রাত যখন খান খান হয়ে যায়

চোখ মেলে তাকায় সোহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি! উঠে বসতেই মনে পড়ে গত রাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার মধ্যে নমিতাদের উজানগাঁও গ্রামে এসেছে। এসেই ঘুম। হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা হাতে নেয় সোহেল। সকাল সাড়ে সাতটা। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামে। বিশাল লম্বা বারান্দা। কাউকে দেখছে না। দরজা ঠেলে উঠোনে নামে। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত ভালো লাগায় চোখ-মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিশাল নিকানো উঠোন। উঠানোর সীমানার পরে আম আর কাঁঠাল গাছ। ওইসব গাছের পরে ঝাঁকড়া বাঁশঝাড়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস। উঠোনে মোরগ-মুরগির দঙ্গল। উঠোনের একবারে পূর্বদিকে গোয়ালঘর। সেখানে কয়েকটা গরু ডাকছে হাম্বা..। জীবন একটা আশ্চর্য লাটিম। কাল সকালে ছিল ঢাকা শহরের বিদঘুটে বাস রিকশা ট্রাক লরির জ্যামে। আর এখন? দাঁড়িয়ে লৌকিক গ্রামীণ এক সুরভিত বাড়ির উঠোনে।

নমিতাদের বাড়িটা বেশ বড়। উত্তরমুখী। ওদের থাকার ঘরটাও বেশ বড়। পাখির কিচিরমিচির ডাকে সোহেলের হূৎস্পন্দন বেড়ে যায়। গ্রামে আসাই হয় না। সেই কবে শৈশবে একবার গিয়েছিল.. আর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে এলো নমিতা হালদারের বাড়ি। নমিতা আর সোহেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের ছাত্র। পড়তে পড়তে পরিচয়, আড্ডা। কথায় কথায় যখন শুনল, গ্রামীণ জীবনের বিন্দু পরিমাণ অভিজ্ঞতা নেই- গা জ্বালানো বিখ্যাত খিক খিক হাসে।

তুই হাসিস কেন?

তুই বাংলাদেশের ছেলে। যে বাংলাদেশের রাজধানীতে থাকো, সেই রাজধানীর রাজপাশে গ্রাম আর গ্রাম। ফুটানি করো, গ্রাম চেনো না? মারবো এক থাপ্পড়।

বিশ্বাস কর, নমিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে সোহেল। আমার জন্মেরই আগে বাবা ঢাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছে। দাদা-দাদিও নেই। ছোট চাচা বাড়িতে। সে-ই সব খায় বা দেখাশোনা করে-

নমিতা হালদার একটু গম্ভীর হয়ে যায়, বুঝলাম। কিন্তু এইটা কোনো কাজের কথা না। তুই এই দেশের মানুষ। পড়িস নৃবিজ্ঞানে। অথচ দেশ-্রামের সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই- লোকে শুনলে হাসবে।

আমার দোষ কোথায়? দাদাবাড়ির দাদাদাদি নেই অনেক কাল থেকেই। বাবা বিয়ে করেছেন ঢাকায়। আমার মামারা থাকেন ঢাকায়, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। সবচেয়ে ছোট মামা থাকেন মালয়েশিয়ায়। আমি ঢাকা শহরটা যেমন চিনি, তেমন চিনি ক্যানবেরা, সিডনি, কুয়ালালামপুর।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নমিতা, একেই বলে আলোর নিচে অন্ধকার। তুই দুনিয়া চিনিস কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম চিনিস না- এটা হত পারে না। হতে দেওয়া উচিত নয়। সোহেল, তুই আমার গ্রামে চল।

তোর গ্রামে?

হ্যাঁ, আমার গ্রামে। আমার গ্রাম একেবারে গ্রাম। বাড়ির কাছে প্রবলভাবে বয়ে যাচ্ছে বিরাট নদী কচা। আমাদের বাড়িতে গরু আছে। মোরগ-মুরগি আছে। বাড়ির কাছে বিশাল দীঘি আছে। তোর ভালোই লাগবে। যাবি?

যাব। কবে যাবি তোর গ্রামের বাড়ি?

এই তো সামনের ছুটিতে। গেলে তোর বাপ-মাকে বলে রাখিস।

বাবা-মাকে বলতে হবে কেন?

আহারে সোনার চান পিতলা ঘুঘু! আমি জানি না- তোমারে তোমার বাপ-মায়ে মুরগির ছানার মতো পালে। চোখের আড়ালে গেলে কেঁদে বুক ভাসায়। বাংলাদেশের পোলা জানো না সাঁতার। আবার যাইতে চাও বরিশাল। বরিশালের আসল নাম জানো?

নমিতার বরিশালের আঞ্চলিক বাক্যে হাস্যরসের বাণে বিভ্রান্ত সোহেল হাসান, বরিশালের আবার আসল নাম কী?

ও মনু, শেরেবাংলার নাম হনোচো? হেই শেরেবাংলার কাল হইতে বরিশালের আর এক নাম- ধান নদী খাল, এই নিয়ে বরিশাল। তুমি হেই নদী-খালের দ্যাশে যাইবা- হাতর তো জানো না। তোমার বাপ-মায় না কইলে মুই তোমারে নেতে পারমু না।

ওদের এই আড্ডায় ছিল রনজয়, শিমুল, তাহের, আদুরীসহ আরও কয়েকজন। নমিতার কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সবাই। শিমুল এগিয়ে আসে নমিতার কাছে, খালা যা কইছোসরে…।

যদিও এসব হয়েছিল স্রেফ আড্ডায়। কিন্তু সোহেলের করোটিতে গেঁথে যায় নমিতার ওই বাক্য- ‘তুই এই দেশের মানুষ। পড়িস নৃবিজ্ঞানে। অথচ দেশের গ্রামের সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই। লোকে শুনলে হাসবে।’ সোহেল সিদ্ধান্ত নেয়, যাবে নমিতাদের উজানগাঁও, গ্রামের বাড়ি। দেখবে বাংলাদেশের গ্রাম। আর গ্রাম দেখতে বরিশালেই যাওয়া উচিত। খাল-নদীতে বিধৌত বাংলাদেশ দেখার সাধও মিটবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বললে, শুরুতে রাজি হয় না দু’জনার কেউ-ই। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে সোহেল- কোথায় আমার অধিবাস? আমি অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইউরোপ যেতে চাইলে বাবা-মা কোনো আপত্তি করে না। অথচ..। কিন্তু না, আমাকে এই শিকল ভাংতে হবে। কৌশলে প্রথমে রাজি করায় বাবাকে। বাবাই রাজি করায় মাকে। ফলে, আজকে এই স্নিগ্ধ নির্মল সকালে নমিতাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে।

পাশের বাড়ির কয়েকটা ছেলেমেয়ে দৌড়ে উঠোন পার হয়ে যায়। যেতে যেতে সোহেলকে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে। সোহেল তাকিয়ে ছেলেমেয়েদের দুরন্ত শৈশব দেখছে। মনে পড়ে না, কোনোদিন এমন করে শৈশবে দৌড়ানোর সুযোগ হয়েছে। শহুরে জীবনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক বুক ঝিম ভালোবাসায় বুকটা ভরে যায়..।

ক্যামন আছো পোলা? চমকে তাকায় সোহেল। সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধা। সারা শরীরে সদ্য স্নানের জল; মাথায় ঘোমটা। সিঁথির উপর সিঁদুর জ্বলছে। মুখে অনন্যমণ্ডিত মাখা লাবণ্য। পবিত্র সকালটা আরও পবিত্র হয়ে উঠল সোহলের কাছে সামনে দাঁড়ানো এই নারীকে দেখে- তুমি আমারে চেনো নাই? মুই নমিতার ঠাকুরমা।

ঠাকুর মা! মানে, মানে দাদি, পায়ে হাত রাখে সোহেল, কেমন আছেন ঠাকুরমা?

ভালো। তুমি একলা ক্যা? নমিতা ওডে নাই? এই করে মাইয়া- বাড়িতে আইলে খালি ঘুমায় আর ঘুমায়। তুমি খাড়াও। মুই গরুর বাচ্চাডারে লইয়া আই। নমিতার ঠাকুরমা সোহলকে অতিক্রম করে সামনের দিকে যায়। সোহেল হতবাক তাকিয়ে, ঠাকুরমা চোখে দেখতে পান না? ঠাকুরমা অনুমানের উপর ভর করে হাঁটছেন। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলেন, মনে হয়নি তো!

তুই কখন উঠলি? হাই তুলতে তুলতে সামনে আসে নমিতা।

এই তো উঠলাম। ঠাকুরমাকে দেখিয়ে, উনি দেখতে পান না?

নাহ।

কী হয়েছে ঠাকুরমার?

সক্কাল বেলা ওই বোলকুমড়া মহিলাকে নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

বোলকুমরা মহিলা মানে!

আমাদের এই এলাকায় বোলকুমড়া নামে একটা ফল আছে। অনেকটা বেলের মতো। উপরের রঙ সবুজ। যখন পাকে তখন হয় সিঁদুরের মতো বাইরের খোসাটা। ছেলেমেয়েরা ভুল করে সেই ফল পাড়ে। পাড়ার পর দেখে, ভিতরে কালো এক ধরনের ভর্তা, আর গন্ধ। উপরেরটা সিঁদুরের রঙ দেখেই ভুল করো না। মহিলা আমাকে বেশ জ্বালাতনে রাখে।

তুই ঠাকুরমাকে একটা খারাপ ফলের সঙ্গে তুলনা দিলি?

এক দেখাতেই প্রেম? ঠিক আছে, যাবার সময় ঠাকুরমাকে তোর সঙ্গে দিয়ে দেব। যদিও তার জামাই বহাল তবিয়তে আছে। নমিতা হাত ধরে সোহেলের, তুই তো নবাবের পোলা। আইচো আমাগো পচা নোংরা গাঁও-গেরামে। ব্রাশ আনচো? না আনলে ক, আমগাছের ডাল ভাইঙ্গা মেচক বানাইয়া দি। আর বাথরুমের অবস্থা কিন্তু করুণ। বদনা লইয়া যাইতে অইবে মনু…।

সোহেল হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।

আগে আমার লগে আয়- হাতে টান দেয় নমিতা।

ও নমি, পোলাডারে ঘাডলাডা দেহাইয়া দে। মুখ ধুইবে না?

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সোহেল, ঠাকুরমা গোয়ালঘর থেকে বাছুর হাতে বের হয়ে আসছে। অবাক, কী নির্ভার আর স্বাভাবিক গতিতে বাছুরটা নিয়ে উঠোনের পাশে একটা কাউফলা গাছের সঙ্গে বাঁধে। বাছুরটা ছটফট করছে আর ম্যা-ম্যা ডাকছে। ঠাকুরমা আবার গোয়ালঘরে ঢোকে। নমিতা হাত টানে। বিরক্ত সোহেল, একটু দাঁড়া। দেখি ঠাকুরমা কী করে?

করবে ঘোড়ার আন্ডা। তুই আয়-

কথার মধ্যে ঠাকুরমা গোয়ালঘর থেকে গাই গরুর দড়ি হাতে বের হয়ে আসছে। পেছনে গাই গরু- হাম্বা।

নমিতার টানাটানিতে সোহেল যেতে বাধ্য হয়। উঠোন পার হয়ে সামান্য একটা বাগানের মতো। বাগানের পরেই বিরাট বড় একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে এসে দেখে, অনেক মানুষ। ছেলে-বুড়ো নানা বয়সের। পুকুরের দুইপাড়ে কয়েকটা খেজুরগাছ ফেলে ঘাটলা বানানো। সেই ঘাটলার উপর বসে কেউ মুখ ধুচ্ছে, কেউ গোসল করছে, দাঁত মাজছে মেচওয়াক দিয়ে। দুই-একজনার হাতে ব্রাশও দেখতে পায় সোহেল। নমিতার সঙ্গে সোহেলকে দেখে সবাই তাকায়।

নমিতা হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, এইডা ঢাহা শহর না। পুহুইরের এই ঘাটলায় বইয়া মুখ ধুইতে অইবে। পারবি না?

ঘাড় কাৎ করে সোহেল, ঠিক আছে। চ্যালেঞ্জ নেয়, তুই কি মনে করছিস আমি ওই ঘাটলায় বসে মুখ ধুতে পারব না? আমি যাচ্ছি, তুই দ্যাখ। সোহেল হন হন হাঁটে ঘাটলার দিকে। ঘাটলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক একজনকে ডাকে, ও বিজন কাকা?

বিজন কুলি করতে করতে তাকায়, কী?

ও আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু সোহেল হাসান। আমার লগে আইচে গ্রাম দেখতে। পুহুরের পানিতে জীবনে হাত-মুখ ধোয় নাই। অরে ঘাটলায় একটু জায়গা দাও-

ঘাটলার উপর চার-পাঁচজনে বসে বসে হাত-মুখ-পা ধুচ্ছিল। নমিতার কথায় তিন-চারজন দ্রুত কাজ সেরে উঠে যায়। ঘাটলার কাছে গিয়ে জুতো পায়ে নামতে গিয়ে বুঝতে পারে সোহেল, জুতো পায়ে নামা যাবে না। অতি ব্যবহারে খেজুরগাছের ঘাটলার উপরের ছাল-বাকল উঠে গিয়ে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। যে কোনো সময়ে পা পিছলে…।

আপনে জোতা খুইল্লা নামেন, বলে বিজন কাকা।

জুতো খুলে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে সোহেল। দুটো ধাপ নামার পরই পা এলোমেলো। পুরো শরীর টলমল কাঁপছে। দ্রুত হাত ধরে বিজন কাকা, অ্যাহন নামেন।

আরও দু’ধাপ নামার পর পানির নাগাল পায় সোহেল।

হাসে বিজন, ভয় পাইয়েন না। অ্যাহন বসেন।

ঘাটলার উপর হাঁটু মুড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে পানি হাতের নাগালে চলে আসে। পানিতে হাত নাড়াচাড়া করতে করতে সোহেল ভাবে, গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে প্রতিদিনের জীবনাচারে কত পার্থক্য!

শহরের নাগরিক একজন সোহেল হাসানের সঙ্গে গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের পরিচয়ের প্রথম সকাল শুরু হয় এইভাবে। মুখ ধুয়ে বাড়িতে এসে দেখে নাশতা প্রস্তুত। ঘরের সামনে বিরাট বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বাড়ির ছেলেবুড়োরা খেতে বসেছে। নমিতা একে একে দাদামশাই, ছোট কাকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবার সঙ্গে পাটির উপর বসে। ছোট কাকি গরম ভাত নিয়ে গামলা থেকে সবার থালায় বেড়ে দিচ্ছে। ভাত দেওয়া শেষ হতে না হতেই ঠাকুরমা তরকারি নিয়ে আসে। এবং বাটি থেকে চামচে করে সবার পাতে তরকারি দিয়ে যায় অবলীলায়। সোহেল ভেবে পায় না- কীভাবে সম্ভব! গরম ভাত আর গরম তরকারি মুখে দিতেই অন্যরকম স্বাদে মুখটা ভরে যায়।

ও পোলা, রান্দন ভালো অইচে? ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করেন সোহেলকে।

বারান্দার অদূরে একটা খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নমিতা। মুখে হাসি। সোহেলের ভাবনার জগৎ ওলট-পালট- সামনে দাঁড়ানো হালকা-পাতলা গড়নের আটপৌরে এই নমিতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে চেনাই যায় না। কী তরতাজা চোখমুখ- মুখে চব্বিশ ঘণ্টা খই ফোটে। আর গ্রামে, নিজের বাড়িতে? বাড়ির মেয়ে!

সবাই তাকিয়ে সোহলের মুখের দিকে, গরম খাবার ও ঝাল। একটু হাঁপায়। সামনে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে তাকায় ঠাকুরমার দিকে-

ঠাকুরমা, জীবনে প্রথম গ্রামের কোনো বাড়িতে খাচ্ছি। বললে বিশ্বাস করবেন কি-না- জানি না। খুব সুস্বাদু হয়েছে। মনে হচ্ছে, এত মজার খাবার অনেক দিন খাইনি।

ঠাকুরমায়ের মুখে হাসি ও প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

বরিশালের উজানগাঁওয়ে সেই দিন থেকে পরের দুটি দিন-রাত এক মায়ার জালে কেটে যায় সোহেলের। অগণিত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত বাড়িতে যাওয়া, পুকুরে কোমরপানিতে নেমে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, ডাব-নারকেল পেড়ে খাওয়া, কচা নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, নৌকায় চড়া, গ্রামীণ রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালি পায়ে হাঁটা, রাখালদের সঙ্গে মাঠে গরু চরানো, বাঁশি বাজানোর চেষ্টা, গ্রামীণ বাজার দেখা, হালচাল করার চেষ্টা- ইত্যাকার কাজে বা খেলার মধ্যে দিন-রাত চলচ্চিত্রের দৃশ্যের গতিতে কেটে গেছে সোহেলের। আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় বাস। ব্যাগ প্রস্তুত। একটু আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে সোহেল। আর শরীরও ক্লান্ত। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভাঙে সোহেলের- বিষণ্ণ শোকাচ্ছন্ন করুণ খান খান কান্নার বিলম্বিত তালের শব্দে। ঘুম ভেঙে গেলে বিছানার উপর বসে সোহেল। বুঝতে পারে, বাড়ির সবাই জেগে ওই কান্না শুনছে। ঘরের মধ্যে হারিকেন জ্বলছে। আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে কান্নাটা বেহালার করুণ সুরের মতো প্রত্যেকের অস্তিত্বের গভীর কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করছে- কে কাঁদছে? কেন কাঁদছে? কেউ কিছু বলছে না কেন? সবাই চুপ করে এই ভারাক্রান্ত কান্নাকে গ্রহণ করছে কেন? কে দেবে সোহেলের এসব প্রশ্নের উত্তর?

গ্রামীণ রাতে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে; শুনেছে সোহেল হাসান। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগের রাতে- না, তেমন কিছু ভাবতে সায় দিচ্ছে না অন্তর্যামী। এই ক’দিন-রাতে উজানগাঁওবাসী আর নমিতাদের বাড়ির মানুষদের সঙ্গে মিশে কথা বলে, এক অসাধারণ মানবিকবোধ নিয়ে ফিরে যাওয়ার আগের রাতে এসব কিছু ঘটতে পারে না। কিন্তু কাঁদছে কে? কেন কাঁদছে? ঘোর লাগা ভাবনার মধ্যে বিছানা থেকে নামে সোহেল হাসান। সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায় নমিতা। ধরে হাত, মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভয় পেয়েছিস?

কাঁদছে কে? পাল্টা প্রশ্ন করে সোহেল।

আমার সঙ্গে আয়, হাত ধরে দরজা খুলে উঠোনে নামে নমিতা। সোহেল ভেবে পায় না, কেন নমিতা এমন কোমলগান্ধার স্বরে কথা বলছে! মনে হচ্ছে, এই কান্না ও অনুভব করে, এই রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে দেওয়া কান্নাকে ও ধারণ করে। কেন? উঠোনে নেমে একেবারে বাড়ির শেষ প্রান্তে, ঝাঁকড়া আমগাছের আড়ালে নিয়ে যায় সোহেলকে। কে কাঁদছে, বুঝতে পারছিস? জিজ্ঞেস করে নমিতা হালদার।

না। কিন্তু কে কাঁদছে? কেন কাঁদছে?

আমার ঠাকুরমা।

ঠাকুরমা কাঁদছে! কেন?

মুখরা নমিতা হালদার কেমন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। উপরের আকাশে ঝলমলে চাঁদ। আম পাতার ফাঁক গলে সেই রুপালি আলোর প্রপাত নমিতার গোলাপি গালে, ওষ্ঠে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ঠাকুরমার কান্নার শব্দ এখান থেকে খুব কম ভলিউমে শোনা যায়- ছিন্ন এস্রাজের সুরে। নমিতা কি কিছু গোপন করতে চাইছে আমার কাছে- ভাবছে সোহেল।

আমার বাপ-কাকারা তিন ভাই। সবচেয়ে বড় কাকা প্রশান্ত হালদার ছিলেন উজানগাঁও হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক। মানুষের মুখে শুনেছি- প্রশান্ত কাকাকে বলা হতো অংকের জাহাজ। এমন কোনো অংক নাই তিনি পারতেন না। দূর-দূরান্ত থেকে কাকার কাছে অংক শেখার জন্য লোক আসত। প্রশান্ত কাকা স্কুলে বা বাড়িতে বসে সেসব মানুষকে গণিত শেখাতেন। এই মানুষটার দুনিয়াতে একটাই প্রিয় জায়গা ছিল, ঠাকুরমায়ের কোল। সেই সময়ে ঠাকুরমার কী একটা রোগে চোখ থেকে পানি ঝরত। পিরোজপুরে নিয়ে ডাক্তার দেখানোও হয়েছে। আজ থেকে বিশ-বাইশ বছর আগে এ অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসার জন্য মহকুমা শহর পিরোজপুরের বাইরে যাওয়ার সাহস করত না। সুতরাং ঠাকুরমার চোখ আর ভালো হয়নি। আরও খারাপ খবর হলো- কোনো এক কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন ঠাকুরদা। সেটা আরও খারাপ হয়েছিল।

চোখের জন্য কাঁদছেন ঠাকুরমা? প্রশ্ন করে সোহেল।

না, ঠাকুরমা কাঁদছেন বড় ছেলে প্রশান্ত কাকার জন্য।

মানে! তিনি কোথায়?

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজো কাকা যুদ্ধে চলে যান। আমার বাবা ছোট। তখন বাবার বয়স ছিল ষোলো বছর। আমার বাবা ছিল অসুস্থ। তাই দূরের গ্রাম পিসিদের বাড়িতে ছিল লুকিয়ে। আর প্রশান্ত কাকাকে ঠাকুরমা নিজেই যুদ্ধে যেতে দেননি।

কেন? ওনার তো সবার আগে যাওয়ার কথা। বড় ভাই-

হ্যাঁ, তোর কথাই ঠিক। প্রশান্ত কাকা যেতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু ঠাকুরমা যেতে দেননি। আগেই বলেছি তোকে, প্রশান্ত কাকা মা ছাড়া দুনিয়ায় কিছু বুঝতেন না। বিয়ে করেছেন; একটা বাচ্চাও হয়েছে, কিন্তু মায়ের পাশে না ঘুমুলে তার ঘুম আসত না। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রশান্ত কাকার সব কাজ করে দিতেন ঠাকুরমা। তো যুদ্ধের সময় ঠাকুরমা বললেন- প্রশান্ত যুদ্ধে গেলে না খেয়েই মারা যাবে। যুদ্ধ করবে কখন? আর আমার মনে হয়, কাকা যুদ্ধ, রক্ত- এসব ভয় পেতেন। সুতরাং মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে তিনি যুদ্ধে গেলেন না। বাড়িই থেকে গেলেন। কিন্তু প্রলয় শুরু হলে দেবালয়ও রেহাই পায় না। তুই তো জানিস, আর সবার মতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাংলাদেশই তো লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল হায়েনা পাকিস্তানি আর্মি আর এ দেশের রাজাকাররা।

প্রশান্ত কাকা কি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছিলেন?

আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে যে পাড়াটা, ওটা ব্যাপারীপাড়া। ওই ব্যাপারীবাড়ির সাত্তার ছিল এই এলাকার রাজাকার কমান্ডার। শুনেছি, তার ছেলেমেয়ে প্রশান্ত কাকার কাছে গণিত শিখত। ওরা তো সব খবর রাখত। যে কোনোভাবেই হোক রাজাকাররা জেনে গিয়েছিল, আমাদের মেজো কাকা উমেশ হালদার যুদ্ধে গেছেন। তো এক রাতে আমাদের বাড়ি ওরা আক্রমণ করে। তখন কাকা ভাত খেতে বসেছিলেন। ভাত দিয়েছিলেন ঠাকুরমা। ঠিক সময়ে এসে রাজাকার আর বর্বর পাকিস্তানি মিলিটারিরা প্রশান্ত কাকাকে তুলে নিয়ে যায়। ঠাকুরমা দু’হাতে জাপটে ধরে ছিলেন প্রশান্ত কাকাকে। বলেছিলেন- আমারে মাইরা হালান। আমার পোলাডারে মাইরেন না। কে শোনে কার কথা! যখন ঠাকুরমা ছাড়ছিলেন না প্রশান্ত কাকাকে, তখন লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কাকাকে নিয়ে যায় রাজাকাররা।

বাড়ির আর সব তখন কোথায় ছিল?

বাড়ির সবাই তো ভয়ে তটস্থ। দিনের বেলায় রাজাকাররা এসে আমাদের ক্ষেতের ফসল, গোয়ালের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে যেত, আর হুমকি দিত। দিনের বেলা যেমন-তেমন, রাত হলে সবাই গোয়ালঘরের মাচায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত। কেউ কেউ জঙ্গলে চলে যেত। সে এক বিভীষিকার দিন গেছে রে। ভাগ্যিস, আমরা একাত্তরের পরে জন্ম নিয়েছি-

প্রশান্ত কাকার কী হলো? সোহেলের গলা বিষণ্ণ।

নিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেননি তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুনেছি, প্রশান্ত কাকাকে কচা নদীর পারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকার মিলে। সেই রাত থেকে ঠাকুরমার কান্না শুরু। ঠাকুরমা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতেন আর বলতেন- প্রশান্তকে আমি মেরেছি।

মানে!

প্রশান্ত কাকা যুদ্ধে গেলে তো বেঁচে যেতেন। তিনি যেতে দেননি; দায় তার। মেজো কাকা তো এখনও বেঁচে আছেন। যুদ্ধের পর তিনি খেতাব পেয়েছেন বীরবিক্রম। প্রশান্ত কাকাকে যদি ঠাকুরমা যেতে দিতেন..

উজানগাঁওয়ের রাতটা সোহেলের চওড়া কাঁধের উপর ভারী হয়ে আসে। বিপন্ন আর অস্থির মনে হয় নিজেকে। এই দেশটার স্বাধীনতার জন্য কত মানুষ কতভাবে জীবন দিয়েছে! সবটা কি ইতিহাসে লেখা হয়েছে? লেখা সম্ভব? ঠাকুরমায়ের বুকভরা রোদনের ভাগ কেউ নিয়েছে? নিশ্চয়ই না। সোহেল প্রশ্ন করে নমিতাকে, এখন কেন কাঁদছেন ঠাকুরমা?

সেই সময়ে তো বাড়ির বা গোটা দেশের মানুষের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? প্রশান্ত কাকাকে হত্যার পরদিন এই বাড়িতে আর কোনো পুরুষ ছিল না। একা একা গোটা বাড়ি সামলেছেন ঠাকুরমা। তো কাকাকে রাজাকাররা নিয়ে যাওয়ার দিন-তারিখ ঠিক নির্দিষ্ট করে কারও মনে নেই। ঠাকুরমা একা একা প্রশান্ত কাকার জন্য দিন-নাত কান্নাকাটি করতেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটোর যে সামান্য আলো ছিল, চিরকালের জন্য নিভিয়ে দিয়েছেন। এবং তিনি নিরক্ষর; কোনোদিন স্কুলে যাননি। নিজের নাম লিখতে পারেন না। কিন্তু বছরের এই একটা রাত তিনি কেমন করে বুকের ভেতরে পুষে রেখেছেন, কী চিহ্নে ধারণ করেছেন, আমরা জানি না।

মানে! সোহেল হাসানের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কী বলতে চাস তুই?

একুশ বছর ধরে ঠাকুরমা ঠিক এই রাতে প্রশান্ত কাকাকে মনে করে কাঁদেন… সারা বাড়ি হাঁটেন আর খুঁজে ফেরেন প্রিয় পুত্রকে।

আজ তো নভেম্বরের ১১-

কোন শক্তিতে, কোন পুণ্যতে ঠাকুরমা ছেলের হারিয়ে যাওয়ার রাতকে হিসাবে রাখেন আমরা জানি না। কিন্তু যে রাতেই তিনি করুণ সুরে রোদন করেন, এই বাড়ি ও আশপাশের সবাই বোঝে, ঠাকুরমা কেন কাঁদছেন!

সূত্র: সমকাল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত