খোদাতালার কান্না

খোদাতালার কান্না

মুকিমনগরের মোবাইল টাওয়ারের মাথা ছুঁয়ে সূর্যটা সেই কখন অস্ত গেছে। ক্রমেই আঁধার ঘনাচ্ছে। আলো বলতে একমাত্র মোড়ের

মাথায় বেলালের চায়ের দোকানে। সেখানে ভিড় বাড়ছে। বেলাল তার চায়ের দোকানে সেটবক্স লাগানো একটা বড় রঙিন টিভি টাঙিয়েছে, সেটা চলছে।

হাজারটা চ্যানেল, হাজার রকমের ব্যাপার-স্যাপার। কোনো চ্যানেলে শুধুই গান তো আবার কোনো চ্যানেলে লিছাক্কা সিনেমা। আবার কোনো চ্যানেলে খেলা তো কোনো চ্যানেলে খালি খবর। বেলালের দোকানের টিভিতে এখন সেরকম একটা খবরের চ্যানেল চলছে। কোথায় নাকি মুসলমানদের কচুকাটা করে কাটছে। গুলি করছে। জ্যান্ত আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আবার কোথায় নাকি মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়িঘরে চড়াও হয়ে লুটপাট চালাচ্ছে। আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। ঘরবাড়ি তো ঘরবাড়ি, মসজিদেও নাকি বোমা ফাটাচ্ছে। নামাজিরাও পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না।

আজকাল টিভিতে এসব খবরই খুব বেশি বেশি দেখাচ্ছে। তার ওপর ধর্ষণ তো রোজকার ঘটনা। কলকাতার কোনো নামি স্কুলের দুজন মাস্টার বাথরুমে ক্লাস ফোরের এক ছাত্রীর সঙ্গে কী সব করেছে, তা নিয়েই আজকে খবরের চ্যানেলগুলো বেশ সরগরম। স্টুডিওতে পক্ষে-বিপক্ষের লোক বসিয়ে যুক্তি-পালটা যুক্তির লড়াই চলছে। নাকি আস্ফালন! বোঝা খুব দুষ্কর। তবু সবাই দেখছে। না দেখে উপায় নেই। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর গ্রামবাসীর কাছে এই ভরসন্ধ্যায় যাকে বলে এসবই হলো গিয়ে আজকালকার বিনোদন।

আগের কালে অবশ্য গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন গাছের তলায় মানুষ এসে বসত। নানারকম গল্প করত। সবই তাদের গ্রামের গল্প। তাদের নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প। কখনো কখনো গানের আসর বসত। কখনো-বা কাহানির আসর। কিন্তু এখন গ্রামে তেমন কোনো প্রাচীন গাছ আর একটিও নেই। উন্নয়নের নামে রাতারাতি সব লোপাট হয়ে গেছে। সেসব জায়গায় মোবাইল টাওয়ার বসেছে। কিংবা ইলেকট্রিক পোস্ট, যাকে বলে খাম্বা। যার নিচে মানুষের বসাও নাকি খুব বিপদের! বুকের দোষ হতে পারে। শরীরের রক্ত শুকিয়ে যেতে পারে। তাহলে মানুষ আর কোথায় বসবে?

অগত্যা তাই গ্রামের মোড়ে মোড়ে বেলালের চায়ের দোকানের মতো শত শত চায়ের দোকান গজিয়ে উঠেছে আমাদের এই গ্রামবাংলায়। মানুষ এখন সেসব দোকানেই বসছে। চা খাচ্ছে। টিভি দেখছে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে। কোথাও কোথাও আবার ক্যারম খেলাও হচ্ছে। নামেই ক্যারম, আসলে জুয়া খেলা হয়। গ্রামের চ্যাংড়ারা খেলে।

