার খাওয়ার ইচ্ছা চলে গেছে। আমার অ্যাসাইনমেন্টটা ফেল করছে, রউফ স্যারকে কীভাবে বলব তা ভাবছি। আপনারে একটা কথা বলতে এসেছি, আমরা কোনো সময়ই মিছা বলি না, যা সুন্দর- আমরা তাই বলি- এই গ্রামের সবাই সুন্দর বলে, তাকে মিথ্যা ভাববেন না। আরেকটা কথা, আমি কিন্তু পরী না; নাম পরী। আব্বা আপনার সঙ্গে আমার কিছু ভাবে নাই। পরী দোতলার দরোজা থেকেই চলে গেল। কুপির আলোয় মুখের অর্ধেক অন্ধকার দেখতে পেলাম আমি। ঠিক তো, এরা আলো দিয়ে কী করবে? মানুষেরা কারেন্টের বাতির মধ্যে অন্ধকার ভুলে যাবে। ভুলে যাবে নক্ষত্র আর রাতের আকাশের দূরে আলোদের। ভুলে যাবে বেজির মুখের মায়া। জোনাকি আলোয় দেখা পথে এলাচ পাতার গন্ধ নিতে নিতে যুবকেরা আধভোলা গান গাওয়ার চেষ্টা ভুলে যাবে। আপনাকে আরেকটা কথা বলে যাই, দয়া করে আপনি সরকারকে বলবেন, আমাদের কারেন্ট দরকার নেই। রক্তপাত হবে, আব্বা বলেছেন। আপনি পারবেন, আমাদের বাঁচাতে।
আচ্ছা।
২.
বিশেষজ্ঞরা বলেছিল, গ্রামবাসীর দাবি ঠিক নয়। এই গ্রামের মানুষেরা মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত। এই প্রজেক্টের ফলে শুশুক বা হাড়গিলার কোনো ক্ষতি হবে না। কয়লা টানা নৌকায় নদী বা মাটির কোনো ক্ষতি হবে না। অতএব বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছিল। আমি নিউইয়র্ক থেকে সাত বছর পর ফিরে গিয়েছিলাম গ্রামের মানুষদের কথা শুনতে। পরী বা রতন মেম্বার কারোরই দেখা পাইনি। আশ্চর্য! ওখানে কোনো লাল পাতা ভরা গ্রাম বা এমন কিছু নেই। কে যেন বলল, এখানে কখনও কোনো লাল পাতা ভরা গ্রাম ছিল না, ওখানে কখনোই কোনো দুধনদী বয়ে যায়নি।
সূত্র: সমকাল