বেলালের চায়ের দোকানে অবশ্য ক্যারম খেলার সরঞ্জাম নেই। বেলাল ইচ্ছা করেই রাখেনি। সে জানে জুয়া খেলা হারাম। তবে তার দোকানে টিভি আছে। টিভি দেখাও হারাম। কিন্তু তার দোকানের টিভিতে ‘পিস টিভি’ নামে একটা চ্যানেল আছে, যেখানে জাকির নায়েকের মতো মাওলানারা সর্বক্ষণ মানুষকে হেদায়েত দান করছেন। তাছাড়া টিভিতে খবর তো আছেই। সেই খবরে গাঁ-গেরামের কথা না থাকলেও দ্যাশ-দুনিয়ার খবর থাকে। তাক লাগা খবর সব! যেমন কোনো শিল্পপতির বউ যে চা খায়, সেই এক কাপ চায়ের দাম তিন লাখ টাকা। যেখানে তারা নিজের বাড়ির দু-চারশো টাকা কারেন্টের বিল ঠিকমতো দিতে পারে না, সেখানে এই দেশে এক শিল্পপতি তার বাড়ির কারেন্টের বিল দেয় মাসে বাহাত্তর লাখ টাকা। তাই এসব খবরে তাদের সবার খুব আগ্রহ। এসব খবর শুনে তারা অবাক হয়। আর অবাক হয়ে নিজেদের অভাব-অভিযোগ ভুলে গিয়ে গর্ববোধ করে। গর্ববোধ করারই কথা। কেননা প্রতিমুহূর্তে দুনিয়ার কোন প্রান্তে কোথায় এরকম কত কী ঘটছে, তারা শুধু জানতেই পারছে না, এই বেলালের দোকানে টাঙানো টিভিটার দৌলতে দেখতে পর্যন্ত পাচ্ছে। তাও আবার জীবন্ত। তাই তো, গ্রামের একমাত্রা জীবিত সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি, যার নাম কাসেম আলি, সন্ধ্যা হলেই তিনিও এখানে ছুটে আসেন। কতদিন আগে বিদ্যাশে কাম করতে গিয়ে তার যে ছেলেটা নিখোঁজ হয়েছিল, ওই টিভিতে যদি তার খোঁজ পাওয়া যায়! যদিও কাসেম আলি অন্ধ মানুষ। কোনো ছোটবেলায় বসন্তরোগে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। চোখে কিছু দেখতে না পেলেও বেলালের চায়ের দোকানের এই টিভির দৌলতে কানে শুনে তিনি দ্যাশ-দুনিয়ার সবকিছু জানতে পাচ্ছেন। শুধু বেলাল আজ কদিন কিছু জানতে পারছে না। কিংবা এটাও হতে পারে, সে জানতে চাইছে না। সে চোখে আঁধার দেখছে। সে বুঝতে পারছে, তার দোকানে যা বিক্রিবাটা সে-তুলনায় খরচ এত বেশি যে, দোকান শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে না হয়।

এই যে এতক্ষণ যারা এসে বসে আছে, এক কাপ চা খেয়ে টিভি দেখছে তো দেখছেই। উঠবার নাম নেই। আর ওদিকে টিভির কারণে তার দোকানে কারেন্টের বিল উঠছে হু-হু করে। তার ওপর টিভির সেটবক্স ভাড়া তো আছেই। সেটবক্স ভাড়া মাসের দশ তারিখ ফেল মারলেই টিভির পর্দায় আর কিছুই আসবে না, শুধুই ঝিলঝিল। এখানে যারা বসে বসে টিভি দেখছে, তাদের অনেকের বাড়িতেই টিভি আছে। কিন্তু ওই যে বানিয়া গ্যাঁড়াকল। সেটবক্স না কি! মাস গেলেই ভাড়া গুনতে হবে। তাও এক-একটা চ্যানেলের এক এক রকম দর। সেসব বোঝার মতো বুদ্ধি থাকলেও উপরি অর্থ নেই বলে তাদের বাড়ির টিভিগুলো সব জঞ্জালের বাক্স হয়ে পড়ে আছে। সেটা অন্য গল্প। বেলাল সেসব নিয়ে কিছুই ভাবছে না। তবে আজ তার অসহ্য লাগছে। আগামী নদিনের মধ্যে কারেন্টের বিল আর ছদিনের মধ্যে সেটবক্সের ভাড়া মেটাতে না পারলে কী যে হবে, কে জানে! স্বভাবতই তার কিছু ভালো লাগছে না। এমনিতেই আকাশে মেঘ জমে আছে। বাতাসে গুমোট ভাব। কে জানে গত রাতের মতো আবার বৃষ্টি নামবে কিনা! তাহলে শুধু শুধু আর বসে থাকা কেন? বাড়ি যাওয়াই ভালো। এমনটা ভেবে সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরবে বলে সবাইকে তাড়া দিতে যাবে, হঠাৎ কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে রাকিব এসে হাজির হয়। আর এসে এসেই হাঁফাতে হাঁফাতে সে তার হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, আর কিছু শুন্যাছ?

টিভিতে কে কী খবর শুনছিল কিংবা কে কী নিয়ে আলোচনা করছিল, সব ভুলে গেল। সবাই নজর ঘুরিয়ে রাকিবকে দেখল। তারপর নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অবশেষে ফজলু রাকিবকে জিগ্যেস করল, কী শুনব বে? তুই আবার কুণ্ঠে থেকে কী শুনে এলি? এই সাঁঝের সুমায় কুণ্ঠে আবার কী ঘটল? দ্যাশ-দুনিয়ায় যা ঘটছে সবই তো টিভিতে দেখাইছে!

সত্যিই দুনিয়ার যেখানে যা-ই ঘটুক তাদের গ্রামে তো কখনোই কিছু ঘটে না। ঘটলে আর সব ঘটনা যেমন টিভিতে দেখাচ্ছে, নিশ্চয় রাকিব যেটা দেখে এসেছে সেটাও দেখাত। অবশ্য কখনো কখনো চুরির মতো কিছু কিংবা ছোটখাটো মারামারি কিংবা ঝগড়াঝাঁটি হয়। সেটা সব জায়গাতেই হয়। হয়ে থাকে। এসব ঘটনা টিভিতে দেখায় না। কিন্তু রাকিব যেভাবে বলল যে, আর কিছু শুন্যাছ? তাতে ওদের মনে হলো গ্রামে হয়তো সত্যিই ভয়ংকর কিছু ঘটেছে! কিন্তু সেই ভয়ংকর কিছুটা কী?

সবাই রাকিবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাকিব কী বলবে, শুনবে। কিন্তু রাকিবের মুখ বন্ধ। সে একদৃষ্টে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।

সেটা কারো সহ্য হচ্ছে না। আবার কেউ কিছু বলতেও পারছে না। অপেক্ষা করছে। ফজলু কিন্তু অপেক্ষা করতে পারছে না। সে আবার জিগ্যেস করল, বোল না বে – তুই আবার কুণ্ঠে থেকে কী শুনে এলি?

রাকিব বলল, সব সুমায় টিভিতে মুখ গুঁজে বসে থাকলে শুনবা কী কর‌্যা? সব খবর কি টিভিতে দেখায়?

রাকিবের এই এক স্বভাব। কোনো কথা সহজে ভেঙে বলবে না। এটা সবাই জানে। ফজলুর পার্টনার মঞ্জুরও জানে। তার ওপর সে রগচটা। ধৈর্য হারিয়ে তাই সে একসময় খেঁকিয়ে উঠল, জলদি বুলবি না শালা তোর পাছায় মারব এক লাথ বে?

রাকিব মঞ্জুরকে ভয় পায়। মঞ্জুর মুখে যা বলে, কাজেও করে দেখায়। একবার কী একটা ব্যাপারে তাকে আমরুল্লা হাজির ইঁদারায় ফেলব বলেছিল। সে পাত্তা দেয়নি। কিছুদিন পর নিজেও ভুলে গেছিল সে-কথা। তারপর একদিন যখন সে ওই ইঁদারায় পানি তুলছিল, মঞ্জুর কোথা থেকে এসে তার পা-জোড়াকে তুলে ধরে তার গোটা শরীরটাকেই ইঁদারায় উপুড় দিয়েছিল। আর ইঁদারা থেকে আওয়াজ উঠেছিল ঝপাং! সেই আওয়াজে রাকিবের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে গেলেও মঞ্জুর নিজেও তাকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে ইঁদারায় ঝাঁপিয়েছিল। তাকে বাঁচিয়েও ছিল। সেটাও অন্য গল্প।

রাকিব এতক্ষণে আসল কথায় এলো, মাজুর কী হইয়্যাছে সত্যিই তুমরা জানো না?

– কুন মাজু?

– কেনে হারঘের মাজু। জুবের ভায়ের বেটা, গাফফার মৌলবির জামাই। রাজস্থানে না কুণ্ঠে কাম করত! এমত্মাজ বলে উঠল, সে তো মেলাঝুনায় মেলা জায়গায় কামে গেলছে। সকলের খোঁজখবর রাখা যায়, নাকি জানা যায়?

– তুমাকে জানতে হবে না। তুমি যাও তুমার বিবির বুকে মাথা গুঁজে নিঁদ দ্যাও গা!

বিরক্তির সঙ্গে বলল রাকিব। যদিও এমত্মাজ সম্পর্কে সে ভুল কিছু বলল না। এমত্মাজ নিজের মুখেই একদিন গল্প করেছিল, ‘কী বুলবো ভাই তোর ভানীর বুকে মাথা গুঁজে দিলেই আরামে হামার দুই চোখ জুড়ে পরি হুই নিঁদ নেমে আসে। তখুন দুনিয়াজাহানে কী ঘটে না ঘটে হামার কুনু খিয়াল থাকে না।’

এমত্মাজও যে ভুল কিছু বলে তা নয়, তার এই স্বভাবের জন্য সত্যিই তার বাড়িতে প্রায় চোর ঢোকে। চোর তার বাড়িতে কী পায় চোরই জানে। অবশ্য কেউ কেউ বলে, ‘চোর লয় চোর লয়, একেবারে চামড়া চোর! এমত্মাজের বিবির বুকের টানে আসে। তা এমত্মাজের ওই মাথা গুঁজা স্বভাবের লেগে শালা চামড়া চোর চান্স পায় না।’

এসব কথা বহুদিন ধরে রসের কথা হয়ে বিভিন্ন আসরে প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেমন এখন পড়ল। কেউ কেউ এমত্মাজের বউয়ের বুকটাকে স্মরণ করে ‘হো-হো-হো – ’ করে হেসে উঠল। যদিও মাজুর ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কিন্তু কৌতূহল হারাল না। সবাই জানে মাজু বিদ্যাশে থাকে। আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করত। এখন ঠিকেদারি করে। ভালো রোজগার করে। এই তো গত বকরিদে বাড়ি এসেছিল। খুব জাঁকজমক করে বকরিদের নামাজ পড়ে গেল। সবার স্পষ্ট মনে পড়ছে মাজুকে।

এবারে সবার হয়ে আসলাম জিগ্যেস করল, মাজুর কী এমন ঘটল যে, তুই ছুটতে ছুটতে এলি হারঘেরকে খবর দিতে?

রাকিব বলল, যাও কেনে! খোঁজ লিয়ে এসো। যেই দ্যাখো গা অর বাড়ির দুয়ারে মেলা মানুষের ভিড়।

মঞ্জুর বলল, কাহুকে ভাগিয়ে লিয়ে এস্যাছে নাকি বে?

তাই তো! এ-কথাটা একবারের জন্য কারো মনে হয়নি। রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে আসার ঘটনা এ-অঞ্চলে বিরল নয়। শেষবার নাশু মোড়লের বেটা আমিরুদ্দি ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিল এক মাড়োয়ারির মেয়েকে। তা নিয়ে এলাকায় যে-চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছিল তা আজো সবার মনে আছে। কিন্তু মাজু তো বিবাহিত। দুই সমত্মানের বাপ। তাছাড়া মানুষ হিসেবেও সে খুব ভালো। সবাই এমন ভাবলেও কারো কারো সন্দেহ থেকে যায়। তাদের তর সয় না। তারা ভাবে, গিয়ে একবার দেখে এলেই হয়।

তাহলে আর বসে থাকা কেন? সত্যিই মাজুদের বাড়ি গিয়ে জানা দরকার – বিদেশবিভুঁইয়ে মাজুর কী এমন ঘটল?

কিন্তু ইতোমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে তার ভিজে কারেন্ট অফ। অগত্যা সবাই অন্ধকারে বসে থাকে। বসে বসে বিড়ি টানে। আর মাজুর কথা ভাবে। রাকিবও আর কিছু বলে না। ছোড়া চুপচাপ নিজের মোবাইলে কী যেন দেখে!

মঞ্জুরের সেটা সহ্য হয় না, সে বলে ওঠে, বোল না বে শালা – কী হইয়্যাছে মাজুর?

মোবাইলের পর্দায় কী দেখতে দেখতে এতক্ষণে রাকিব নিজেও কেমন অধৈর্য হয়ে উঠল। বলল, মাজু যেখানে কামে গেলছিল সেখানেই খুন হইয়্যাছে। বেলালের চায়ের দোকানে যারা বসে আছে, কারো বিশ্বাস হয় না এ-কথা। মাজু এদের সবার চোখের সামনে বড় হয়েছে। জুবের আলির ছেলে বলতে ওই একটাই – মাজু – যে-বংশের মান মরিয়াদার ভেবেছে। সৎপথে চলেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে। মানুষের আপদে-বিপদে ছুটে গেছে। বিদ্যাশে গিয়েও গ্রামের কথা ভোলেনি। টাকার জন্য গ্রামে কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না শুনে টাকা পাঠিয়েছে। কারো অসুখের খবর শুনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি বলে গ্রামে কেউ ভাই পড়ছে জেনে তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে।

এসবের জন্যই তো গাফফার মৌলবি তার মেয়ে খালেদার সঙ্গে মাজুর বিয়ে দিয়েছিল। তাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে। তারা টাউনের নামি স্কুলে পড়ে। বলতে গেলে সুখের সংসার। তাহলে সেই মাজু খুন হয় কী করে? আর গাফফার মৌলবির বিটি খালেদারই-বা এমন পোড়া কপাল হয় কী করে? খালেদা যা সুন্দরী, মাজুর চেয়ে কত ভালো স্বামী পেতে পারত! পারত কী – অনেকেই তো এসেছিল খালেদাকে তাদের সংসারে বউ করে নিয়ে যেতে। শ্রীরামপুরের খানু হাজি এসেছিল তার পোতা মাতিনের জন্য। জয়রামপুরের হাসু মিঞা এসেছিল ছেলে কিবরিয়ার জন্য। তারপর দেওয়ান সরাইয়ের ইদ্রিস মোড়ল এসেছিল নাতি হায়দারের জন্য। গাফফার মৌলবি সবাইকে ‘না’ করে মাজুর সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বৃদ্ধ কাসেম বলে উঠল, মাজুকে কে খুন করলে? কেনে করলে? জুবেরের বেটাগিলার ভেতর ওই ছুঁড়াই তো সব চাইতে ভালো ছিল!

সবাই চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এমনকি সবার শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ। রাকিবের মুখ থেকে ‘বিদ্যাশে’ মাজুর খুন হওয়ার ঘটনা শুনতে আগ্রহী সবাই।

বুঝতে পেরে রাকিব বলতে শুরু করল, মাজু খুন হইয়্যাছে সত্যি। তার সেই খুন হওয়ার ছবি মোবাইলে মোবাইলে দুনিয়াজাহানে ঘুরছে। সেই ছবি হামার মোবাইলেও আছে।

রাকিব আসলে কী বলতে চাইছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। মোবাইলে মাজুর খুন হওয়ার ছবি! বেলাল অধৈর্য হয়ে উঠল, চক্কর না কেটে সিধা রাস্তায় আয় তো!

রাকিব নিজেও হয়তো ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল। তাই সে আর ভ্যানতারা না করে সিধা রাস্তায় এলো। বলল, এই দ্যাখো সেই ছবি।

বলে রাকিব তার মোবাইলটা সবার চোখের সামনে তুলে ধরল। আর এক কাসেম আলি বাদে সবাই দেখতে পেল সাদা প্যান্ট, লাল জামা পরা একটা লোক মাজুকে কোপাচ্ছে। মাজু কোপ খেতে খেতে জিগ্যেস করছে, ‘বাবু মারছো কেনে – ও বাবু হামি তুমার কী করনু? ও বাবু হামাকে বাঁচাও। ও বাবু!’ কিন্তু লোকটা মাজুকে কুপিয়েই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মাজু আর কিছু বলতে পারছে না, উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। গোঙাচ্ছে। ওই অবস্থায় লোকটা মাজুর শরীরে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মাজুর শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। না, শুধু মাজুর শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে না, বেলালের চায়ের দোকানে বসে যারা রাকিবের মোবাইলের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখছে, প্রত্যেকেরই অন্তর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাজুর সঙ্গে প্রত্যেকেই যেন কোপ খাচ্ছে। পুড়ে মরছে। মাজু ওই অবস্থায় পড়েও কিছু কথা বললেও এরা কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার মুখে আশ্চর্য এক কুলুপ। শুধু বৃদ্ধ কাসেম, সেই ছোটবেলায় বসন্তরোগে যে অন্ধ হয়ে গেছিল, বহুদিন আগে যার ছেলে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তবে শুনতে পাচ্ছে। না, মাজুর আর্তনাদ নয়। সে শুনতে পাচ্ছে কারো কান্না! কে কাঁদছে তবে? মাজুর বাপ জুবের ভাই কি? না মাজুর বিবি খালেদা? নাকি শ্বশুর গাফফার মৌলবি?

বৃদ্ধ কাসেম আলি ব্যাপারটা যখন ঠিক ঠাওর করতে পারছে না, তখন তার মনে হচ্ছে তাহলে নিশ্চয় খোদাতালা কাঁদছেন। আর খোদাতালার সেই কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে দুনিয়াজাহানে।

সূত্র: কালিও কলাম

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত